কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


প্রতিবিম্ব

রণেনই এই বাংলোটা বুক করেছিল ছ’টা ঘর আমাদের পাঁচটা ফ্যামিলিরণেনের একটা রুমমানে পুরো বাংলোটাই এই তিনদিনের জন্য আমাদেরপ্রতিবার রণেন আমাদের ট্যুর ম্যানেজারের দায়িত্ত্ব পালন করে থাকে নিখুঁত অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে ওর জুড়ি মেলা ভার আমরা কেউ ওর ঠিক করা কোন ব্যাপারেই দ্বিমত পোষণ করিনা করিনি কোনদিন আমাদের কাজ শুধু টাকা দেওয়া আর আনন্দ করা কে রাতে রুটি খাবে, কে ভাত, কোন বাচ্চার সকালে দুধ কর্ণফ্লেক্স না হলে চলেনা, কোন বাচ্চার লং জার্নির বাসে বমি হয়, কে ভেজ, কে নন-ভেজরণেনের সব ঠোঁটস্থ আমাদের বাচ্চারাও ট্যুরে গিয়ে রণেন আঙ্কলের কাছেই তাদের যাবতীয় আব্দার, ইচ্ছে জানিয়ে থাকে বউরাও রণেনদাকে তাদের যেকোন সমস্যার কথা নির্দ্বিধায় শেয়ার করতে পারে আমরা সবাইমিলে মুস্কিলআসান রণেনের খরচটা শেয়ার করি শুধু অনেক কষ্ট করে এই ব্যবস্থায় ওকে রাজী করানো গেছে পরিবর্তে কদিনের হ্যাসেল ফ্রি রিল্যাক্সেশন কি কম কথা!

এবার সবাই মিলে যে সন্ধ্যায় সুশান্তর বাড়িতে আলোচনায় বসা হল, সেদিন লোকেশন, খরচের এস্টিমেট, প্ল্যান ইত্যাদি রেডি হয়ে যাওয়ার পর রণেনের হাতে অ্যাডভান্স হিসেবে হাজার দশেক টাকা তুলে দিয়ে যখন নিশ্চিন্ত হয়ে রেড লেবেল খোলা হবে, সেইসময় রণেন একটা আশ্চর্য প্রস্তাব দিল আশ্চর্য কারণ কোনদিন ওকে নিজের জন্য কিছু চাইতে শুনিনিএটাই কি টেকেন ফর গ্র্যান্টেড ধরে নেওয়া হয়েছিল, যেহেতু রণেনের ফ্যামিলি নেই, ও সবার বেগার খাটার জন্যই ট্যুরের একজন, আড্ডা ও গেট টুগেদারে একজন?   রণেনের প্রস্তাবটা ছিল, ও এবার ওর সঙ্গে একজন গেস্ট নিয়ে যেতে চায়, যার খরচ ও নিজে পেমেন্ট করবে

প্রবীর বলে উঠল, “হঠাৎ আমাদের মধ্যে একজন থার্ড পার্সন ঢুকবে, এতে আমাদের প্রাইভেসি হ্যাম্পার্ড হবে না?”

আমি মাথা নেড়ে প্রবীরের কথায় সায় দিলাম সুশান্তওএকে একে রূপক, কল্যাণ এবং আমাদের বেটার-হাফরা প্রত্যেকেই রণেনের এই প্রস্তাবে অবাক হয়ে গেল

কল্যাণের বউ মিলি বলে উঠল, “এই রণেনদা, ট্যুরে গিয়ে আমরা সবাই মিলে একসাথে বসে ড্রিংক-ট্রিংক করি, নাচানাচি হয়, এসব তো করা যাবে না এবার?”

সুস্মিতা, ঋতুপর্ণা, শ্রাবন্তী, গার্গীরাও একই সুরে বেজে উঠল, যার মোদ্দা কথাবাইরের লোক কেন? ‘প্রাইভেসিশব্দটার ভেতরে যে অন্তঃসারশূন্যতার দালানবাড়ি, এই আয়নার সামনে কে দাঁড়াবে!

রণেন এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল এরপর বলল, “আমি কিছু বলি? প্রথম কথা হল, আমার এক বন্ধু সন্দীপ যাবে আমার রুম শেয়ার করবে আর ও গেলেও কারো কোন সমস্যা হবেনা, কথা দিলাম বরং একটা দুর্দান্ত ব্যাপার ঘটবেযদি আমার ওপর সবার ন্যূনতম ভরসা থাকে, তাহলে রিকোয়েস্ট করব, জীবনে একবার অন্তত একটা অন্যরকম মজা পাওয়ার জন্য এই প্রস্তাবে সবাইকে রাজী হতে

সবাই চুপ করে আছে প্রত্যেকের মনে দ্বিধা, সংশয় এবং আপত্তি রণেনের আশ্বাসেও গেল না, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আড্ডার তাল কেটে গেছে কি! গ্লাস খালিই রয়ে গেছে কারো খেয়াল নেই

সবেমাত্র রাত্রি সোয়া নটা, সুস্মিতা বলে উঠল, “ডিনার রেডি করি?” পরিষ্কার বোঝা গেল রণেনের এই অন্যরকম প্রস্তাব কাউকেই বিন্দুমাত্র খুশী করেনি

বোসোরণেন সুস্মিতাকে বলল এবং সবার গ্লাসগুলো ভরে দিতে লাগলতারপর সবাই গ্লাস হাতে তুলে নিতেই রণেন বলল, অর্থাৎ আমি এতদিন কারো কাছেই এতটুকুও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি তাই তো?

রূপক বলল, “আঃ! এসব কথা উঠছে কেন? কেউ কি বলেছে তোকে?”

যদি তা নাই হবে, তাহলে আমার এই অন্যরকম প্রস্তাব শুনে সবার কেন মনে হলনা, দেখাই যাক না, ব্যাপারটা কি দাঁড়ায় শেষপর্যন্ত?”

কল্যাণ বলল, “তুই আমাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রোপোজালটা ফিল কর, রণেন মেয়েরা সবাই এক পেগ করে খেয়ে তোর দিকেই গ্লাস বাড়িয়ে দেয় তুই জানিস কাকে কতটা দিতে হবে এই যে আমাদের মস্তি উইদাউট এনি হেজিটেশন, এটা কি তোর বন্ধুর সামনে করতে পারব আমরা? করা সম্ভব?”

আমি তো কথা দিচ্ছি কোন প্রবলেম হবেনা শেষে তোরা প্রত্যেকেই বলতে বাধ্য হবি, ওঃ দারুণ একটা এক্সাইটমেন্ট হল বটে!”

প্রবীর জিজ্ঞেস করল, “তুই হঠাৎ ওনাকে নিয়ে যেতে চাইছিস কেন?”

একটা চার্মিং গেম ভেবেছি প্রত্যেক ট্যুরেই তো কিছু না কিছু চমক দিই, ধরে নে সন্দীপই এবারের চমক

ট্রেনে উঠে যখন যে যার সিট খুঁজে নিচ্ছে, দেখা গেল রণেন নিজের লাগেজ একটা সিটের তলায় তাড়াহুড়ো করে ঠেলে দিয়ে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেবোঝা গেল  সন্দীপের জন্য অপেক্ষা করছে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেল, কোথায় সন্দীপ! শেষপর্যন্ত ছেড়েও দিল কাঁটায় কাঁটায় নির্দিষ্ট সময়েসন্দীপ এলনা আমাদের সবাই মনে মনে যে নিপাট স্বস্তি পেল বলাই বাহুল্যকোন দ্বন্দ্ব রইল না আপত্তিগুলো অহেতুক হয়ে গেল আর কোন সংকট নেই কিন্তু এটা তো আর রণেনের সামনে প্রকাশ করা যায়না তাই সকলেই চুপচাপ রূপক বলল, “তুই এত নিঁখুত, তোর বন্ধু এমন ঢিলে কেন রে?” স্পষ্ট বোঝা গেল এই ঠেস মেরে বলা কথাটা রণেন নিতে পারল না ও শুধু হাসল একটু, বিড়বিড় করে বলল, “আসবে ও আসবেই

ট্রেনে উঠে বাচ্চারা সবাই টফি পেয়ে গেল, বউয়েরাও পেল স্ন্যাক্স আর ধেড়ে  খোকারা একসাথে আলাদা বসেছে যারা, পেল সবুজ রঙের বোতলে একটা ঘোলাটে পানীয় সবার হাতে হাতে এক চুমুক করে ঘুরবে বোতলটাসঙ্গে কাজুবাদাম আহা! উল্লাস! যথারীতি কামাল দেখাতে শুরু করে দিয়েছে রণেন

ভাই, তোর মনখারাপ, ফিল করছি কিন্তু তুই এভাবে নিভে থাকলে তো আমাদের আলোর ডেফিসিয়েন্সি হয়ে যাচ্ছ সুশান্ত কি একটু বেশীই প্রগলভ

তোদের মনে হচ্ছে আমি নিভে আছি? ও আসবেই কথা যখন দিয়েছে ও ঠিক আসবেরণেনের হাতে সবুজ বোতল

ওকে কেন আনতে চেয়েছিলাম, বলেই ফেলি?” রণেনের কথায় সবাই এদিকে তাকালোওর একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে, বুঝলি? কারো চোখের দিকে এক মিনিট মত তাকালে, ও নিমেষে তার মনের ভেতর অনেকদূর চলে যেতে পারেএটা একটা দারুণ মজা হতনা? তোরা কি বলিস?”

এ তো জাঙিয়া পর্যন্ত খুলে নেওয়ার প্ল্যান ছিল তোর!” কল্যাণ হালকা ছলে ভারী কথা বলে বসল জোরে হেসে উঠল সবাইগার্গী বলে উঠল, “বড্ড স্ল্যাং!”

তোর মাথা খারাপ? এরকম সাঙ্ঘাতিক লোককে কেউ আনে? শালা, পুরোনো বান্ধবীদের নামধাম বেরিয়ে গিয়ে এক নতুন কেলো পাকাতে চাইছিস নাকি?” কল্যাণ আবার ছক্কা হাঁকালো সবার হাসি আর ধরছে না গার্গীও সেই হাসিতে যোগ দিয়েছে বটে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে ওর ভেতরে ধস নামছেশ্রাবন্তী আড়চোখে গার্গীকে দেখে নিয়ে লুকিয়ে একটা আলতো ঠেলা দিয়ে ওর সম্বিত ফেরালো কোথা দিয়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে গন্তব্য স্টেশনও এসে গেল এর মধ্যে সবাই কয়েক রাউন্ড খাবার পেয়েছে কফিও কিন্তু সবুজ বোতল আর হাতে হাতে ঘোরেনি

দুটো স্করপিওতে ষোলজন ধরে গেল যেখানে এসে থামল গাড়ি দুটো, জায়গাটা দেখে সবাই তো তাজ্জবহোয়াট আ কালেকশন, রণেন! অ্যান এথনিক স্পট ইনডিড! শিউকান্থের দেখা পাওয়া গেল তখন কটা চোখের গাট্টাগোট্টা বেঁটে মানুষটা যেন বিনয়ের অবতার, কিন্তু এক ঝলক দেখেই বোঝা যায় ভেতরে অনেকদূর পর্যন্ত একটা ফাঁকা রাস্তা বিছিয়ে আছে কিংবা ভুলও হতে পারে, হয়ত সেরকম আদৌ নয় জায়গাটার জন্য ধন্যবাদ জানাতে প্রবীর রণেনের গালে শব্দ করে একটা চুমু খেল কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এল গরম গরম ফুলকো লুচি আর সাদা আলুর মাখামাখা তরকারি সঙ্গে কালাকাঁদ সবাই মোহিত! ইতিমধ্যে রণেনের মোবাইলে একটা কল এলকি রে, ট্রেন মিস করে ফেলেছিস? কিভাবে আসছিস? সব্জির ট্রাক-ড্রাইভারকে ম্যানেজ করে? ওঃ এসব তোর পক্ষেই সম্ভব শোন, তোর জন্য এখানে সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে তাড়াতাড়ি আয়

আমি আর কল্যাণ ততক্ষনে আবার বসে পড়েছি রণেনের কথা কল্যাণের কানে যেতে, ও চাপা গলায় বলে উঠল, “বালের উদগ্রীব!” আমি ওকে আরও বেশী কিছু বলার আগেই থামালাম কোনক্রমেরণেন উচ্ছ্বসিতভাবে বন্ধুর আসার খবর দিল সবাইকে শুকনো পাতা মাড়িয়ে হেঁটে যেতে ঋতুপর্ণা আবৃত্তি করছিল – “হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান”…প্রকৃতির অপরূপ মুখশ্রী, তার সাথে সুরার মোলায়েম স্পর্শে জমে উঠছিল হেমকান্তি মৌতাত কেউ কাউকে মুখে কিছু না বললেও সবাই মনে মনে ভাবছিল, সন্দীপ এসে পৌঁছনোর আগে যতটুকু আয়েশ করে নেওয়া যায় আর কি! রণেন দৃশ্যতই খুব খুশী শিউকান্থের সঙ্গে ও লাঞ্চের তদারকি করতে চলে গেছে দিশি চিকেনের ফাটাফাটি গন্ধে মৌজ যেন ঘনিয়ে উঠছিল রোদ এখানে ছায়ায় বিপর্যস্তহাওয়া সুগম যতদূর চোখ যায় সভ্যতার চিহ্নমাত্র নেই যাপন না চাইলেও তাকে মাঝেমাঝে এমন মহার্ঘ্য উপহার দিতে হয়

জায়গাটা অনবদ্য!” আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল মুগ্ধতার রোশনাইসেইজন্যই কি ডিভিডেন্ড পেতে চাইছে?” রূপকের বাঁকা জিজ্ঞাসা রণেনের কান অবধি পৌঁছল না ঠিক হল, সন্দীপ নিয়ে আমরা কিছুই বলব না, জাস্ট ইগনোর করব

শ্রাবন্তী কল্যাণের সামনে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলছে, “রণেনদার বন্ধু যদি আমাদের সম্পর্কের কথা বলে হাটে হাঁড়ি ভাঙে! কি হবে ভেবে দেখেছ?” দূর থেকে নয়, কাছেই একটা গাছের আড়ালে আমি ছুঁয়ে ফেললাম এই আগুনরেখাদেখলাম ঋতুপর্ণাও শুনতে পেয়েছে রূপক আর গার্গীও নিজেদের মত করে আড়াল খুঁজে নিয়েছিল সে আড়াল প্রয়োজন হয়েছিল সংশয়ের জন্য, উদ্বেগের জন্যওদেরও দুশ্চিন্তা ছিলযদি সবার সামনে সবকিছু উন্মুক্ত হয়ে যায়! প্রবীর হাঁ হয়ে গেছে সুস্মিতাও

এই নিষিদ্ধ গোপন নিয়ে সন্ত্রস্ত চরিত্ররা প্রত্যেকে ভেবেছিল, অন্য কেউ বোধহয় দেখতে পেলনা, শুনতে পেলনা কিছুই কিন্তু সে গোপন আর গোপন রইল কই! একই মেঘের নীচে সূর্য-ঢাকা-পড়া ছায়ায় চুপচুপে হয়ে গেল অনেকেইরণেনের কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই সন্দীপ আসবেএই আনন্দে ও গুনগুন করছিল বোঝাই যাচ্ছে খুশীর সৌরভে ম ম করছে

একটা সময়ে লাঞ্চও হয়ে গেল সন্দীপ এসে পৌঁছলো নাওর নাম্বারে কল কানেক্টও হচ্ছেনা রণেন স্বভাবতই বিমর্ষওর শরীরী ভাষায় এক আলো নিভে যাওয়া দালানের স্তম্ভগুলো ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছেবিকেল হয়ে আসছেএখানে দিন অকালমৃত হয়ে যায় গোটা বনভূমি জুড়ে আসন্ন সন্ধ্যার প্রস্তুতি সাজাচ্ছে আলোর দূত, জোনাকিরা বাংলোয় জ্বলে ওঠে আলো, সে আলোয় চারপাশের অন্ধকার আরও নিকষ হয়ে ওঠে এই গা ছমছমে ফিলিংসটা সুরার গ্লাসে তুফান তোলে হাসাহাসি হৈ হুল্লোড় ঠাট্টা গান কবিতায় নিজেকেও ছাপিয়ে যেতে চায় যারা, তারা আসলে নিজেকে লোকাতে চায় লোকানো কি যায়! অনাবৃত, অসংবৃত হয়ে থাকার শৈলীতে অপ্রকৃতিস্থ রাত নামে প্রকৃতির নিজস্ব উঠোনে

আজ রণেন ফুল ফর্মে আছে নিজেও টইটম্বুর হয়ে উঠেছে তবু বন্ধুর বউদের কিন্তু মেপে দিতে ভুল হচ্ছেনা ওর এর মধ্যেই কাল বনফায়ার হবে প্রস্তাব উঠলরণেন মাথা পেতে নিল দায়িত্ত্ব শিউকান্থ প্রথমেই বারণ করেছিল, রাতে রিসর্টের ক্যাম্পাস ছেড়ে কেউ যেন ভুল করেও বাইরে না বেরোয় শিরাপথে যখন অ্যালকোহল কণিকারা উন্মত্ত ছোটাছুটি শুরু করে, তখন নিষেধকেই ভাঙতে ইচ্ছে হয় এই প্রবণতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রণোদনাই তো নেশা, যা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক কিউসেক বেশী গভীর, কয়েক নিক্তি বেশী টুসটুসে! রূপক, প্রবীর, সুশান্তরা সামনেটায় একটু হাঁটাহাঁটি করবে ঠিক করল কিন্তু পাথরের মূর্তির মত শিউকান্থের কটা চোখের শীতল দৃষ্টির নৈঃশব্দ্য ওদের প্রশমিত করল রণেন জোরে হেসে উঠে বলল, “ওরে অবোধ, সতর্ক হ, নিষেধটাকে মান”….

বনফায়ারের প্রস্তাবে শিউকান্থের তীব্র আপত্তিকে রণেন অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে উড়িয়ে দিতে পারল ফতোয়া রইল, বেশী রাত করা যাবেনাপ্রত্যেকে পারফর্ম করল তার নিজের মত করে গান, কবিতা, আবৃত্তিতে যখন আসর জমে উঠেছে হঠাৎ রণেন বলল, “আমি এবার এমন একটা খেলা খেলব, বনফায়ারের মজা দশ গুণ বেড়ে যাবে।” সবাই নড়েচড়ে বসল

সন্দীপের খেলাটা আমিই দেখাইবনফায়ারের আগুনের জোশ কি কমে এল? সবার মুখগুলো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে না!

কি হবে এসব খেলায়? কেউ কি অ্যাট অল ইন্টারেস্টেড?” প্রবীর বলে উঠল জড়ানো গলায় উচ্চারিত শব্দগুলোর ভেতর এমন সম্মোহন ছিল যে প্রায় প্রত্যেকেই নাবলল অর্থাৎ নিজের ভেতরটা বের করে আনতে কেউই চায়নাবেশ কয়েক পেগের পরও এই সচেতনতা টাল খেয়ে যায়নি কারো অন্দরমহলে যে অন্ধকারের নিকষ, পৃথিবীর কোন আলো নেই তাকে বিন্দুমাত্র উজ্জ্বল করতে পারে স্বেচ্ছা স্খলনের কাছে চিরপদানত মানুষ ভালোবেসে চেয়েছে অনির্বাণ কৌশলে তাকে গোপন রাখতে শুধু তাই নয়, এ ভন্ডামি যে তার নিজেরই অর্জিত, এও কি অস্বীকার করতে চায়নি! পাঁচটি যুগল, তাদের মধ্যে ঝুরঝুরে বালির মত দাম্পত্য, সুখের বিকল্প খুঁজে মদির হয়ে ওঠার ভুল দিশায় চলতে চলতে কখন যে সব হারিয়েছে বুঝতেই পারেনি প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, পরাক্রম সবকিছু খোলামকুচি হয়ে গেছে বিকৃতির কাছেতবু হুঁশ ফিরল নাহুঁশ সহজে ফেরেনা

রণেনের হাসি পেয়ে গেলওর তীব্র হাসিতে কেঁপে উঠল অরণ্যের নৈঃশব্দ্যও ঘুমন্ত পাখিরা জেগে উঠল যে পাতাটি পতিত হওয়ার অপেক্ষায়, তার অনিবার্য নিঃশব্দ পতনে বৃক্ষের সঙ্গে বিচ্যূতির মুহূর্তটি বড় ঘনিয়ে উঠল মায়া হয়ে একটি হাওয়া মুখর হতে চাইল তার সর্বস্ব উজাড় করেও অরণ্যের মন পেলনা, চিরকুট রেখে গেল মুহূর্ত চয়ন করা সটান প্রবাহে এ অপাপবিদ্ধ বৈরাগ্য বাধিত করবে কাকে! এ সমীচীন সন্দর্ভ কার জন্য অপেক্ষমান! তড়িৎ অনুভূতির মত এ সাযুজ্যকে উপেক্ষা করতে পারে কি কেউ?

শিউকান্থের কটা চোখ আরও ঘোলাটে দেখাচ্ছে ওর ভাবলেশহীন মুখশ্রীতে কোন অভিব্যক্তি নেই যেমন ছিলনা কোনদিনও তরল স্বরে ও বলে উঠল, “ইয়ে কাহানী আপকে মু সে ইতনে বার শুন চুকা হু কি, মুঝে ইয়াদ হো গ্যায়া

তারপর জিজ্ঞেস করল, “এক বাত পুঁছু, সাহাব?”

রণেন ওর দিকে তাকিয়ে চোখ মটকালো

ও বলল, “সন্দীপ নামসে কোই থা?”

রণেনের ঢুলু ঢুলু লাল চোখের হাসিটা এবার এত ধারালো হয়ে উঠল যে, শিউকান্থের কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিলও মুখটা ফিরিয়ে নিল খুব কাছ থেকেই শুরু হওয়া অন্ধকারের দিকে! দৃশ্য থেকে পালিয়ে ও কোথায় পৌঁছতে চায়! স্মৃতির দিকে! সেই স্মৃতি, যা ওকে আজও মাঝেমাঝেই চূড়ান্ত অস্থির করে তোলে তখনই ও সাহাবের কাছে দারু মাঙতে আসে দারুর বদলে ওকে এ কাহানী শুনতেই হয়শিউকান্থ জানেনা এরা কারা

জ্বলন্ত আগুনের ভেতর কাঠগুলো পুড়ে যাচ্ছিল আর তাদের প্রাণহীন অস্তিত্ব থেকেই নানারকম অপ্রকৃতিস্থ শব্দ উৎপন্ন হয়ে চলছিল একটানা যাদের কোন অর্থ নেই

 



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন