কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৪


ধর্ম

ফৈয়জ আর নেই। মারা গেছে পরশু। অবশ্য ফৈয়জ বেঁচে ছিল সেকথাও খুব একটা লোকের মনে ছিলো না। মনট্রিয়েল শহরের এই লেনটায় দশটা মুখোমুখি বাড়ি। প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে গাছ। দুটি মুদির দোকান। বাড়ির সামনের গাছ এবং রাস্তা, বাড়ির চালা যাকিছু এখন সব বরফে ঢাকা। চারিদিক সাদা হয়ে আছে। ইলেক্ট্রিক লাইনের ওপর বরফজমে আছে। ফৈয়জ পাঁচের-সি বাড়ির কেয়ারটেকার। দুদিন আগে ফৈয়জকে মৃত পাওয়া গেছে বাড়ির পোর্টিকোয় বরফঢাকা অচল গাড়িটার ভেতর। পুলিশের গাড়ি এসেছে। টুঁ শব্দটি নেই বাড়িটায়। বেশিরভাগ ঘরে তালা। বাড়ির মালিক কয়েকমাস আগে ইন্ডিয়া গিয়ে আর ফেরেনি। গোটা পরিবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ওরা যাচ্ছিল কোন এক পাহাড়ে তীর্থে। হঠাত গাড়িটা খাদে পড়ে যায়। সব শেষ। ফৈয়জ একা একাই সামলাচ্ছিল সব। ফৈয়জ আদতে ইসলামাবাদের লোক। এখানে ইণ্ডিয়ান পরিচয় দিয়ে থাকত। পাকিস্থানের গ্রহণযোগ্যতা নেই তেমন এদেশে। আমি সব জানি। কারণ আমিও ওখানেই থাকি। আমি ফৈয়জকে ভালোবাসতাম। এইরকম শীতের এক সন্ধ্যায় ফৈয়জ আমাকে বাঁচিয়েছিল। আমি আর ফৈয়জ কাছাকাছি শুয়ে থাকতাম। খাবার ভাগ করে খেতাম। আসলে ওর কোন নাগরিকত্ব কার্ড ছিলো না। এমন বেনাগরিক বিশ্বের সারা দেশেই আছে। পালাতে পালাতে এদেশ সেদেশ ডিঙিয়ে সে কিভাবে যেন মনট্রিয়েল শহরে আসে। ভিক্ষে করত, মোট বইত পাকরাশির অফিসের সামনেই। মাঝেমাঝে ওর গাড়ি ধুয়ে দিত, বদলে খাবার পয়সা পেত। লেকের পাড়ে শুয়ে থাকত। আমাকে সব কথা বলেছিল সে। ওসমান ভাই  -এর দলে কাজ করত সে করাচিতে। দালালের। ফৈয়জের মা দুর্গাবতী আর বাবা ভৈরব আর ওর দুইবোন থাকত। জন্মেছিল রমেশ হয়ে, রাজস্থানের এক ঊষর গ্রামে। তারপর কত বছর। ফৈয়জ আমার মতোই মানুষকুকুর ছিল, তবে আমাদের কুকুরদের নাগরিক কার্ড লাগে না।

ওর পুরনো গ্যাং-এর লোকরা একদিন ওকে দেখে ফেলল পাকরাশির গাড়িতে। সেদিন রাতে রুটি আর বেকন  কিনে এলো। আমরা খেলাম। এমন সময় নিঃসাড়ে কয়েকটা লোক এলো। এই শীত রাতে এখানে তেমন পুলিশ টহল থাকে না। বাড়ির ভেতর ঢুকে বার করে আনল ওকে। আমি একজনের পা কামড়ে ধরলাম। ফৈয়জ গাড়ির ভেতর ঢুকে লক করে দিলো কিন্তু ওর গুলি লেগেছে পেটে বুকে। আমারও গুলি লাগতে পারতো কিন্তু বাঁচলাম। ওদের দিকে চিৎকার করে ছুটে যেতে ওরা চলে গেল। ফৈয়জ নড়ছিল। পরদিনও নড়ছিল। বরফে ঢেকে গেল গাড়িটা। আমি মুখে করে খাবার এনে গাড়ির নিচে শুয়ে থাকলাম। কিন্তু গাড়ির দরজা খুলতে পারলাম না। গাড়ির কাঁচে রক্ত দিয়ে ফৈয়জ ওর দেশের ভাষায়  লিখলো ‘আম্মি’। আজ পাঁচদিন  ফৈয়জ নড়েনি। এখন পুলিশ ঘিরে আছে ওর লাশ। ওর কোনো পরিচয়পত্র নেই তাই ফৈয়জের লাশ কি পোড়াবে না দাফন করবে না সমাহিত করবে বেওয়ারিশ, বুঝতে পারছে না ওরা। কারণ মানুষের চামড়ায় লেখা নেই ধর্ম। এখন আবার তুষারপাত হচ্ছে। আমি দূর থেকে সব দেখছি। ওরা ধর্ম খুঁজছে লাশের গায়ে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন