ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি
… আমাদের বিনোদ - প্রতিবাদের অভিনেত্রী
প্রতি,
সদ্য
পেরলো বিশ্বনাট্য দিবস। সেদিনও প্রতিবাদের নাট্য প্রযোজনা চলল। আসলে, থিয়েটার শুধুই
তো অভিনয়ের জন্যে অভিনয় নয়। থিয়েটার হল প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিবাদীদের প্রথম বিষয় ছিল,
নারী শোষণ নিয়েই। কিন্তু এই প্রতিবাদের হুল্লোড় শুধু ওই একটা দিন নিয়েই তো নয়। আমাদের
মানে যারা নাটকের ছত্রছায়াতে নিজেদের খুশিতে তাদের প্রতিবাদ চলমান, এমনই কিছু প্রযোজনা
দেখা গেল নামী-অনামী নাট্যদলের, যারা নিরন্তর প্রতিবাদী। আদর্শপণ এই লড়াইয়ের সাক্ষী
থাকতে পেরে এক অন্য আনন্দ হয়েই চলেছে।
বিশ্বনাট্য
দিবসের ঠিক আগের দিন, সারাদিন ধরে নাটকের সেমিনার আর প্রযোজনার আয়োজন করে রবীন্দ্রভারতী
বিশ্ববিদ্যালয়-এর নাটক বিভাগ। বিভাগের উদ্যোগে ওইদিন বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন-এর নাটক
বিভাগের শিক্ষার্থী কুশীলব দারুণ অভিনয় করে। অতি উত্তম, চমৎকার সেই নাটকের মাহাত্ম্য।
নাটকের পুরো অনুষ্ঠান চলছিল নটী বিনোদিনী মঞ্চে। এই মঞ্চ থিয়েটার করিয়েদের প্রাণ। আর
তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। কেননা, নাটকের জন্যে যিনি প্রাণপাত করেছিলেন, যিনি ছিলেন
আমৃত্যু নাট্যপ্রাণা, তাঁর নামে মঞ্চ হবে, এতে আশ্চর্যের কিবা!
তবে,
ফিরে দেখা ইতিহাসে এর সুতো বাঁধা কিনা। নাটক সমাজের প্রতিচ্ছবি, মানে সমাজ বোঝার ছবি।
আর সেই সমাজ থেকেই তো অভিনেত্রীদের নেওয়া হয়েছিল।
একথা এখন কে না জানেন। তবুও, কিন্তু, এখন, যখন নাটকের মেয়ে প্লাস মেয়েদের নিয়ে আলোচনা
হয়, তখন সেখানে নারীবাদ তকমা সহজেই সেঁটে যায়।
কেননা,
হাসির হলেও, ব্যঙ্গ করে এক তার্কিক বলেন যে, সমাজে মেয়েদের পক্ষে ‘একটু ভাল হতেও পারে’
এরকম কিছু হলেই তা নারীবাদ। তারই উত্তরে আরেক তার্কিক বলেছেন যে, নারী বুঝি বা বাদ…?
তাহলে
সমাজে থাকে কে বা কারা? সমাজের দুই অংশ। নারী-পুরুষ। আর বাকি কিছুই থাকে না? থাকে তর্ক,
দিনের জোগানে দিন-তারিখের হিসেব দিতে নারীবাদের কিছু কথা, যা আগে নারীনামক এক সত্তাকে
বাদ দিয়েই চলছিল। এই কথা লেখা মাত্র বাকি সত্তা সোচ্চার, বলল, তাহলে নারী বাদ নয় বলছ?
তাহলে নারীবাদ নিয়ে উদার। এইমাত্র বাতাসে লেগে নারী ধর্ষণের পরিসংখ্যান, উল্লেখের যে
পুরুষ-ধর্ষণ হয় কিনা লেখা হয়নি সেভাবে। সেভাবে যেভাবে নারী মুক্তির আন্দোলনে প্রাথমিকভাবে
নারী ভ্রূণে-ই ধর্ষিত হতে হতে জন্ম নেয়। অর্ধেক নারী তার অর্ধেক পুরুষ…। কথাটা চলিত,
কানে বেজে উঠল। এইবারে তবে সমাজের ঘরে প্রবেশ করা যাক, অনেকটা দ্রুত প্রশ্নোত্তরের
মতো। কয়েকটা চালু প্রশ্ন করে নেওয়া যাক। কবে থেকে নারীর অধিকার এল? কবে থেকে নারী শিক্ষা?
কবে থেকে নারীর দীক্ষা হল পেশায়? কবে থেকে নারী মানে যুদ্ধ করে জায়গা দখল? কবে থেকে
নারী মানে দুখণ্ড মাংসপিণ্ডের মধ্যে ঘুরপাক নয় শুধু বলে প্রশ্ন উঠল? তারিখ, সন জানা
নেই। কিন্তু, নারী যেদিন কলমে কিছু লিখল, তা সে বেনামী চিঠিই হোক বা নামে থিয়েটার-নাটক।
একদিকে চলছে নারী, থুড়ি, মেয়ে, মেয়েরা কতটুকু করবে, কিকি বিষয় করবে, কোন পরিধিতে তাদের
ঘুরপাক থাকবে, ইত্যাদি নিয়ে। এরসঙ্গে আদর্শ নারী কাকে বলে, সেই সংজ্ঞা নিয়ে আজও মীমাংসা
হল না। নারীকে যাচাই করে চলে সময়।যেমন, আদর্শ, লক্ষ্মী, ভালো, শান্ত, সুশীলা, ঘরোয়া
প্রভৃতি প্রাথমিক গুণসম্পন্ন মেয়েদের চাহিদা বেশি। মেয়েদের চাহিদার বাজারস্তরে বড় অংশের
মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েদের কি কি দিয়ে সাজালে ভালো হয়, সেই জিজ্ঞাসার মধ্যে ঘূর্ণিতে
মেয়েরা নিজেদের আন্দোলনে আসে। মেয়েদের আন্দোলনের কারণ নিঃসন্দেহে দাবি, অধিকার, সম্মান।
শতকে শতকে মেয়েদের এই দাবি কিছু মিলেও যাচ্ছে। আবার, কিছু দাবি মিলছেও না। তাই, প্রশ্ন
ওঠে, আদর্শ, লক্ষ্মী, ভাল, শান্ত, সুশীলা, ঘরোয়া প্রভৃতি প্রাথমিক গুণওয়ালা মেয়েদের দাবি-দাওয়া থাকতে পারে? নাকি তারা প্রতিবাদী হতে
পারে?
কাট-টু-কাট
গেলেও, হ্যাশট্যাগ জমানার অনেক আগেই গুরুতর কিছু প্রাথমিক অধিকারের লড়াই মেয়েরা করে।
এবং নিজেদের দাবি আদায় করে। একটা মেয়ে এসব ইতিহাস কিছুই জানত না। পুঁটি, ভালো নাম বিনোদিনী।
কখনও জানতে ইচ্ছে করে, এই নাম তাঁকে কে দিয়েছিলেন? তাঁদের পরিবারের পেশা বিনোদ করা
নয়, আমোদ দেওয়াই ছিল। আমোদের নয় বিনোদিনী ওরফে বিনোদ-কে আমরা চিনেছি, নটী হিসেবেই।
নটী, মানে অভিনয় যার পেশা। এটুকুতেই থেমে গেলে আজ তাঁকে নিয়ে এত্ত হুজুগ থাকত না। বা
তাঁর নামে মঞ্চ করে দিয়ে জনতার রঙ্গমঞ্চে টিআরপি বাড়াতে হত না। নটী বিনোদিনীর একটা
বাজার এখনও রয়েছে। সেটা অভিনেত্রীর বাজার নয়। কারণ, নাটকের অভিনয় তো ওই মঞ্চে কাজের
সঙ্গে সঙ্গে দেখতে দেখতে চলে। তাঁর বাজার ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু সেটা প্রতিবাদের
অভিনেত্রী হিসেবে।
একথা
হেসে উড়িয়ে দিলেও, সভ্যতার ইতিহাসে প্রতিবাদের বাজারের রমরমা। এখন দেখার যে, কোন প্রতিবাদের
মেয়াদ কতটা? কোন প্রতিবাদে কোন কোন সুবিধে মেলে? কোন প্রতিবাদে পাবলিসিটি মেলে? এটাই
চিরকালের একটা ভালো ব্যাপার যে, পাবলিসিটি।
প্রতিবাদী
সেলিব্রিটি হলে বাজার ভালো। একুশ শতকের এই উত্তাল সংস্কৃতির ফাঁপা বাজারে, অকালে-কালে
এটাও বিনোদিনীর তৈয়ের করা। তাহলে, পাঠক, বুঝলেন তো... একজন সদর্থক পাবলিক ফিগার বা
নটী, কতটা সমৃদ্ধি পেতে পারেন, নিজের গুণ দিয়ে। আসলে, খাঁটি মানুষ বিনোদিনী, যে কাজই
করেছেন মনপ্রাণে করেছেন। তো, তিনি একটা প্রতিবাদের ভাষাও মনেপ্রাণে তৈরি করেছিলেন,
হ্যাভ আর হ্যাভ নটস্-দের মধ্যে। সেই প্রতিবাদের বিষয় যেমন চিরকালীন, তেমনই প্রতিবাদী
নটী বিনোদিনীও অমর।
_
ইতি
একুশ
শতকের ফ্ল্যাশব্যাক স্বত্বাধিকারী…
সমৃদ্ধ হলাম ❤
উত্তরমুছুন