ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(৪২)
একদিন আগ্নেয়র সঙ্গে বিহান সমুদের ধারে বসে আছে। বিহান বলেছিল, হৃদয় কেন যে ওকে এত পছন্দ করে, ওই শ্রমণকে, আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না।
আগ্নেয় মাথা নাড়ে। বলে, হৃদয় বরাবরই এরকম। স্তাবকতা বুঝতে পারে না। একদম অন্ধ হয়ে
যায়। ওর পছন্দের তালিকায় প্রথম নাম বিশ্রুত। তারপর শ্রমণ। অথচ এদের মধ্যে না আছে প্রতিভা
না আছে গভীরতা না আছে নিজস্বতা। হৃদয় যা বলে এরা অন্ধের মতো শুনবে। হৃদয়ও তাই এদের
ব্যাপারে অন্ধ। এই পারস্পরিক অন্ধতাই দেখে যাচ্ছি দিনের পরদিন।
বিহান হাই তোলে। তারপর বলে, কিন্তু শ্রমণের অনেক গুণ আছে। ওর মধ্যে যে সারল্য ও
পাগলামি আছে তা নাকি স্বর্গীয়। অসম্ভব নিষ্পাপ ওর মন। বাইরে থেকে দেখলে যতই এলোমেলো
লাগুক, ভেতরে ভেতরে ও গভীরভাবে আধ্যাত্মিক। তাছাড়া ওর মতো প্রেমিকও নাকি বিরল...
তুই এসব বিশ্বাস করিস? আগ্নেয় বলে ওঠে। আমি তো ওর মধ্যে কিছুই পাই না। একটা বখে
যাওয়া ছেলে। সারাক্ষণ বাজে বকছে। নেশা করে পড়ে আছে। না আছে হুঁশ, না আছে কাণ্ডজ্ঞান।
ফুল নিয়ে যে জাদুগুলো দেখায় কী আছে সেগুলোয়? আমি তো কিছুই পাই না। কিছুই হয় না ওর।
অথচ হৃদয় বলে বেড়ায়, শ্রমণের জাদুগুলো বাইরে থেকে দেখলে খুবই সরল। এই সারল্যই ওকে টানে।
আসলে এই সারল্য খুবই ডিসেপটিভ। ওর মধ্যে অনেক গভীর জ্ঞানের কথা আছে। উপলব্ধির কথা আছে।
খুব দার্শনিক জাদু নাকি ওগুলো। আর আমার মনে হয় সবটাই বোগাস, ফাঁপা। আমাদের হেয় করতেই
হৃদয় ওকে মাথায় তুলে নাচে। আমাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে ওকে দাঁড় করাতে চায়। প্রথমে বিশ্রুতকে
দিয়ে চেষ্টা করেছিল পারেনি। এখন জুটেছে এই শ্রমণ। হৃদয় ওর চোখধাঁধানো প্রতিভায় সম্মোহিত।
আসলে খুব সূক্ষ্ম রাজনীতি জানে হৃদয়। এইসব চতুর ষড়যন্ত্রে ওর কোনও জুড়ি নেই।
বিহান কিছু বলে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে হাসে। ঠিক এই কথাগুলোই শুনতে চায় ও। সত্যিই
কী আছে শ্রমণের মধ্যে? ওর মধ্যে কোনও জটিলতাই নেই। জটিলতা ছাড়া দর্শন হয়? ফুলের চর্চা
হয়? শ্রমণের সব জাদুই সরল আর মিষ্টি। হৃদয় মুগ্ধ হয়ে দেখে। ওদের মনে কোনও দাগই কাটে
না। যে জাদু যত দুর্বোধ্য ও জটিল সে জাদু তত রহস্যময়। এই রহস্যই ওদের টানে। এই রহস্যের
মধ্যে অনেক দার্শনিক পাগলামি রয়েছে। কিন্তু যে জাদুতে সব কিছুই স্পষ্ট ভক্তের আর্তি
নিয়ে যা দেখানো হয়েছে ফুলের প্রতি বিনম্র নিবেদনেই যার মীমাংসা, সেখানে কোনও রহস্য
থাকতে পারে? হৃদয় কিন্তু ওদের সঙ্গে একমত হতে পারে না। সে বলে, শ্রমণের সব জাদুই খুব
আধ্যাত্মিক। প্রেম নিয়ে কোনও জাদু দেখালে সেটা শেষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিকতার দিকে বাঁক
নেয়। শ্রমণের কাছে ফুলই হল সেই আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। স্থির কেন্দ্র। ফুলের মতোই ওর
জাদুগুলো। এমনিতে খুব সরল আর স্পষ্ট। কিন্তু বারবার মাথা ডোবালে নীচে সিঁড়ির পর সিঁড়ি
চলে যেতে দেখা যায়। তখন বোঝা যায় কতটা গভীরে সেই জাদুগুলো এবং সেই গভীরে কীভাবে একটার
পর একটা সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে। শ্রমণকে নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে হৃদয়। এর একটা
বিহিত হওয়া দরকার।
হঠাত আগ্নেয় জানতে চায়, কিন্তু শ্রমণের ওপর তোর অত রাগ কেন? সমিধা তো শ্রমণকে খুব
পছন্দ করে।
শ্রমণ আমার প্রতিপক্ষ নয়।
ও তুই সেটা বুঝিস তাহলে? আগ্নেয়র স্বরে শ্লেষ উঠে আসে। কেন বল তো?
আর কেন! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিহান। তারপর বলে, সমিধার একজন নিজের বশংবদ অনুগত
চাই। যার দুর্বলতার ওপর ও নিজের জোর খাটাতে পারবে। শ্রমণকে দিয়ে এ কাজ হবে না। ও সম্পূর্ণ
ভাবের ঘোরে থাকে। সমিধা তো ওকে রীতিমতো ভক্তি করে।
আর তোকে করুণা। আগ্নেয় আবার খোঁচা দেয়। তারপর বলে আর ভক্তির কথায় মনে পড়ল, একটা
সময়ে যেমন করত হৃদয়কে? সেরকম?
বিহানের দুটো চোখই জ্বলে ওঠে। তারপর বলে, ওসব পুরনো কথায় লাভ কী?
একদিন হৃদয় মন দিয়ে গান শুনছে। শ্রমণ টলতে টলতে ঢোকে। ওকে দেখলেই টের পাওয়া যায়,
কতটা নেশাগ্রস্ত হয়ে আছে সে। ওর কথা জড়িয়ে যায়। হৃদয়ের খুব রাগ হয়। সে বলে, এখন চলে
যা শ্রমণ। আমি এখন গান শুনছি।
শ্রমণ কিছুতেই যাবে না। সে বলে এটা আমার নিজের বাড়ি। আমার নিজকের পরিবার। নয় কী?
আমি এক্ষুণি প্রমাণ দেব। তুই একবার শুধু মাকে ডাক...
চলে যা শ্রমণ। হৃদয় আবার বলে।
না যাবো না। এ আমার নিজের বাড়ি। নিজের পরিবার। তাই না বিহান?
বিহান সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। এবার তীব্র
শ্লেষে বলে, সে তো দেখতেই পাচ্ছি...
কথাটা হৃদয়ের কানে গিয়ে খট করে লাগে। পরে সে বিশ্রুতকে বলে, শ্রমণের ওপর বিহানের
কুব রাগ। তাই না?
সে আর হবে না? বিশ্রুত বলে ওঠে। ফুলের বাগানে যে যত বেশী নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবে
সে তত বেশী ওদের টার্গেট হয়ে যাবে।
কী বলছিস তুই? চমকে ওঠে হৃদয়।
ঠিকই বলছি। ওরা নিজেরা কী কাজ করে? কতটুকু সময় দেয়? ওই আগ্নেয় আর বিহানের কথা বলছি
আমি। অতলান্তের কথাও। শুধু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। শ্রমণের মতো ছেলে, সব সময়ে স্বার্থহীন,
সব সময়ে অন্যের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত সবাইকে আপন ভাবে নিজের করে পেতে চায় তাকে
এরা অত সহজে ছাড়বে? ওকে নোংরা না করে শস্তা না করে এরা ছাড়বে না। তাছাড়া...
হৃদয় কৌতূহলী হয়ে তাকায়। বিশ্রুত বলে বিহানের ঈর্ষার আরও কারণ আছে। সাঁঝ সেদিন
আমাকে বলছিল। ও সমিধাকে ভালোবাসে। আমাদের কাছে এসে সুবিধা চায়। যেখানে প্রেম আর ক্ষমতা,
সেখানেই স্রমণের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। শ্রমণকে আমরা তিনজনেই পছন্দ করি। ভালোবাসি। যেগুলো
ওর দুর্গ হতে পারত, সেগুলোই এখন শ্রমণের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। শ্রমণকে ওর ঈর্ষা না করে
উপায় নেই।
হৃদয় চুপ করে যায়। বিহান ওকেও ছাড়ে না। কিছুদিন পর হৃদয়ের সঙ্গেও রূঢ আচরণ করে।
ওর স্পর্ধা আর ঔদ্ধত্য দেখে সেই প্রথম হৃদয় তাজ্জব বনে যায়। বিহান যেন বদলে গেছে। একদম
অচেনা হয়ে গেছে।
ফুল নিয়ে একটা সেমিনারে ওরা কয়েকজন গেছিল। লাঞ্চের সময়ে বাইরে এসে গাছের ছায়ায়
বসে গল্প করছিল। আগ্নেয় বলল, এখানে দেখছি সবাই বক্তা। সবাই সমালোচক। কোনও শ্রোতা নেই।
যে বলছে, সেই শুধু শুনছে। বাকিরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। শোনার কোনও দায় তাদের নেই।
আর মাঝে মাঝে যে বলছে তার মুণ্ডপাত করছে। কেউ কারও সম্পর্কে একটাও ভালো কথা বলছে না।
শুধু কার বক্তব্যে কী ভুল আছে, কী ফাঁক আছে, কী দুর্বলতা আছে, সে সব ছাড়া কারও মুখে
কোনও কথা নেই।
শ্রমণ বলল, আমিও এটা লক্ষ করেছি। এখানে আর থাকতেও ইচ্ছে করছে না আমার। সবাই মিলে
বরং সমুদ্রের ধারে যাই। ঘুরে আসি।
আমি এখানেই থাকব। কোথাও যাবো না। বিহান রূঢভাবে বলে ওঠে।
হৃদয় বলল, নাঃ আমারও ভালো লাগছে না। বরং সমুদ্রের ধারে একটু ঘুরে আসি। একটু তাজা
বাতাস লাগিয়ে আসি...
তোর ইচ্ছা হলে যেতে পারিস। আমি যাবো না। এখানেই থাকব। বিহান এবার আগের চেয়েও বেশি
রূঢভাবে বলে ওঠে। হৃদয় অবধি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। কঠোর হয়ে উঠেছে সেই মুখ।
ওর মুখের এই ভাব আগে কখনও দেখেনি হৃদয়। বিহান কথা বাড়ায় না। নিজের বক্তব্যটুকু রেখে
ভিতরে ঢুকে যায়।
ওর পেছন পেছন চলে যায় আগ্নেয় আর অতলান্ত।
হৃদয় যখন সমুদ্রের ধারে আসে, ওর সঙ্গে তখন শ্রমণ আর বিশ্রুত। শ্রমণের ওপর কোনও
কিছুরই প্রভাব পড়ে নি। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ও বলে যাচ্ছিল, আমার আদর্শ নেপোলিয়ন বা
আলেক্সাণ্ডার। ওদের মতোই আমার দিগ্বিজয়ী হতে ইচ্ছা করে। তবে নতুন দেশ নয়, আমি জয় করে
আনব দুর্লভ সব ফুল। নতুন নতুন দেশে যাবো। নতুন নতুন ফুল আবিষ্কার করব। সেগুলো সব জোগাড়
করে নিয়ে আসব আমাদের ফুল বাগানে। প্রতিবার দেশে ফিরব, আর সবাই মিলে খুব আনন্দ করব।
হৃদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাঁটতে হাঁটতে শ্রমণ একটু দূরে চলে যায়। বিশ্রুত হৃদয়কে
বলে, ও সব সময়ে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। ওর মন খুব দয়ালু। সংস্কারহীন। ফূর্তি আর আনন্দে
ভরা। কোনও সঙ্কীর্ণতা নেই। ওর সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, এই দুনিয়ায় পাপ বলে, অন্যায় বলে,
অবিচার বলে কিছু নেই। ও কখনও কারও সমালোচনা করে না। ও নিজেই অসুস্থ মনের ওষুধ। ওর সঙ্গে
কিছুক্ষণ মিশলে আপনিই যেন মনের উত্তরণ ঘটে।
সেই জন্যই তো ওকে এত ভালোবাসি। হৃদয় বলে ওঠে...
বিশ্রুত বলে, বিহান কিন্তু বদলে গেছে। ওকে আমিই এখানে নিয়ে এসেছিলাম। এখন সে কথা
ভাবলে মাঝে মাঝে আপশোস হয়। সাঁঝের বাড়িতে প্রথম ওর সঙ্গে আমার আলাপ। যেচে যেচে এসে
আমার সঙ্গে কথা বলত। ছেলেটাকে দেখে আমারও ভালো লাগত। কথাবার্তায় বিনীত মার্জিত রুচির
ছাপ। দেখলেই বোঝা যায় শিক্ষিত মেধাবী ছেলে। কেমন যেন আমি আকৃষ্ট হলাম। আর সেটা বুঝে
ও আমাকে একদম আঁকড়ে ধরল। কথার জাদুতে, নম্রমধুর স্বভাবে, একেবারে সম্মোহিত করে দিল।
আমাকে বুঝিয়ে ছাড়ল, ও প্রচণ্ড এক অবিচারের শিকার। ওর জন্য কিছু না করলেই নয়। দারিদ্র
আর অভাব ওকে মাথা তুলতে দিচ্ছে না। বিশেষ করে ফুল নিয়ে ওর দারুণ প্যাশন। এ ব্যাপারে
আমার দুর্বলতা ও ঠিকঠাকই ধরে ফেলেছিল। আমি তোর কাছে ওকে নিয়ে এলাম। সাঁঝও আমাকে উৎসাহ
দিয়েছিল। আসলে ও নিজেও বুঝতে পারেনি। পরে সাঁঝ যেমন বুঝেছে, আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম
তোকে পেয়ে আমাকে ও কিছুটা এড়িয়েই চলেছে, ঠিক যেমন আমাকে পেয়ে সাঁঝকে এড়িয়ে চলছিল। আর
আমাকে যেভাবে আঁকড়ে ধরেছিল, সেভাবে ধরেছে তোকে। তোর একদম হাঁসফাঁসের দশা, একদম ছাড়ছে
না তোকে। একটুও ফাঁকা স্পেস দিচ্ছে না। খটকা আমারও লেগেছিল...। আর এখন তো দেখছি তোকেও
ছেড়ে দিয়ে হাত বাড়িয়েছে সমিধার দিকে। একেবারে মোক্ষম দাঁও মারতে চলেছে...
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন