সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নারীর আদ্যন্ত ভাগ্য
(গত সংখ্যার পর)
(২)
ঋষি গালব আনন্দের আতিশয্যে মাধবীর হাতদুটি জড়িয়ে ধরেন, “তুমি আমায় বাঁচালে যযাতির দুহিতা। কী বলে যে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানাব!”
“থাক। শুধু কথা দিন, আপনার অভীষ্ট
সিদ্ধ হয়ে গেলে আমাকে…”
“সে আর বলতে। আমি কি বুঝি না এমনভাবে
জীবন কাটাতে মেয়েদের কত কষ্ট হয়!”
গালব চলে গেলেন। মাধবীর ঠাঁই হল
রাজা হর্ষশ্বেরের অন্তঃপুরে। এখন হর্ষশ্বেরকে তৃপ্ত করাই তার একমাত্র সাধনা। শুরু হল
বহমান নদীর জীবন। তাতে যা-ই নিক্ষেপিত হোক তার চলা থামে না।
একটি একটি করে দিন যায়। কী ভাবে
যে যায় সে শুধু সে-ই জানে। একে একে তিন রাজার শয্যাসঙ্গিনী হলেন মাধবী পিতৃদায় শোধ
করতে। কারণ তার সর্বজ্ঞ পিতা সব জেনেই তাকে এ জীবনের জন্য তুলে দিয়েছেন গালবের হাত
দিয়ে প্রথমে হর্ষশ্বের, পরে কাশীরাজ দিবোদাস, তারপর ভোজরাজ ঊশীনর। এঁরা প্রত্যেকেই
মহৎ, কিন্তু পৃথক ধরনের মানুষ।
হর্ষশ্বের দানধ্যানের সুনাম আছে,
দিবোদাস বীর, ঊশীনর সত্যের পূজারী। শুধু একটা বিষয়েই তিনজনের ভীষণ মিল। মাত্র দুশোটি
ঘোড়ার বিনিময়ে একটি নারীকে ভোগ করতে কারও মনে এতটুকু দ্বিধা নেই। কে জানে, হয়তো
এর মধ্যেও ধর্মের কোনো গূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে। সে যাইহোক, এঁদের কার্যসিদ্ধি হয়েছে।
প্রকৃতির নিয়মে এঁদের প্রত্যেকের গৃহেই গর্ভবতী হয়েছে মাধবী, তিনজনকেই উপহার দিয়েছে
একটি করে পুত্র। হর্ষশ্বেরের ঘরে বসুমনা, দিবোদাসের প্রাসাদে প্রতর্দন, ঊশীনরের রাজপুরীতে
শিবি। প্রতিটি জন্মের সংবাদই যথাসময়ে পৌঁছেছে মাধবীর পিতার কানে। আশ্চর্য, তিনিও দৌহিত্র
লাভ করে নাকি মোহিত! তিন সন্তানকেই দুধ-মা-র কাছে ছেড়ে রেখে গেছে মাধবী পরবর্তী দুশো
ঘোড়ার জন্য। প্রথমবার যখন অযোধ্যা থেকে গালব
নিতে এলেন, বসুমনার জন্য বুক ফেটে যাচ্ছিল মাধবীর। যতই ঘোড়ার বিনিময়ে হোক,
সে তো মা। তার প্রথম সন্তান। অতটুকু দুধের শিশু ফেলে.....! হর্ষশ্বেরকে বলল, “পুত্র
এখন আমার কাছে থাক। একটু বড় হলে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।”
তিনি সম্মত হলেন না। তাঁর পুত্র
অন্যের ঘরে প্রতিপালিত হবে? অসম্ভব। পশুপাখির জগতে শিশু মায়ের, মানুষের জগতে নয়।
মাধবীর বুকের দুধ যন্ত্রণার পুঁজ
হয়ে জমে জমে শুকিয়ে মরে গেল।
ঊশীনরের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে মাধবী
গালবকে বলল, “এখনও তো আপনার দুশো ঘোড়া সংগ্রহ বাকি। এবার কোথায়?” গালবকে সেদিন একটু
যেন বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। হতাশ স্বরে বললেন, “আমার চেষ্টা বোধহয় সফল হবে না। সমস্ত শ্রম
আমার ব্যর্থ হয়ে গেল। মহা সমস্যায় পড়ে গেছি। কালই গরুড় আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি
এক নতুন সংবাদ দিয়ে গেলেন। …এই যে সব দুর্লভ অশ্ব, এ সবই নাকি আগে মহর্ষি ঋচিকের ছিল।
তিনি এদের পেয়েছিলেন বরুণালয়ে। তাঁর কন্যা সত্যবতীর বিয়ের সময়ে মহর্ষি ঋচিক কান্যকুব্জরাজ
গাধিকে এরকম এক হাজারটি ঘোড়া যৌতুক দিয়েছিলেন। মহারাজ গাধি ঘোড়াগুলোকে নিজের কাছে
রাখেননি, সবই তিনি ব্রাহ্মণদের দান করে দেন। সেই ব্রাহ্মণরা যখন ঘোড়া নিয়ে ফিরছিলেন
তখন হর্ষশ্বের, দিবোদাস আর উশীনর তাঁদের কাছ থেকে দুশোটি করে ঘোড়া কিনে নিয়েছিলেন।
বাকি চারশো পথে চুরি হয়ে যায়। অর্থাৎ এরকম ঘোড়া আর আমার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। গরুড়
অবশ্য বলছিলেন, ‘তুমি এই ছ-শো ঘোড়াই গুরুদেব বিশ্বামিত্রকে দক্ষিণা দিয়ে দাও। তোমার
অসুবিধের কথা খুলে বললে তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন’।”
পলকের জন্য অন্তরে যেন মুক্তির
স্বাদ পেল মাধবী। উজ্জ্বল মুখে বলল, “বিষ্ণুসখা গরুড় যা বলছেন তাই করুন তবে।”
ভবী ভোলবার নয়। গালব বললেন, “তা কি হয় যযাতির কন্যা? গুরুদক্ষিণা পুরো না দিলে
আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় কী করে?” বলতে বলতে গালব অপাঙ্গে মাধবীর দিকে তাকালেন, “একটা
বুদ্ধি অবশ্য মাথায় এসেছে, জানি না তাতে লাভ হবে কিনা—
যদি অবশিষ্ট ঘোড়ার বদলে গুরুদেব তোমায় রাখেন… না না, এ বোধহয় হয় না। গুরুদেব হয়তো এতে আহত
হতে পারেন। তিনি তো ঘোড়াই চেয়েছেন, স্ত্রীলোকে কি তিনি সন্তুষ্ট হবেন?”
এখন আর আশ্চর্য হয় না মাধবী। তিন-তিনজন
রাজর্ষির শয্যা তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। মনে মনে সে বলে, 'খুব হবেন। ঋষি হলেও তিনি
পুরুষ তো বটে।’ গালব মাধবীর হাত ধরলেন, “আর-একবার আমার জন্য কষ্ট
করবে যযাতির কন্যা? এই শেষবার।”
চোখে জল এসে গেল রাজকন্যার। তবুও
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “চলুন।”
নির্দয় পুরুষ অপরের করুণা চায়!
সে করুণার প্রকৃতিই বা কীরকম? না, ঘোড়ার বদলে সুন্দরী ভোগ করে অপরজনটি তৃপ্ত হবেন
কী হবেন না !
মাধবীর ধারণাই মিলে গেল। এক ঝলক
তাকে দেখামাত্রই ঋষি বিশ্বামিত্রের কামজ্বর এসে গেল। গদগদ গলায় বললেন, “তুই কী আহাম্মক
গালব! এমন এক সর্বসুলক্ষণা নারী তোর হাতে আছে,
অথচ তাকে আগে আমার কাছে আনিসনি! থাকি তো বনেবাদাড়ে, ঘোড়া আমার কী কম্মে লাগবে? নেহাত
গুরুদক্ষিণা দেব, গুরুদক্ষিণা দেব বলে বায়না জুড়েছিলি, তাই তোকে পরীক্ষা করার জন্যে…।
এহেহেহে, এই ক-টা বছর মেয়েটাকে…”
ব্যস্। এবার আর রাজপ্রাসাদ নয়,
মুনির তপোবন। এবারও সেই একই পরিণতি। তিন রাজার মতো মাধবীকে ছিঁড়েখুঁড়ে একশা করলেন
ঋষিবর। ফলত আর-একটি ছেলে। অষ্টক। ছেলে জন্মাতেই ঋষির কামজ্বর উধাও। বুঝি বা পরমব্রহ্মের
কথা মনে পড়ে গেল। তুচ্ছ মানবীতে কতদিন আর আটকে থাকতে পারেন সাধুসন্ন্যাসীরা!
আবার গালবের কাছে প্রত্যাবর্তন।
এতদিনে সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গালবকে দেখে হৃদয়ে এখন আর এতটুকু চাঞ্চল্য জাগে না
মাধবীর। প্রণয়ের ক্ষুধা গেছে মরে, প্রথম প্রেম
এখন দূরের স্মৃতি। তবু মনে একটা ক্ষীণ স্বস্তি, যাক আর ভেসে বেড়াতে হবে না। রাজকন্যা
হই আর যাই হই, নারীদের যে কোনো আলাদা সত্তা থাকতে নেই এ হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে মাধবী। নারীদের আবার ইচ্ছে-অনিচ্ছে
কী? এখন বাকি জীবনটা গালবের সঙ্গে চোখ-কান বুজে কাটিয়ে দিতে পারলে সে নিজেকে ধন্য
মনে করবে। গালবের পিছু পিছু হাঁটছে আবার। নদী গিরি প্রান্তর অরণ্য লোকালয় পার হয়ে
হাঁটছে তো হাঁটছেই।
এক দুপুরে এক স্রোতস্বিনী পার হল
তারা। তিলেক বিশ্রামের জন্য বসেছে এক শিংশপা গাছের নীচে। জায়গাটা ভারি চেনাচেনা লাগে
মাধবীর। এখানেই প্রথম দিন তারা পাশাপাশি বসেছিল। গালবও বুঝি চিনেছেন জায়গাটাকে। ঘুরে
ঘুরে দেখছেন চারদিক । নদীকেও। চৈত্রমাসের ঊষ্ণ বাতাসে ঘূর্ণি উঠছে ছোট ছোট। কোত্থেকে একটা কোকিল ডেকে
উঠল। নির্বাক মানুষটা হঠাৎ সবাক হলেন, “কী ভাবো যযাতির কন্যা?” গাম্ভীর্য স্বরে মৃদু
হাসি উঁকি দিল, “ক-টা বছর তোমার ওপর দিয়ে...।”
এসব কথা মাধবীর মনে আর কোন দুঃখ
জাগায় না। সে জানে তার একান্ত আপন মানুষটির কাছে সে কেবল একটি বিনিময়ের পণ্য। তাই উত্তর দেয় না।
পুনরায় নীরবতা ভেঙ্গে বলে ওঠে
গালব, “তোমার এই আত্মত্যাগ বিফল যাবে না, দেখো। তোমার চার সন্তানেরই নাম ত্রিভুবনে
ছড়িয়ে পড়বে। বসুমনা হবে দাতা, প্রতর্দন হবে বীর, শিবি ধার্মিক হবে, আর আমার গুরুর
সন্তান অষ্টক হবে যজ্ঞকারী। কী, খুশি তো?” পলকের জন্য চারটে কচিকচি মুখ বুকে ভেসে ওঠে
মাধবীর মানসপটে। কী দুঃসহ যন্ত্রণা দশমাস গর্ভ ধারণের পর সব মায়া ছিন্ন করে দুধের
শিশুকে মাতৃ স্তন থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবার
অন্য পুরুষের অঙ্কশায়িনী হওয়া। আছে ছেলেগুলো? কী করছে? মাকে কি খোঁজে তারা? মা-র
জন্য কাঁদে? নাকি ভুলেই গেছে এই অভাগিনী মাকে? বুকফাটা কষ্টের মধ্যেও তার হাসি পেল
সহসা। গালব আশীর্বাদ করছেন তার ছেলেদের, তাকে নয়! নারীদের এতটুকু গৌরব দিতেও এত কার্পণ্য?
হায় রে পুরুষ !
অথচ এই মানুষটির ভালোবাসা, সঙ্গসুখ
লাভের জন্য সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা মেনে নিতে পেরেছে মাধবী। তিন-তিনজন শূরবীরের ও এক
কামোন্মত্ত ঋষি পুরুষের হাতে নিজের শরীরকে অবলীলায় সঁপে দিয়েছে, প্রতি বার তার সদ্যোজাত
সন্তান ত্যাগ করে।
সে নীরস স্বরে বলল, “আমার খুশিতে
আপনার কী দরকার? আপনার কার্যসিদ্ধি হয়েছে, সেটাই যথেষ্ট।”
কোকিলের ডাক আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে।
গালব কাছে সরে এলেন, একদম পাশটিতে। কাঁধে হাত রেখেছেন, পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন রিক্ত
মাধবীকে। এক সময়ে ওই স্পর্শের জন্য উন্মুখ ছিল হৃদয়, কিন্তু সেই মুহূর্তে কোনো রোমাঞ্চ
অনুভব করলাম না সে। অথচ এই দৃষ্টি তার কত চেনা। ওই স্পর্শের ভাষাও। শুকনো গলায় বলে
ওঠে হতভাগ্য রাজকন্যা, “সংযত হোন ঋষি।”
“কেন?”
“এখানে নয়। এভাবে নয়।”
“কেন, এই স্থান কী দোষ করল?” গালব সবলে আলিঙ্গনে
বেঁধে ফেললেন মাধবীকে।
আজ তার গুরুদক্ষিণার দায় নেই।
এবার সে তার প্রাপ্ত নারীর ভাগ বুঝে নিতে চায়।
কানেকানে ফিসফিস করে বললেন, “এ
তো অতি মনোরম স্থান। নদী গাছ প্রকৃতি… তুমি আর আমি… মনে নেই এখানেই একদিন তুমি আমার সেবা করতে চেয়েছিলে?
আজ তোমার জীবনে সেই সৌভাগ্য এসেছে। শুভলগ্ন বয়ে যেতে দিয়ো না।”
হঠাৎ কেমন গা গুলিয়ে উঠল মাধবীর।
এত বিবমিষা আগে কখনও জাগেনি। তিন রাজার শয্যাসঙ্গীনী হয়েও নয়, বিশ্বামিত্রের অঙ্কশায়িনী হয়েও নয়।
রূঢ়ভাবে বলল মাধবী, “এত তাড়াহুড়োর
কী আছে? আর তো কারও কাছে আমাকে পাঠানোর নেই! চলুন, আপনার আশ্রমে যাই, সেখানে নয় সারা
জীবন ধরে আমাকে যত খুশি….”
“সারা জীবন ধরে? আমার আশ্রমে? তোমাকে নিয়ে?” গালব
ছিটকে সরে গেলেন, “তুমি কি জানো না, তোমাকে আশ্রমে আর নিয়ে যাওয়া যায় না? আশ্রম
অতি পবিত্র স্থান, অন্যপূর্বা নারীকে নিয়ে সেখানে বাস করাটা অধর্ম। আমি কোনোভাবেই
তোমাকে আমার সহধর্মিনী করতে পারি না।”
বাঃ রে শাস্ত্রাচারী ঋষি। কী তব
শাস্ত্রের মহিমা। নিজের প্রয়োজনে এক কুমারী নারীকে বারবার বিভিন্ন রাজার শয্যায় পাঠানো
যায়, গুরুকেও নিবেদন করা যায়। সেই গুরুর সম্ভোগিতা নারী, যে মাতৃতুল্য তাকে সম্ভোগ
করা যায়! কিন্তু তাকে সসম্মানে স্ত্রীর পরিচয়ে নিজের বাসস্থানে নিয়ে যাওয়া যায়
না!
পলকের জন্য স্তম্ভিত মাধবী, পলকেই
স্থিত আবার।
বাঃ বাঃ, এই তো যোগ্য উত্তর। এরকমটাই
তো আশা করা উচিত ছিল। তবু আজ তার নারীত্বের স্বাভিমান জেগে উঠল। বলল, “আমি অন্যপূর্বা
নই। সন্তান প্রসব করা হয়ে গেছে, এখন আমি আবার কুমারী।”
“তুমি কুমারী!” গালব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, “ওসব
গালগল্প তুমি আমাকেও বিশ্বাস করতে বলো?”
রাগে হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেল। ঘৃণায়
ধিক্কারে চিৎকার করে উঠল মাধবী, “যদি জানেনই গালগল্প, একের পর এক পুরুষের কাছে আমায়
কুমারী সাজিয়ে পাঠালেন কী বলে? এতে অধর্ম হয়নি?”
“তুমি নেহাতই বোকা যযাতির কন্যা। এও বোঝ না, মহৎ
কারণে ছোটখাটো ছলনার আশ্রয় নিলে কোনো পাপ হয় না।”
গালব আবার তাকে আলিঙ্গন করলেন,
“বাজে তর্ক কোর না। এসো আমরা মিলিত হই। চিন্তা নেই, তোমার বাবার কাছে তোমাকে পৌঁছে
দিয়ে আসব।”
ঘৃণায় চোখ-মুখ বিকৃত করে বলে মাধবী,
“না। কক্ষনও না। আপনি স্পর্শ করবেন না আমাকে। সরে যান”।
না, এরপর গালব আর তাকে স্পর্শ করেননি।
বোধহয় তাঁর সম্মানে লেগেছিল। পিতার হাতে নামহীন যযাতির কন্যাকে তুলে চিরতরে বিদায়
নিলেন ঋষি গালব।
এখানেই মাধবীর কাহিনি শেষ হয়ে
যেতে পারত। বাদবাকি জীবন রাজা যযাতির অন্তঃপুরেই, সুখে না হোক, শান্তিতে কাটিয়ে দিতে
পারত। রাজকন্যাদের তো আর খাদ্যবস্ত্রের অভাব হয় না ।
কিন্তু বিধিলিপি কে খণ্ডাতে পারে।
মহাপুণ্যবান রাজা যযাতি দু-বেলা কন্যার কাছে এসে হা-হুতাশ করেন, ঘরে অবিবাহিতা কন্যা।
তাই দুশ্চিন্তায় তাঁর নাকি রাতে ঘুম হয় না! আরও দুঃখ, কন্যা পতিহীন থাকলে মৃত্যুর
পরে স্বর্গে তাঁর নাকি ঠাঁই হবে না! অতএব কন্যাকে পাত্রস্থ করতেই হবে। ওদিকে মনে আবার
সঙ্কোচও আছে, চার সন্তানের জননীর পুনরায়
বিবাহ দিতে চাইলে অন্য রাজারা হাসাহাসি না করে!
অনেক ভেবেচিন্তে পাঁচ ছেলের সঙ্গে
পরামর্শ করতে বসলেন রাজা। শেষ পর্যন্ত নিজেরা নিজেরা একটা উপায়ও বার করে ফেললেন। মাধবীকে
ডেকে হুকুম জারি করা হল, “প্রস্তুত হও। তোমার স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করা হয়েছে।”
আতঙ্কিত মাধবী আপত্তি জানাতে গেলে কেউ কর্ণপাত করল না। গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে, প্রয়াগতীর্থে
নাকি সভা ডাকা হয়ে গেছে, তাকে যেতেই হবে। তা রাজপ্রাসাদ থাকতে ওখানে কেন? না প্রয়াগতীর্থ
অতি পুণ্যস্থান, ওখানে স্বয়ম্বরা হলে মাধবীর সব দোষ কেটে যাবে। পিতা যেটা প্রকাশ
করলেন না সেটা হল— দোজবর হোক, তেজবর হোক, একটা বোকাসোকা ভালোমানুষ
রাজা কপালে জুটে গেলে এবারকার জীবনটা তো তার উদ্ধার হয়ে গেল।
ক্রমেই এগিয়ে এলো সেই দিন। এখন
বাকিটুকু স্বয়ং মাধবীর জবানিতেই শোনা যাক।
“আজ সেই শুভদিন। প্রয়াগতীর্থের এক আশ্রমে আনা হয়েছে
আমাকে। এখানেই বসেছে স্বয়ম্বর সভা। বাবা নিজে আসেননি, রাজকাজে ব্যস্ত। হতেও পারে,
নাও হতে পারে— সত্যি-মিথ্যে আমি জানি না। আয়োজনে অবশ্য কোনো
ত্রুটি নেই। আমার দুই দাদা যদু আর পুরু নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে আশ্রম সাজিয়েছে, রাজকীয়
মঞ্চ বানিয়েছে, ফুলের গন্ধে আমোদিত হয়ে আছে দশদিক। লোকলস্কর সেপাই-শান্ত্রী ছুটে
বেড়াচ্ছে অবিরাম, আগত রাজাদের আপ্যায়নে যেন কোনো ফাঁক না থাকে।
অবাক কাণ্ড! চার ছেলের মাকে বিয়ে
করতে রাজাও কিছু এসেছেন বটে! এমনকি নাগ-যক্ষ-গন্ধর্বরাও উপস্থিত। এত লোক আমাকে পেতে
আগ্রহী? কেন? রাজার কন্যা বলে? নাকি পুত্রদায়িনী সুলক্ষণা মেয়েমানুষ হিসেবে প্রমাণিত
হয়েছি তাই?
একটু আগে সখীরা আমায় বধূসাজে সাজিয়ে
দিল। ঋষিকন্যারা বরমালা গেঁথে ধরিয়ে দিয়েছে হাতে, এবার সভায় গিয়ে পছন্দসই কাউকে
পরাতে হবে সে মালা ।
কাকে পরাব এই মালা? কোন হর্ষশ্বের,
দিবোদাস, ঊশীনর অথবা বিশ্বামিত্রকে? অথবা কোন গালবকে ? এদের একজনকেও না-বাছার স্বাধীনতা
আজ আমার আছে, কিন্তু তারপর? বাবার কাছে থাকা, সেও তো এক পুরুষের আশ্রয়েই থাকা। বাবা
মারা গেলে ভাইদের আশ্রয়, তারাও তো পুরুষ। অপেক্ষা করব ছেলেরা কবে বড় হয়ে মাকে নিয়ে
যাবে? হায়, ততদিনে তারাও তো এক-একটা আস্ত পুরুষমানুষ হয়ে যাবে !
কোনো পথ নেই? কোনো পথ নেই?”
হাহাকার করে ওঠে মাধবীর নারীসত্তা।
ভালোবাসার জন্য উন্মুখ অতৃপ্ত নারী হৃদয়। মাতৃস্নেহ বুভুক্ষু নারী হৃদয় আর্তনাদ করতে থাকে। ভাবতে থাকে—
জঙ্গলে চলে যাব? বাঘ-ভাল্লুক-শিয়াল-কুকুরদের জগত কি মানুষের সমাজের চেয়ে হীন কিছু
হবে?
নিশ্চল নিশ্চুপ থাকে বরমাল্য হাতে
যযাতির কন্যা।
আর নয়। এবার একাই বাঁচবে সে, একাই
তার বাকি পথ চলা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন