মসীচিত্র
বৈরাগীর লাউ
হ্যানয় ভিয়েতনামের রাজধানী। পুরানো শহর, বয়স কম করিয়া হাজার বছর তো হইবে। তবে ইহার সজ্জা নূতন, ইহার প্রাণ নবীন। অন্তত যতটুকু দেখিলাম তাহাতে তেমনই মনে হইল। অপরাহ্ন পাঁচ ঘটিকায় হোটেল হইতে বাহিরে আসিলাম। আমাদের বলা হইল – চটপট রিক্সায় উঠিয়া পড়ুন। না না, এক রিক্সায় একজন করিয়া বসিবার নিয়ম। ইহাদের রিক্সার গঠন ভিন্ন – সাইকেল রিক্সা বটে তবে চালক পিছনে বসিয়া প্যাডেল করে। যাত্রীর আসন সম্মুখে, তাহার দৃষ্টিপথ বাধাহীন। আচমকা এক তরুণী ক্যামেরা লইয়া আসিয়া আমার একটি ছবি তুলিয়া লইল। ঘাবড়াইয়া গিয়াছিলাম, তবু আমিও হাত নাড়িলাম।
রিক্সা চলিল। বড় রাস্তা বাদ দিয়া মাঝারি ও ছোট রাস্তা দিয়া চলিতেছিল। দুইপাশে ভিয়েতনামি জীবন-যাত্রা দেখিতেছিলাম। ইহাদের দেশে বড় শপিংমল তেমন চোখে পড়ে নাই। রাস্তার দুই পাশে অগুন্তি দোকানপাট। বিক্রিবাট্টা ভালই হইতেছে। এক জায়গায় দেখিলাম প্লাসটিকের খেলনা ও জিনিসপত্রের আড়ৎ। কলিকাতার বড়বাজারের কথা স্মরণ হইতেছিল। রাস্তায় নরনারী ব্যস্ত হইয়া চলিতেছে। তবে ইহারা আমাদের অপেক্ষা বহুগুণ পরিছন্ন। রাস্তায় জঞ্জাল নাই। আগেও লক্ষ করিয়াছি এই দেশে চার-চাকা গাড়ি কম, দুই- চাকা বাহনই অধিক। সাইগন শহরে দেখিয়াছিলাম, দুই-চাকা বাহন চমৎকার নিয়ম মানিয়া চলিতেছে। সকলের মাথায় শিরস্ত্রাণ, মুখে মাস্ক। হ্যানয় শহরের এই অঞ্চলগুলি কিন্তু আমাকে বেশ আপন করিয়া লইল। আমাদের দেশের মত অতটা না হইলেও দুই-চাকা বাহন ডানদিক বাঁদিক করিয়া পথের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া চলিতেছে। রিক্সা-চালকেরাও বীরবংশীয়, কারণ একাধিকবার দেখিলাম ট্রাফিক আলোর লাল চক্ষুকে অবজ্ঞা করিয়া সটান চলিয়া গেল।
পথের দুইপাশের দোকান ও মানুষজন দেখিতেছিলাম। সব থেকে ভালো লাগিল রাস্তার ধারের খাবারের দোকানগুলি। অফিস ফেরতা অনেকে ফুটপাথে নিচিনিচু চেয়ারে বসিয়া খাইতেছে। কফির মন-মাতানো গন্ধ। পাশাপাশি বসা ছেলেমেয়েদের দেখিলাম। ইহাদের মধ্যে ভালবাসা রহিয়াছে কিংবা অঙ্কুরিত হইতেছে। কোথাও বা প্রবীণ-প্রবীণা বসিয়া আছেন। দু-একটি দোকানে দেখিলাম খরিদ্দার নাই – মনে হইল এইসব দোকান নৈশভোজনের জন্য। এইরূপ একটি দোকানে দেখিলাম একটি লোক পা ছড়াইয়া বসিয়া আছে। কোনো এক আড্ডাবাজ বন্ধু জুটিয়া গিয়াছে, দুইজনে প্রাণের কথা বলিতেছে। দুটি কিশোর ইসকুলের ব্যাগ কাঁধে লইয়া সেই স্থান দিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল।
এক কথায় নগর জীবন চলিতেছে। আমিও যেন কিছুক্ষণের জন্য ইহাতে সামিল হইয়া গিয়াছিলাম।
রিক্সা পরিক্রমা শেষ হইল। নামিবার উপক্রম করতেছি এমন সময় সেই হাস্যমুখ তরুণী আসিয়া রিক্সায় বসা আমার একটি ফটো আমাকে দিয়া বলিল - এক ডলার। দেখিলাম অতিশয় বোকাবোকা ফটো উঠিয়াছে, তবু এক ডলার দিয়া ছবিটি লইয়া বুক-পকেটে রাখিয়া দিলাম। হ্যানয় শহরে রিক্সা ভ্রমণের প্রমাণপত্র।
ইহার পরে আমাদের একটি ‘পুতুল-নাচের’ অনুষ্ঠান দেখিতে হইবে। মাঝে কিছুটা সময় রহিয়াছে। আমার সতীর্থ ভ্রমণকারীরা ব্যস্ত হইয়া পড়িল। কারণ ফুটপাথে বহুকিছু বিক্রয় হইতেছে। ছাতা, নানা ধরনের ব্যাগ, টুপি, ঘর সাজাইবার জিনিস, টি-শার্ট আরও নানান সামগ্রী। কাঠের তৈয়ারী ছোটছোটো সুদৃশ বুদ্ধ মূর্তিও রহিয়াছে। দাম কম এবং দরাদরি চলিতেছে। দেখিলাম সকলেই উৎসাহে ডগমগ। ইহার মধ্যে একজন খবর আনিল – আরে, ইহারা ভারতীয় টাকা লইতেছে। পাঁচশো টাকায় তিনটি টি-শার্ট কিনিলাম। ব্যাস, যাহারা কিনিব-কি-কিনিব-না র দ্বিধায় ছিলেন তাঁহারাও ঝাঁপাইয়া পড়িলেন।
আমি দাঁড়াইয়া রহিলাম। চারিদিকে সুবেশ নরনারী, রাস্তা, গাড়ি, কোলাহল, হাসি। আমার মনে হইতেছিল এই বিচিত্র বিদেশি ভীড়ের ভিতর আমি একেলা। কি কিনিব? যে সাধের ঘরে তাহা লইয়া যাইব সেখানে আজ আর কেহ নাই। কী হইবে স্মৃতির খড়কুটা জড়ো করিয়া? কী হইবে মায়ায় জড়াইয়া। এই বিদেশি শহরে আমার মনে হইল কোথায় যেন ঢ়ুঢ়ুং ঢ়ুঢ়ুং শব্দে একতারা বাজিতেছে। একটি বাউল গানের কলি বারংবার আমার মন ছাইয়া ফেলিতেছে।
… আমার অন্তরে বৈরাগীর লাউ বাজে গো সজনী, অন্তরে বৈরাগীর লাউ বাজে…
এই দেশে আসিয়া পর্যন্ত ছোটবড় বহু বুদ্ধমূর্তি দেখিতেছি। আগেও দেশে-বিদেশে অনেক দেখিয়াছি। তবু আজ যেন এই মুহূর্তে মনে হইল ভগবান বুদ্ধের মুখমণ্ডলে স্মিত হাসির যে আভাসটুকু লাগিয়া থাকে, তাহার অর্থ কিছুটা অন্তত বুঝিতে পারিতেছি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন