কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

               

হে নেপথ্যচারিণী


 

(২১)    

 

অস্মিতা

মাঝেমাঝে মনে হয় আশুদার এই আলোর খোঁজ ফরাসী ঔপন্যাসিক গাস্টন লেরুঁর উপন্যাসের অপেরার ভূতের মতো। এই খোঁজে আলোর যে কম্পাঙ্ক আশুদা খুঁজে চলেছে, সেই খোঁজ শেষ হবার নয়। কারণ সেই আলো কোনও ফোটোমিটারে কয়েদ নেই। সেই আলো আসলে মানুষের মনের ভিতরের জটিল অলিগলিতে উঁকি দিতে থাকা সম্ভাবনার আলো আর সবিতা আগরওয়ালের মতো দুর্দান্ত নারীর নেপথ্যচারিণী অন্ধকারের প্রতি ভারসাম্য। সেই ভাবনাটুকু মনের ভিতর বয়ে নিয়ে বিকেলের দিকে গেলাম অত্রির বাড়ি। সুচন্দ্রা এখন অনেকটাই সুস্থ। তার ভিতর যে সম্ভাবনা বেড়ে উঠছে, অত্রিকে কি তার কথা বলেছে আশুদা বা ডাক্তার মালাকার! কে জানে। আমাদের বসার ঘরে  বসতে বলল সুচন্দ্রা। অত্রি কলেজ থেকে ফিরেছে সামান্য আগে। ওরা কেউ এখনও ত্রিনেত্র হত্যার কথা জানে না। শুধু সেই হঠাৎ ভুল পথে ধরা পড়ে যাওয়া অত্রির লেক থানার স্মৃতি ভোলবার নয়। আমাকে আশুদা সেই দায়িত্ব দিল। কাহিনীকারের মতো অস্মিতার কথা, শুভাত্রেয়র কথা, ত্রিনেত্রর কথা বর্ণনা করে গেলাম ওদের দুজনের সামনে। আমার বর্ণনা শুনে সুচন্দ্রা আর অত্রি কখনও বিস্মিত হলো, কখনও শিউড়ে উঠল ভয়ে। আড়চোখে দেখলাম আশুদা বসার ঘরের একটা গোটা দেওয়াল আগলে রাখা ডাক্তার মুরারী পাল চৌধুরীর বিরাট বই আলমারীর ভিতর কী যেন খুঁজে চলেছে। আমার বর্ণনা শেষ হলে সুচন্দ্রা হাঁফ ছেড়ে বলল, "বাপরে। ভাবা যায়? একটা মেয়ে এমন নৃশংস হতে পারে!"

দেখলাম আশুদার হাতে দুটো কবিতার বই। দুটি বইই কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর। 'সদর স্ট্রিটের বারান্দা' আর 'নিজস্ব ঘুড়ির প্রতি'। তৃতীয়টি একটি লাল রঙের ডায়রি। আশুদার কথা থেকে বুঝেছি, ওটি ডাক্তার মুরারী পালচৌধুরীর গানের ডায়রি। গাড়িতে বসতে বসতে আশুদা বলল, "অনেকদিন বাদে একজন প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর কবিতাপাঠক পেলাম। ভদ্রলোক বেশ আবেকপ্রবণ পাঠক বলতে হবে। কারণ প্রথম বইটি কৃত্তিবাস থেকে বের হয় ১৯৬৬ সালে। আর দ্বিতীয় বইটি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ১৯৭৫ এ। দুটি বইই এখন আর পাওয়া যায় না। চল। আজ রাতে এদের ডিসেক্ট করে কী পাওয়া যায় দেখি।

গাড়ি পার্ক করতে করতে শুনলাম আশুদা আপনমনে বিড়বিড় করছে, "তাকে মনে রেখে লিখি; সুদূরান্ত মেঘের দুয়ারে/ নিভৃতসঞ্চারী চোখে ছায়াতুর নম্রনত ভাষা/ মায়া ঢালে মনে; উতরোল এ মিহ ভাদরে/ ঝুমকোর প্রগাঢ় রঙে দুলে ওঠে অপার প্রত্যাশা ..."

রাতের শহরে এই রবীন্দ্র সরোবর যেন এক কুহুকিনীর চোখের মতো চেয়ে থাকে আমাদের দিকে। আমাদের ঘরের বারান্দা থেকে এই দৃশ্য বিনিদ্র রাতে রোজ দেখি। এই বাড়ি আমার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ঠিকই, ঠিক পিতার সরাসরি সূত্রে নয়, তাঁর ছোটভাই, অর্থাৎ আমার ছোটকাকু ছিলেন ভূপর্যটক। শেষবার উত্তরবঙ্গে আলিপুরদুয়ার থেকে দেশ ছাড়ার আগে তিনি তাঁর কলকাতার এই ফ্ল্যাট বাবার নামে করে যান। তারপর ছোটকাকুকে আর দেখা যায়নি। সন্ধানও পাওয়া যায়নি কোথাও। শোনা যাচ্ছিল ভাইকিং তন্ত্রসাধনা তাঁর মনে ঘর করেছিল শেষবয়সে। সেই তন্ত্রর টানে তিনি নাকি এদেশের পাট চুকিয়ে উপসালা পাড়ি দিয়েছিলেন। এই ফ্ল্যাটে থাকতে থাকতে আমি কলকাতা শহরকে পাখির মতো দেখতে শিখেছি। আর যেদিন থেকে আশুদা এই ঘরের বাসিন্দা হয়ে গেছে, সেদিন থেকে মাটির বুকের স্পন্দনও আমি ক্রমশ পরখ করতে শিখেছি। শিখেছি ডাঃ সবিতা আগরওয়ালদের মতো দানবিক নেপথ্যচারিণীদের কথা। একাকিনী রবীন্দ্রসরোবরের শান্ত বিনিদ্রিত নয়নের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম অত্রিদের কথা। ডাক্তার মুরারী পালচৌধুরীর কথা। বিচিত্র সেই যাপন। এক জেলচিকিৎসক থেকে বেহালাবাদক প্রেমিক। আশুদার নিয়ে আসা কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর দুটি কবিতার বই আর গানের খাতা আজ আমাদের নিশিযাপনের সঙ্গী হবে বুঝলাম।

আশুদা গানের ডায়রির পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলল, "আশ্চর্য ঘটনা দেখ অর্ক। তোর মোবাইলে লালবাজারের সিজার লিস্ট থেকে পাওয়া সেই চিঠিগুলোর ছবি আছে? বের কর।"

আমি ছবিগুলো বের করতে, সেগুলো সামনে রেখে পাশাপাশি মোমের হাতির পেট থেকে বের করা চিরকুট আশুদা টেবিলে রাখল। তারপর গানের খাতা আর কবিতার বইয়ের লাইনের পাশে পাশে সাইডনোটের মতো লেখাগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে বলল, "হাতের লেখাগুলো দেখ অর্ক। একটা হাতের লেখা নিশ্চিত ডাক্তার মুরারীর। আর অন্যটার ক্ষেত্রে গানের খাতার স্বরলিপির নীচে ছোট অক্ষর খেয়াল কর। 'শ'। সম্ভাব্য শকুন্তলাদেবী। মুরারীর গানের স্বরলিপি লিখে দিতেন শকুন্তলা। যেসব কথোপকথন আর লুকনো প্রশ্নের উত্তর আমরা মরিয়া হয়ে খুঁজছি, তা হয়তো এই দুটি কবিতাবই আর গানের ডায়রিতে আছে!"

দেখলাম কবিতার নীচে সাইডনোট  ছাড়াও তারিখ লেখা। আর সঙ্গে মাঝেমাঝে পাতার খাঁজে আটকে থাকা কয়েকটি সাদা চিরকুট। যেমন একটি কবিতার লাইন - "তুমি খুব দ্রুত হেঁটো না, আমার দিক ভুল হবে।" লাইনটি 'প্রেমিকা' কবিতার নবম ভাগের শেষের দিকের লাইন। পাশে পেনসিল দিয়ে লেখা, "ক্লান্তি। এতো অপমান। সহ্য হয় না।" আবার আর একটি কবিতা 'একটি মৃত পাখি'। তার প্রথম দুটি লাইন লাল পেনসিলে দাগ দেওয়া। "পাখি মরে আছে, পাখি বরফের স্তূপের ভেতরে মরে আছে।" পাশে লেখা, "ও আমাকে একদিন মেরে ফেলবে মুরারী। আমি নিশ্চিত জানি।" তারপর একটা তারিখ। আশুদা একটা সাদা খাতায় নোট নিচ্ছিল সব। লিখতে লিখতেই বলল, "এই কবিতার বইদুটো আসলে একটা চ্যাটবক্স। মুরারী শকুন্তলাদেবীর সময় তো তোদের ওই ওয়াটসঅ্যাপ ছিল না। এই তারিখটা মনে রাখিস। এই তারিখের এক সপ্তাহ বাদেই শকুন্তলাদেবীর গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটে।"

কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন যায় না। কে মেরে ফেলতে চায় শকুন্তলাদেবীকে? অভিনন্দন শিকদার? কিন্তু কেন? যৌন ঈর্ষা? নাকি অন্য কেউ। 'মানুষ, ১৯৬১' কবিতার লাইন, "আড়াল করে দেখে নেবার মতো কোথাও আর গোপন দৃশ্য নেই"। পাশে লেখা, "ওরা জেনে গেছে আমাদের কথা শকুন্তলা। আমার মন বলছে। তুমি সাবধানে থেকো।" এই শব্দ মুরারীর। নীচে তার ছোট স্বাক্ষর। 'নিজস্ব ঘুড়ির প্রতি' বইয়ের 'ঘুম ভাঙার পর' কবিতার শেষে শকুন্তলাদেবীর লেখা, "ঘুম আসে না কেন? তুমি বলো। কেন আসে না ঘুম?" কবিতার লাইন 'কোনো প্রতিদান নেই, তবু চঞ্চল বুকের কাছে পাতা ঝরে পড়ে।' পাশে মুরারী ডাক্তারের লেখা, "ভেবো না এতো। ঠিক একটা পথ বের হবে। কেউ জানতে পারবে না।" সংলাপের নৌকায় চেপে চেপে গানের ভেলায় ভেসে রয়েছি যেন। দুই প্রেমিক প্রেমিকার কথোপকথনের নীরব সাক্ষী হয়ে ছায়ানদী বুনে চলেছি আমি আর আশুদা। গানের খাতায় রামনিধির টপ্পা ছাড়াও রয়েছে শ্যামাসঙ্গীত। হাতের লেখা শকুন্তলাদেবীর হলেও পাশে তারিখ লেখা। সেই লেখা মুরারীর।

-পরবর্তী অভিসারের দিন লিখে এভাবেই পরস্পর পরস্পরকে গোপনে জানিয়ে দিতেন দুজনে। আশুদা বলল।

গানের খাতায় লেখা।

'কী গুণ করেছে তোমার আঁখি বলো না। কথায় কথায় মান অভিমান ছলনা।' গানের স্বরলিপি শকুন্তলাদেবীর লেখা। পাশে লাল পেনসিলে লেখা আরও কয়েকটি নোটেশন। মুরারীর হাতের লেখা। বোঝা যায় ওগুলো বেহালা সঙ্গতের। সেই স্বরলিপির ঢঙেই তারিখ লেখা। যেন এক চতুল বৃন্দাবনী মায়াকাহন। গোপন অভিসার।

-তাহলে এমন কিছু ঘটেছিল যাতে অভিনন্দনের দুরভিসন্ধির কথা জানতে পেরেছিলেন শকুন্তলাদেবী।

আশুদা ভেবে বলল, "হতে পারে। কিন্তু মন বলছে, মূল কুশীলব অভিনন্দন নয়। কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি।"

-কে সে?

-আন্দাজ করতে পারছি। নিশ্চিত হতে আরেকটু সূত্র লাগবে। কাল মনসুরকে ডেকে পাঠাতে হবে। মন বলছে ও আমাদের কাছে কিছু একটা লুকাচ্ছে। তুই শুয়ে পড়। আমি আরও কিছুক্ষণ এই বই খাতা ঘেঁটে ঘেঁটে দেখি।"

অগত্যা আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘরে ফিরে গেলাম। আড়চোখে ঘড়িতে দেখলাম সময়। ভোর পৌনে চারটে।

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন