ছেঁড়া
শেকড়ের অন্তরাখ্যান
(১)
অলীক নয়, জেগে স্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়াও নয়। কখনও কখনও এরকম হয় মানে হতেও পারে। ছাদে দাঁড়িয়ে বছর চোদ্দর অঞ্জিষ্ণু দেখল দৃশ্যটা। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ‘দাদু-উ, দাদু-উ! আর্থকোয়্যাক্!’ বলতে বলতে দুদ্দাড় করে নামল একতলায়।
আকাশ-ফাটানো চীৎকার করে
দিন-দুপুরে গা এলিয়ে দিয়েছে চোঙার মতো অসমাপ্ত নতুন পাঁচতলা। হুড়মুড় করে ধ্বসে গেছে
একতলার দেওয়াল। কলাম দুমড়ে, ভিত উপড়ে, প্লিন্থের ইট-বালি বেরিয়ে এসেছে। দু-আড়াই বছর
আগে কনস্ট্রাকশন শুরু করেছিল প্রমোটার সঞ্জীব সাহা। পুরনো একতলা ভেঙে দিয়ে মাটি
খোঁড়া হল দেখেছে সকলে। বস্তা-বস্তা বালি, কাঁড়ি-কাঁড়ি রাবিশ ঢালা হল। দুরমুশ হল। রাতদিন
আওয়াজে, ধুলোয় জনপ্রাণী অস্থির। পাঁচতলার ছাদ ঢালাইয়ের পর কী কারণে যেন কাজ বন্ধ ছিল
ক-মাস। ইদানিং আবার জোরদার চলছে, প্রায় হয়ে এল। সব মিলিয়ে ন-টা ছোটো ফ্ল্যাট। শোনা
যাচ্ছে সবই ‘বুক্ড্’ হয়ে গেছে। লোকে বিশ্বাস করেনি। বলে, ওসব চালাকির কথাও হতে
পারে। সঞ্জীব সাহা লোক বিশেষ সুবিধের নয়।
ফ্রেম রেডি, এবার জানালা-দরজা
বসবে। মেঝেতে, দেওয়ালে টাইলস্ লাগানো শেষ হয়েছে। ভেতরের অন্যান্য কাজ চলছে। কমোড,
বেসিন, সিংক মাথায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠছে মিস্ত্রিরা। এবাড়িতে লিফট রাখা
যায়নি, জায়গা নেই। গ্যারাজও হবে না, স্থান অকুলান। গোটাকয়েক স্কুটার বা সাইকেল
রাখার মতো একফালি জায়গা ছাড়া রয়েছে। বিলডিং-এর দেওয়ালে কায়দা করে ছোটো ফ্লেক্স টাঙানো,
‘নীলাবাস – নিজাবাস – পকেট খরচায় মনের মতো ফ্ল্যাট – জানালা খুলেই খোলা আকাশ।’
সত্যি বলতে কী, জানালা
দিয়ে কিছুই দেখার নেই। পর্দা সামান্য সরলে উঁকি দেবে অন্য কোনও ফ্ল্যাটের অন্দরের জীবন্ত
মন্তাজ। দিনের বেলাতেও আলো-জ্বলা, কটকটে দেওয়াল, ছাপছোপ পর্দা। আড়াইফিট
ব্যালকনিতে ঝুলন্ত, উড়ন্ত জামাকাপড়, দু-একটা দুঃখী পাতাবাহার। একরত্তি ডাইনিং
টেবিলে ছুরি দিয়ে সবজি-কাটা এলোঝেলো ব্যস্ত গিন্নী। ক্ষুদে ‘কিচেনের’ স্ল্যাব থেকে
উঁকিমারা মাইক্রোওয়েভ। বেডরুমে গোলাপী ওয়ার্ড্রোবের ড্রেসিং টেবিলের খুচরো সাজগোজের
জিনিস। বাচ্চা ছেলে-মেয়ের খাটে বসে হোমটাস্ক। বয়স্ক পুরুষের শর্টস্-পরা লোমশ পা। আরও
অজস্র দেখা যায়, শোনা যায়, পর্দা না সরলেও। কুটি-কুটি আবাস, কুটি-কুটি সংসার। আলো
নেই, আকাশ নেই, বাতাস চলে না। একে অন্যের নিত্যযাপনে সম্পৃক্ত হয়ে থাকা। হাঁড়ির
খবর, কান ভাঙানো, কথা চালাচালি। কখনও গলাগলি ভাব, কখনও মুখ দেখাদেখি বন্ধ।
যান চলাচলের মূল সড়ক থেকে বাঁক নিয়ে ঢুকেছে নাতিপ্রশস্ত রাস্তা। সে রাস্তা ধরে সরু গলিপথ খানিক পায়ে হেঁটে ‘নীলাবাস’। হাঁটতে অপারগ হলে স্কুটার, সাইকেল বা টোটো ভরসা। গলিতে চারচাকা ঢুকতে পারে না। সমস্ত এলাকা জুড়ে আঁকাবাঁকা অতি অপরিসর গলিতে প্রায় গোলকধাঁধাঁ। দু-ধারে ঠাসাঠাসি প্ল্যানবিহীন নিজস্ব দোতলা, তিনতলাও। কয়েকটা আবার প্রমোটারের কেরামতিতে টঙে-বাঁধা বোলতার খোপ। বাড়িগুলো মুখোমুখি, পিঠোপিঠি ফিট হয়ে আছে। পড়ে গেলে আটকে যাবে পাশেরটার গায়ে। ফিসফিস করে বলবে, ‘পইরা যাইতাসি। ধইরা ফালাইস—!’ পাশের বাড়ি বলবে, ‘আরে করস কী! ধরমু কী কইরা? রাখ রাখ।’
নির্ণীয়মান ‘নীলাবাস’ তার পাঁচতলার ছাদ ঢালাইয়ের কিছুদিন পর থেকে দু-এক সেন্টিমিটার করে কাত হয়ে যাচ্ছিল। প্রথম নজরে পড়ল গা-ঘেঁষে দাঁড়ানো অন্য বাড়িদের। গভীর রাতে ফিসফিস করে নীলাবাসকে বলল, ‘অ-রে তুই যে ঝুইক্যা পরতাছস অহনই!’
নীলাবাসের মুখ অন্ধকার,
‘হ। মাথাখান ক্যামন ভার
হইয়া আছে। মইধ্যে মইধ্যে ঘুরায়। ঠ্যাঙ দুইডায় জোর নাই। হের নীচ দিয়া কিসে
য্যান খালি ধাক্কাইতাছে।’ বাকিরা সমস্বরে বলে উঠল,
‘অ-রে কস কী! কী সব্বনাশের
কথা কস! মনিষ্যিগুলান আইব, তুই খারা না দারাইলে হেরা বাস করব ক্যামনে?’
গভীর রাতের এসব আলাপচারিতা
আশেপাশে রাতজাগা প্রাণী বা পথবাসী উন্মাদ, ভবঘুরে ছাড়া কেউ শুনতে পায় না। ওদের
কথার গুরুত্ব দেয় না সমাজ। তাই সর্বনাশ ঘটার খবর আগেভাগে টের পাওয়া যায় না।
যেসব মানুষ এই অঞ্চলে ফ্ল্যাট
কেনে, তারা শহরের বুকের মধ্যে কোলাহলের মধ্যে থাকতে চায়। কিন্তু তাদের কোটি-কোটি
টাকার সঞ্চয় নেই। থাকলে সঞ্জীব সাহার মতো ছোটো প্রমোটারের শরণাপন্ন হত না। হয়ত দীর্ঘমেয়াদী
লোন নিয়ে কিম্বা ঘরের গয়না বন্ধক রেখে অথবা জমানো টাকার চারভাগের তিনভাগ তুলে দিয়েছে
প্রমোটারের হাতে। চোখের তারায় স্বপ্ন- আবাস। একেবারে নিজস্ব স্বাধীন আধুনিক খুপরি!
যখন ব্যাপারটা প্রমোটারের
চোখে পড়ল, তখন দেরি হয়ে গেছে। সরু ফাটল ধরেছে কয়েক জায়গায়। ডাকতে হল ইঞ্জিনিয়ারকে।
পরপর ক-দিন মিটিং চলল। তাড়াতাড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোল-করা দরকার। ইঞ্জিনিয়ার পাশ কাটাতে
চাইল,
“রিস্ক আছে। বলেছিলাম
আগে সাবধান হও। তুমি শুনলে তো! আদতে জবরদখলি জমি। জলা জমি ছিল, নরম ভিত। তার ওপর কী
কোয়ালিটির মালপত্তর ঢেলেছ নিজেও জানো! ঠকানোর একটা লিমিট—যাক্গে—!”
“ফাণ্ডা না ফাটিয়ে রাস্তা
ভাবো।” আগুন মাথা অতিকষ্টে ঠাণ্ডা রেখে সঞ্জীব জানতে চাইল।
“রাস্তা মানে – বড়সড়
খরচের ধাক্কা। রেডি থাকলে খবর দিয়ো।”
“মিনিমাম খরচার উপায় বলো
আপাতত। ওই ফাটল-টাটল – তাপ্পর জমিতে খানিক গ্যাটিস্--। বছর পাঁচেকের মতো একটা ব্যবস্তা—।”
“ভেবে দেখছি।”
সঞ্জীবও চিন্তা করছিল। লোকটা
তাকে গাড্ডায় দেখে শিওর টাকা খাওয়ার ধান্দা করছে। এযুগে কাউকে বিশ্বাস নেই। ওদিকে ফ্ল্যাটগুলো
হ্যাণ্ড-ওভার করার সময় এগিয়ে আসছে। এখন খবর চাউর হলে কপালে দুর্ভোগ। সম্প্রতি এই
অঞ্চলেই হাতে নতুন দু-টো কাজ আসার সম্ভাবনা। ইতিমধ্যে সে কোটেশন জমা দিয়েছে।
জানাজানি হলে সুযোগ ফস্কে যাবে। এমনকী ভবিষ্যতে প্রমোটারি করা ঘুচে যেতে পারে। বছর
চার-পাঁচ আগে দু-তিনটে ছোটখাট কাজ করেছে মফঃস্বলের দিকে, নিজের এলাকায়। এপর্যন্ত সমস্যা
হয়নি। শহরের কাজ এই প্রথম। কাজটা কী ভুল হল? জমিটা ছোটো এবং অন্যান্য অসুবিধা
থাকলেও স্থানিক মূল্য খুব ভালো। ধন্দে পড়েছিল সে। উঞ্ছবৃত্তি ছেড়ে ক-বছর ব্যবসায়
নেমেছে, অভিজ্ঞতা কম। আচমকা ধাক্কা আসবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। কী করা উচিত ভেবে
পাচ্ছিল না। কাজ বন্ধ করে ছেলে-বউকে রেখে ক্যানিং-এর দিকে এক পরিচিতের বাড়িতে গিয়ে
বসে রইল। বউকে কৈফিয়ত দিল, ‘প্রচণ্ড চাপ, ক-দিন রেস্ট নিতে যাচ্ছি’। কাস্টমারদের ফোনের
ভাসা-ভাসা জবাব দিল। সপ্তাহদুই কাটিয়ে আর টিকতে পারল না। ফিরে এল। উদ্বেগ চেপে
গোপনে খোঁজ-খবর নিল। শহরের জনবহুল, অভিজাত অঞ্চলে কয়েকটা হাইরাইজ একদিক চেপে বেঁকে
দাঁড়িয়ে আছে। পড়ে যায়নি। বাসিন্দারা দিব্যি জীবন কাটাচ্ছে সেখানে। সরকার থেকে
‘বিপজ্জনক’ লেখা সাইনবোর্ডও লটকানো নেই। সঞ্জীব নিজের সপক্ষে যুক্তি খুঁজছিল। এই অস্থির,
নড়বড়ে সময়ে একদিন ছেলের ক্লাসের জেনারেল নলেজের বইতে চোখ পড়ল। পৃথিবীর প্রাচীন
সপ্তমাশ্চর্যের অন্যতম ‘পিসা-র স্তম্ভ’ নাকি আটশো বছরের বেশী প্রায় চার ইঞ্চি হেলে
রয়েছে।
নীলাবাসের পেছনদিকে শুকনো ছোটো মাঠের মতো। রোগা আমগাছ। পাশে প্রাচীন দেড়তলা। তার ছাদে উঠে নীলাবাসের পতন দেখছিল অঞ্জিষ্ণু, অধীর সরকারের নাতি। তাঁর বড়ো ছেলে অসীম চাকরিসূত্রে বহুকাল অন্য রাজ্যে। সেখানে পাকাপাকি বসবাস। স্ত্রী-বিয়োগের আগে অধীরবাবু সস্ত্রীক দু-চারবার গেছেন। তাঁর ভালো লাগে না। শুকনো গরম, ‘হিন্দুস্থানী’ কালচার, অবাঙালি ভাষা পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর বছর বয়স নতুন করে গ্রহণ করতে পারে না। বরং ছোটো ছেলে অজয়ের কাছে মাঝে-মাঝে যান। উত্তর চব্বিশ পরগণার প্রান্তে সরকারি ইস্কুলের মাস্টারমশাই সে। বিয়ে করবে কিনা বোঝা যায় না। সেখানে বাপ-ছেলেতে বেশ কাটে। তার বাসা থেকে ক-কিলোমিটার গেলে নদী। অধীরবাবু পায়ে হেঁটে নদীর পাড়ে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন। নাক ভরে শ্বাস নেন, গা পেতে হাওয়া মাখেন। নদীর ওপারে পূর্বপুরুষের দেশ ছিল। দেশ ভাগাভাগির বছর দুই পর ওদেশে তাঁরও জন্ম। তবে স্মৃতি কিছু নেই। শুনেছেন তাঁর দেড়বছর বয়সে দাদামশাই-দিদিমা মাকে সঙ্গে করে এপারে পালিয়ে আসেন। বাবা নাকি খুন হয়েছিলেন। মা ছিলেন একমাত্র কন্যাসন্তান। মামাদের বঞ্চিত করে মৃত্যুর আগে এই সামান্য জমি মা-র নামে দানপত্র করে যান দাদামশাই। শুরুতে ঘটনাটা মোটেই শান্তির ছিল না। অনেক পরে ধীরে ধীরে মিটমাট হয়, মামারা মেনে নেন।
অঞ্জিষ্ণুর চারবছর বয়স
পর্যন্ত ছেলে-বউমা এবাড়িতে ছিল। দাদুর বড্ড নেওটা ছিল নাতি। অধীরবাবু ছাদের একাংশে বড়ো ঘর,
অ্যাটাচড্ বাথরুম করিয়ে দিয়েছিলেন। অসীম অবশ্য ব্যস্ততার মধ্যেও সপরিবার প্রতিবছর
অন্তত বারদুই আসার চেষ্টা করে। এবারে থাকতে পারেনি, ছেলেকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেছে।
অধীরবাবু তাতেও খুশী। কানে ঈষৎ কম শুনছেন আজকাল। নাতির চেঁচামিচিতে তিনি ছাদে
উঠলেন। কর্নিশে ঝুঁকে অবস্থা দেখে তাঁর মাথা টলে গেল। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে নীচে
নেমে এসে ইজি-চেয়ারটায় বসলেন। নাতি জিজ্ঞেস করল,
“দেখেছ দাদু?”
“হ্যাঁ ভাই।”
“ডেঞ্জার! আর্থকোয়্যাক? বাট্
আমাদের তো হল না?”
“না না ভূমিকম্প না।
বাড়ি ভেঙে পড়েছে—।”
কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলা
কাঁপছিল। অতশত বোঝেনি অঞ্জিষ্ণু। বলল,
“তব তো ঠিক—। চলো খাবে
না? আমার বহুত খিদে লাগছে।”
“হ্যাঁ ভাই, চলো।”
ভাত, ডাল, শাকভাজা,
বেগুনী, মাংসের ঝোল টেবিলে গুছিয়ে রেখে গেছে রান্নার মেয়ে লীলা। অধীরবাবু নাতিকে
বেড়ে দিয়ে নিজেও নিলেন। নাড়াচাড়া করে সামান্য মুখে দিয়ে উঠে পড়লেন,
“তুমি মন দিয়ে খাও ভাই,
আমি আসছি। কেমন?”
উঠে দরজা খুলে বাইরে গেলেন।
রোজকার মতো অপেক্ষারত তাঁর পুষ্যি টমি, শান্টু, লালু, কালী, ঘেঁচিরা উপস্থিত। ওদের
সামনে পাতের সবটুকু মাখাভাত ঢেলে দিলেন। সামনে নীলাবাস ঘিরে এখন অনেক লোক। গলিটা
চীৎকার, চেঁচামিচিতে উত্তেজিত। পুলিশভ্যান এসেছে, ঘোরাঘুরি করছে ইউনিফর্মধারীরা। অ্যামবুলেন্সের
সাইরেন বাজল। দু-জন মিস্ত্রি আহত। ভাগ্য ভালো বাকিরা তখন ওখানে ছিল না।
খাওয়া-দাওয়া সারতে গিয়েছিল।
‘প্রমোটারকে ধরা যাচ্ছে
না,’ ‘শালা পালিয়ে যাবে কদ্দূর?” “হারামখোর ফোন অফ্ করে রেখেছে’, ‘আগে একটা
এফ-আই-আর করা দরকার’—জাতীয় আলোচনা কানে আসছিল অধীরবাবুর। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রবীণ
মানুষটি।
‘নীলাবাস’। বাড়ির পুরনো মালিকরা হয়ত প্রমোটারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল ‘নীল’ শব্দটা রাখতে হবে। অধীরবাবু খবর রাখতেন না। তাঁর পুরনো বাড়িটা মনে পড়ে। বহুবছর সে বাড়িতে কেউ থাকেনি। সামনের দেওয়ালে সিমেন্টে খোদাই-করা ‘নীলমণি কুটীর’ লেখাতে রোদে-জলে শেওলা পড়ছিল। গোটা বাড়ি তালাবন্ধ, প্লাস্টারখসা, লজ্ঝড়ে। শুধু এককোণায় একটা ঘর ও সরু বারান্দা নিয়ে নামমাত্র ভাড়ায় থাকত দুঃস্থ ওড়িয়া দম্পতি। বাড়ি ভাঙার আগে এদের তুলে দেওয়া হল। কতবছর হল ‘নীলমণি কুটীরে’র কোনও সদস্যকে অধীরবাবু এ-গলি মাড়াতে দেখেননি। অবশ্য সম্প্রতি বছরতিন আগে ঘনঘন ওদের কেউ না কেউ আসত প্রমোটারের সঙ্গে কথা বলতে। অধীরবাবু দেখতে পেলেও এড়িয়ে গেছেন। ওবাড়ির এক ছেলে নীলেন্দু ছিল তাঁর সমবয়সী। একসঙ্গে খেলাধুলো, মারপিট করেছেন। সেসব দিন কবে ভেসেও গেছে। এখন আর সহজ হতে পারেন না। কেমন অভিমানের বাষ্প ঘন হয়ে জমেছে।
সন্ধের পর অসীমের উদ্বিগ্ন
ফোন এল,
“তোমার ওখানে কী হয়েছে
বাবা? যিশু বলছিল!”
“দেখাচ্ছে তো টিভিতে।”
ক্লান্ত অনুত্তেজিতভাবে
অধীরবাবু বললেন। অসীম রীতিমতো ভীত, বিরক্ত।
“দেখলাম, বিশ্রী ঘটনা। নিরাপদে
আছ তো তোমরা? হাজারবার তো বলছি বেচেবুচে এখানে চলে এসো। ওই পাড়া আর রঙচটা বাড়ির
মায়া করে—তুমি—। যাকগে বলে লাভ নেই। যিশু পরশু যেন সময়মতো এয়ারপোর্টে হাজির হয়,
একা ফিরবে—!”
“দাদাভাইকে আমি নিজে এয়ারপোর্টে
পৌঁছে দেবো। তুই চিন্তা করিস না।”
রাতেও কিচ্ছু খেলেন না অধীরবাবু।
নাতি ছোটো হলেও খানিক চিন্তিত হল। ছেলেটা সরল, দাদুকে ভালোবাসে। নিজের বুদ্ধিমতো দু-চারবার
দাদুকে অনুরোধ করল। তারপর নিজে খেয়ে দাদুর পাশে শুয়ে পড়ল। অধীরবাবু তার মাথায় হাত
বুলিয়ে দিতে লাগলেন। একটু পরে সে বলল,
“তোমার দুঃখ হয়েছে
দাদু?”
“জানি না ভাই!”
“কিন্তু আমাদের বাড়ি তো
ড্যামেজ হয়নি?”
কিশোরের অকপট প্রশ্নে
চোখ ভিজে গেল। অন্ধকারেই মাথা নাড়লেন, চোখ মুছলেন। আর্দ্রস্বরে বললেন,
“শিকড় উপড়ে যাওয়ার
যন্ত্রণা যে খুব বেশী ভাই—। আরেকটু বড় হলে তুমি ঠিক বুঝবে।”
“তোমার কষ্ট হল তো তুমি চল,
আমাদের ওখানে থাকবে। বলব বাবাকে?”
“পরে। এখন ঘুমিয়ে পড়।”
অধীরবাবু চোখ বুজে শুয়ে
রইলেন। একটু পরে বুঝলেন নাতি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাঁর ঘুম এল না। আধোঘুমে স্থির হয়ে পড়ে
রইলেন কাঠের তক্তার মতো। সারা পাড়া নিঝুম অন্ধকার। জানালা দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলো
ঢুকছে ঘরে। হঠাৎ শুনলেন প্রচণ্ড গুম-গুম শব্দ, ঝড় আসার আগে যেমন হয়। সেই সঙ্গে
মানুষজনের কথাবার্তা, চীৎকার, কান্না। তিনি চোখ খোলার চেষ্টা করলেন। চোখের পাতা আঠা
লেগে জুড়ে গেছে। পাশ ফিরে শোওয়ার চেষ্টা করলেন। একচুল নড়তে পারলেন না। নিজেকে মনে
হচ্ছে মরা নদী। দেহের দু-পাশ দিয়ে পিলপিল করে চলমান মানুষের ঢল। শ-য়ে শ-য়ে, হাজারে
হাজারে মানুষ কোলে-পিঠে বাচ্চা, কাঁখে-মাথায় সংসারের টুকিটাকি নিয়ে ক্লান্ত পায়ে
চলছে তো চলছেই। আলোছায়া মেলানো অস্তিত্ব, শরীরী না অশরীরী ধরা যায় না। যেন হাওয়ায়
উড়ে চলেছে। তিনি চেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করলেন,
“তোমরা কারা? কোত্থেকে
আসছ? কোথায় যাবে?”
স্বর ফুটল না। হাত তুলে কোনও
একজনকে ধরার চেষ্টা করলেন। হাত উঠল না। প্রবল জনস্রোত বাতাসে দ্রুত ভেসে যেতে
লাগল। অধীরবাবু জোর করে উঠে বসলেন। মেঝেতে পা রাখলেন। মানুষগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে
না। দ্রুত গিয়ে ছাদে যাওয়ার দরজা খুললেন। ছাদে পৌঁছে কর্নিশের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
গুম-গুম শব্দটা আরও জোরে শোনা যাচ্ছে এখন। ‘নীলাবাসে’র উপড়ে-যাওয়া অংশের ও তার
পাশের জমির বিশাল গর্ত থরথর করে কাঁপছে। ডিনামাইট চার্জ করলে বিস্ফোরণে যেমন হয়
তেমনই। বিছানায় শুয়ে যে মানুষদের তিনি দেখছিলেন শ-য়ে শ-য়ে, হাজারে হাজারে, সকলে
জমা হয়েছে সেই গর্তের ধারে ধারে। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে, কীসের যেন অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ
পর থরথরানি থামল। এবং জমি ফাটিয়ে, ফুঁড়ে বের হল ধুলোয় ধূসর অদ্ভুতদর্শন বিরাট গামলার
মতো বস্তু। গামলাও ঠিক নয়, হাঁড়িও নয়, জামবাটিও নয় – তবে প্রত্যেকটার সঙ্গে
ইতর-বিশেষ মিল। অধীরবাবুর কেমন চেনা লাগল। এত বড়ো নয়, দিদিমার কাছে ছোটো একটা ছিল,
দেখেছিলেন। দিদিমা সেটার মধ্যে চিঠিপত্র, ওষুধের পুরিয়া, টুকরো কাগজ রাখতেন। জিনিসটা
কাঁসা-পেতল, রুপো-তামা এমনকী মাটিরও নয়। শুকিয়ে-যাওয়া বৃহদাকার চালকুমড়োর খোলা।
ভেতরের বস্তু পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিলে কাঠের মতো শক্ত। ঘিরে-দাঁড়ানো মানুষরা
হুমড়ি খেয়ে পড়ছে জিনিসটার ওপর। ছুটে ছুটে খুঁজে কী যেন তুলে নিচ্ছে। তাদের গলার
স্বর এখন অনেক উঁচু। অধীরবাবু মনোনিবেশ করে শোনার চেষ্টা করেন। একটা শব্দ স্পষ্ট
শোনা যাচ্ছে, “পাইছ? পাইছস? পাইছেন না কি?” চালকুমড়োর খোলা আপনমনে গড়ায়, প্রবল ঝনঝন
শব্দ হয়। অধীরবাবু চোখ পাতেন। অসংখ্য কালো-কালো লোহার চাবি ওটার ভেতরে। সব
মরচে-পড়া, ছোটো বড়ো নানারকম, এমনকী গজালের মতো লম্বাও।
ভোরের আলো কখন ফুটেছে
অধীরবাবু জানতে পারেননি। অঞ্জিষ্ণু হাঁটু গেড়ে পাশে বসে ভয়ার্ত গলায় ডাকে,
“দাদু! দাদু! কখন ছাদে এসেছ?
তোমার কী অসুখ হচ্ছে? বাবাকে ফোন করব?”
অধীরবাবু চোখ মেলে নাতির
মুখখানা দেখেন। সদ্য গোঁফের রেখা জাগছে। নিজের কৈশোর খোঁজেন। নাতির জন্মের পর
সুলতা বলতেন তাঁর সঙ্গে নাকি খুব মিল। নাতির কাঁধ ধরে সাবধানে উঠে বসেন। বলেন,
“আমি সুস্থ আছি দাদু। চল
নীচে যাই।”
(ক্রমশঃ)
পরের পর্ব না পড়লে, এই পর্বের কিছুই ফলো করতে পারলাম না।দেশভাগের ব্যাথা আর পুরনো বাসাবাড়ি নিয়ে আমাদের সকলেরই একটা বিশেষ নস্টালজিয়া মরে যাবার আগে পর্যন্ত থাকবে। শুধু শেষ প্যারায় এসে সব গন্ডগোল হয়ে গেল। অপেক্ষায় থাকলাম।
উত্তরমুছুনপড়েছেন জেনে খুব খুশি হয়েছি। অসংখ্য ধন্যবাদ জানবেন। আমি নিজেও এখন নিজের কাছে পরিষ্কার নই লেখা নিয়ে। তাই অপেক্ষায় থাকা যাক।
উত্তরমুছুন