![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
কালো মোছা আলো করা
সুবিনয় মাষ্টারমশাই যখন স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছেন, এই বেলা এগারোটা নাগাদ, তখন দরজায় জোরে জোরে কড়া নড়ে উঠলো। সেই সঙ্গে কড়া গলার হাঁক শোনা গেল-
- মাষ্টারমশাই দরজা খুলুন।
এই কড়া করে কড়া নাড়া বা কড়া
হাঁক ডাক সাধারণ মানুষের নয়। শুনেই বোঝা যায়, এগুলো পুলিশি হুঙ্কার।
সুতরাং সুবিনয় ঘাবড়ে গেলেন। ঘাবড়াবার
অন্য কারণও ছিল। ঘরের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে একটি অপরাধ। পালিয়ে আসা বিয়ের কনে। সে দোষ এই সুবিনয়ের নয়,
অন্য আরেক সুবিনয়ের। তিনি ঘোষ। তার মতো ভট্টাচার্য
নন। কিন্তু দরজা না খুললে পুলিশ তো দরজা ভেঙ্গে ফেলবে! সুবিনয় চট করে শোবার ঘরে ঢুকে
দেখলেন, সে কনে এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখতে পেয়ে সে মেয়ে বললো-
- ভয় নেই। আমি যেমন পালাতে জানি,
লুকোতেও জানি। আপনি যান দরজা খুলুন।
- মনে হচ্ছে পুলিশ।
- হ্যাঁ, সাথে আমার মাও থাকবে মনে
হয়। ভাবছি, আমি যে এখানে সেটা কি করে টের পেল?
- যাবো?
- হ্যাঁ যান। আর হ্যাঁ প্যান্টটা
খুলে ফেলুন। তারপর সেটা পরতে পরতে যান। প্যান্ট আধপরা অবস্থাতেই দরজা খুলুন।
- কেন?
- তাহলে পুলিশ বুঝবে কি কারণে দরজা
খুলতে এতো দেরি হচ্ছিল। আর তাই সেজন্য কোনো জবাব তলব করবে না।
সুবিনয় ভট্টাচার্য বুঝলেন, এ মেয়ে
যে সে মেয়ে নয়!
দরজা খুলতেই সামনে কিন্তু পুলিশ
নয়, একজন মহিলা। ভালো দেখতে। সাজগোজ ভালো। শুধু আওয়াজটা জমকালো।
- তাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?
এবার তাকে ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে এলো
পুলিশ।
- এই যে মাষ্টারমশাই। দেখুন তো
এ লেখাটা আপনার কি না?
- আরে উনি কি বলবেন! আমার ছোটমেয়ে,
তার বান্ধবীরা সব্বাই তো বললো, এই হাতের লেখা এই মাষ্টারমশাই-এর। যদিও এখন ওনাকে আর
মাষ্টারমশাই বলাটা উচিত নয়।
- আঃ। আপনি একটু থামুন না! আমাদের
তো তদন্ত করতে হবে! সেটা করতে দিন। বলুন মাষ্টারমশাই, এ চিঠির হাতের লেখা আপনার?
জবাবটা রাতেই শিখিয়ে দেওয়া ছিল।
সুতরাং সুবিনয় স্যার অতি বিনয়ের সাথে বললেন - দেখে তো অনেকটা আমার হাতের লেখার মতোই
লাগছে। কিন্তু আমি তো কোনো চিঠি লিখিনি। বহুদিন হলো আমি কাউকে কোনো চিঠি লিখিনি। চিঠি
লেখার মতো আমার কেউ নেই। তা কি লিখেছি আমি? আমার না লেখা এই আমার চিঠিতে?
হুবহু মুখস্থ বলতে পারলেন সুবিনয়।
মহিলা শুনে বললেন – তবে রে! ইয়ার্কি
হচ্ছে?
পুলিশ বললো - হুম।
এবার মুখস্ত করা পরবর্তী ডায়লগ
বললেন সুবিনয় - এটা কি প্রেমপত্র?
- না। এটা পলায়নপত্র।
মহিলা তখনো নাছোড়বান্দা।
- ঘর সার্চ করলেই সব ধরা পড়ে যাবে।
এই পুলিসের দল, ঘরে ঢুকুন! খুঁজুন!
- আরে খেলে যা। এখানে কে দারোগা?
আমি না আপনি?
- আমি কেন দারোগা হবো? আমি তো মেয়ের
মা। কিন্তু আপনারা ঘর সার্চ করছেন না কেন? সার্চের অর্ডার দিন।
- হ্যাঁ দিই। এই যে যাও ভাই। খোঁজো।
আর আপনি প্যান্টটা পরে ফেলুন।
- ওহো ভুল হয়ে গেছে।
হ্যাঁ ভুলই হয়েছে। পুলিশের সাথে
গোটা কনভেনশন ওভাবে আধপরা প্যান্টে থাকার নির্দেশ ছিল না।
কিন্তু একি! পুলিশের দল তো ঘরে
ঢুকে পড়লো! কি হবে এখন?
না কিছুই হলো না। কারণ তাদের সার্চটা
হাফ হার্টেড ছিল। তারা জিনিসপত্রের ওপর লাঠির বাড়ি দিচ্ছিল। এবং সবচেয়ে অবাক কান্ড,
ঘরের জানালা খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে ঘর সার্চ করছিল। তাই কিছু পাওয়া গেল না।
'পাওয়া যাবে না' এরকম একটা ভরসা
সুবিনয় মাষ্টারমশাই-এর মনেও ছিল। সাথে যদিও বুকে ধুকপুকানিটাও ছিল।
অতঃপর পুলিশ স্যরি বলে চলে গেল।
আর বলে গেল - এবার আপনি স্কুলে যেতে পারেন।
- কি হবে গিয়ে? অনেক লেট হয়ে
গেছে যে! মাষ্টার হয়ে স্কুল লেট করা কি ঠিক? আজ ছুটি নিতে হবে। ক্যাজুয়াল লিভ ফর
পুলিশ রেইড।
- এ্যাঁ!
হাফ মহিলা দারোগারূপি মেয়ের মাও
তমতম করতে করতে অকুস্থল ছেড়ে গেলেন। সবাই চলে গেলে আঁট করে দরজায় খিল দিলেন ধুকপুক দিল মাষ্টারমশাই।
আর তখন চাপা গলায় আওয়াজটা শোনা গেল-
- এই যে স্যার, উঠোনে আসুন। এসেছেন?
ঠিক আছে। হ্যাঁ এবার উপরে তাকান।
ওপর মানে নিম গাছের ওপর। নিমের
বাতাস স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারি বলে গাছটা উঠোনের একপাশে লাগানো হয়েছে। বাড়তে বাড়তে
সে এখন বেশ বড়সড় গাছ। গোটা পাড়ায় বসন্তকালে কচি পাতার যোগান দেয়। মেয়ে গলার আওয়াজটা
আসছে সেই গাছের ওপর থেকে। রাতের ধরাচুড়া ছেড়ে-ফেলে মেয়েটার পরনে এখন সুবিনয় স্যারের
পায়জামা আর হাফশার্ট। ঐ পোষাকেই সে নিমগাছের ওপরে।
- একি! তুমি ওখানে কেন?
- তা না হলে আর কোথায় লুকোতাম?
কিন্তু ঝোঁকের মাথায় উঠে তো গেছি, এখন নামতে পারছি না।
- তা হলে কি হবে?
- আপনি যদি লুফে নিতে পারেন তাহলে
আমি লাফ দিয়ে নেমে যাব।
- পারবো কি? আমি তো এর আগে কখনো
মেয়ে লুফিনি? ওজন কত তোমার?
- বেশি নয়। তবে স্যার, মেয়েদের
বয়স আর ওজন জানতে চাওয়া অসভ্যতা।
- আর মেয়ে লোফা? সেটা কি?
- যদি মেয়েকে রক্ষা করার জন্য
লোফা হয় তাহলে অসভ্যতা নয় বরং সেটাই সভ্যতা।
পরবর্তী দৃশ্য হুবহু হিন্দি সিনেমার মতো। তবে সিনেমার মতো চোটহীন নয়। যার পরে নায়ক নায়িকা উঠে নেচে নেচে গান গায়। এখানে নায়ক নায়িকা দুজনেই কিছু কিছু চোট পেল। এবং পটপট করে নায়িকার পরনের শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেল। স্যারের শার্টটা তার টাইট হয়েছিল। তবে সে সবকিছুই রিপেয়ার যোগ্য। সামান্যই আঘাত, তাও নিরাময় যোগ্য। আন-রিপায়েবল কিছু থেকে থাকলে সেটা তখনই ধরা পড়ল না।
কিন্তু জীবনের গল্পের শুরুর আগেও
গল্প থাকে। পুরোটা তাই কখনো সূচনাকাল থেকে বলা সম্ভব হয় না। আমি বরং গতরাত থেকে বলার
চেষ্টা করি।
গত রাতেও কড়া নাড়া হয়েছিল। তবে সেটা আস্তে আস্তে। সুবিনয় মাষ্টারমশাই ভেবেছিলেন, এতো রাতে আবার কে এলো!
- কে?
কোনো সাড়া শব্দ নেই।
বার কয়েক আওয়াজ দেওয়ার পর জবাব
এলো - আমি সুকুমার।
সুবিনয়ের কাছে সুকুমার? অবাক কান্ড!
তবে মাষ্টারমশাই নির্ভয়েই দরজা খুললেন। যাকে দেখলেন, তিনি চেনা মুখ। এ পাড়াতেই থাকেন। তবে পাড়ার একেবারে
ও মাথায়। কিন্তু জোড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বিনীত সুকুমারকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে
যে দুর্বিনীতা মেয়েটি ঘরে ঢুকে পড়লো, তার পরনে বিয়ের কনের সাজ।
এরকমটা সিনেমাতে হয়। বিয়ের রাতে
বিয়ের কনে পালালো। ঢুকে পড়লো নায়কের ঘরে। কিন্তু এই সুবিনয় স্যারের আচরণ নায়কোচিত নয়। ভীত, স্তম্ভি্ত, ভ্যাবাচ্যাকা।
ঝটপট দোর দিয়ে দিলেন বিনীত সুকুমারবাবু।
- ইনি কি বিয়ে পালানো কনে?
- হ্যাঁ স্যার। - বুড়ো বর?
- না স্যার।
- তবে কি অন্য প্রেম?
- অনেকটা তাই। তবে গতানুগতিক নয়।
আমার মেয়ের প্রেম শিক্ষার সাথে। ওর ইচ্ছে অনেক অনেক পড়াশোনা করবে, যাতে অন্য কিছু
হওয়া যায়।
- তা আপনি তো মেয়ের বাবা। আপনিও
যদি তাই চান, তবে বিয়েটা হচ্ছে কেন?
- হচ্ছে কারণ মেয়ের মা…
- চুপ করো বাবা। সব দোষ একা মায়ের
না। তুমিও সমান দোষী।
- হ্যাঁ মা। জানি। আমি ভয়ানক ভীতু
মানুষ। এই যে তোকে নিয়ে পালিয়ে এলাম এটাও তো ভয়ে ভয়ে। ওদিকে কি হচ্ছে কে জানে?
- এখনই কিছু হবে না। শেষ লগ্নে
বিয়ে। সবাই শেষ রাতে টের পাবে।
- ছেলেটা কিন্তু ভালো ছিল রে?
- চিন্তা কোরো না। এ ভালো পাত্র
মা হাতছাড়া করবে না। দেখে নিও। ঠিক পটিয়ে পাটিয়ে বোনের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে। হয়তো
এই প্যান্ডেলেই। হয়তো পরের লগ্নেই। তুমি আপাতত পালাও।
- আমি এখানে থেকে যাই? সকাল সকাল...
- উঁহু না। তাহলে পার্টনার ইন ক্রাইম
হিসেবে দুজনেই ধরা পড়ে যাবে। আমিও বাঁচব না। তুমি বিয়ে বাড়ি ফেরো। খুঁজে পেতে একটা
বোতল জোগাড় করে খেয়ে লটকে যাও।
- কখনো খাইনি তো?
- তাহলে তো আরো ভালো। অল্প খেলেই
লটকে যাবে। মাল খেয়ে আউট হওয়া বাপকে কেউই কনে হাপিসের জন্য দায়ী করবে না।
বাবাকে বিদেয় করে দিয়ে চোখের জল মুছে মেয়েটি সুবিনয় মাষ্টারমশাইকে বলেছিল -
- আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি শোবো না।
- আমারও তো ঘুম আসবে না।
- তাহলে ঠিক আছে। দুজনেই জাগি।
আগামীকাল খুব সম্ভবত পুলিশি ঝামেলা হবে। সে জন্যেই প্রস্তুতি নেওয়া যাক। অভিনয় আসে?
- না তো। খুব ছোটোবেলায় ডাকঘর
নাটকে দইআলা হয়েছিলাম। মঞ্চে ধুতি খুলে গেছিল। তখন মাথার গামছা কোমরে জড়িয়ে মঞ্চ
ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। কিন্তু মঞ্চে যাই বিপদ হোক, রিহার্সালে আমার অভিনয় ঠিকই ছিল।
- ওতেই হবে। তবে ডায়লগ ঠিকঠাক
বলতে হবে। একদম মুখস্থ করে নিতে হবে।
এবার মঞ্চে ধুতি নয় আধখোলা ফুলপ্যান্ট
ছিল। কিন্তু সেটা পূর্ব নির্ধারিত। অর্থাৎ অভিনয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে। এবং সেটা
দারুণ উৎরে ছিল। পুলিশ কনভিন্সড হয়েছিল।
সন্ধ্যের আঁধারে সে মেয়ে যখন সুবিনয় মাষ্টারমশাই-এর ঘর থেকে বের হলো, তখন তার পরনে স্যারের ফুলপ্যান্ট। স্যারের ফুলহাতা শার্ট। পায়ে স্যারের জুতো। এ ক্ষেত্রে অবাক কান্ড, কোনটাই সাইজে খুব একটা ছোটো বড়ো হলো না। তারপরের খবরগুলো হলো –
(এক)
সে মেয়ে তার মা'কে হাড়ে হাড়ে
চিনত। সেম প্যান্ডেলেই বিয়ে হলো। জাস্ট দুদিন পরে। পাত্র এক। পাত্রী আগের পাত্রীর
বোন।
(দুই)
মেয়ের বাবা বিস্তর গাল খেয়েছেন।
সাথে কনে সম্প্রদানও করেছেন উপোস থেকে।
(তিন)
রাতে বিয়ের ভোজ খেয়ে উনি লুকিয়ে
লুকিয়ে ওটাও খেয়েছেন। প্রথমবার খেয়েই বুঝেছিলেন, জিনিসটা মন্দ নয়।
(চার)
পরদিন থেকে সুবিনয় মাষ্টারমশাই
আবার হেডমাস্টার হবার জন্য পড়াশোনা শুরু করেছিলেন, যে পড়াশোনার ব্যাপারে উনি দুবার
ফেল হয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এবার কিন্তু ঠিক করলেন, আবার প্রস্তুতি নেবেন এবং
আর ফেল করবেন না। এবার ওনাকে পারতেই হবে। মেয়েটা যে পড়াশোনার জন্য কি রকম লড়ে যেতে
হয়, সেটা তাকে শিখিয়ে গেছে।
(পাঁচ)
না, পাঁচনম্বর খবরটা পাওয়া যায়নি।
মেয়েটার খবরও কিছু জানা যায়নি।
এখন যায়নি। কিন্তু একদিন ঠিক জানা
যাবে। এবং সবার বিশ্বাস, সেটা ভালো খবরই হবে। কালো মুছে আলো করা ভালো খবর!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন