মহিষাসুরমর্দিনীরহস্য
সহস্রাব্দ সহস্রাব্দ
পূর্বে। মধ্য এশিয়ার ঊষর মরু বালুতে সেচ দিয়ে উর্বর করে ব্যাপক ফলন সমৃদ্ধ করছে এক
দল সুঠাম কর্মঠ মানুষ। তারা নিজেদের অহুর বলে। ক্রমাগত সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য
ইতিমধ্যেই তাদের মধ্যে শুরু হয়েছে বিভাজন। কৃষিজমির অধিকার যারা পায়নি তাদের পশুপালন
ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই দুই বিবাদমান গোষ্ঠী নিজেদের ভূমিকে বলে পার্থিয়া। পৃথু—তাদের পূর্বপুরুষ—এই মরুভূমিকে প্রথম
বাসযোগ্য করেন। গোষ্ঠীর সাধারণ লোকজন তাঁকে নেতা মেনেছিল। নেতাকে তারা "রাজন"
অভিজ্ঞায়িত করে। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলতে থাকে। উল্টে পুরো
গোষ্ঠী-সমাজ এবার ত্রিভাজিত হয়ে পড়ে। ভাগগুলিকে এখন গণ বলা হয়। Man, Deman, Divin। Man, Demon,
devine। মানব, দানব, দেব। দানবগণ শারীরিক শক্তিতে সকলকে হার মানায়। দেবগণ
আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে রপ্ত হয়ে ওঠে। তুলনায় দুর্বল মানবগণ তাই বাধ্য হয় আদিভূমি
পার্থিয়া ছেড়ে ক্রমশ পূর্বদিকে যাযাবর হতে। যাযাবর যাপনের শুরুয়াৎ হয় নেতা মনুর
নেতৃত্বে । তিনি প্রজা রক্ষাকারী প্রজা বৃদ্ধিকারী প্রজাপতি।
মনুকে তারা পিতা মেনেছিল।
পিতা শুধু জন্মদাতা অর্থে নয় পালক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। মনুর পুত্র/পালিত গণ'ই হল মানব।
মানব গণের উচ্চারণে পার্থিয়া হয়ে দাঁড়ায় পার্শিয়া। পূর্বচারণকারী মানবগণ পর্বত-সিন্ধুকোশ
বা হিন্দুকুশ পেরিয়ে প্রবেশ করে ভারতবর্ষে আনুমানিক ছয় সহস্র বছর পূর্বে। দেবগণও পরবর্তী
শতাব্দীতে তাদের অনুসারী হয়। তাদের উচ্চারণে পার্থিয়া হয়ে যায় পৃথিবী। তারা
তাদের আদি ভূমি থেকে শুরু করে পুরো ভারতবর্ষের সমগ্র ব্যাপ্ত অঞ্চলকেই পৃথিবী নামকরণ
করে। ক্রমে দানবগণের একটা অংশ ভারত অভিমুখে যাত্রা করে। মানবগণ ও দৈবগণের ভাষ্যে ‘অহুর’
‘অসুর’-এ রূপান্তরিত হয়। এইভাবে ভারত ভূমির আদি বাসিন্দাগণও দেব ও মানবগণের
দ্বারা অসুর অভিধা লাভ করে। আজকের পুরাণ তন্ত্র শাস্ত্র প্রভৃতিতে যে দেবাসুর দ্বন্দ্বের উল্লেখ সমূহ পাওয়া যায় এই হল তার
নৃতত্ত্বগত ব্যাখ্যা। ‘পার্শিয়া’ আরও দু’হাজার বছর পর থেকে ‘পারস্য’ বলে উচ্চারিত
হতে থাকে।
ভারত ভূমিতে মানবগণ
প্রথমাবস্থায় পশুপালন করলেও ধীরে ধীরে তারা কৃষি নির্ভর হতে শুরু করে। এ বিষয়ে তারা
সাহায্য পায় দেবগণের যারা আধুনিক প্রযুক্তির কৃষিযন্ত্র, কৃষিবীজ প্রভৃতি উদ্ভাবন করতে
থাকে। অসুরগণ বলপূর্বক লুঠ করতে চায় উর্বর জমি সকল। দেবতাদের উদ্ভাবিত আধুনিক অস্ত্র
শস্ত্রও অসুরদের প্রতিহত করতে পারে না। দেবগণ তাই শুধু পুরুষদের নয় তাদের গণভূত নারীদের
যুদ্ধে প্রবুদ্ধ করতে থাকে। পুরাণে উল্লিখিত দেবী দুর্গার অসুরগণকে পরাজিত করবার আখ্যানই
এই কথার অন্যতম প্রমাণ। অসুরদের অভেদ্য দুর্গ বা প্রতিরোধকে যিনি প্রতিহত করেন তিনিই
দুর্গা । অসুরগণ কিন্তু এই যুদ্ধে কোনও নারী-নেতৃত্ব নির্মাণ করতে পারেনি। দেবগণ
এইখানেই এগিয়ে থাকে। প্রতিভাময়ী নারী শক্তিকে
তাঁরা দেবী বলে স্তুতি করতে থাকে। এইভাবে প্রগতিশীল মানসিকতায় দেবগণ অসুরগণকে অনেক
অনেক পিছনে ফেলে দেয়। দুর্গা হয়ে ওঠেন দেবগণের ত্রাতা, মাতা, ঈশ্বরী।
ভারতের পুরাণ শাস্ত্র
যা কিছু নিয়েই আলোচনা চলুক না কেন আধ্যাত্মিকতাকে বাদ দিয়ে কিছুই হবার নয়। আধ্যাত্মিকতা
এদেশের প্রাণশক্তি। পুরাণ, তন্ত্র, শাস্ত্র এমনকি বেদান্তও “শক্তির” পূজারী।
শক্তি—জগৎ চালিকা শক্তি। সেই শক্তিরই আরেক নাম দুর্গা। তন্ত্র, শাস্ত্র, পুরাণে যত
রকম দেবীর উল্লেখ পাই প্রত্যেকেই শক্তিস্বরূপা। পুরাণ মতে প্রত্যেকেই দেবীই দুর্গার
অংশ।
এই শক্তি সৃজনকারী পালনকারী
শক্তি। মানুষের অন্তরে এই শক্তির বোধন ঘটাতে হয়। মানব সত্তায় যে নঞর্থক শক্তি নিহিত
আছে, যা তার চেতনাকে আচ্ছাদিত করে রাখে মোহ-মূঢ়তায়, তাকে পরাভূত করার জন্যই এই মাতৃশক্তির
আরাধনা। নঞর্থক শক্তি যা সৃষ্টির, জগতের ক্ষতি সাধন করে তাই হল অসুর। অ-সুর, সুর
বা তানের বিপরীত। স্বর হল ঐক্য-সাম্য-ভারসাম্য বা হারমোনি। অসুর এর অর্থ এই প্রকারে
দাঁড়াচ্ছে বিশৃঙ্খলা। দুর্গাশক্তি এই বিশৃঙ্খলার নাশকারিণী। বিভিন্ন পুরাণে বিধৃত
দুর্গার কাহিনীসকল শেষপর্যন্ত এই তত্ত্বকেই প্রমাণ করে। এই কাহিনীগুলোই এবার আলোচ্য
হয়ে উঠুক।
প্রথমে দক্ষ কন্যা সতীর
কাহিনীটিই ধরা যাক। দক্ষ হলেন দেবগণের প্রজাপতি। পৃথিবীর সকল জাতির দেবগণ অমরত্বের
অধিকারী—তারা মৃত্যহীন। দক্ষ অমরত্বের উপাসক—মৃত্যু বিরোধী। কিন্তু সৃষ্টির বিপরীতে
ধ্বংস অনিবার্য। শিব মৃত্যর দেবতা—লয়কারী। দক্ষের যজ্ঞ জন্মের জয়গান—মৃত্যুর পরিপন্থী।
শিব সেখানে তাই অনাহুত। দক্ষ-কন্যা সতীর স্বয়ম্বর সভাতেও শিব অনামন্ত্রিত। তবুও সেই
সভায় শিবকে আসতেই হয় কারণ সতী তাঁকে স্মরণ করেছেন। সতী শিবকেই বরমাল্য দান করেন। সতী
যিনি মাতৃশক্তি, জগৎপালিকা তিনি স্বয়ং মৃত্যুকে বরণ করেন। কারণ মৃত্যুই জীবনের অঙ্গ।
বেদান্ত তো তাই প্রতিপাদন করতে চায়। জন্ম-মৃত্যু একটি চক্র। প্রতিটি জীবকেই এই চক্রবাহিত
হয়ে বারংবার যাওয়া আসা করতে হয় এই পৃথিবীতে। যা কিছু জরাগ্রস্ত, অপ্রয়োজনীয়, পুরাতন
মৃত্যু তাকে গ্রাস করে স্থান করে দেয় নতুনকে। শিব-সতীর বিবাহ যেন জন্ম-মৃত্যুর
ভারসাম্য রক্ষা। দক্ষের যজ্ঞে যেমন শিবের প্রবেশাধিকার নেই, তেমন নেই সতীরও–দক্ষের
বিদ্রোহী কন্যা যে পিতার অমতে হয়েছে মরণের ঘরণী। দক্ষের যজ্ঞ শিব-বিরোধী—মৃত্যু-রোধী।
শিবের নিষেধ অগ্রাহ্য করে সতী সেই যজ্ঞে আবির্ভূতা হন। সতী যেন বিদ্রোহিনী সেই কন্যা—যিনি
পিতা ও স্বামী দুই পুরুষ অভিভাবককেই অতিক্রম করেন; যেন পিতৃতান্ত্রিক অভিভাবনায় প্রচণ্ড
আঘাত হানেন। দক্ষের কাছে যজ্ঞ ক্ষেত্রে সতীর এই অনাকাঙ্খিত প্রবেশ তো মৃত্যুর বার্তা
বহন করা ছাড়া আর কিছু নয়। দক্ষের শিব নিন্দায় আহত হয়ে অতঃপর সতীর দেহত্যাগ। মৃত্য-রোধী
যজ্ঞে আত্মজার মৃত্যুবরণ—এতো দক্ষের প্রবল পরাজয়।
তারপর যজ্ঞ ক্ষেত্রে
শিবের প্রবেশ—প্রেমিক শিব—শোকোন্মত্ত শিব—প্রলয় নটরাজ—তাণ্ডবে তাঁর যজ্ঞ হল পণ্ড। জীবনের
উপর মৃত্যুর নাচই হল সত্য। তবুও শোকার্ত শিব। যিনি স্বয়ং মৃত্যুর বিধাতৃ তিনিও প্রিয়া
বিরহে কাতর। এতদিন তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত। জগৎবাসীর—মর্ত্য জগতের মৃত্যু-আহত জীবের বিচ্ছেদ
ব্যথার প্রগাঢ়তা সম্বন্ধে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অনবহিত। সতী তাঁর পাষাণ হৃদয়ে—শ্মশান
হৃদয়ে বুনেছেন প্রেমের বীজ। দেহ ত্যাগ করে সতী সেই ত্রিগুণাতীত নিস্পৃহ অমর দেবাদিদেবকে
করে তুলতেন মর-মানুষের সমতুল্য। মৃত্যর জ্ঞান যাঁর ছিল, ছিল না শোকের ধারণা সেই
শিবকে সতী দিলেন শোক-জ্ঞান। এখানেই সতীর জিৎ। আবার মৃত্যু-রোধী দক্ষকেও শেখালেন
মৃত্যুর আবশ্যিকতা, অবসম্ভাব্যতা। পিতা-পতি দুই পুরুষকেই মানুষ করলেন সতী।
দক্ষ যজ্ঞে দেহত্যাগের
পর সতী আবার নতুন দেহ ধারণ করেণ হিমালয় দুহিতা পার্বতী-রূপে জন্মগ্রহণ করেন। পর্বতের
কন্যা-পার্বতী-পর্বতবাসিনী। হিমালয়ের উত্তরে শিবালয়—কৈলাস। এই জন্মে শিবের সঙ্গে পার্বতীর
পুনরায় মিলন। সেই মিলনের পূর্বে হৈমবতী-দুর্গার প্রবল কৃচ্ছসাধন। সেই সাধনায় জগৎ কম্পমান।
শেষে তাঁর মা তাঁকে প্রতিহত করতে বলেন “উঃ মাঃ”! অর্থাৎ “আর না”। এই ভাবে তাঁর নাম
হল উমা। এরপর তাঁর শিব-লাভ। দুর্গার এই কৃচ্ছসাধন জীবের আত্মজয়কারী সাধনার প্রতীক।
কাম-ক্রোধ-মোহ-মদ-মাৎসর্য্যাদি জয় করে সত্ত্বরজস্তমাদি ত্রিগুণের উর্দ্ধে উঠে ত্রিগুণাতীত
অবস্থা প্রাপ্তিই হল ‘উমা’ হয়ে ওঠা। তখন সাধক তুরীয়াতীত শিবকে লাভ করেন। তুরীয়াতীত
শিব হলেন সাধকের কাছে ব্রহ্মের স্বরূপ। ব্রহ্মানন্দ লাভ করে সাধক এখন শান্ত ও জগতের
শান্তি বা শমকারী শম্ভু শঙ্কর। দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধ সকল প্রকার বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে
সৃজনশীলতার যুদ্ধ। মহিষাসুরও অমরত্ব-লোভী। সে দেবগণেরও অপরাজেয়। দেবী মহিষাসুরের বুকে
শিব-প্রদত্ত ত্রিশূল বিদ্ধ করে জগতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অমরত্বের নিপাত ঘটান। আবার
মানুষের ভিতরকার পাশবিকতার প্রতীকও মহিষাসুর। তারও পরাজয় ঘটে পাশুপত ত্রিশূলের আঘাতে।
শিব পশুপতি অর্থাৎ পশুশক্তির উপর জয়লাভকারী। দুর্গা পশুপতির অর্ধাঙ্গিনী। শিব-উমা আসলে
অদ্বয়- অর্ধনারীশ্বর। নারী রূপে—দুর্গা রূপে পাশবিকতার বিরুদ্ধযাপন; তারপর জয়লাভের পর পরমেশ্বর হয়ে ওঠা। তাই মহিষমর্দিনী
রূপের একদম উর্দ্ধে রাখা হয় ধ্যানগম্ভীর শিবের মূর্তি বা প্রতিকৃতি। ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার
অন্তে চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তা।
এই নিষ্ক্রিয়তাই পরম
গন্তব্য। সাধকের চূড়ান্ত অবস্থা। সাধকের ব্রহ্মস্থিতি। তাই শিবের অবস্থান সবকিছুর উর্দ্ধে।
কিন্তু এই আত্মজয়ের যুদ্ধই হল সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ। জীবের জন্মজন্মান্তর ধরে চলতে থাকে
এই যুদ্ধ। তন্ত্রানুসারে ব্রহ্মরন্ধ্রেই শিবের অবস্থান । 'কুণ্ডলিনী’ বা ঘুমন্ত তপশক্তি
যা নিহিত থাকে মূলাধার চক্রে বা লিঙ্গমূলে তাকে জাগ্রত করা হল জীবের প্রথম সাধন। তারপর
সেই তপশক্তিতে একটির পর একটি চক্র পেরিয়ে ব্রহ্মরন্ধ্রে পৌঁছানোই হল ব্রাহ্মীস্থিতি।
এই কুণ্ডলিনী শক্তিই হলেন দুর্গা। লিঙ্গমূল থেকে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত মানব দেহে সাতটি
চক্র আছে বলে কল্পনা করা হয় তন্ত্রে। লিঙ্গমূলের কামশক্তিকে তপঃশক্তিতে পরিবর্তিত করে
জীবের উদ্বর্তন ঘটান দেবী দুর্গা। কামই হল মহিষাসুর। জীবের সৎক্রিয়া নষ্টকারী তমোগুণ।
তমো-কে পরাভূত করতে হয় রজশক্তি বা ভাইটাল এনার্জি দ্বারা। দেবীর সিংহ এই রজোগুণের প্রতীক।
রজঃগুণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সত্ত্বগুণ দ্বারা। সিংহ বাহনা দেবী হলেন সত্ত্বস্বরূপিণী।
তাঁর উর্দ্ধে শিব ত্রিগুণাতীত অবস্থার দ্যোতক। অন্তর্নিহিত পশুশক্তির সঙ্গে তীব্র লড়াই
করেই কুণ্ডলিনীকে তুলতে হয় চক্র থেকে উর্দ্ধ চক্রগুলিতে। এই সংগ্রাম যেন দুর্গম হিমালয়ের
অগম্য উত্তুঙ্গ শৃঙ্গগুলিকে অভিযান করার, জয় করার প্রচেষ্টার তুল্য। কুণ্ডলিনীকে ব্রহ্মরন্ধ্রে
পৌঁছে দিয়ে ঘটাতে হয় শিব-দুর্গা—ব্রহ্ম-শক্তি—আত্মনের সঙ্গে পরমাত্মার মিলন। তন্ত্রে
ইহাই দুর্গা রহস্য। গূঢ় রহস্য। দেবীর নাম তাই পার্বতী। তাঁর রহস্য ভেদ করা সুদূর-সম্ভব।
তাঁকে উপলব্ধি করা হল পার্বতী-জ্ঞান লাভ। সেই জ্ঞানলাভের উদ্দীপনা পর্বত বিজয়ের উদ্দীপনার
সমান।
দুর্গা অর্থাৎ যিনি
দুর্গম। যাঁকে বোধ করা অসম্ভব। অ-জ্ঞানগম্য—অবোধসম্ভব। একমাত্র তিনিই পারেন তাঁর রহস্য
উন্মোচন করে সাধককে সহায়তা করতে। সাধক তখন বোধ করে আত্মরহস্য উন্মোচনই দুর্গারহস্য
উন্মোচন। পার্বতী তখন সুগম হয়ে ওঠেন। সকল বাধা জয় করে সেই জগৎ-মাতৃকাকে লাভ করে
সাধক হয়ে ওঠেন সুগত। অগম্যকে গম্যকরণ, দুর্গমকে ‘সুগম’করণ যিনি করেন তিনিই
সুগত। শাক্য সিংহ গৌতমীপুত্র জান্তবকে, মার-কে, মারণ-মরণকে জয় করে হয়ে ওঠেন
পরম সুগত-সিদ্ধার্থ। এই সুগত’র পথ অবলম্বন করে যিনি বোধি লাভ করেন তিনি সৌগত
বোধিসত্ত্ব।
বুদ্ধের কথার প্রসঙ্গেই
এবার আলোচ্য হোক বৌদ্ধতন্ত্র বিধৃত দেবীতত্ত্ব। প্রথমে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্রের
একটি শ্লোক স্মরণ যাক—
“নিজগণভূত মহাশবরীগণ সদগুণসম্ভৃত কেলিতলে,
জয়ো জয়ো হে মহিষাসুর মর্দিনী রম্যকপর্দিনী শৈলসুতে"।
নিজগণভূত অর্থাৎ নিজের গণের বা গোষ্ঠীভূত; আবার নিজ প্রকৃতিস্বভাবসম্পন্ন। শবরী অর্থাৎ পর্বতবাসিনী। অতএব এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে নিজ গোষ্ঠীভূত সদগুণসম্পন্না পর্বতবাসিনী মহা সুকন্যাবৃন্দের সঙ্গে ক্রীড়ারতা সুরম্য কবরীবন্ধসমৃদ্ধ শৈল দুহিতা দেবী মহিষাসুরমর্দিনীর জয় হোক। আবার অন্যভাবে অর্থ করলে, শবর শবে রত। শব—মৃত্যু। শব—স্থিতিশীলতা, শব—নিস্ক্রিয়তা। শবে রত যিনি তিনিই শিব। শবর অবস্থা প্রাপ্তি মানেই ব্রাহ্মীস্থিতি বা সোহহং–আমিই সে—আমিই ব্রহ্ম—অয়ং ব্রহ্মাস্মি—এই অবস্থা প্রাপ্তি। এটাই সাধকের সিদ্ধি লাভ। শিব সিদ্ধেশ্বর মহা শবরবৃন্দ বা মহা সিদ্ধগণের অগ্রগণ্য সর্বশ্রেষ্ঠ শবর। এই ভাবে অর্থ করলে শ্লোকের অর্থ দাঁড়াচ্ছে দেবী পার্বতীর প্রকৃতিসম্পন্না অর্থাৎ যাঁরা নিরন্তর দেবী পার্বতীর ধ্যান করতে করতে পার্বতী-স্বরূপা হয়ে উঠেছেন সেই সকল মহা সিদ্ধ যোগিনীগণ—সদগুণসম্ভৃতা মহাশবরীগণের সঙ্গে লীলারতা রম্যকজটাধারিণী মহিষাসুরমর্দিনী দেবীর জয় হোক। দেবী পার্বতী এই মহাশবরীগণের আরাধ্যা পরম শবরী-পরমেশ্বরী। বৌদ্ধতন্ত্রে বর্ণিত দেবী পর্ণশবরী-র তত্ত্ব আলোচনা করলেই দেখা যাবে দেবী দুর্গাই বিবর্তিত হয়ে পর্ণশবরী রূপ নিয়েছেন। বজ্রযান অনুযায়ী পর্ণশবরী ও সবুজ তারা একই। উভয়েই পর্ণাভ সবুজবর্ণা। পর্ণশবরী মাররোধী-মারণরোধী-মারীরোধী-মরণরোধী দেবী যিনি স্ত্রী বোধিসত্ত্ব সপ্তাক্ষী তারার রূপ পরিগ্রহ করেছেন। সপ্তাক্ষী তারা ক্ষেত্রবিশেষে পত্রাভ সবুজবর্ণ ধারণ করেন। মহাশবরী দুর্গার আরেক নাম সুপর্ণা। এইভাবে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মহাশবরী বৌদ্ধতন্ত্রের পর্ণশবরীর সঙ্গে এক হয়ে যান।
ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের
মহাদেবী দুর্গার দশমহাবিদ্যার একটি রূপ হল তারা। তারা আকাশতত্ত্বের তথা মহাবিশ্বের
তত্ত্বস্বরূপা। আবার প্রথম মহাবিদ্যা কালী কালতত্ত্বের নির্ধারক। তিনি কৃষ্ণবর্ণা—অন্ধকার
মহাশূন্যের প্রতীক। তিনি মহাকাল-শিবের উপর বিপরীত রতিতুরা। মহাকাল যা অনাদি—অন্তহীন,
তার প্রতীক। তাঁর উপর মহাকালী হলেন কালখণ্ড যে খণ্ডে জীবের জন্ম-মৃত্যু চক্র ঘূর্ণিত
হয়। জন্ম-মৃত্যু-রহিত হলে মানুষ মহাকালে লীন হয়। সে তখন শিব হয়ে ওঠে। পুরাণ মতে অসুর
রক্তবীজের নিধনার্থে দেবী পার্বতী কালী রূপ ধারণ করেন। রক্তবীজের রক্ত মাটিতে পড়লে
শত শত রক্তবীজের সৃষ্টি হয়। একটু গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায় রক্তবীজ হল সেই মারণ জীবাণু
যা মুহূর্তে শতশত বংশবৃদ্ধি করে। কালী হচ্ছেন সেই জীবাণু ধ্বংসকারিণী। সৃষ্টিকে তিনি
মহামড়ক থেকে রক্ষা করেন। দেবীর দশমহাবিদ্যা রূপের সবকটির মন্দির একত্রে দেখা যায় হিন্দু-তীর্থ
মাতৃপীঠ সতীপীঠ কামাখ্যায়। কামাখ্যা পাহাড়েই পূজিতা হন দেবী বনদুর্গা। বনদুর্গা দেবীর কোনও মহাবিদ্যা রূপ না হলেও দেবীর
প্রকৃতিচারিণী, বনলক্ষী—বনদেবী রূপের মূর্তায়ন। কামাখ্যা সংলগ্ন সিলেট ময়মনসিংহ এবং
খাসি পাহাড়ের ব্যাপৃত অঞ্চল জুড়ে স্থানীয় দেবীরূপে পূজিতা হন দেবী বনদুর্গা। সূতিকাগৃহে
তাঁর অধিষ্ঠান—সাধারণত কোনও মূর্তিতে নয়—বৃক্ষ
বিরুৎ-এ তিনি মারীর বিরুদ্ধে দুর্গ-স্বরূপা–মারীর আক্রমণ, রোগের আক্রমণ প্রতিরোধ করে
দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর মন্দির ও কামাখ্যা পাহাড়ে ঘন অরণ্য—চির সবুজ বেষ্টিত। অরণ্যও
দুর্গের ভূমিকা পালন করে—সুরক্ষিত করে বনাশ্রিত জনজাতি, প্রাণী সকলের জীবনযাপন; সভ্যতার
আগ্রাসন থেকে, মড়কের আগ্রাসনের কবল থেকে। বনদুর্গা সেই অরণ্যের মূর্তপ্রতীক। আবার
তিনি বনের দেবী। তিনি প্রতিরোধের দেবী—রোগ, মরণ এবং যাবতীয় অশুভ শক্তির। তিনি সবুজ
প্রকৃতির, পৃথিবীর রক্ষাকারিণী।
এইভাবে কামাখ্যা পাহাড়ের হিন্দু দেবী বনদুর্গার মধ্যে
বৌদ্ধ তন্ত্রের রোগ প্রতিরোধকারিণী পর্ণশবরী দেবীর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। খাসি
পাহাড়, কামাখ্যা পাহাড় অঞ্চল বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মানুষ দ্বারা অধ্যুষিত। আবার কবি নৃতাত্ত্বিক
হুমায়ন কবীরের মতে আসাম, মেঘালয় ও সংলগ্ন বাংলাদেশের মুসলিম অধিবাসীবৃন্দ মূলত ধর্মান্তরণের
আগে বৌদ্ধ ছিলেন। বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাব আজও এইসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনে
আচার অনুষ্ঠানে প্রবল ভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন বাংলার পাহাড়পুর, ওদন্তপুরী বৌদ্ধ
বিহারগুলির বজ্রযানী তন্ত্র শিক্ষার নির্যাস লুকিয়ে রাখা আছে চর্যাপদের পদকর্তাদের
রহস্যময় পদ সামগ্রিক- চর্যাচর্য-বিনিশ্চয়-এ। পদকর্তা শবরপাদ রচিত পদটিই
স্মরণ করা যাক—
উঁচা উঁচা পাবত তহি বসই শবরী বালী
মোরঙ্গি পিচ্ছা পরহিন শবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।
বাংলা ভাষার আদি রূপ চর্যায় রচিত বৌদ্ধ বাঙলার এই পদটির অর্থ নিম্নরূপ…
সুউচ্চ পর্বত। সেখানে
শবরী কন্যা বাস করেন। শবরী কন্যা ময়ূর পুচ্ছ পরিধান করেন। কণ্ঠে কিংবা গ্রীবাতে তাঁর
গুঞ্জর ফুলের মালা।
সাধক শবরপাদ সেই শবরীর
ভক্ত ও অনুরক্ত। শবরীর পদাশ্রিত হয়েই তিনি শবরপাদ। শবরী পর্বত কন্যা। পর্বতের দেবী।
তিনি ময়ূর পালক পরেন। ময়ূর সাপ বিনাশক-বিষ বিনাশক। ময়ূর পোকামাকড় উদরসাৎ করে ক্ষেতকে
বাঁচায়, জনপদকে বাঁচায়। শবরী এই ভাবে, একই সঙ্গে জীবানুবিনাশক ফসল প্রদায়িণী লক্ষ্মী
দেবী হয়ে ওঠেন। ময়ূর পালক পরিধান করেন ব্রাহ্মণ্য দেবতা বিশ্ব পালনকর্তা শ্রীবিষ্ণুর
অবতার, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁরই প্রকৃতি বা শক্তি শ্রীরাধিকা। তিনিও ময়ূরপুচ্ছধারিণী
পরম বৈষ্ণবী। তাঁরও বাস বৃন্দাবনের নিকট বরসানার পাহাড়ে। প্রথমেই বলা হয়েছে পাহাড়বাসী
একটি জনজাতি হল শবর। এই ভাবে পার্বতী দুর্গা বা মহাশবরী বৌদ্ধ পর্ণশবরী এবং বৈষ্ণবী
শ্রীরাধা যেন একাকার বা একই দেবী প্রকল্পের ত্রিস্থানিক ত্রিকালিক ত্রিরূপ। দেবীসূক্ত
চণ্ডীতে আবার দেবী মহিষমর্দিনী দুর্গাকে ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মহেশ্বরী এই ত্রি-রূপে
স্তব করা হচ্ছে।
বৌদ্ধ দেবী পর্ণশবরীর
আরও এক রূপভেদ হলেন নীল তারা। তিনি নীলসরস্বতী বলেও পরিচিতা। তিনি বৌদ্ধ ময়ূর-বাহনা
মহাময়ূরী দেবী নীল সরস্বতীর আরেক রূপভেদ। মহাময়ূরী দেবী রোগ মড়া এবং সর্প-ভয় বিনাশক।
ময়ূর আবার ব্রাহ্মণ্য দেব সেনাপতি কার্তিকেয়র বাহন। দেবী দুর্গা, স্কন্দ কার্তিকেয়র
জন্মদাত্রী। নবরাত্রি উৎসবে সময় দেবী যে নব-দুর্গা রূপের আরাধনা করা হয় তার একজন
হলেন দেবী স্কন্দমাতা। আবার নবপত্রিকারূপে পূজিতা দেবী দুর্গার একটি রূপ হলেন
দেবী কার্তিকী । জয়ন্তী বিরূৎ-এ তিনি পূজিতা
হন। যে ধারণা-কল্পের নাম কার্তিক, তারই স্ত্রী প্রতিরূপ হলেন কার্তিকী। বাঙালির দুর্গাপূজায় তাই দেবী মহিষমর্দিনীসহ
তার আর সকল রূপ কার্তিক লক্ষ্মী সরস্বতী গণেশের পূজা করা হয়। নবরাত্রির শেষ রজনীতে
দেবীর সিদ্ধিদাত্রী রূপের পূজা করা হয়। সিদ্ধিদাত্রীর পুরুষ প্রতিরূপ রূপে আরাধিত
হন সিদ্ধিদাতা গণেশ। আবার প্রথম রাত্রিতে পূজিত হন দেবী ব্রহ্মচারিণী বা ব্রহ্মাণী,
যিনি দেবী সরস্বতীর রূপভেদ। দেবী দুর্গার নবপত্রিকা রূপের মধ্যে ‘ধান্য’ সমস্ত ফসলকে
প্রতিকায়িত করে, ধান্য ধন শব্দজাত। ধন এবং ধান এবং সকল ফসল শস্য সম্পদ সমৃদ্ধির দেবী
লক্ষ্মী। নবপত্রিকা ধান্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী।
নবপত্রিকার অন্তর্গত
বৃক্ষ লতা বিরূপ শস্যগুলির ভেষজ গুণ অনস্বীকার্য। দেবীর মারী-মড়ক প্রতিরোধী রূপের
পূজা করা হয় নবপত্রিকায়। বৃক্ষ-বিরূৎ-অটবীর দেবীর পূজার উপচারও নবপত্রিকা পূজায়
নিহিত। মহাশবরী-পর্ণশবরী অরণ্য রক্ষাকারিণী, অরণ্য দুর্গ বেষ্টন বা প্রতিরোধের প্রযুক্তি
তাঁর হস্তগত। পর্বতও দুর্গের ভূমিকা পালন করে। পার্বতী দুর্গা সেই পর্বতের অধিষ্ঠাত্রী
দেবী। এইভাবেই দেখা যাচ্ছে সমস্ত রকম প্রতিরোধ বা যুদ্ধের—সে মারীর বিরুদ্ধে হোক বা
মড়কের বিরুদ্ধে বা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দেবী হচ্ছেন দুর্গা। আজও নবপত্রিকার
হরিদ্রার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন উমা। সারা বাংলা জুড়ে চৈত্র মাসে বাসন্তী উমা পূজিতা হন। শ্বেত
শুভ্রা হৈমবতী গৌরী-পার্বতী যদি পৃথিবীর শ্বেতাঙ্গ জনগণের প্রতিভূ হন তবে
হরিদ্রাভ উমা সমগ্র এশিয়াবাসীর গাত্রবর্ণ ধারণ করে আছেন। আর কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিভাত করছেন কৃষ্ণবর্ণা মহাকালী। দেবী দুর্গা
এইভাবে রূপভেদে জাগ্রত হয়ে উঠেছেন
বিশ্ব মানবিকতায়। তিনি বিশ্বের সমস্ত বর্ণের মানুষের জননী।
এবার বাঙালির পূজিতা মহিষমর্দিনী
দুর্গা-প্রতিমার আরেকটি ইতিহাস
আলোচনা করা যাক। আলোচনা শুরু
হয়েছিল পৃথু রাজার ভূমি পার্থিয়া থেকে। পৃথু শব্দ থেকেই পৃথিবী, পার্থিব, পার্থিয়া, পৃথুলা প্রভৃতি শব্দের উৎপত্তি।
মহাভারতে আমরা রাজা পৃথুর উল্লেখ পাই সমগ্র পৃথিবীর রাজা হিসাবে। দশ সহস্র খ্রিস্টপূর্বাব্দে
সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা মেসোপটেমিয়া
সভ্যতার
ইতিহাস ও তার বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেব-অসুর—অসুর দলনে দুর্গার রহস্য অনেকটা আলোকিত
হবে। আধুনিক কালের ইরাক মেসোপটেমিয়ার ঐতিহাসিক ভূমি হলেও সভ্যতার বিস্তৃতি ছিল ইরান, তুর্কি, সিরিয়া, কুয়েত ছুঁয়ে আরো
পূর্বে। সামগ্রিক মেসোপটেমিয়াতেই ৪০০০-২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বৃদ্ধি পেয়েছে
সুমেরীয় সভ্যতা। ২৫০০-৬০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তারই নাম হচ্ছে
আসীরীয় সভ্যতা। আসীরীয় নাম আজও লুকিয়ে আছে সিরিয়া শব্দটির মধ্যে। প্রাচীন আসীরীয়দের
জাতীয় দেবতা ছিলেন অসুর। তাদের রাজধানীর নামও অসুর। তাদের শাসকরাও অসুর উপাধি
গ্রহণ করত। যেমন প্রথম পুজার অসুর (আসীরীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা), প্রথম অসুর বাণীবাল, দ্বিতীয় অসুর বাণীপাল, অসুর উবল্লিত প্রভৃতি। এই
আসীরীয়রাই বৃত্তকে প্রথম ৩৬০
ডিগ্রিতে ভাগ করেন। বৃত্তাকার পৃথিবীর ধারণা তারাই প্রথম করেন। পৃথিবীকে অক্ষাংশ ও
দ্রাঘিমাংশে বিভাজন তারাই করেন। প্রাচীন সাংখ্য, কপিল যার সংকলক, তারাও আদি প্রনয়ণকারী আসুরী-অসুর
জাত।
এই অঞ্চলে
খ্রিস্টপূর্বাব্দ ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে জরাথুস্ট্রবাদ প্রাধান্য পেতে থাকে। ধর্মদূত জরাথুস্ট্রের আবির্ভাব
আনুমানিক ৬২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ও মৃত্যু আনুমানিক ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দতে। তিনি
অহুরমজদার উপাসক। জরাথুস্ট্রবাদীরা অহুরগণকে পূজা করেন। ভাষাবিদ গ্ৰিম ও ভার্নার-র সূত্র অনুযায়ী নর্ডিকদের
‘স’ সেমিটিকদের দ্বারা ‘হ’ উচ্চারিত
হয়।
ইন্দো-ইরানীয় ভাষা গোষ্ঠীর ভারতগামী যাযাবরদের নর্ডিক বলা হয়। তাদের জাতভাই ইউরোপের প্রাচীন নর্সরা
অহুর-কে বলে অসেইর । জরাথুস্ট্রবাদীরা দেবস-গণকে জাগতিক
বিশৃঙ্খলার
জনক মনে করেন। দেবস শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ দিউস থেকে যা আবার গ্রীক জিউস-রই
উচ্চারণান্তর। দেবস গণের অনুগামীরা অসুর উপাসক আসীরীয়দের সঙ্গে এঁটে উঠতে না
পেরে সিন্ধু কোশ বা হিন্দু
কুশ অভিমুখে যাত্রা করেছিল। তারা ভ্রাম্যমাণ জীবনে বাধ্য হয়। তারা
নিজেদের আর্য বলত। √ঋ+ণৎ= আর্য। ঋ -
ভ্রাম্যমান বা ঘূর্ণন অর্থের মূল। আর্য অর্থাৎ যারা সর্বদা ভ্রাম্যমাণ। মূল ভারত
ভূখণ্ডে আর্য শব্দটি বিভিন্ন সময়ে অর্থসংশ্লেষ করেছে। মহাভারতের কাহিনীগুলির ঘটনাক্রমের সময় আর্য
শব্দটি ভদ্র, মার্জিত, ধার্মিক, সৌজন্যশীল অর্থে ব্যবহৃত হত।
আরো পরে আসীরীয়
সাম্রাজ্য ‘পার্থিয়ান’ সাম্রাজ্য নাম পরিগ্রহ করে। ২৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দতে এই
অঞ্চলের অধিপতি আরসসাস আর্সামীদ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অরসসাস এবং অসুরস যেন
একই শব্দের স্থানভেদ
কালভেদগত উচ্চারণান্তর। আরো পরে এই অঞ্চলের নাম হয় আক্কাদীয় সাম্রাজ্য। ইন্দো-ইরানীয় ‘স’ সেময়-হামিও ভাষাগোষ্ঠীর মুখে ‘ক’-তে পরিবর্তিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ দাবি করা যায়
রোমান ‘c’-র ‘স’ ও ‘ক’-এর উচ্চারণ ভেদ—Circle(সার্কেল)। এই সূত্র
অনুযায়ী আসিরীয়-আর্সাসীদ-আর্কাকীদ-আক্কাদীয়।
যুগান্তর ব্যাপী উচ্চারণান্তর।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানগণ আকাশের রাশি
নক্ষত্র পর্যালোচনা কালে লক্ষ্য করেন কন্যা রাশি সিংহ রাশির সঙ্গে সন্নিহিত হয়ে আছে। রাশি
হাইড্রার শিরোভাগে রয়েছে বৃষ রাশি। যেন বৃষ কিংবা মহিষ মুণ্ডধারী শাসিত
হচ্ছে সিংহ বাহনা কন্যার দ্বারা। আকাশের ছায়াপথ মাটিতে নেমে এলো তাঁদের দৈবি কল্পনায়। তার
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমরা পাই মেসোপোটেমিয়ান মহিষমর্দিনী মূর্তিতে। ইতিহাসের
সেই ধূসর প্রাগ্-পর্বে যখন বাসভূমির কর্তৃত্ব নিয়ে লড়াই চলছিল অসুরগণ ও দেবগণের মধ্যে ঐ আদি
পৃথু-ভূমিতে, তখন হয়তো দেবগণকে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন জোয়ান অব আর্কের মত কিংবা রানী মাটিল্ডার মতো সিংহ বিক্রমা
কোনো নারী। হয়তো কোনো অত্যাচারী , দুরাচারী একনায়কের মুখোশ
খুলে দিয়েছিলেন তিনি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণনায়িকা। নারসিংহী। পশ্বাচারী একনায়কের শিরাবনমনকারিনী মহিষমর্দিনী।
পরাভূত দেবগণ প্রতিষ্ঠা
পুরুষ পৃথুর স্মৃতির বাহক হয়ে জম্বুদ্বীপ ভারতে প্রবেশ করে। সুদূর পশ্চিমে ইউরোপ থেকে
জম্বুদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তীর্ণভূমি আজ তাদের পৃথিবী। পৃথু শব্দটি স্থূল, শক্ত-সমর্থ, ব্যাপৃত প্রভৃতি অর্থে
সংশ্লিষ্ট হয়। জম্বু শব্দ ও জাম্বো শব্দ
এই
শব্দের স্থানিক উচ্চারণ ভেদ। এর অর্থ বৃহৎ। এই বিস্তীর্ণ জম্বু দ্বীপেও আর্য দেবগণ নির্বিঘ্ন বসতি স্থাপন
করতে পারেনি, জন্মভূমির আদি
অধিবাসীরা তা করতে দেবেই বা কেন।
এই
আদি অধিবাসীগণ আর্যদের ভাষ্যে আর্যেতর। আর্যেতর জাতিগুলির মধ্যে প্রবণতা ছিল কোনো বলশালী পশুর চিহ্ন ধারণ
করা। তারা পশু-পূজারী ছিল। এদের উত্তর পুরুষ বিবিধ ভারতীয় উপজাতিগণ আজও পশু পূজা
করেন। মহারাষ্ট্র ছত্রিশগড়ের বাইসন-হেড মারিয়া গোল্ড প্রভৃতি উপজাতি এর উদাহরণ।
মারিয়া উপজাতির পুরুষগণ মাথায় বাইসনের বৃহৎ শিং পরিধান করেন। ভারত ভূমিতে প্রবেশকারী
ইরানীয় অসুরগণের অধিপতিগণও হয়তো মহিষ বাইসনের শিং শিরোভূষণ করতেন—হয়ে ওঠেন মহিষাসুর।
মনস্তাত্ত্বিক নৃতত্ত্ব তো বর্তমানে এই inter-civilization cultural transmission বা সভ্যতান্তর সাংস্কৃতিক বহমানতা নিয়েই
নিমজ্জিত হয়ে আছে।
১৯২৮ -২৯ সনে মহেঞ্জোদারো
উৎখননের সময় যে ত্রিমুখী সীল-র প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া যায় যা পশুপতি সীল বা মহাযোগী সীল বা
প্রটোশিব সীল নামে পরিচিত তারও শিরোভূষণ মহিষ-শৃঙ্গ যা বাইসন হেড
মারিয়াদের কথাই মনে করায়। খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩৩০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দে বৃদ্ধি পাওয়া
সিন্ধু সভ্যতার কোন আদিবাসী নায়কই হয়তো সীলের প্রভু-কল্প। ইন্দো-ইরানীয় আগন্তুকদের সঙ্গে
নিরন্তর সংগ্রাম সিন্ধু সভ্যতার
পতনের অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত হয়। বিজেতা ইন্দো-ইরানীয় দেবগণ পশু পূজক এবং পশু চিহ্ন বা টোটেমধারী
আর্যেতর জম্বুদ্বীপীয় আদি অধিবাসী গণের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে ওই সকল টোটেম
পশুগুলিকে নিজেদের বাহন বলে অভিহিত করেন। আরো পরে প্রাক-ঋগ্বৈদিক যুগে
ভারতীয় উপদ্বীপে যখন ইন্দো-ইরানীয়গণের উত্তর পুরুষরা বর্ণাশ্রম ধর্ম আচরণ করতে থাকে
তখন বাহন পশুগুলিকে আরো বেশি করে আত্মসাৎকরণের মাধ্যমে তারা আর্যেতর গোষ্ঠীগুলিকে বর্ণাশ্রম
ধর্মে আনয়নের পথ প্রশস্ত করে। তাদের দেবতাদের সঙ্গে বাহনরাও পুজো পেতে, সম্মান পেতে থাকে। বর্ণাশ্রমধর্মী দেবগণ
এবং দেব গণানুসারীগণ এটা করতে কার্যত বাধ্য ছিল কারণ ইতিপূর্বেই তাদের বিরোধী গোষ্ঠী
ইন্দো-ইরানীয় অসুর বা দানবগণের একটি শক্তিশালী শাখা ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপন করতে
এগিয়ে আসে এ কথা আগেই বলা হয়েছে। ক্রমশ সমগ্র দক্ষিণ ও পূর্ব ভারত অসুর দানবগণের দখলে
চলে যায়। হিমালয়ের পাদদেশ ও সিন্ধু গঙ্গা উপত্যকার মধ্যে তারা দেবগণ ও মানবগণকে আবদ্ধ করে
ফেলে। পুরাণ মহাভারত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দানবগণ একনায়কতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত
হতো। কখনো হিরণ্যকাশ্যপ,
কখনো
বলী, কখনো
শুম্ভ-নিশুম্ভ, ভ্রাতাদ্বয়
কখনো বা মহিষাসুর। দেবগণ গোষ্ঠী অধিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। ইন্দ্র এই সকল অধিপতিদের নেতা
হলেও বরুণ পবন সূর্য অগ্নি রুদ্র প্রভৃতি সমর্যাদায় অভিষিক্ত হতেন। দেবগণের মধ্যে
অলিগার্কী চলত। তারা অসুরগণের তুলনায় অনেক বেশি
গণতান্ত্রিক ছিল। তাই তাদের মধ্য থেকেই গণনায়িকা দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। প্রসঙ্গত দেবরাজ ইন্দ্রের
আরেক নাম পুরন্দর—পুর বা নগর ধ্বংসকারী। উল্লেখ করা যেতে পারে সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক। ইন্দো-ইরানীয়গণ
ক্রমাগত আক্রমণ করে তাদের নগর-প্রাকার-প্রতিরোধ ধূলিসাৎ করে নগরকেন্দ্রিক ব্যবস্থাটাই বিপর্যস্ত করে
দেয়। দেবগণের নায়িকা দুর্গা
কিন্তু প্রকৃতিকে বনকে পর্বতকে দুর্গ রূপে ব্যবহার করেন, এতো আগেই আলোচিত হয়েছে। তিনি যেন
বন পাহাড়ের দেবী প্রকৃতি-স্বরূপা নগর যান্ত্রিকতার বিপরীতে। প্রকৃতির প্রতিশোধ সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের
আরেকটি অন্যতম কারণ। মরুভূমির বিস্তার, নদী
শুকিয়ে
যাওয়া, নিকাশি
ব্যবস্থার বিপর্যয়, জলের উৎসগুলির বিষিয়ে ওঠা, নিত্য জলাভাব, তৎসহ মারী মড়কের আক্রমণ
সিন্ধু সভ্যতাবাসীদের ধ্বংস করে দেয়। দীর্ঘযুগব্যাপী দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে ইন্দো ইরানীয় দেবগণ ক্রমশ
প্রকৃতিকে রপ্ত করে তোলে। প্রাকৃতিক শক্তি গলিকে আত্তীকরণ করার চেষ্টা করে। প্রাকৃতিক
শক্তিগুলির পূজক হয়ে ওঠে ইন্দ্র-বজ্র , বরুণ-জলশক্তি, পবন-বায়ুশক্তি একাকার
হয়ে যায়। তাদের গণনায়িকা দুর্গা সমস্ত রকম প্রাকৃতিক শক্তির অধিশ্বরী হয়ে ওঠেন। দেবী দুর্গাকে
দেবতাদের অস্ত্রশস্ত্র দানের
পুরাণকাহিনী
শুধুমাত্র এই বিষয়টিকেই প্রতিভাত করে না। গণের শক্তিকে গ্রহণপূর্বক
গণনায়িকার উত্থানকেও সূচিত
করে। তিনি একই সঙ্গে মারী মড়কেরও
প্রতিরোধী
হয়ে ওঠেন।
জরাথুস্ট্রের অনুগামী প্রাচীন
আসীরীয়গণের উপাস্য আহুরমজদা ছিলেন অগ্নিরক্ষক। অগ্নি তখন সহজ উৎপাদ্য ছিল না। অরণি, মন্থ বা ওই জাতীয় কাঠ
যা অগ্নি উৎপাদকের কাজ করতো তা ছিল অতি দুষ্প্রাপ্য। অগ্নিমূল্য শব্দটি আজও উচ্চমূল্যের অর্থে
প্রচলিত। পুরো গোষ্ঠী বা গোত্রের জন্য একটি মাত্র অগ্নিহোত্র থাকতো। অন্য গোত্র বা অপর গোষ্ঠী থেকে
অগ্নি ভিক্ষা করা যেত না,
কেউ
কাউকে অগ্নি প্রদান করতে চাইতো না। অগ্নিপ্রার্থী হওয়া ছিল লজ্জার বিষয়। গোত্র বা গোষ্ঠীচ্যূতগণ অগ্নিহীন বীভৎস
জীবন কাটাতো। অগ্নি ছাড়া ধাতব অস্ত্র, নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী তৈয়ার করা ছিল অসম্ভব। রন্ধন কার্য
বন্ধ থাকতো। অগ্নি ছাড়া আহার,
আহুতি
অসম্ভব হয়ে পরে। শত্রুর ওই
অগ্নি লুট করত, গ্ৰাম জনপদে অগ্নি নিক্ষেপ করত কিংবা হোত্রের অগ্নি নিভিয়ে দিয়ে
প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে। জরাথুস্ট্রবাদীরা আজও তাঁদের মন্দিরে পবিত্র অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে রাখেন। দেবী
দুর্গার উদ্দেশ্যে বৎসরে দুবার পালিত নবরাত্রি উৎসবে প্রজ্বলিত করে রাখতে হয় অক্ষয়-জ্যোতি-অগ্নি। দুর্গা দেবগণ ও মানবগণের
অগ্নিরক্ষক । হিন্দুর বিভিন্ন
অনুষ্ঠানে
প্রদীপযুক্ত জাগ্ হাঁড়ি কিংবা আই-হাঁড়ি এবং হোম যজ্ঞ সেই ইতিহাসেরই cultural recapitulation বা সংস্কৃতিগত
ঐতিহ্য আচরণ।
মহিষমর্দিনীর কাহিনীতে দেখা যায় মহিষাসুর দেবগণ মানবগণের আহুতি ধ্বংসকারী। দুর্গা তাকে এবং
তার সৈন্যদলকে নিপাত করেন।
যুদ্ধকালে প্রতিরক্ষার্থে পরিহিত তার
মহিষ চর্ম দ্বারা নির্মিত বর্ম ও মহিষ শৃঙ্গ দ্বারা নির্মিত শিরোস্ত্রাণ ছিন্ন
বিচ্ছিন্ন করে দেন দুর্গা। এটি
মহিষের মুণ্ডপাত অন্তে মহিষাসুরের বহিরাবির্ভাব।
এই যুদ্ধের কাহিনী
পরবর্তীকালে সংঘটিত সমজাতীয় সমস্ত ঘটনায় আরোপিত হতে থাকে। জনের বিঘ্ন উদ্রেককারী যেকোনো শক্তিকেই ভারতবর্ষে অসুর
অভিধা দেওয়া হতে থাকে। যেমন সুদূর দক্ষিণে বানাসুর। কুমারিকা অন্তরীপের
ভারতীয় উপদ্বীপের শেষ প্রান্তবিন্দুতে সামুদ্রিক বান যখন প্রবল ভাবে ভূমিক্ষয় করতে
আরম্ভ করে, সুনামির মতো প্রাকৃতিক তাণ্ডব যখন অন্তরীপকে ক্রমশ সমুদ্র গ্রাসে নিমজ্জিত করতে
থাকে, মহাসমুদ্রের উত্তরগামী বিস্তার যখন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন সেই
বিস্তার কে যে নারী
প্রতিহত করেন তিনি দেবী দুর্গার মর্যাদা লাভ করে হন কন্যাকুমারী। তামিল জাতি রোগ মারী প্রতিরোধের
জন্যও তাঁর আরাধনা করেন। দক্ষিণ ভারতীয় দেবী কাঞ্চাম্মার কাহিনীও অসুর নিধনের গল্প। বাংলায় মারীর
নাম দেওয়া হয় জ্বরাসুর। দেবী শীতলা তাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। অসুর নিধনকারী বল-বীর্যসম্পন্না দেবীরা সিংহ বা
ব্যাঘ্র বাহিনী হলেও দেবী শীতলা
গর্দভ আসীনা। গর্দভের দুধ শ্বাসযন্ত্রের ও পাচনতন্ত্রের সর্বরোগ দূর করে। এটি জ্বরের ও চর্ম
রোগের উপশমকারী। চর্মরোগ প্রতিরোধকারী ঔষধ মলম নির্মাতা সংস্থাগুলি বহুল্যে গর্দভী দুগ্ধ
সংগ্রহ করে।
সভ্যতার সংশ্লেষ,
সংস্কৃতির
বিবর্তন-পরিবর্তন এই ভারত ভূমিতে
অত্যাশ্চর্যজনক। তাই আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে আজও অসুর পূজক গোষ্ঠী দেখা যায়। এইসব
গোষ্ঠীভুক্ত মানবরা নৃতত্ত্বগতভাবে প্রাচীন ইন্দো-ইরানীয় অসুরদের চাইতে পৃথক।
উদাহরণস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গের ও ঝাড়খন্ড ওড়িষ্যার ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের শবর উপজাতির কথা বলা যায়। তাদের
পূজ্য মহিষাসুর। তাদের পুরাণগাথায় তাঁর নাম হুদুর দুর্গা। তিনি দয়ালু ও
বহুগুণসম্পন্ন প্রজাবৎসল রাজা। দুর্গা তাঁকে বধ করেন তার সারল্যের সুযোগ নিয়ে। শারদীয়
দুর্গাপূজার ওই কয়দিন আদিবাসী ওইসব মানুষদের বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ রাখা হয় যাতে
ঢাকের আওয়াজ তাদের কর্ণে প্রবেশ না করে। এই শবরদের উল্লেখ মহাভারতেও আমরা পাই। ইতিহাসের গতিস্রোতে হয়তো
ইন্দো-ইরানীয় অসুরগণ, ইন্দো-ইরানীয়
পর্বতবাসী দেবগণ আর পাহাড়বাসী
আদিবাসী শবরগণের মধ্যে ধর্মগত সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটে গেছে। অথবা কোনো যুগে শুধুমাত্র
একটি বা দুটি প্রজন্মের জন্য ইন্দো-ইরানীয় দেবগণ ও অসুরগণ নিজেদের গোত্রে
আদিবাসীদের বিবাহপ্রবেশে সম্মত হয়েছিল। পুরীর জগন্নাথ দেবের পুরাকথায় তো শবর
রাজকন্যার সহিত আর্য ব্রাহ্মণের বিবাহের উদাহরণ রয়েই গেছে।
দুর্গা-মহিষাসুরের যুদ্ধ মনোস্তত্ত্বের শিক্ষার্থীর কাছে সেলফ এবং আদার—স্ব এবং অপর-এর যুদ্ধ। সেলফ ও আদার একই ইগো বা অহং-এর দুই পৃষ্ঠ। অন্ধকারের নিরিখে আলোর, দোষের নিক্তিতে
গুণের পরিমাপ। মহাকাব্যিক যে কোন গাথার বৈশিষ্ট্যই হল বিজিতের শৌর্য বীর্যের প্রশংসা করা যাতে
বিজেতাকে আরো গৌরবান্বিত করা যায়। তাই মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিতে দেবীর সঙ্গে মহিষাসুরকেও পূজা করা
হয়। মহিষাসুর মূর্তিতে উপবীত দিয়ে তাকে
বর্ণাশ্রম ধর্মে গ্রহণ করা হয়। পুরাণকাহিনী অনুযায়ী দেবী দুর্গা মৃত্যুকালে তাকে
ব্রাহ্মণত্বের আশীর্বাদ করেন। নিজের ভুল বুঝতে পারার পর মহিষাসুর দেবীর কাছে বর প্রার্থনা
করে মর্তলোকে দেবীর সহিত পূজা পাওয়ার। দেবী তাকে ব্রাত্য করেননি। তিনি পাপ বিরোধী কিন্তু পাপীর প্রতি
সমব্যথী। মায়ের মত পরম শান্তি ও সান্ত্বনার হাসি হেসে তিনি মহিষাসুরকে আশীর্বাদ করেন। মৃত্যুকালে দেবী
তার সকল যন্ত্রণার উপশম করেন। জগতের
মাতৃশক্তির মহামূর্তি ওই মহিষমর্দিনী মূর্তি যেখানে শত্রু আর শত্রু থাকে না, দেবীর সাথে চির
অমর হয়ে পূজিত হতে থাকে মহিষাসুর।
এবার মহিষমর্দিনী মূর্তিকে একটু অন্যভাবে দেখা যাক। পাত সংস্থান তত্ত্ব অনুযায়ী
প্রোটো ইন্দো-অস্ট্রেলীয় পাত বিভাজিত হয় অস্ট্রেলীয় পাত ও দক্ষিণ ভারতীয় পাত
গন্ডোয়ানা ল্যাণ্ডে। ভারত্বের কারণে প্রায় পাঁচ কোটি বছর পূর্বে কৃষ্ণবর্ণ গন্ডোয়ানা
ল্যাণ্ড ক্রমাগত প্রবেশ করতে থাকে ধূসর
বর্ণের
ইউরেশীয় পাতের নিচে। ফলত অগভীর সমুদ্র টেথিস-র পাললিক শিলাস্তরগুলি ক্রমশ ভাঁজ হতে হতে উত্থিত হতে থাকে।
এইভাবে সৃষ্টি হয় হিমালয় পর্বতমালা। এই উত্থান আজও অব্যাহত। তারই প্রতিফলন সম্পূর্ণ
হিমালয়িক অঞ্চল ব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ভূকম্পন। আরো উত্তরে তিব্বতের মালভূমিও ওইভাবে গঠিত হলেও হিমালয়ের
তুলনায় তা অনেক বেশি স্থিতিশীল।
ধূসর
বর্ণের সিংহের নিম্নে কৃষ্ণবর্ণের মহিষের প্রবেশ ও সিংহের উপরে অবস্থিত পার্বতী তো পুরো ভূতাত্ত্বিক
ঘটনাটির মূর্ত প্রতীক। পার্বতী—উমা—আর না—আর আলোড়ন না। তিব্বতের মালভূমির শান্ত-ধী কৈলাস
পর্বত শিবের দ্বারা প্রতীকায়িত। মহিষমর্দিনী মূর্তির উর্দ্ধাংশে ধ্যানমগ্ন শিব চিত্রিত
থাকেন। আর টেথিস সমুদ্রের ইতিহাস গুপ্ত থাকে, দেবীর “সিন্ধু সুতা” নামের মধ্যে… “দনুজ নিরোষিনী দিতিসূত
রোষিনী দুর্মদ-শোষিণী সিন্ধু সুতে”। ভারতীয় ঋষিগণ
এইভাবে পৃথিবীর আদি ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন বা বলা ভালো সংস্কৃতিবদ্ধ করেন। এইখানে
ভারতবর্ষ অনন্য—অনন্য তার প্রত্যক্ষকরণ ক্ষমতা, চিন্তন ক্ষমতা। ভারতীয়
পুরাকল্প তাই শুধু ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা নয়— ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোল ভূতত্ত্বকে গর্ভে
ধারণ করে মহাসাহিত্য হয়ে
ওঠে—দেবীরহস্য-এর জালিকা
বিস্তার ও রহস্যের উন্মোচন এইভাবে যুগ যুগ ধরে একইসঙ্গে সমান্তরাল ভাবে সংঘটিত
হয়ে চলে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন