কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

গৌরাঙ্গ মোহান্ত

 

ট্যাং কবিতা: কাব্যাদর্শের রেনেসাঁস



 

চীনের প্রাচীন কবিতা বিশ্বসাহিত্যে একটি বিশিষ্ট জায়গা আলোকিত করে আছে। প্রাচীন চীনা সমাজে কবিতার প্রভাব ছিল বিস্ময়কর। কবিতা ছিল প্রধানত উচ্চতর শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। কনফুসিয়াস কবিকে অলোকসামান্য মানুষ হিসেবে গণ্য করেছেন। তাঁর মতবাদ অনুযায়ী কবির দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয় সমাজের বিচ্যুতি—কবির অনন্য প্রয়াসে সমাজ ত্রুটিমুক্ত ও আলোকদীপ্ত হয়ে ওঠে। কবি আবির্ভূত হন নৈতিকতার অবিকল্প কণ্ঠস্বর হিসেবে। কনফুসিয়াসের দর্শন রাজকীয় প্রতিষ্ঠানকে সুসংহত করেছে। হান রাজবংশ (খ্রিস্টপূর্ব ২০৬-২২০ খ্রিস্টাব্দ) হতে এ দর্শন শাসনতান্ত্রিক নীতিমালার আদর্শ হিসেবে আদৃত হয়ে এসেছে। কনফুসীয় মূল্যবোধ চীনা সমাজের অগ্রগতি ও চীনা সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে রেখেছে অভূতপূর্ব ভূমিকা। কনফুসিয়াস স্কুলের 'অ্যানালেক্টস'-এ কবিতার গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কবিতাকে আত্মোন্নয়নের সূত্র; দেশের অবস্থা অবলোকনের দর্পণ; পিতার যত্ন নিশ্চয়ন, পারিবারিক আচরণ পরিশীলন ও জ্ঞান ব্যবহারের নির্দেশতন্ত্র; মিথষ্ক্রিয়ামণ্ডিত, সমাজবদ্ধ জীবন পরিচালনার বিধান; পাখি, চতুষ্পদী প্রাণী ও বৃক্ষ সংবলিত কোষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে (Eno 96)।

তৃতীয় শতকে হান রাজবংশের পতনের পর দীর্ঘ সময় ধরে চীনে কেন্দ্রীয় সরকারের অবর্তমানে রাজনৈতিক অনৈক্য ও সামাজিক নৈরাজ্য প্রবল হয়ে ওঠে; চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিভিন্ন আঞ্চলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্বল্পায়ু সুই রাজবংশ (৫৮১- ৬১৮) এবং অনুবর্তী ট্যাং রাজবংশে (৬১৮-৯০৭) চীনের অখণ্ডতা দৃশ্যমান হয়। চীনের কাব্যিক ঐতিহ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ইতিহাসের অনিবার্য প্রতিফলন (Hinton 145)। ট্যাং রাজবংশ দীপ্তিময় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রচনার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে প্রোজ্জ্বল। সামন্ততান্ত্রিক এ শাসনামলে নাগরিকগণ নির্বিবাদ পরিবেশে জীবন ধারণ করেছেন। রাত্রিকালে তাদের দরজায় অর্গল লাগাতে হয়নি। হৃত দ্রব্যাদি পথেঘাটে পড়ে থাকলেও লুব্ধতাবশত কেউ তা স্পর্শ করেনি। নারীর সমমর্যাদা সমাজে ছিল প্রতিষ্ঠিত। সমাজ্ঞী য়ু জেতিয়ান সিংহাসনে আরোহণ করে সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত করেছিলেন। তিনি তাওবাদ ও বৌদ্ধধর্মের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন এবং শিক্ষা ও সাহিত্যের উন্নয়ন সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন। নানা জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের সহাবস্থানে কোনো সমস্যা

পরিলক্ষিত হয়নি। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ উদ্দীপ্ত ও প্রশস্ত থাকায় সৃষ্টিশীলতা অনবদ্য উচ্চতা স্পর্শ করেছিল। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ট্যাং যুগে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় কিংবা রাজপ্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মে নিয়োগ দানের জন্য কাব্য প্রতিভা মূল্যায়িত হত। আমলা বা কর্মকর্তাগণের মূল্যায়নপর্বে কবিতা রচনায় দক্ষ ব্যক্তি চাকরি লাভে সক্ষম হতেন (Shushe 12)।

ট্যাং রাজবংশের রাজধানী চেংয়ান (Chang'an) ও লুইয়াং (Luoyang) তৎকালীন পৃথিবীর বৃহত্তম ও অতি কজমোপলিট্যান শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল; এ জাতীয় শহরে বিদেশি পণ্য ও অদ্ভুত পোষাক পরিহিত পর্যটকের আধিক্য ছিল লক্ষণীয়। গ্রহণযোগ্য বৈদেশিক নীতি প্রচলিত থাকায় পারস্য ও আরব দেশীয় ব্যবসায়ীগণ বিখ্যাত সিল্ক রোড ধরে রাজধানীসহ অন্যান্য উপকূলবর্তী শহরে আগমন ও বসতি স্থাপন করতেন। সিল্ক রোড ও সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা বিধানের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট ছিল। সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার কারণে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলত অ্যান-শি বিপ্লব (৭৫৫- ৭৬৩) ট্যাং রাজবংশের বিপর্যয় ডেকে আনে। অ্যান লুশান ও শি সিমিং পরিচালিত বিপ্লবী সামরিক বাহিনী রাজধানী দখল করে কার্যত ট্যাং রাজবংশের ধ্বংস নিশ্চিত করে। দেশের দু-তৃতীয়াংশ জনতা মৃত্যুবরণ করেন অথবা আশ্রয়হীন হয়ে বিতাড়িত হন। বিপ্লবোত্তর এক শতক ধরে শিল্পকলা বেগবন্ত থাকলেও গৃহযুদ্ধে সৃষ্ট ভয়ংকর সমরবাদের বিভীষিকা থেকে এ রাজবংশ মুক্তি লাভ করতে পারেনি।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে 'শি জিং' বা কবিতার বই রচিত হলেও ট্যাং যুগ চীনে চিহ্নিত হয় কবিতার সোনালি ক্ষেত্র হিসেবে। ট্যাং কবিতায় ভাস্বর মানবিক মূল্যবোধ, দুঃখ, বেদনা, প্রেম, মৃত্যু, অসাধারণ নৈসর্গিক ও সৌন্দর্য চেতনা পাঠককে আবিষ্ট করতে পারে। ট্যাং কবিগণের কাব্যভাষার সাথে চিত্রভাষার সাদৃশ্য লক্ষণীয়। চর্যাপদের আগে রচিত ট্যাং কবিতায় চর্যাপদীয় দুর্বোধ্যতা ও সাধনতত্ত্ব যেমন দুর্নিরীক্ষ্য তেমনি এ্যাংলো-স্যাক্সন কবিতার লোকাতীত সংবেদনাও দুর্লক্ষ্য। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ ছিলো ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ যুগে রচিত 'চর্যাপদ' আমাদের একমাত্র প্রাচীন কাব্য। আমাদের প্রাচীন কাব্যভাণ্ডারে ২৪ জন কবির সাড়ে ছেচল্লিশটি কবিতা মূলত গূঢ় তত্ত্বের দীপ্তি দান করে। অন্যদিকে, ট্যাং যুগে ২২০০ জন কবি উপহার দেন প্রায় ৫০,০০০ কবিতা যেগুলো ভাব, বিষয় ও ছন্দে বিচিত্র। ষোলো শতকে বিকশিত তিন পঙ্ক্তি সংবলিত জাপানি হাইকু কবিতা, চার পঙ্ক্তিবিশিষ্ট ট্যাং কবিতার প্রভাব-পুষ্ট মানস সম্পদ (Wilson 17)। ট্যাং যুগের বিখ্যাত কবিগণের মধ্যে লি বাই, ডু ফু, ওয়াং ওয়েই, মং হাওরান, ওয়াং চ্যাংলিং, মং জিয়াও, লি হো, উয়ান ঝেন, বাই জুয়ি, লুও বিন-ওয়াং, ঝ্যাং রো-জু, চ্যাং জিয়ান, হান য়ু, ঝ্যাং জি, লি শ্যাং-য়িন, পি রি-জিউ উল্লেখযোগ্য।

রোমান্টিক চেতনা ট্যাং কবিতাকে সমুজ্জ্বল করে তুলেছে। রোমান্টিক স্কুলের পুরোধা হিসেবে লি বাই (৭০১-৭৬২) সমধিক উল্লেখযোগ্য। চীনের ইতিহাসে এরূপ প্রতিভাধর কবির আবির্ভাব কমই ঘটেছে। 'কবিতার অমর সাধক' হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। সামন্ততান্ত্রিক গোঁড়ামির শৃংখল ভেঙে তিনি মানবসত্তাকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন; আপন কল্পনার অসীম বর্ণে নির্মাণ করেন কবিতার উদার চিত্রকল্প। 'চাঁদের নিচে নিঃসঙ্গ সুরাপান' তাঁর একটি উপভোগ্য কবিতা। 'পুষ্পরাজির মাঝখানে এক জগ মদ:/ একা করছি পান, সন্নিকটে নেই কোনো বন্ধু।/ কাপ তুলে ধরে, ইঙ্গিতে ডাকি উজ্জ্বল চাঁদকে;/ আমার ছায়াসহ আমরা তিনজনের পার্টি। যদিও চাঁদ সুরাপানে অনভ্যস্ত/ এবং ছায়া কেবল অনুসরণ করে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ/ মুহূর্তের জন্য তারা যা তাই ধরে নেবো,/ বসন্ত সমাগম, করি বসন্ত উপভোগ/...।" এখানে কবি তাঁর ছায়া ও চাঁদকে নিয়ে যে উচ্ছলিত ভঙ্গিমায় বসন্ত উপভোগ করেন তা ট্যাং যুগের অন্য কবিতায় বিরল। এ কবিতায় কবি আনন্দপিয়াসী চিত্তের উদ্দাম স্বাধীনতাকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন।

বস্তুবাদী স্কুলের অগ্রণী কবি ডু ফু (৭১২-৭৭০) এ্যান-শি বিদ্রোহের (৭৫৫- ৭৬৩) প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। এ বিদ্রোহজাত গৃহযুদ্ধের ফলে ক্রমান্বয়ে ট্যাং রাজবংশের হিরণ্ময় দ্যুতি ম্লান হয়ে আসে। যোদ্ধা ডুফু শাসকের পক্ষে যুদ্ধ করেও শাসক মহলের নিকট থেকে প্রতিভা ও কর্মের কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি লাভ করেননি। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি 'কাব্য মহাজ্ঞানী' হিসেবে আদৃত হন। বঞ্চনা ও দারিদ্র্য ডু ফু-কে বিষণ্ণ, নিঃসঙ্গ ও বস্তুবাদী করে তোলে। তাঁর কবিতা 'ভ্রমণে নিশীথ ভাবনা' পাঠকের সামনে তুলে ধরে মগ্ন বিলাপের শিল্পিত ধ্বনিপুঞ্জ: 'কূল জুড়ে হালকা নলখাগড়া, ক্ষীণবল বায়ু।/ নিভৃত নিশীথে, উচ্চ-মাস্তুলযুক্ত নৌকা।/ নিঃসীম ভূতলের প্রান্তরূপে নক্ষত্রপুঞ্জ করে অবতরণ।/ চাঁদ ভেসে ওঠে, বহমান বিশাল নদীর ওপর।/ আমার কাব্যসৃষ্টির জন্য সুখ্যাত হওয়া কীভাবে সম্ভব?/ অফিসের বাইরে বৃদ্ধ ও অসুস্থ—সামনে পেছনে, এখানে ওখানে/ কার সাথে রয়েছে আমার সাযুজ্য, তবু?/ নিঃসঙ্গ এক শঙ্খচিল, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থলে সুস্থিত।' কবিতার প্রথম স্তবকে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির নান্দনিক চিত্রায়ণ পরিলক্ষিত হলেও শেষ স্তবকে খেদ ও নিঃসঙ্গতার রূপকল্প প্রমূর্ত। 'নিঃসঙ্গ এক শঙ্খচিল' কবির করুণ, বিজন মানসকে প্রতীকায়িত করে। 'বসন্ত পরিপ্রেক্ষিত' শীর্ষক কবিতায় বসন্ত কুসুমের ভেতর কবি যুদ্ধের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া অবলোকন করেন: 'জাতির পতন ঘটেছে, দেশ ভোগ করছে দুঃখকষ্ট:/ শহরে বসন্ত বৃক্ষ ও তৃণ সতেজ হয়ে উঠছে।/ কালপ্রবাহে বিপন্ন পুষ্পরাজি বয়ে আনে অশ্রু;/ ভয়াবহ বিদায়-গ্রহণ—পাখিরা থমকে দেয় আত্মা।' ডু ফু যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের বাস্তব চিত্র এঁকেছেন পরম মমতায়। 'পাথর পরিখা গ্রাম নিয়োগকর্তাগণ' কবিতায় সৈনিক সংগ্রহের জন্য কর্মকর্তাগণ দিনান্তে পাথর পরিখা গ্রামে উপস্থিত হলে এক বৃদ্ধার মর্মভেদী বিলাপ শোনা যায়:

'ইয়েচেঙের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত তিন ছেলের মধ্যে/ একজন কেবল বাড়িতে পাঠিয়েছে চিঠি।/ অন্য দুজন যুদ্ধে হয়েছে নিহত।/ উত্তরজীবী যথাসাধ্য কৌশলে লাভ করেছে জীবন;/ মৃতরা তাদের নিয়তিকে করেছে নিরুদ্ধ ।/ আমার দুগ্ধপোষ্য নাতি ছাড়া/ এ সংসারে আর কোনো পুরুষ নেই।/ সেজন্য পুত্রবধু এখনও আমাদের যায় নি ছেড়ে-/ তাছাড়া তার নেই কোনো শোভন পোশাক।' যন্ত্রণাকাতর বৃদ্ধার বিলাপ কবিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে; তিনি শুনতে থাকেন 'দূরবর্তী সাশ্রু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ'।

সাবঅলটার্ন মানুষের চিত্র শুধু ডু ফু আঁকেননি, পিউ এ সিয়ো (আনুমানিক ৮৩৪-৮৮৩) তাঁর 'ওক ফল সংগ্রহকারিণী মহিলার জন্য বিলাপ' কবিতায় এক নিরন্ন বৃদ্ধার জীবন ধারণের বাস্তব বর্ণনা তুলে ধরেছেন। 'হেমন্তে পাকে ওক ফল,/ কণ্টকিত ঝোপে আচ্ছাদিত পাহাড়ে পড়ে ঝরে।/ পীতবর্ণ চুলের কুঁজো এক মহিলা/ ওগুলো কুড়োবার জন্য মাড়ায় প্রভাতী হিম।/ ঘণ্টা খানেকের শ্রমে তার মেলে এক মুঠো কেবল,/ দিনমানে ওক ফলে পূর্ণ হয় এক ঝুড়ি।/ সেদ্ধ করে বার বার রোদ্দুরে দেয়া হলে,/ খাদ্য হিসেবে ওগুলো ব্যবহৃত হবে সারা শীতকাল।' প্রাচীন চীনের মতো প্রাচীন বঙ্গেও ভাতের অভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়। চর্যাপদের কবি ঢেন্টণপাদ উচ্চারণ করেছিলেন: 'টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।/ হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেসী।' অর্থাৎ টিলার ওপরে প্রতিবেশীহীন ঘরে কবির হাঁড়িতে ভাত নেই। দারিদ্র্যের এ জাতীয় প্রকট রূপের সাথে সওদাগরদের জীবনের তুলনা করেছেন ঝ্যাং জি (৭৬৬-৮৩০) তাঁর 'বুড়ো কিষাণের গান' কবিতায়। খাজনাক্লিষ্ট দরিদ্র কৃষক পাহাড়ে গিয়ে সন্তানদের ওক ফল জোগাড় করতে বলেন। কবিতার শেষে সওদাগরি জীবনধারার সংকেত মূর্ত হয়ে ওঠে: 'পশ্চিম নদীতে, সওদাগরদের রয়েছে অপরিমিত মুক্তা;/ তাদের নৌকার ভেতর কুকুরগুলোকে দেয়া হয় মাংস।' এভাবে শ্রেণিবৈষম্যের ভয়াবহ দিক উন্মোচিত হয় ট্যাং কবিতায়।

ট্যাং কবিতায় দারিদ্র্যের অসহনীয় অবস্থার বর্ণনা পাঠের পর চীনের পাহাড়ি গ্রাম প্রত্যক্ষ করার জন্য আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। ট্যাং রাজবংশের পরিবেশের সাথে আধুনিক পাহাড়ি পরিবেশের উন্নয়নগত ব্যবধান বিদ্যমান থাকলেও চীনা পাহাড়ি পরিবেশ বোধকে শাণিত করতে পারে, এ বিশ্বাস ছিলো দৃঢ়মূল। আমি ২০১৪ সালের জুন মাসে ইউনান প্রদেশের য়ু দিং কাউন্টিভুক্ত চ দিয়ান (Cha Dian) পাহাড়ি গ্রাম পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়ি। এ গ্রামে য়ি কিংবা লোলো নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার সাথে আমার পরিচয় ঘটে। তারা সামাজিকভাবে সুসংগঠিত বলে আমার কাছে প্রতিভাত হয়। সামাজিক ও উন্নয়নধর্মী বিষয়াবলির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তারা নিয়মিত তাদের সম্মেলন ভবনে উপস্থিত হন। পাহাড়ি বাড়িগুলো অত্যাধুনিক না হলেও প্রধানত ইষ্টকনির্মিত। পরিবারের নানা বয়সের সদস্যগণ শিক্ষা, কৃষি ও শিশু পালনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। য়ি জনগোষ্ঠির বাড়িগুলোতে রয়েছে রকমারি ফলের গাছ। আপেল, নাশপাতি, আম, কলা, আখরোট, ডালিম ছাড়াও রয়েছে নাম অজানা অনেক ফলগাছের সমারোহ। বিভিন্ন উচ্চতার পাহাড়ি জমিগুলোতে হচ্ছে ধান, তামাক ও সবজির চাষ। গ্রিনহাউজ ভেষজ উদ্ভিদের চাষ এখানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাড়িগুলো থেকে যে রাস্তা নেমে এসেছে তার দু ধারে ডালিম গাছের সারি। গ্রামটিতে বাংলাদেশের মতোই রয়েছে পোষা কুকুরের আনাগোনা। বাড়িগুলোতে রয়েছে ছাগল পালনের সুব্যবস্থা। ছাগলগুলোর সুন্দর স্বাস্থ্য দেখে প্রতীয়মান হয় যে, এখানে পুষ্টিকর পশুখাদ্যের কোন অভাব নেই। কোনো কোনো বাড়িতে রয়েছে গ্রামীণ পশু ফার্ম। সেখানে হাঁস, মুরগি ও শুকর পালন করা হচ্ছে। গ্রামের এ পরিবেশ দেখে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে, প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে এখন আর দারিদ্র্যের উল্লেখযোগ্য কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের বিদায় জানাবার জন্য য়ি মানুষজন যে সাংস্কৃতিক আবহ রচনা করেন তা খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

গ্রামের মহিলাগণ একটি লাইনে দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে নাতিদীর্ঘ একটি গীত পরিবেশন করেন। তাদের ভাষা দুর্বোধ্য হলেও বাংলাদেশের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির গীতের মতোই প্রলম্বিত, আন্তরিক সুর আমার বিস্ময় ও আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ট্যাং কবিতায় মানুষের দৈন্যের সাথে যে প্রাকৃতিক প্রতিবেশ চিত্রিত হয়েছে তার প্রচ্ছায়া প্রায় চৌদ্দশত বছর পরে আধুনিক চীনে দুষ্প্রাপ্য।

মধ্য ট্যাং যুগের কবি লি হো (৭৯০-৮১৬) রোমান্টিক হলেও প্রথাবিরুদ্ধ কল্পনায় ভাস্বর করে তুলেছেন কাব্যভুবন। নিজের জীবন-প্রদীপ ২৬ বছর প্রোজ্জ্বল থাকলেও কবিতা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে কালাতীত উজ্জ্বলতা। লি হোর কবিতা 'ম্যাজিক তন্ত্রীর জন্য শিল্পকর্ম' আজও বিকিরণ করে প্রাতিস্বিক বিভা: 'পশ্চিম পাহাড়ে সূর্য অস্ত যায়, পূর্ব পাহাড়ে ঘনায় অন্ধকার,/ ঘূর্ণিঝড়ে উৎক্ষিপ্ত ঘোড়াগুলো পদদলিত করে মেঘপুঞ্জ ।/ বর্ণিল বীণা ও আটপৌরে বাঁশি থেকে ঝরে ক্ষীণ সুরমালা:/ যখন সে শরৎ ধুলোয় পা ফেলে খসখস করে ওঠে তার বুটিদার ঘাগরা।/ বাতাস যখন ছুঁয়ে যায় দারুচিনি পাতা এবং ঝরে পড়ে একটি দারুচিনি বীজ/ নীল র‍্যাকুনের চোখ ঝরায় রক্ত আর শীতার্ত খেঁকশেয়াল যায় মরে।/ স্বর্ণখচিত লেজসহ ড্রাগন অঙ্কিত প্রাচীন প্রাচীরগাত্রে/ বৃষ্টির দেবতা শরৎ পুকুরে বেড়ায় ভেসে;/ বৃক্ষের অপদেবতায় রূপান্তরিত শতবর্ষী পেঁচার বাসায় যখন সবুজ অগ্নিশিখা উদ্‌গত হয় তখন শোনে সে হাসির শব্দ।' অদ্ভুত চিত্রকল্পে রচিত হয়েছে কবিতাটি। কবির অন্ধকার, মৃত্যু ও প্রেত চেতনা একান্তই ব্যক্তিগত এবং বিখ্যাত চৈনিক কবিদের নির্মল কল্পনা থেকে তা ভিন্ন। বস্তুত কনফুশীয়, টাওয়িস্ট ও বৌদ্ধ বিশ্বাসের পরিমণ্ডল থেকে নিজের দূরত্ব রচনা করে তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন অদ্ভুত কাব্যশিল্প। মধ্য ট্যাং যুগের হলেও তিনি অন্ত্য ট্যাং যুগের অমলিন বৈশিষ্ট্যে জ্যোতিষ্মান।

ট্যাং কবিতা প্রধানত প্রাচীন ও নব্য কাব্যপ্রকরণ অনুযায়ী লিখিত। ট্যাং যুগের পূর্বে অনুসৃত রীতি তথা অনিয়ন্ত্রিত অক্ষর সংখ্যা ও ছন্দশৈলী যোগে রচিত হয়েছে অনেক ট্যাং কবিতা। নব্য প্রকরণের মধ্যে লুশি ও জুয়েজু উল্লেখ্য। লুশি প্রকরণ অনুযায়ী আট পঙ্ক্তি দিয়ে ছন্দে রচিত হয় কবিতা এবং জুয়েজু প্রকরণ অনুযায়ী চার পঙ্ক্তির সমন্বয়ে ছন্দে সজ্জিত হয় কবিতার শরীর।

ট্যাং রাজবংশ সমকালীন জ্ঞাত পৃথিবীর সাথে ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক সূত্রে যুক্ত থাকায় কাব্যসাহিত্যে যেরূপ ঔজ্জ্বল্য সঞ্চালিত হয় তেমন উদ্ভাস পরিবাহিত হয় চিত্র, স্থাপত্য ও মৃৎশিল্পেও। চীনের বিভিন্ন জাদুঘর, বৃটিশ মিউজিয়াম, কোরিয়ার জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ট্যাং রাজবংশের শিল্পকলা ও স্থাপত্যের নিদর্শন একটি অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক রেনেসাঁসের পরিচয় অনুধাবনে যথেষ্ট সহায়ক বলে আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। বৃটিশ মিউজিয়ামে ট্যাং শাসনামলের মৃৎপাত্র প্রদীপ, পুষ্পদলের নকশাখচিত উজ্জ্বল মৃৎপাত্র ট্রে, ধূপদানি, মোমদানি, চীনামাটির স্টেম-কাপ, ব্রোঞ্জ পাত্র, সমাধি মৃৎপাত্র, ত্রিবর্ণরঞ্জিত জগ প্রভৃতি উন্নত শিল্পরুচির স্মারক হিসেবে গণ্য। ট্যাং সমাজে ইহজীবন ও পরজীবনে সম্পদের জাঁকালো প্রদর্শনীর প্রচলন ছিল। ফলে জীবদ্দশায় যেমন বর্ণিল পাত্র বা বাক্স ব্যবহার করা হত তেমনি সমাধির জন্য ব্যবহৃত হত বর্ণোজ্জ্বল মৃৎপাত্র। সমাধি মৃৎপাত্র ট্যাং সমাজের আন্তর চারিত্র্যকে উন্মোচন করে। উজ্জ্বল বর্ণশোভিত পাত্র ইরান অথবা সিরিয়া থেকে আহরণ করা হতো; এগুলোর শোভাকর মোটিফ গৃহীত হত ইরান এবং কেন্দ্রীয় এশিয়া থেকে। সাংকাই (Sancai) বা ত্রিবর্ণে সিসা-ঔজ্জ্বল্যের ব্যবহার মৃৎপাত্রকে অতিমাত্রায় আকর্ষণীয় করে তুলত । সাধারণত সবুজ, হলুদাভ বাদামি ও হলুদাভ শুভ্র রং মিলে ত্রিবর্ণ মায়াময় সৌন্দর্য সৃষ্টি করত। শৈল্পিক সমাধি পাত্র মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সম্মানের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত ছিল। কোরিয়ার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে ট্যাং যুগের একটি বৌদ্ধ স্তম্ভ (Buddhist Stele)। গাও ওয়ানহাই তাঁর মৃত পিতামাতার শান্তিপূর্ণ চিরবিশ্রামের জন্য আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় ৬৬০ খ্রিস্টাব্দে এ স্তম্ভ নির্মাণ করেন। সপ্তম শতকের ট্যাং স্থাপত্যে বোধিসত্ত্বের চিত্রায়ন একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

বৃটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত এশীয় প্রত্ন-নিদর্শন কবি এজরা পাউন্ডকে এশীয় সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি অনুরাগী করে তুলেছিল। শিল্প সমালোচক অধ্যাপক ফেনোলোসার টীকাভাষ্য অনুসরণে এবং অধ্যাপক মোরি ও অ্যারিগার অর্থোভেদ অনুযায়ী পাউন্ড ১৯১৫ সালে প্রাচীন চীনা কবিতার অনুবাদকর্ম 'ক্যাথি' (Cathay) প্রকাশ করেন। এ কাব্যে প্রাচীন চীনা কবিতা ও এ্যাংলো-স্যাক্সন যুগের 'সমুদ্রাভিযাত্রী' (The Seafarer) কবিতাসহ মোট ১৫ টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়। এ কাব্যগ্রন্থে চীনের অষ্টম শতকের ট্যাং কবি রিহাকু বা লি বাইকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। লি বাই এর দীর্ঘ কবিতা 'নির্বাসীর পত্র' (Exile's Letter)-সহ ১২টি অনুদিত কবিতা 'ক্যাথি' কাব্যে সংকলিত হয়েছে। পাউন্ড চীনা ভাষায় জ্ঞান লাভ করেননি। কিন্তু প্রাচীন

চীনা কবিতার অর্থঘনত্ব, রূপকল্পময়তা ও প্রতীকতা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিলো। তিনি আধুনিক ইংরেজিতে প্রাচীন চীনা কবিতার কথাবস্তুর অনুবাদ করেছেন মাত্র, ভাষান্তরিত কবিতাকে দৃঢ়সংলগ্ন করার জন্য তিনি চীনা ব্যাকরণ রীতির অনুগামী হতে পারেননি। পাউন্ডের অনুবাদে বিকিরিত চীনা কবিতার শক্তি ও দীপ্তির প্রশংসা করেছেন ডব্লিউ. বি. ইয়েটস, ফোর্ড ম্যাডোক্স ফোর্ড, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস ও টি. এস. এলিয়ট। ট্যাং কবিতার স্বপ্নডাঙা বাংলা ভাষার কবি ও কবিতাপ্রেমীগণকে ঝলকে ওঠা পথের সন্ধান দিতে পারে।

ট্যাং যুগে সম্রাট, প্রশাসক, সওদাগর, গবেষক, যোদ্ধা, নারী, শিশু, সন্ন্যাসী, টাওয়িস্ট যাজক, পরিব্রাজক, ভৃত্য, গণিকা সকলেই কাব্যচর্চা উপভোগ করতেন। স্থাপত্য, মৃৎশিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রশান্ত ধারায় সমাজ নিয়ত স্নাত হত বলে অভাবনীয় মানস সম্পদে ট্যাং যুগ পূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্তর্গত আনন্দের মূল্যবান উৎস হিসেবে আমরা ট্যাং কবিতার দিকে ফিরে তাকাতে পারি।

 

উদাহৃত রচনাবলি

1. Graham, A. C.. Poems of the Late T'ang. New York: New York Review Books, 1977.

2. Hinton, David. Classical Chinese Poetry: An Anthology. New York: Farrar, Straus and Giroux, 2008.

3. Shushe, Huangshan., ed. The Poetry of Tang Dynasty. Chinese Red. 2012.

4. The Analects of Confucius. Ed. Robert Eno. 2003, 2012, 2015. (www.indiana.edu)

5. Ting-Chen, Zhang and Bruce M. Wilson. 100 Tang Poems. Beijing: China Translation and Publishing Corporation, 1988.


1 কমেন্টস্: