![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
জলকুম্ভি
চেয়ারে বসা পঞ্চায়েত প্রধান নিত্যানন্দ দাস। উড়ে উড়ে আসছে তার কথাগুলো – ‘মাথামুন্ডু কিছুই বুঝি না, খোরাখি’র জলে এতো জলকুম্ভি কোত্থেকে জেগে ওঠে? এই তো দু মাস আগেই কত টাকা খরচা করে পুরো সরোবরটাকে সাফ করানো হলো!’
মিটিং-এর পাশেই জঙ্গলের মধ্যে বৃটিশ
আমলের ভাঙাচোরা দাঁত বের করা একটা গেষ্টহাউজ। চারপাশে বড় বড় গাছ। আশেপাশে তারই ঘন ছায়া।
এখানেই খোলা জায়গায় মাছমারাদের মিটিং। সবাই ঘাসের আসনে। গ্রামের মাছুয়া কোঅপারেটিভ সংঘের জমায়েত। মিটিং-এর
মধ্যমণি পঞ্চায়েত প্রধান নিত্যানন্দ দাস। তিনি এই কোঅপারেটিভের মুখিয়াও। একটু দূরেই ‘খোরাখি’ সরোবর।
হেক্টর হেক্টর জমি দখল করে এই জলাশয়টা ত্রেতাযুগ থেকে গ্রামের বুকে সুখেদুখে জেগে থাকে।
এই খোরাখি সরোবরই এই অঞ্চলের প্রাণ। এর উপরেই নির্ভরশীল স্থানীয় মানুষজনের জীবন ও জীবিকা।
সরোবরের দিকটা থেকেই ভেসে আসছে ঠান্ডা ঠান্ডা জলীয় হাওয়া। আশপাশের আম জাম অশ্বথ গাছের
পাতায় বাতাসের সর সর আওয়াজ।
মিটিং-এ হাজির গ্রামের লোকজন মূলতঃ
জেলে বা মাছমারা মানুষ। এইসব মাছমারাদের নিয়ে এখানকার খোরাখি মাছুয়া কোঅপারেটিভ সংঘ,
যা কিনা বকলমে পঞ্চায়েতেরই অধীনে।
সরোবরের জলে জলকুম্ভি বা রাশি রাশি
কচুরীপানা জাতীয় আগাছার প্রসঙ্গটা গ্রামবাসীদের সবার কাছেই সত্যিই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সনাতন কেওট, হাফ নোংরা গেঞ্জি, ভিড়ের মধ্যে উঠে দাঁড়ালো। জমায়েতের একজন নির্ভার প্রতিনিধি।
লোকটা সবিনয়ে কবুল করলো - ‘এজন্যেই তালাবে মোদের জাল বাইতে বিস্তর অসুবিদে। দুদিনেই
মাছ ধরবার জাল ছিড়েফুড়ে যাচছে। ছেড়া জালে মাছ ধরবো ক্যামনে?’
শ্যাওলা কচুরীপানা জলকুম্ভির বিরুদ্ধে
বিক্ষুব্ধ মৎসজীবিরা সনাতন কেওটের কথাতে হা হা করে সায় দিলো – ‘ঠিক ঠিক বলছো বাপু!
দুদিনেই মোদের জাল ছিড়েফুড়ে যাচ্ছে। বড্ডো নোকশান। এমন সুন্দর তালাবে মাছ ধরার কম্ম ভোগে গেছে! মোদের কপালডাই খারাপ!’
নিত্যানন্দ দাস মোলায়েম স্বরে মিটিংকে
জিজ্ঞেস করলো – ‘সমস্যাটা তো সবাই জানি। তোরাই বল, এর সমাধানটা কী? গত একবছরে চার-চারবার
জলকুম্ভি সাফ করানো হয়েছে। এই খাতে গত বছরেই খরচা গ্যাছে চারলাখ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। পঞ্চায়েতের খরচায়
জলকুম্ভি সাফ করাবার জন্যে দুদুটো শক্তপোক্ত নৌকা কেনা হয়েছে। একবার জলকুম্ভি সাফ হবার
পর আবার যেই কে সেই অবস্থা! দুদিনেই সরোবর ভরে যাচ্ছে শ্যাওলা আর কচুরীপানায়!’
মিটিং চুপচাপ। সামান্য অঘোষিত বিরতি। জমায়েত হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে কেউ একজন ফিস ফিস করে বললো – নিচ্চয়ই গ্রামের মধ্যে কেউ লুকিয়ে টুকিয়ে অন্য জায়গা থেকে শ্যাওলা কচুরিপানা এনে রাতের অন্ধকারে তালাবের পয়-পরিস্কার জলে ঢেলে দেয়! তা নইলে একবার সাফ হবার পরে কি করে খোরাখি’তে জলকুম্ভির এতো বাড় বাড়ন্ত?
নিত্যানন্দ দাস মিটিংকে বলে –
‘হাজির সব দোস্তরা! সরোবরের মাছমারা দোস্তরা, তোরাই বল দেখি? কিভাবে এই সমস্যার থেকে
নিস্তার পাওয়া যাবে? আমাদের ফান্ড থেকে তালাব সাফাই-এর জন্যে দু’দুটো নৌকা কেনা হয়েছে।
মনরেগার ভাতা থেকে এ পর্যন্ত জলকুম্ভি সাফাইতে বহুৎ পয়সা খরচা করা হয়েছে। তবু যেই কে
সেই! আমরা সরকার থেকে যে টাকাটা পাই, তাতে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না! শীঘ্রই এই তালাবের
সাফ সাফাই বন্ধ হয়ে যাবে। তোদের সবারই সরোবরে জাল-ফেলা, মাছ-মারা – সব কিছু বন্ধ হয়ে
যাবে! কেউ কি কোনো উপায় ঠাওরেছিস?’
সমবেত ভীড় চুপচাপ। উপস্থিত গ্রামের
লোক, মাছমারাদের দলেরাও বুঝে উঠতে পারে না, কিভাবে শ্যাওলা কচুরীপানাদের এতো বাড় বাড়ন্ত?
পঞ্চায়েতের উদ্যোগে এক একবার সাফ সাফাই হয়ে যায়। তারপরেও আবার ওগুলো হপ্তা-বিয়োনার
মতো ফিরে ফিরে আসে?
নিত্যানন্দ দাস মিটিং নিচ্ছে।
- ‘জলকুম্ভি সাফে পঞ্চায়েতের টাকা সব ফতুর! এভাবে কদ্দিন চালানো যাবে? গ্রামের সবাই
- কেওট, ধীমর, মাছুয়া দোস্তসব! তোরা সবাই মন দিয়ে শুনিস! এখন ঠিক করেছি, কচুরীপানা
আর শ্যাওলা সাফাইতে তোদেরও আরো বেশি করে হাত লাগাতে হবে। কারণ, খোরাখি-সরোবর তোদেরই
জীবন ও জীবিকা।
- ‘এই মিটিং-এ আমি প্রস্তাব রাখছি,
এই কাজের জন্যে এবার থেকে তোরা সবাই পালা করে স্বেচ্ছাশ্রম দিবি। পঞ্চায়েতের নিজের
নৌকা আছে। সেগুলো নিয়ে খোরাখি-র শ্যাওলা কচুরীপানা তোরাই সাফ করবি। বছরে মাত্র দশদিন।
ভলানটারি জব! (হতভাগাগুলো ভলানটারি-র মানেটা বুঝলো কি?) এ কাজটা করতে হবে পঞ্চায়েতকে
ভালোবেসে, নিজের ইচ্ছেয়। বিনা মজুরীতে। বুঝলি?’
- ‘ভালো করেই জানিস, এই খোরাখি
সরোবর তোদের সবার জীবন। খোরাখি আমাদের গ্রামের, আমাদের পঞ্চায়েতের গর্ব। খোরাখি সাফ
সাফাই থাকলে, তোমাদেরও মাছ ধরারও সুবিধে। কি বলিস সবাই?’
ভীড়ের মধ্যে দু একজন মাছুয়া মাথা
নাড়লো।
একটু থেমে পঞ্চায়েত প্রধান তার
ভাষণে যোগ করলো - ‘যারা স্বেচ্ছায় সাফাই-এর এই কাজ করতে রাজী হবে না, আমরা ভেবে রেখেছি,
মনরেগার বাৎসরিক কাজের পাওনাগন্ডা থেকে দশদিনের টাকা পঞ্চায়েত কেটে রাখবে। এটা না-লায়েক
মাছমারাদের জলকুম্ভি সাফ না করার জরিমানা। কি, বুঝলি তো সবাই?’
মিটিং চুপচাপ। সবাই ভাবছে, বছরের এই দশ দশটা দিন তারা জলকুম্ভি সাফ করবে, মজুরী পাবে না! এ সব দিন কি তারা হাওয়া খেয়ে, পেটে কাপড় বেঁধে বেঁচে থাকবে?
পঞ্চায়েত প্রধান নিত্যানন্দ দাস
বলে চলেছে- ‘কি রাজি তো? বছরে মোট দশদিন, তার মানে প্রত্যেক মাসে মাত্র একটা বা দু’টা
দিন। আমাদের এতোগুলো মানুষ। ভাববি, সমাজসেবা! প্রত্যেক মাসে মাত্র একটা বা দু’টা দিন।
স্বেচ্ছাশ্রমে জলকুম্ভি হটানোর কাজ।’
এখানে উপস্থিত সবাই জানে, সরকার
থেকে তারা ১০০ দিনের মনরেগার তারা পায়। তাদের জন্যে জব-কার্ডও বানানো আছে। তারা রাস্তা
মাঠেঘাটে মেহনত করে, মাটি কাটে, মাটি ফেলে, পুকুর বানায়, জঙ্গল সাফ করে, সরোবর থেকে
জলকুম্ভি হঠায়। টিপছাপ বা কলমের সই দিয়ে পঞ্চায়েত অফিস থেকে পরিশ্রমের বিনিময়ে তারা
মনরেগার পয়সা তোলে। আর এসব কিছুর মূল দায়িত্বে পঞ্চায়েত প্রধান নিত্যানন্দ দাস, আর
তার মগজ! তিনি আবার মাছুয়া কোঅপারেটিভেরও মাথা! তিনিই সমাজ-সেবা তথা স্বেচ্ছাশ্রমের
ফর্মূলা বাতাচ্ছেন!
উপস্থিত হাড়হাভাতে মানুষগুলো মাথার
উপর দিয়ে স্বেচ্ছা-শ্রমের ফর্মূলা উড়ে উড়ে ঘোরে! খোরাখি সরোবরের জলকুম্ভি কেন রোখা
যাচ্ছে না? এরই মধ্যেই কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন প্রস্তাব এসেছে, বিনা মজুরীতে
গ্রামের লোকেদের শ্যাওলা কচুরী পানা সাফ করতে হবে। যে একাজ করতে অস্বীকার করবে, তার
সারা বছরের মনরেগার উপার্জন থেকে দশ দিনের মজুরী কাটা যাবে। সেই টাকা কি পঞ্চায়েতে
জমা হবে? জলকুম্ভি সাফাইএর এ কেমনতরো অলিখিত ট্যাক্স? এই মিটিং এর দিকে তাকিয়ে বৃটিশ
আমলের ভাঙাচোরা গেষ্টহাউজটাও নিঃশব্দে হাসে!
জমিতে বসে থাকা ভানু নিষাদ ফিসফিস
করে বলে – পঞ্চায়েত আর কোঅপারেটিভের টাকা পয়সার কি কোনো হিসাব নিকাশ আছে! আমাগো নিতুদাসই
পঞ্চায়েতের বেবাক সম্পত্তির মালিক!
পাশে বসা দুএকজন ফিস ফিস করে বলে
ওঠে – ‘এ কেমন কতা! বিনা মজুরিতে বেগার খাটা? হুকুম না মাইনলে পাওনাগন্ডা থিকা দশদিনের
মজুরি কাটা যাইবো?’ ভাগ্যিস এই ফিসফিসানি চেয়ারে বসা চেয়ারম্যান নিতু দাসের কান অব্দি
পৌছায় না!
পঞ্চায়েত প্রধান নিত্যানন্দ দাস
মোলায়েম স্বরে উপস্থিত গ্রামবাসীদের বলে – ‘কি সবাই রাজী তো? কেউ যদি এই প্রস্তাবে
রাজী না থাকে, তাহলে তাকেই বলতে হবে, তালাবে জলকুম্ভির সমাধানের উপায়?’
ভবেন মাছুয়া ভীড়ের মধ্যে ঘাসের
আসন ছেড়ে খাড়া উঠে দাঁড়ায়। মাছ ধরা নৌকা বাওয়া, জাল ফেলা লোকটার জীবিকা। ভবেন সাহস
করে ফুসফুসে একবুক হাওয়া ভরে নেয়। দু’হাতে নমস্কার করতে করতে সে নিতু দাসকে বলে –
‘একটোই উপায় আছে প্রেধানকত্তা। জলকুম্ভিকে হটাতি গেলে, সবার আগে যেটাকে হটাতি হবে,
তা হচ্চে পঞ্চায়েত আর কোঅপারেটিভের ঘিলুতে আটকে থাকা যত্তো সব জঞ্জাল, শ্যাওলা আর কচুরিপানা।
সেখানকার মগজ সাফসুতরা থাকলেই আমাগো খোরাখি সরোবর সাফ-সুতরো থাকপে, কোনোদিনও সেকানে
আর জলকুম্ভি থাকপে না!’
‘ভবেন, তুই কি বইলতে চাচ্ছিস, সাফ
সাফ বল! তোর কথা কেউ বুঝতে পারছে না!’
মিটিং এর মধ্যে সামান্য ফিসফিসানি
ওঠে। নিত্যানন্দ দাস, সভায় অহেতুক গোলমাল হবে বলে বিষয়টা নিয়ে আর এগোয় না। পঞ্চায়েতের
মগজ সাফসুতরা করবার পরামর্শ দিচ্ছে লোকটা? আস্পর্ধা তো কম না!
পঞ্চায়েতের ঘিলুতে আটকে থাকা যত্তো সব জঞ্জাল পরিস্কারের প্রস্তাব দেবার কয়েকদিনের মধ্যেই ভবেন মাছুয়া কোঅপারেটিভ সংঘ থেকে বহিস্কৃত হলো, খোরাখি জলাশয়ে তার মাছ ধরাও নিষিদ্ধ হলো। গ্রামবাসীদের বলা কওয়াতেও কিছু হলো না! পঞ্চায়েত প্রধান নিত্যানন্দ দাস তার সিদ্ধান্তে অনড়।
অগত্যা ভবেন মাছুয়া গেলো রায়পুর
শহরে, সেখানে সে একটা দোকানে থাকে। একজন ঠিকাদারের কৃপায় বহু কষ্টেসৃষ্টে মাছের আড়তে
সে একটা কাজ জোগাড় করলো। বড়ো অনিশ্চিত ভবেনের সে জীবন। সঙ্গে তার বউও আছে। এমনি ভাবে
তিন মাস কেটে গেলো। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে একটা অপরিচিত শহরে তাদের ঠিকঠাক পোষাচ্ছিল না।
অল্প কিছুদিন বাদেই ভবেন বউএর হাত ধরে আবার ফিরে এলো নিজের গ্রামে। ভেবেছিল পঞ্চায়েত
প্রধানের কাছে ক্ষমাটমা চেয়ে, তার হাতেপায়ে ধরে আবার কোঅপারেটিভেই মাছ ধরবার কাজে বহাল
হবে। এটা ভেবে সে গেল গ্রামের পঞ্চায়েত অফিসে।
আশ্চর্যের কথা, ঠিক সেদিনও সেখানেই বসেছে মাছমারাদের মিটিং। পঞ্চায়েতের অধীনস্ত খোরাখি মাছুয়া কোঅপারেটিভ সংঘের জমায়েত।
সবাই বসে আছে সেই ঘাসের জমিনে।
মিটিং নিচ্ছে পঞ্চায়েত প্রধান, নিত্যানন্দ দাস। তাকে ঘিরে মাছমারাদের দল, স্থানীয় মানুষজন।
মিটিং-এর পাশেই সেই বহু পরিচিত বৃটিশ আমলের ভাঙাচোরা গেষ্টহাউজটা।
ভবেন মাছুয়া তিনমাস বাদে তাকিয়ে
দেখলো, কিছুদিন আগে সাফ হওয়া খোরাখি সরোবরটা
আবার আগের মতোই জলকুম্ভিতে ছেয়ে গেছে - সবুজ কচুরিপানার ফুলগুলো যেন একএকটা কাগজের
নোটের মতো, তাকিয়ে তাকিয়ে খিলখিল হাসছে! জলকুম্ভি আবৃত খোরাকি সরোবরটাকে দেখাচ্ছে ভাসমান
একটা জলজ উদ্যান! সবুজে সবুজ, টাকায় টাকায় লালে লাল! সরোবরের সেই ভাসমান উদ্যানের উপরে
একটা চেয়ারে বসে আছে নিত্যানন্দ দাস! গলায় ঝোলানো টাকার মালা। পঞ্চায়েতপ্রধান জলজ হাওয়ার
রুমালে নিজের মুখটাকে ঢেকে মিটিংএ বসে বসেই সবার অলক্ষ্যে মিটিমিটি হাসছে!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন