কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

সুকান্ত পাল

  


সমকালীন ছোটগল্প

বীজ


(এক)

বাড়ির আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে পাড়ার প্রতিবেশী সবাই খুব অবাক হয়ে গেছে রাজতাভর স্ত্রী অন্বেষার আচরণে। রজতাভও কম অবাক হয়নি। সদ্য সন্তানহারা মা কিভাবে এমন স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে! দিগন্তই ছিল তাদের প্রথম সন্তান। শুধু তাদের নয়, তাদের পরিবারের এই প্রজন্মের প্রথম সন্তান। তাকে হারিয়ে শোকে তো একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। যেমনটা হয় আর দশজনের ক্ষেত্রে। কিন্তু অন্বেষার আচরণে তেমন কিছুই চোখে পড়ে না। প্রথম প্রথম কয়েকদিন খুবই মনমরা হয়ে ছিল সে ঠিকই কিন্তু তারপরই একেবারে স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। অথচ এমন একটা বিপর্যয় যে ঘটে গেছে তার কোনো চিহ্ন অন্বেষার মধ্যে দেখা যায় না।

তার অলক্ষ্যে সবাই বিভিন্ন মতামত প্রকাশে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলল, মহিলা একটা ডাইনি ছাড়া আর কিছুই নয়। কেউ কেউ বলল, তা নয়, আসলে খুঁজে দ্যাখো গে নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আবার কেউ বলেই ফেলল, হয়তো এখনই বাচ্চা নিতে চায়নি। তাই ওর কোনো শোকতাপ বলে কিছু নেই। কিছু সহমর্মী মহিলারা বলল, না, না ওসব বাজে কথা। আসলে প্রথম সন্তান হারিয়ে রজতাভর বৌ টা হয়তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, তাই ওর এই রকম আচরণ। আরে বাবা সন্তান হারিয়ে পৃথিবীর কোন মা এরকম স্বাভাবিক আচরণ করেরাজতাভর উচিত ওকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো। পৃথিবীর কত গল্প উপন্যাসেই তো দেখা গেছে যে কত মা সন্তান হারিয়ে নির্বাক হয়ে গেছে। এমনকি বিন্দুমাত্র কান্নাকাটিও করে নি। পরে যখন তার গভীর কালো পাথরের মতো স্তব্ধ শোকের রাজত্ব থেকে বেরিয়ে এসেছে তখন আর তাকে সামাল দেয়া যায়নি।

রজতাভ ভীষণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে অন্বেষার অতি স্বাভাবিক আচরণের জন্য। এমনকি তাদের দাম্পত্য জীবনে অন্বেষার ব্যবহার তাকে বিস্মিত করে তোলে প্রতি রাতে। যেন এই সবে তাদের বিয়ে হয়েছে। শরীর নিয়ে উথালপাথাল হয়ে ওঠে অন্বেষা। রজতাভ হাবুডুবু খেতে খেতে পাগল হয়ে যায়। সে ভাবে, সত্যি কি অন্বেষা পাগল হয়ে গেছে! ঐ দুর্ঘটনার পর থেকেই রজতাভ লক্ষ্য করেছে অন্বেষা তাকে যেন আরো বেশি বেশি করে যত্ন করছে। তার যত্নের মাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। খুবই অস্বস্তি হয় তার কিন্তু কিছু বলতে পারে না যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায় কিছু! এও এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। এর থেকে যদি অন্বেষা শোকে মূহ্যমান হয়ে যেত, যেটা স্বাভাবিক, তবে সে নিজেই তো অন্বেষাকে তার শোকের সাগর থেকে উদ্ধার করার যাবতীয় প্রচেষ্টা চালাত! তার পরিবার পরিজনেরা, কাছের মানুষরা সবাই তাকে সান্ত্বনা দিয়ে এক স্বাভাবিক জীবন যাপনে নিয়ে আসার চেষ্টা করত। কিন্তু অন্বেষাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে এক অকল্পনীয় স্বাভাবিক আচরণ করাতে আজ প্রত্যেকের  কাছেই মনে হচ্ছে এটাই অস্বাভাবিক।

(দুই)

সেদিন ঘটনার আকস্মিকতায় রজতাভের বাড়িতে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। খবরটা রজতাভর ছোটভাই সুমিতাভর মোবাইলে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ এসেছে।  কালিম্পং এর ডি,এস,পি নিজে ফোন করে খবরটা দিয়েছেন। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ঘটনাটা ঘটেছে।

দিন সাতেকের জন্য সুমিতাভর দাদা রজতাভ বৌদি এবং তাদের একবছরের বাচ্চা অর্থাৎ সুমিতাভর ভাইপো দিগন্তকে নিয়ে কালিম্পং এর এক অফ্ বীট জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিল। ফেরার পথে ওদের গাড়ি ব্রেক ফেল করে মাত্র দশ ফুট নিচে পড়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতেই যা বিপত্তি ঘটার ঘটে গিয়েছে।

দাদা এবং বৌদি কালিম্পং এর সদর হাসপাতালে জখম হয়ে চিকিৎসাধীন। কিন্ত দিগন্তের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। না পাবারই কথা। গাড়িটা নাকি যখন গড়িয়ে নিচের দিকে পড়ছিল তখন একটা বড়ো পাথরে ধাক্কা খেয়ে গাড়ির একদিকের দরজা খুলে যায়। যেদিকে বৌদি দিগন্তকে কোলে নিয়ে বসেছিল সেদিকেরই দরজাটা খুলে গেলে কোনোরকমে বৌদি সামনের দুই সীটের মাঝে একটা হাত ঢুকিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে পতন রোধ করতে পারে। আর তখনই তার কোল থেকে ছিটকে বাইরে পড়ে যায় দিগন্ত। যেন একটা ফলবতী গাছ থেকে তার একটা ফল প্রবল হাওয়ার তোড়ে টুপ করে ঝরে পড়ল নিচের মাটিতে। অন্বেষা তার দুই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে পাহাড়ের সেই ঢালের দিকে যেখানে চিরকালের মতো হারিয়ে গেল দিগন্ত। তারপর থেকেই সে চুপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসার পর যখন তারা দুজনে ছাড়া পেল তখন থেকেই অন্বেষা কিছুটা স্বাভাবিক। বাড়ি ফেরার পর কয়েকদিন একটু মনমরা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু কয়েকদিন পর থেকেই সে অদ্ভুত ভাবে স্বাভাবিক হয়ে গেল। তার এই স্বাভাবিকতা কিন্তু কেউ মেনে নিতে পারেনি। রজতাভও পারেনি।

(তিন)

সব বুঝেছিল অন্বেষা। তার প্রতি বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মনোভাব সে বুঝতে পারলেও সে কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। এমনকি পাড়ার প্রতিবেশীদের কথাবার্তা সে সবই শুনেছে এবং বুঝতেও পেরেছে। কিন্তু সে নিরুপায়। তার পাঁজরের নিচের অন্ধকারের পরতে পরতে তো কত কিছুই নীরবে রয়ে গেছে! সেখানে আরো একটা নতুন নিথর বেদনার পরতকে জায়গা করে দিতেই হয় যে! এখানে ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো পছন্দ ধোঁপে টেকে না। এর থেকে মুক্তি নেই তার।

সে শুধু মনে মনে ভাবে এবং কঠিন প্রতিজ্ঞায় নিজেকে আবদ্ধ করে, গাছ থেকে যে ফলটা ঝরে গেছে তাকে আর কোনদিনই পাওয়া যাবে না। এর থেকে চরমতম সত্যি যে আর কিছুই হয় না!

তাই তাকে বীজের উৎসকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে লালন পালন করতেই হবে। তাকে বীজ রক্ষা করতে হবে যাতে ফসলের মরশুম থাকতে থাকতেই গাছ আরো বেশি করে ফলবতী হয়ে উঠতে পারে।

 



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন