কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


(পর্ব ২৩)

পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন বছর মাস চলে যায়। শৈশব জীবনটা তবু প্রতিটি মানুষের মনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে। অথচ তার থাকে না তখন সো কল্ড ব্যক্তিস্বাধীনতা তার থাকে না কোনোই ক্ষমতা, সে ক্ষুদ্র অসহায় প্রাণ। তবু,তবু ওই সময়টুকুই অধিকাংশ মানুষের কাছে স্বর্ণযুগ। আমারও তাই। আমার স্বপ্নে আমার গল্পে  আমার কাহিনীতে আমার মানসিক গঠনের ভেতর গাঢ় হয়ে বসে আছে আমাদের ছোট্টোবেলার সেই গ্রাম। যেখানে সবুজের রাজত্ব মানুষগুলো সহজ সরল আর কোলাহল কেবল হরেক রকম পাখির ডাকে। সত্যিই তো আমরা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জেগেছি। তাই এই ঝঞ্ঝাপূর্ণ আজকের তথ্য প্রযুক্তির চরম বিকাশের দিনে সব আছে শুধু শান্তি নেই। শান্তি ওই প্রকৃতিই একমাত্র দিতে পারে। মাঘ ফাল্গুনে সেখানকার আদি বসবাসকারীদের অনেকের ঘরে ঘরে হতো সংকীর্তন। ভোরবেলা করতাল খোল বাজিয়ে হরিনাম করে পরিক্রমা হতো। নবদ্বীপ শহরে বহু বছর পর্যন্ত এই পরিক্রমা চালু ছিল ইদানিং আছে কিনা আর খবর রাখার কেউ নেই। কলকাতা শহর থেকে এসে একটু একটু করে আমরা যারা বাড়ি পেতেছিলাম তাদের আপন করে নিতে গোড়ায় আপত্তি ছিল মূল অধিবাসীদের। তারা প্রায় সকলেই তপশিলি প্রজাতির। কলকাতার বাবু বিবিদের চলন বলন তাদের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু শিশুদের কাছে হার মানতেই হয়। আমি অনায়াসেই প্রবেশাধিকার পেতাম তাদের টালির এবং মাটির দাওয়ার ঘরে। ঘরে ভাজা চালভাজা, ভর দুপুরে পেয়ারা আতা গাছে চড়া, কাঁচা তেতুল পাড়া এসবই তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে যারা আমার বন্ধু। পাড়ার যুবকরা সন্নাস নিত। গাজনের সং সেজে পাড়ার লোকেরা যারা পারত শিবের গাজন গাইত।আমাদের গ্রামের চরণখুড়ো গলায় নানা প্রকার মালা পড়ে একরাশ তাড়ি খেয়ে টলোমলো পায়ে নেচে গেয়ে বুড়ো বটতলা প্রদক্ষিণ করতো যার অসংখ্য ঝুড়ি নেমেছে বাধানো গোড়ায় কালো একটি ডিমের মতো কালো পাথর যাকে শিবজ্ঞানে পুজো করা হতো। আমাদের দেখাশোনা করত গ্রামেরই সরস্বতী দিদি পোলিওতে হাত পা ব্যাঁকা অসীম প্রাণশক্তি মায়ের কাছে গ্রামের মহিলারা যারা এমনিই আসতো চা খেতে সাদা কালো দুরদর্শন দেখতে সরস্বতীদি তার মধ্যে একজন। আমাকে লাল ফিতে দিয়ে বেড়া বিনুনি করে দিত একজন। ফ্রক পরে সরস্বতীদির হাত ধরে যেতাম যেখানে চরকের ঝাঁপ হতো। মাঠে তিল ধারনের জায়গা নেই।গ্রাম ভেঙে পড়ত।দুটি লম্বা বাঁশ খাটানো থাকত আড়াআড়ি দুটি ওপরে। ওখান থেকে হতো বঁটি ঝাঁপ  কাঁটা ঝাঁপ ইত্যাদি।কাঁটা মানে একটা বস্তা ভরতি পেরেক তার ওপর উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ত। এও এক টেকনিক কারন কেউ ই সাধারনত ইন্ঞ্জিওর্ড হতো না। অনেক বউরা মানসিকের দণ্ডি কাটত। গরম জিলিপি, নিমকি, কাঁচের চুড়ি আর ফটাস জল বিক্রি হতো ধার বরাবর সেই বৃত্তাকার মাঠে। আমরা প্রতিবার ঝাঁপ দেখতে গিয়ে শিহরিত হতাম।

আমাদের গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তি হতো খুব জমজমাট। গ্রামের ছেলেরা সন্ন্যাস নিতো।প্রসঙ্গত মনে আছে সে সময় আমাদের গাঁয়ে প্রচুর গরু ছিল।বাড়ি ফিরতাম যখন স্কুল থেকে গরুর পাল খালের ওপারের বিস্তীর্ণ মাঠ থেকে ফিরত পেছনে রাখাল। শিশু আমি,আজ রূপকথা মনে হয় সত্যিই রাখাল ও গরুর পাল দেখেছি,আজ এ আই জগতে বসে, হাতের মুঠোয় নতুন এক পৃথিবী সেও আমারই দেশ।যা বলছিলাম, সেই সময় দেখেছি কারো গরু মারা গেলে বাড়ির লোকটির অশৌচ হতো মুখে একটা এক বিগত সমান বাঁশ কাঠি ও সাদা কাপড় গায়ে ঘুরত, সব বাড়ি থেকে কিছু না কিছু টাকা দেওয়া হতো।

সন্ন্যাস নেওয়া ছেলেরাও ওরকম সারা মাস খালি পায়ে গাছ কোমর করে খেঁটে ধুতি জড়িয়ে ঘুরত উপবাসে। এই সময় ঈদ হতো পাশের গ্রামের ছেলেরাও এভাবেই উপোসে থাকত রমজানের।

নীল ষষ্ঠিতে মা ও উপোস করতেন সন্ধ্যাবেলা ছেলে মেয়ের নামে। শিবের পুজো মানে ধুতরো ফুল, ধুতরোর ফল নীল অপরাজিতা আর বেলপাতা, যার গায়ে সাদা রেখা থাকবে না যার তিনটে পাতা থাকবে নিঁখুত।

গাজনের সং সাজা আর গাজনের দলের গান যা শিবেরই লৌকিক আরাধনা এসবই হতো চৈত্র সংক্রান্তির সময়। গ্রামতুতো সরস্বতী দিদির সঙ্গে মা পাঠাতেন চরকের ঝাঁপ দেখতে পরেও প্রতি বছর যাই এখনও বুড়ি সরস্বতী দিদিকে সঙ্গে নিয়ে যদিও নাগরিক আগ্রাসনে খুবই অনারম্বর এখন চরকপুজো। চৈত্রসংক্রান্তির বিকেলে সবচেয়ে বুড়ো সকলের চরণখুড়ো গলায় অনেক মালা পরে একরাশ তাড়ি খেয়ে শিবের গান গাইতে গাইতে পাক দিত মোষপুকুরের ধারের বুড়ো বটগাছটা ঢাক বাজত কাঁসর বাজত পেছন পেছন আদুল গায়ের বালকের দল তারপর তারা যাত্রা করত চরকঝাঁপের মাঠে। সেদিন খুড়োই নায়ক। সে প্রধান। মাঠের মাঝে দুটি লম্বা বাঁশ পোঁতা আড়াআড়ি দুটো ওখান থেকে ঝাঁপ হতো বঁটি ঝাঁপ কাঁটা ঝাঁপ ইত্যাদি। একটা বস্তা ভর্তি পেরেক সব চটের বস্তা থেকে বেরিয়ে যেন ভীষ্মের শরশয্যা, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত একে একে শিবের নাম নিয়ে। আশপাশের থে গ্রামঢেলে লোক আসত ধর্ম নির্বিশেষে। অনেক বউ দণ্ডি কাটতো। এসবের মানে সেদিন বুঝিনি আজও বুঝি না তবে উৎসব ছিল রোমাঞ্চকর এবং উল্লাসের। গরম জিলিপি, নিমকি, ফুচকা, তেলে ভাজা বসত মাঠের ধারে। এর পরেই হতো পীরবাবার মেলা সে মেলাও খুব বড়ো করে হতো। এবং শীতলা মেলা। আজও এই মেলাগুলি সব চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ত শৈশবের গন্ধ লেগে আছে বলে।

আমরা হয়ত সেই আশ্চর্য প্রজন্ম যারা নকশাল আন্দোলনের বোমা খুন তোলপাড়ে জন্মেছি বামপন্থী শাসনকালেই বড় হয়েছি তারপর লেসার ইভিল, বামপন্থী ভাবধারা,আদর্শে আমরা দেখেছি কৃষিভিত্তিক পেছিয়ে থাকা দেশ থেকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবেশ, কালো ল্যাণ্ড ফোন যা সামান্যকিছু বাড়িতে থাকত সেখান থেকে এণ্ড্রয়েড,স্মার্ট ফোন এ আই যা মৃত মানুষকে পর্দায় ফের জ্যান্ত করে দেয় লেসার ইভিল বাছতে গিয়ে গাঁ উজাড়।

একান্নবর্তী থেকে নিউক্লিয়ার পরিবার আর তারপর মা বাপের তীব্র কামনায় একটি দুটি ছেলে মেয়ে প্রবাসে রামের বনবাসের মতোই, বৃদ্ধ একাকী পিতা কিম্বা মাতার বৃদ্ধাবাস অথবা একা একা পচা গলা লাশ হয়ে পড়ে থাকা।

ছোটোবেলায় রচনা লিখতে দিত "বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ" এবং "your aim in l8fe" দুটো রচনাই কালজয়ী ও তাৎপর্যপূর্ণ আজ।

যাইহোক, পয়লা বৈশাখ গরিব গ্রামে নয় কাটত শহরে নয় মাতামহীর বাড়ি অথবা ইন্টালির আদি পিতৃগৃহে। নতুন জামা পড়ে বড়োদের পা ছৌঁয়া, ফুলকো লুচি, কাঁসা পেতলের বগি থালায় আর ফুলকাটা পেতলের বাটিতে পঞ্চব্যঞ্জন। ঘটি বাড়িতে মাছে বিশেষ বৈচিত্র নেই, কাতলা ভেটকি গলদা চিংড়ি, মুর্গির মাংস কখনও বাড়িতে ঢুকত না পাঁঠার মাংস। আসল উত্তেজনা ছিল সন্ধ্যায় যখন অনেক দাদু দিদার মধ্যে বিশেষত মেজ দাদুর হাত ধরে হালখাতা করতে যাওয়া হতো। একেকটি দোকানে একেক রকম আকারের মিষ্টির বাক্স দিত তাতে নোনতাও থাকত, দোকানে ঢুকলেই কোল্ড ড্রিংক্স,আইসক্রীম বা সুগন্ধী সরবত আসত মালিক হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে সকলকে আপ্যায়ন করতেন। সকলেই বাংলা ক্যালেণ্ডার দিত।আমাদের ছোটোবেলায় প্রায় সবার ঘরের দেওয়ালে একটা বড় ইংরেজি ও একটি বাংলা ক্যালেণ্ডার ঝুলত, মহাপুরুষদের ছবি টাঙানো থাকত। এভাবেই একদিন সম্পর্কিত মামা ফিরলেন পয়লা বৈশাখ কাটাতে তিনি শিলিগুড়ির একটি ব্যাঙ্কে সেই সময় পোস্টেড। সে রাতে আমরা ঘরে ফেরার ট্রেন ধরলাম। তিনিও শিলিগুড়ি ফেরার ট্রেনে। সকালে জি আর পি খবর পাঠালো আপার বাঙ্কে শুয়ে গভীর নিদ্রার মধ্যেই সুস্থ সবল মানুষটি অন্য কোনো লোকে যাত্রা করেছেন মৃত্যুর রেলগাড়িতে চেপে। দুটি ছোটো ছেলে,একটি দুই একটি চার।

বড় হতে হতে মনে মনে সত্যিই আজ আমাদের একলা বৈশাখ এসেছে যদিও শহর সাজিয়ে রাখি শপিং মল, রাত পার্টি আর নাইটক্লাবের হুল্লোরে। জীবন এখন ফেসবুকের বিজ্ঞাপনের জন্য মডেল।

তবুও আমরা আজও অসহায় শিশু প্রকৃতির কাছে। তবুও বিজ্ঞান আজও সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। তাই জীবন আজও ম্যাজিক দেখাতে পারে। তাই মৃত্যূর পর .... একটি প্রশ্নচিহ্ন মনে খচখচ করেই।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন