কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১২৯ / ত্রয়োদশ বর্ষ : দ্বিতীয় সংখ্যা




 

বিগত ৫ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত নন্দন চত্বরে অনুষ্ঠিত হলো পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা ২০২৫। মেলায় অংশগ্রহণ করেছিল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার পায় ৫০০টি লিটল ম্যাগাজিন। গত বছরে আমি দুর্ঘটনাজনিত অসুস্থতার কারণে মেলায় যেতে পারিনি। এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে না পারলেও গত ৮ এপ্রিল মেলায় গেছিলাম। গেছিলাম পত্র-পত্রিকার আকর্ষণে এবং লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক-কর্মী এবং সাহিত্যিকবন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হবার এক অমোঘ টানে। হ্যাঁ, দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল কিছুজনের সঙ্গে, আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি যে কত কতজনের সঙ্গে! খুব মনে পড়ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত সন্দীপ দত্তর কথা। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্রের কর্ণধার সন্দীপ দত্তর প্রস্তাবেই পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের ৯ জানুয়ারী শুরু হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিন মেলা। তখন বামফ্রন্টের আমল। তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই সূচনা করেছিলেন লিটল ম্যাগাজিন মেলার। মেলার প্রদীপে প্রথম সলতে জ্বালিয়েছিলেন কবি অন্নদাশংকর রায়। লিটল ম্যাগাজিন মেলা এবং কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় টেবিল থাকত লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে। সন্দীপ প্রতিদিন মেলায় তাঁর টেবিলে বসে থাকত। টেবিলে ছড়ানো থাকত বই ও পত্রিকা। আর সন্দীপের গায়ে জড়ানো থাকত ‘লিটল ম্যাগাজিন পড়ুন ও পড়ান’ লেখা পোস্টার। তার মাথায় বসানো কাগজের টুপিতেও সেই একই শ্লোগান। আজীবন সন্দীপ লিটল ম্যাগাজিনের স্বার্থে কাজ করেছেন। আমার জানা নেই, আর কারও সন্দীপের মতো লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা আছে কিনা। হয়তো কারও কারও আছে। আর সেক্ষেত্রে উচ্চারণ করতেই হয়, তার পেছনে আছে একমাত্র সন্দীপ দত্তর ‘অনুপ্রেরণা’। আর তাই নন্দন চত্বরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, কেমন যেন একটা শূন্যতার আবহ ছড়িয়ে আছে মেলা প্রাঙ্গনে।

এবছর নন্দনে আয়োজিত সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলায় অনেকে এসেছেন, অংশগ্রহণ করেছেন কবিতাপাঠ ও সাহিত্য বিষয়ক আলোচনায়। আবার বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক-সঞ্চালক মেলা বয়কট করেছেন। যাঁরা আকাদেমির আমন্ত্রণপত্র পাননি, এমনকি যাঁরা আমন্ত্রণপত্র পেয়েছেন, তাঁরাও অনেকে অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন। প্রাসঙ্গিক এই বয়কটের স্বপক্ষে তুলে ধরছি বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট শ্রদ্ধেয়  কবির ফেসবুক বক্তব্য। তিনি লিখেছেন – “দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য উৎসবে সানন্দে অংশগ্রহণ করে আসছি। কখনও এমন সংকটের মুখোমুখি হইনি। এখন পশ্চিমবঙ্গে অদ্ভুত এক আঁধারের মুখোমুখি হয়েছি। অভয়াহত্যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল, প্রতিবাদে মিছিলেও হেঁটেছি। আর এখন রাজনীতিসৃষ্ট অসহনীয় সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও হিংসার আবহ এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উদ্ভুত শিক্ষক নিয়োগে চরম দুর্নীতির প্রকাশ ও বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের চাকুরিহীনতা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুবই অস্থির করে তুলেছে। এই অবস্থায় লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও কবিতা উৎসবে যোগ দেওয়ার মতো আমার মানসিক স্থিরতা ও প্রশান্তি বিপর্যস্ত। আমি এই আয়োজন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত একান্তই আমার ব্যক্তিগত। আমাকে উদ্বোধনী মঞ্চে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণের জন্য আকাদেমিকে ধন্যবাদ”

তাঁর এই বক্তব্য, অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিগত। কিন্তু উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, যাঁরা বয়কটের দলে, তাঁদের বক্তব্যও একই। এবং শুধু যাঁরা কবিতাপাঠ ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেননি, তাঁরাই নন, লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যের অনুরাগী অনেক অনেক মানুষ এই বক্তব্যের ভাবনাই মনে পোষণ করেন। এমনকি যাঁরা মেলায় গেছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি দুর্বার আকর্ষণে, তাঁরাও এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন।

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের জানাই বাংলা নতুন বছরের আন্তরিক শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

গৌরাঙ্গ মোহান্ত

 

ট্যাং কবিতা: কাব্যাদর্শের রেনেসাঁস



 

চীনের প্রাচীন কবিতা বিশ্বসাহিত্যে একটি বিশিষ্ট জায়গা আলোকিত করে আছে। প্রাচীন চীনা সমাজে কবিতার প্রভাব ছিল বিস্ময়কর। কবিতা ছিল প্রধানত উচ্চতর শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। কনফুসিয়াস কবিকে অলোকসামান্য মানুষ হিসেবে গণ্য করেছেন। তাঁর মতবাদ অনুযায়ী কবির দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয় সমাজের বিচ্যুতি—কবির অনন্য প্রয়াসে সমাজ ত্রুটিমুক্ত ও আলোকদীপ্ত হয়ে ওঠে। কবি আবির্ভূত হন নৈতিকতার অবিকল্প কণ্ঠস্বর হিসেবে। কনফুসিয়াসের দর্শন রাজকীয় প্রতিষ্ঠানকে সুসংহত করেছে। হান রাজবংশ (খ্রিস্টপূর্ব ২০৬-২২০ খ্রিস্টাব্দ) হতে এ দর্শন শাসনতান্ত্রিক নীতিমালার আদর্শ হিসেবে আদৃত হয়ে এসেছে। কনফুসীয় মূল্যবোধ চীনা সমাজের অগ্রগতি ও চীনা সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে রেখেছে অভূতপূর্ব ভূমিকা। কনফুসিয়াস স্কুলের 'অ্যানালেক্টস'-এ কবিতার গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কবিতাকে আত্মোন্নয়নের সূত্র; দেশের অবস্থা অবলোকনের দর্পণ; পিতার যত্ন নিশ্চয়ন, পারিবারিক আচরণ পরিশীলন ও জ্ঞান ব্যবহারের নির্দেশতন্ত্র; মিথষ্ক্রিয়ামণ্ডিত, সমাজবদ্ধ জীবন পরিচালনার বিধান; পাখি, চতুষ্পদী প্রাণী ও বৃক্ষ সংবলিত কোষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে (Eno 96)।

তৃতীয় শতকে হান রাজবংশের পতনের পর দীর্ঘ সময় ধরে চীনে কেন্দ্রীয় সরকারের অবর্তমানে রাজনৈতিক অনৈক্য ও সামাজিক নৈরাজ্য প্রবল হয়ে ওঠে; চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিভিন্ন আঞ্চলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্বল্পায়ু সুই রাজবংশ (৫৮১- ৬১৮) এবং অনুবর্তী ট্যাং রাজবংশে (৬১৮-৯০৭) চীনের অখণ্ডতা দৃশ্যমান হয়। চীনের কাব্যিক ঐতিহ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ইতিহাসের অনিবার্য প্রতিফলন (Hinton 145)। ট্যাং রাজবংশ দীপ্তিময় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রচনার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে প্রোজ্জ্বল। সামন্ততান্ত্রিক এ শাসনামলে নাগরিকগণ নির্বিবাদ পরিবেশে জীবন ধারণ করেছেন। রাত্রিকালে তাদের দরজায় অর্গল লাগাতে হয়নি। হৃত দ্রব্যাদি পথেঘাটে পড়ে থাকলেও লুব্ধতাবশত কেউ তা স্পর্শ করেনি। নারীর সমমর্যাদা সমাজে ছিল প্রতিষ্ঠিত। সমাজ্ঞী য়ু জেতিয়ান সিংহাসনে আরোহণ করে সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত করেছিলেন। তিনি তাওবাদ ও বৌদ্ধধর্মের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন এবং শিক্ষা ও সাহিত্যের উন্নয়ন সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন। নানা জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের সহাবস্থানে কোনো সমস্যা

পরিলক্ষিত হয়নি। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ উদ্দীপ্ত ও প্রশস্ত থাকায় সৃষ্টিশীলতা অনবদ্য উচ্চতা স্পর্শ করেছিল। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ট্যাং যুগে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় কিংবা রাজপ্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মে নিয়োগ দানের জন্য কাব্য প্রতিভা মূল্যায়িত হত। আমলা বা কর্মকর্তাগণের মূল্যায়নপর্বে কবিতা রচনায় দক্ষ ব্যক্তি চাকরি লাভে সক্ষম হতেন (Shushe 12)।

ট্যাং রাজবংশের রাজধানী চেংয়ান (Chang'an) ও লুইয়াং (Luoyang) তৎকালীন পৃথিবীর বৃহত্তম ও অতি কজমোপলিট্যান শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল; এ জাতীয় শহরে বিদেশি পণ্য ও অদ্ভুত পোষাক পরিহিত পর্যটকের আধিক্য ছিল লক্ষণীয়। গ্রহণযোগ্য বৈদেশিক নীতি প্রচলিত থাকায় পারস্য ও আরব দেশীয় ব্যবসায়ীগণ বিখ্যাত সিল্ক রোড ধরে রাজধানীসহ অন্যান্য উপকূলবর্তী শহরে আগমন ও বসতি স্থাপন করতেন। সিল্ক রোড ও সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা বিধানের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট ছিল। সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার কারণে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলত অ্যান-শি বিপ্লব (৭৫৫- ৭৬৩) ট্যাং রাজবংশের বিপর্যয় ডেকে আনে। অ্যান লুশান ও শি সিমিং পরিচালিত বিপ্লবী সামরিক বাহিনী রাজধানী দখল করে কার্যত ট্যাং রাজবংশের ধ্বংস নিশ্চিত করে। দেশের দু-তৃতীয়াংশ জনতা মৃত্যুবরণ করেন অথবা আশ্রয়হীন হয়ে বিতাড়িত হন। বিপ্লবোত্তর এক শতক ধরে শিল্পকলা বেগবন্ত থাকলেও গৃহযুদ্ধে সৃষ্ট ভয়ংকর সমরবাদের বিভীষিকা থেকে এ রাজবংশ মুক্তি লাভ করতে পারেনি।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে 'শি জিং' বা কবিতার বই রচিত হলেও ট্যাং যুগ চীনে চিহ্নিত হয় কবিতার সোনালি ক্ষেত্র হিসেবে। ট্যাং কবিতায় ভাস্বর মানবিক মূল্যবোধ, দুঃখ, বেদনা, প্রেম, মৃত্যু, অসাধারণ নৈসর্গিক ও সৌন্দর্য চেতনা পাঠককে আবিষ্ট করতে পারে। ট্যাং কবিগণের কাব্যভাষার সাথে চিত্রভাষার সাদৃশ্য লক্ষণীয়। চর্যাপদের আগে রচিত ট্যাং কবিতায় চর্যাপদীয় দুর্বোধ্যতা ও সাধনতত্ত্ব যেমন দুর্নিরীক্ষ্য তেমনি এ্যাংলো-স্যাক্সন কবিতার লোকাতীত সংবেদনাও দুর্লক্ষ্য। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ ছিলো ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ যুগে রচিত 'চর্যাপদ' আমাদের একমাত্র প্রাচীন কাব্য। আমাদের প্রাচীন কাব্যভাণ্ডারে ২৪ জন কবির সাড়ে ছেচল্লিশটি কবিতা মূলত গূঢ় তত্ত্বের দীপ্তি দান করে। অন্যদিকে, ট্যাং যুগে ২২০০ জন কবি উপহার দেন প্রায় ৫০,০০০ কবিতা যেগুলো ভাব, বিষয় ও ছন্দে বিচিত্র। ষোলো শতকে বিকশিত তিন পঙ্ক্তি সংবলিত জাপানি হাইকু কবিতা, চার পঙ্ক্তিবিশিষ্ট ট্যাং কবিতার প্রভাব-পুষ্ট মানস সম্পদ (Wilson 17)। ট্যাং যুগের বিখ্যাত কবিগণের মধ্যে লি বাই, ডু ফু, ওয়াং ওয়েই, মং হাওরান, ওয়াং চ্যাংলিং, মং জিয়াও, লি হো, উয়ান ঝেন, বাই জুয়ি, লুও বিন-ওয়াং, ঝ্যাং রো-জু, চ্যাং জিয়ান, হান য়ু, ঝ্যাং জি, লি শ্যাং-য়িন, পি রি-জিউ উল্লেখযোগ্য।

রোমান্টিক চেতনা ট্যাং কবিতাকে সমুজ্জ্বল করে তুলেছে। রোমান্টিক স্কুলের পুরোধা হিসেবে লি বাই (৭০১-৭৬২) সমধিক উল্লেখযোগ্য। চীনের ইতিহাসে এরূপ প্রতিভাধর কবির আবির্ভাব কমই ঘটেছে। 'কবিতার অমর সাধক' হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। সামন্ততান্ত্রিক গোঁড়ামির শৃংখল ভেঙে তিনি মানবসত্তাকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন; আপন কল্পনার অসীম বর্ণে নির্মাণ করেন কবিতার উদার চিত্রকল্প। 'চাঁদের নিচে নিঃসঙ্গ সুরাপান' তাঁর একটি উপভোগ্য কবিতা। 'পুষ্পরাজির মাঝখানে এক জগ মদ:/ একা করছি পান, সন্নিকটে নেই কোনো বন্ধু।/ কাপ তুলে ধরে, ইঙ্গিতে ডাকি উজ্জ্বল চাঁদকে;/ আমার ছায়াসহ আমরা তিনজনের পার্টি। যদিও চাঁদ সুরাপানে অনভ্যস্ত/ এবং ছায়া কেবল অনুসরণ করে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ/ মুহূর্তের জন্য তারা যা তাই ধরে নেবো,/ বসন্ত সমাগম, করি বসন্ত উপভোগ/...।" এখানে কবি তাঁর ছায়া ও চাঁদকে নিয়ে যে উচ্ছলিত ভঙ্গিমায় বসন্ত উপভোগ করেন তা ট্যাং যুগের অন্য কবিতায় বিরল। এ কবিতায় কবি আনন্দপিয়াসী চিত্তের উদ্দাম স্বাধীনতাকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন।

বস্তুবাদী স্কুলের অগ্রণী কবি ডু ফু (৭১২-৭৭০) এ্যান-শি বিদ্রোহের (৭৫৫- ৭৬৩) প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। এ বিদ্রোহজাত গৃহযুদ্ধের ফলে ক্রমান্বয়ে ট্যাং রাজবংশের হিরণ্ময় দ্যুতি ম্লান হয়ে আসে। যোদ্ধা ডুফু শাসকের পক্ষে যুদ্ধ করেও শাসক মহলের নিকট থেকে প্রতিভা ও কর্মের কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি লাভ করেননি। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি 'কাব্য মহাজ্ঞানী' হিসেবে আদৃত হন। বঞ্চনা ও দারিদ্র্য ডু ফু-কে বিষণ্ণ, নিঃসঙ্গ ও বস্তুবাদী করে তোলে। তাঁর কবিতা 'ভ্রমণে নিশীথ ভাবনা' পাঠকের সামনে তুলে ধরে মগ্ন বিলাপের শিল্পিত ধ্বনিপুঞ্জ: 'কূল জুড়ে হালকা নলখাগড়া, ক্ষীণবল বায়ু।/ নিভৃত নিশীথে, উচ্চ-মাস্তুলযুক্ত নৌকা।/ নিঃসীম ভূতলের প্রান্তরূপে নক্ষত্রপুঞ্জ করে অবতরণ।/ চাঁদ ভেসে ওঠে, বহমান বিশাল নদীর ওপর।/ আমার কাব্যসৃষ্টির জন্য সুখ্যাত হওয়া কীভাবে সম্ভব?/ অফিসের বাইরে বৃদ্ধ ও অসুস্থ—সামনে পেছনে, এখানে ওখানে/ কার সাথে রয়েছে আমার সাযুজ্য, তবু?/ নিঃসঙ্গ এক শঙ্খচিল, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থলে সুস্থিত।' কবিতার প্রথম স্তবকে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির নান্দনিক চিত্রায়ণ পরিলক্ষিত হলেও শেষ স্তবকে খেদ ও নিঃসঙ্গতার রূপকল্প প্রমূর্ত। 'নিঃসঙ্গ এক শঙ্খচিল' কবির করুণ, বিজন মানসকে প্রতীকায়িত করে। 'বসন্ত পরিপ্রেক্ষিত' শীর্ষক কবিতায় বসন্ত কুসুমের ভেতর কবি যুদ্ধের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া অবলোকন করেন: 'জাতির পতন ঘটেছে, দেশ ভোগ করছে দুঃখকষ্ট:/ শহরে বসন্ত বৃক্ষ ও তৃণ সতেজ হয়ে উঠছে।/ কালপ্রবাহে বিপন্ন পুষ্পরাজি বয়ে আনে অশ্রু;/ ভয়াবহ বিদায়-গ্রহণ—পাখিরা থমকে দেয় আত্মা।' ডু ফু যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের বাস্তব চিত্র এঁকেছেন পরম মমতায়। 'পাথর পরিখা গ্রাম নিয়োগকর্তাগণ' কবিতায় সৈনিক সংগ্রহের জন্য কর্মকর্তাগণ দিনান্তে পাথর পরিখা গ্রামে উপস্থিত হলে এক বৃদ্ধার মর্মভেদী বিলাপ শোনা যায়:

'ইয়েচেঙের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত তিন ছেলের মধ্যে/ একজন কেবল বাড়িতে পাঠিয়েছে চিঠি।/ অন্য দুজন যুদ্ধে হয়েছে নিহত।/ উত্তরজীবী যথাসাধ্য কৌশলে লাভ করেছে জীবন;/ মৃতরা তাদের নিয়তিকে করেছে নিরুদ্ধ ।/ আমার দুগ্ধপোষ্য নাতি ছাড়া/ এ সংসারে আর কোনো পুরুষ নেই।/ সেজন্য পুত্রবধু এখনও আমাদের যায় নি ছেড়ে-/ তাছাড়া তার নেই কোনো শোভন পোশাক।' যন্ত্রণাকাতর বৃদ্ধার বিলাপ কবিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে; তিনি শুনতে থাকেন 'দূরবর্তী সাশ্রু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ'।

সাবঅলটার্ন মানুষের চিত্র শুধু ডু ফু আঁকেননি, পিউ এ সিয়ো (আনুমানিক ৮৩৪-৮৮৩) তাঁর 'ওক ফল সংগ্রহকারিণী মহিলার জন্য বিলাপ' কবিতায় এক নিরন্ন বৃদ্ধার জীবন ধারণের বাস্তব বর্ণনা তুলে ধরেছেন। 'হেমন্তে পাকে ওক ফল,/ কণ্টকিত ঝোপে আচ্ছাদিত পাহাড়ে পড়ে ঝরে।/ পীতবর্ণ চুলের কুঁজো এক মহিলা/ ওগুলো কুড়োবার জন্য মাড়ায় প্রভাতী হিম।/ ঘণ্টা খানেকের শ্রমে তার মেলে এক মুঠো কেবল,/ দিনমানে ওক ফলে পূর্ণ হয় এক ঝুড়ি।/ সেদ্ধ করে বার বার রোদ্দুরে দেয়া হলে,/ খাদ্য হিসেবে ওগুলো ব্যবহৃত হবে সারা শীতকাল।' প্রাচীন চীনের মতো প্রাচীন বঙ্গেও ভাতের অভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়। চর্যাপদের কবি ঢেন্টণপাদ উচ্চারণ করেছিলেন: 'টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।/ হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেসী।' অর্থাৎ টিলার ওপরে প্রতিবেশীহীন ঘরে কবির হাঁড়িতে ভাত নেই। দারিদ্র্যের এ জাতীয় প্রকট রূপের সাথে সওদাগরদের জীবনের তুলনা করেছেন ঝ্যাং জি (৭৬৬-৮৩০) তাঁর 'বুড়ো কিষাণের গান' কবিতায়। খাজনাক্লিষ্ট দরিদ্র কৃষক পাহাড়ে গিয়ে সন্তানদের ওক ফল জোগাড় করতে বলেন। কবিতার শেষে সওদাগরি জীবনধারার সংকেত মূর্ত হয়ে ওঠে: 'পশ্চিম নদীতে, সওদাগরদের রয়েছে অপরিমিত মুক্তা;/ তাদের নৌকার ভেতর কুকুরগুলোকে দেয়া হয় মাংস।' এভাবে শ্রেণিবৈষম্যের ভয়াবহ দিক উন্মোচিত হয় ট্যাং কবিতায়।

ট্যাং কবিতায় দারিদ্র্যের অসহনীয় অবস্থার বর্ণনা পাঠের পর চীনের পাহাড়ি গ্রাম প্রত্যক্ষ করার জন্য আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। ট্যাং রাজবংশের পরিবেশের সাথে আধুনিক পাহাড়ি পরিবেশের উন্নয়নগত ব্যবধান বিদ্যমান থাকলেও চীনা পাহাড়ি পরিবেশ বোধকে শাণিত করতে পারে, এ বিশ্বাস ছিলো দৃঢ়মূল। আমি ২০১৪ সালের জুন মাসে ইউনান প্রদেশের য়ু দিং কাউন্টিভুক্ত চ দিয়ান (Cha Dian) পাহাড়ি গ্রাম পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়ি। এ গ্রামে য়ি কিংবা লোলো নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার সাথে আমার পরিচয় ঘটে। তারা সামাজিকভাবে সুসংগঠিত বলে আমার কাছে প্রতিভাত হয়। সামাজিক ও উন্নয়নধর্মী বিষয়াবলির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তারা নিয়মিত তাদের সম্মেলন ভবনে উপস্থিত হন। পাহাড়ি বাড়িগুলো অত্যাধুনিক না হলেও প্রধানত ইষ্টকনির্মিত। পরিবারের নানা বয়সের সদস্যগণ শিক্ষা, কৃষি ও শিশু পালনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। য়ি জনগোষ্ঠির বাড়িগুলোতে রয়েছে রকমারি ফলের গাছ। আপেল, নাশপাতি, আম, কলা, আখরোট, ডালিম ছাড়াও রয়েছে নাম অজানা অনেক ফলগাছের সমারোহ। বিভিন্ন উচ্চতার পাহাড়ি জমিগুলোতে হচ্ছে ধান, তামাক ও সবজির চাষ। গ্রিনহাউজ ভেষজ উদ্ভিদের চাষ এখানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাড়িগুলো থেকে যে রাস্তা নেমে এসেছে তার দু ধারে ডালিম গাছের সারি। গ্রামটিতে বাংলাদেশের মতোই রয়েছে পোষা কুকুরের আনাগোনা। বাড়িগুলোতে রয়েছে ছাগল পালনের সুব্যবস্থা। ছাগলগুলোর সুন্দর স্বাস্থ্য দেখে প্রতীয়মান হয় যে, এখানে পুষ্টিকর পশুখাদ্যের কোন অভাব নেই। কোনো কোনো বাড়িতে রয়েছে গ্রামীণ পশু ফার্ম। সেখানে হাঁস, মুরগি ও শুকর পালন করা হচ্ছে। গ্রামের এ পরিবেশ দেখে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে, প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে এখন আর দারিদ্র্যের উল্লেখযোগ্য কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের বিদায় জানাবার জন্য য়ি মানুষজন যে সাংস্কৃতিক আবহ রচনা করেন তা খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

গ্রামের মহিলাগণ একটি লাইনে দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে নাতিদীর্ঘ একটি গীত পরিবেশন করেন। তাদের ভাষা দুর্বোধ্য হলেও বাংলাদেশের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির গীতের মতোই প্রলম্বিত, আন্তরিক সুর আমার বিস্ময় ও আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ট্যাং কবিতায় মানুষের দৈন্যের সাথে যে প্রাকৃতিক প্রতিবেশ চিত্রিত হয়েছে তার প্রচ্ছায়া প্রায় চৌদ্দশত বছর পরে আধুনিক চীনে দুষ্প্রাপ্য।

মধ্য ট্যাং যুগের কবি লি হো (৭৯০-৮১৬) রোমান্টিক হলেও প্রথাবিরুদ্ধ কল্পনায় ভাস্বর করে তুলেছেন কাব্যভুবন। নিজের জীবন-প্রদীপ ২৬ বছর প্রোজ্জ্বল থাকলেও কবিতা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে কালাতীত উজ্জ্বলতা। লি হোর কবিতা 'ম্যাজিক তন্ত্রীর জন্য শিল্পকর্ম' আজও বিকিরণ করে প্রাতিস্বিক বিভা: 'পশ্চিম পাহাড়ে সূর্য অস্ত যায়, পূর্ব পাহাড়ে ঘনায় অন্ধকার,/ ঘূর্ণিঝড়ে উৎক্ষিপ্ত ঘোড়াগুলো পদদলিত করে মেঘপুঞ্জ ।/ বর্ণিল বীণা ও আটপৌরে বাঁশি থেকে ঝরে ক্ষীণ সুরমালা:/ যখন সে শরৎ ধুলোয় পা ফেলে খসখস করে ওঠে তার বুটিদার ঘাগরা।/ বাতাস যখন ছুঁয়ে যায় দারুচিনি পাতা এবং ঝরে পড়ে একটি দারুচিনি বীজ/ নীল র‍্যাকুনের চোখ ঝরায় রক্ত আর শীতার্ত খেঁকশেয়াল যায় মরে।/ স্বর্ণখচিত লেজসহ ড্রাগন অঙ্কিত প্রাচীন প্রাচীরগাত্রে/ বৃষ্টির দেবতা শরৎ পুকুরে বেড়ায় ভেসে;/ বৃক্ষের অপদেবতায় রূপান্তরিত শতবর্ষী পেঁচার বাসায় যখন সবুজ অগ্নিশিখা উদ্‌গত হয় তখন শোনে সে হাসির শব্দ।' অদ্ভুত চিত্রকল্পে রচিত হয়েছে কবিতাটি। কবির অন্ধকার, মৃত্যু ও প্রেত চেতনা একান্তই ব্যক্তিগত এবং বিখ্যাত চৈনিক কবিদের নির্মল কল্পনা থেকে তা ভিন্ন। বস্তুত কনফুশীয়, টাওয়িস্ট ও বৌদ্ধ বিশ্বাসের পরিমণ্ডল থেকে নিজের দূরত্ব রচনা করে তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন অদ্ভুত কাব্যশিল্প। মধ্য ট্যাং যুগের হলেও তিনি অন্ত্য ট্যাং যুগের অমলিন বৈশিষ্ট্যে জ্যোতিষ্মান।

ট্যাং কবিতা প্রধানত প্রাচীন ও নব্য কাব্যপ্রকরণ অনুযায়ী লিখিত। ট্যাং যুগের পূর্বে অনুসৃত রীতি তথা অনিয়ন্ত্রিত অক্ষর সংখ্যা ও ছন্দশৈলী যোগে রচিত হয়েছে অনেক ট্যাং কবিতা। নব্য প্রকরণের মধ্যে লুশি ও জুয়েজু উল্লেখ্য। লুশি প্রকরণ অনুযায়ী আট পঙ্ক্তি দিয়ে ছন্দে রচিত হয় কবিতা এবং জুয়েজু প্রকরণ অনুযায়ী চার পঙ্ক্তির সমন্বয়ে ছন্দে সজ্জিত হয় কবিতার শরীর।

ট্যাং রাজবংশ সমকালীন জ্ঞাত পৃথিবীর সাথে ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক সূত্রে যুক্ত থাকায় কাব্যসাহিত্যে যেরূপ ঔজ্জ্বল্য সঞ্চালিত হয় তেমন উদ্ভাস পরিবাহিত হয় চিত্র, স্থাপত্য ও মৃৎশিল্পেও। চীনের বিভিন্ন জাদুঘর, বৃটিশ মিউজিয়াম, কোরিয়ার জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ট্যাং রাজবংশের শিল্পকলা ও স্থাপত্যের নিদর্শন একটি অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক রেনেসাঁসের পরিচয় অনুধাবনে যথেষ্ট সহায়ক বলে আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। বৃটিশ মিউজিয়ামে ট্যাং শাসনামলের মৃৎপাত্র প্রদীপ, পুষ্পদলের নকশাখচিত উজ্জ্বল মৃৎপাত্র ট্রে, ধূপদানি, মোমদানি, চীনামাটির স্টেম-কাপ, ব্রোঞ্জ পাত্র, সমাধি মৃৎপাত্র, ত্রিবর্ণরঞ্জিত জগ প্রভৃতি উন্নত শিল্পরুচির স্মারক হিসেবে গণ্য। ট্যাং সমাজে ইহজীবন ও পরজীবনে সম্পদের জাঁকালো প্রদর্শনীর প্রচলন ছিল। ফলে জীবদ্দশায় যেমন বর্ণিল পাত্র বা বাক্স ব্যবহার করা হত তেমনি সমাধির জন্য ব্যবহৃত হত বর্ণোজ্জ্বল মৃৎপাত্র। সমাধি মৃৎপাত্র ট্যাং সমাজের আন্তর চারিত্র্যকে উন্মোচন করে। উজ্জ্বল বর্ণশোভিত পাত্র ইরান অথবা সিরিয়া থেকে আহরণ করা হতো; এগুলোর শোভাকর মোটিফ গৃহীত হত ইরান এবং কেন্দ্রীয় এশিয়া থেকে। সাংকাই (Sancai) বা ত্রিবর্ণে সিসা-ঔজ্জ্বল্যের ব্যবহার মৃৎপাত্রকে অতিমাত্রায় আকর্ষণীয় করে তুলত । সাধারণত সবুজ, হলুদাভ বাদামি ও হলুদাভ শুভ্র রং মিলে ত্রিবর্ণ মায়াময় সৌন্দর্য সৃষ্টি করত। শৈল্পিক সমাধি পাত্র মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সম্মানের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত ছিল। কোরিয়ার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে ট্যাং যুগের একটি বৌদ্ধ স্তম্ভ (Buddhist Stele)। গাও ওয়ানহাই তাঁর মৃত পিতামাতার শান্তিপূর্ণ চিরবিশ্রামের জন্য আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় ৬৬০ খ্রিস্টাব্দে এ স্তম্ভ নির্মাণ করেন। সপ্তম শতকের ট্যাং স্থাপত্যে বোধিসত্ত্বের চিত্রায়ন একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

বৃটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত এশীয় প্রত্ন-নিদর্শন কবি এজরা পাউন্ডকে এশীয় সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি অনুরাগী করে তুলেছিল। শিল্প সমালোচক অধ্যাপক ফেনোলোসার টীকাভাষ্য অনুসরণে এবং অধ্যাপক মোরি ও অ্যারিগার অর্থোভেদ অনুযায়ী পাউন্ড ১৯১৫ সালে প্রাচীন চীনা কবিতার অনুবাদকর্ম 'ক্যাথি' (Cathay) প্রকাশ করেন। এ কাব্যে প্রাচীন চীনা কবিতা ও এ্যাংলো-স্যাক্সন যুগের 'সমুদ্রাভিযাত্রী' (The Seafarer) কবিতাসহ মোট ১৫ টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়। এ কাব্যগ্রন্থে চীনের অষ্টম শতকের ট্যাং কবি রিহাকু বা লি বাইকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। লি বাই এর দীর্ঘ কবিতা 'নির্বাসীর পত্র' (Exile's Letter)-সহ ১২টি অনুদিত কবিতা 'ক্যাথি' কাব্যে সংকলিত হয়েছে। পাউন্ড চীনা ভাষায় জ্ঞান লাভ করেননি। কিন্তু প্রাচীন

চীনা কবিতার অর্থঘনত্ব, রূপকল্পময়তা ও প্রতীকতা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিলো। তিনি আধুনিক ইংরেজিতে প্রাচীন চীনা কবিতার কথাবস্তুর অনুবাদ করেছেন মাত্র, ভাষান্তরিত কবিতাকে দৃঢ়সংলগ্ন করার জন্য তিনি চীনা ব্যাকরণ রীতির অনুগামী হতে পারেননি। পাউন্ডের অনুবাদে বিকিরিত চীনা কবিতার শক্তি ও দীপ্তির প্রশংসা করেছেন ডব্লিউ. বি. ইয়েটস, ফোর্ড ম্যাডোক্স ফোর্ড, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস ও টি. এস. এলিয়ট। ট্যাং কবিতার স্বপ্নডাঙা বাংলা ভাষার কবি ও কবিতাপ্রেমীগণকে ঝলকে ওঠা পথের সন্ধান দিতে পারে।

ট্যাং যুগে সম্রাট, প্রশাসক, সওদাগর, গবেষক, যোদ্ধা, নারী, শিশু, সন্ন্যাসী, টাওয়িস্ট যাজক, পরিব্রাজক, ভৃত্য, গণিকা সকলেই কাব্যচর্চা উপভোগ করতেন। স্থাপত্য, মৃৎশিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রশান্ত ধারায় সমাজ নিয়ত স্নাত হত বলে অভাবনীয় মানস সম্পদে ট্যাং যুগ পূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্তর্গত আনন্দের মূল্যবান উৎস হিসেবে আমরা ট্যাং কবিতার দিকে ফিরে তাকাতে পারি।

 

উদাহৃত রচনাবলি

1. Graham, A. C.. Poems of the Late T'ang. New York: New York Review Books, 1977.

2. Hinton, David. Classical Chinese Poetry: An Anthology. New York: Farrar, Straus and Giroux, 2008.

3. Shushe, Huangshan., ed. The Poetry of Tang Dynasty. Chinese Red. 2012.

4. The Analects of Confucius. Ed. Robert Eno. 2003, 2012, 2015. (www.indiana.edu)

5. Ting-Chen, Zhang and Bruce M. Wilson. 100 Tang Poems. Beijing: China Translation and Publishing Corporation, 1988.


শ্রেষ্ঠা সিনহা

 

রামায়ণ’-এর রামগাথার পরিবর্তন; আদি কবির রচনা থেকে পরবর্তী কবিদের ‘রামচর্চা’র ইতিকথা

 



‘শ্রীরাম চন্দ্র কৃপালু ভজমন।

হরণ ভব ভয় দারুণম্‌।। 

ষোড়শ শতাব্দীর খ্যাতনামা ব্যক্তি তুলসীদাস রচিত ‘রামস্তুতি’র বাংলা তর্জমা করলে দেখা যায়, দশরথাত্মজ রাম জন্ম-মৃত্যুর ভীষণ ভয়কে হরণ করেন, অতত্রব তিনি মনকে সততভাবে রামবন্দনায় নিয়োজিত হতে বলেছেন।এহেন ত্রিতাপহরণকারীর বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় সংস্কৃত ভাষায় রচিত বাল্মিকীর ‘রামায়ণ’-এ। ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্তরাগে প্রজ্জ্বলিত রয়েছে ‘রামায়ণ’ তথা ‘রাম’-এর কৃতিত্ব, তার ন্যায়পরায়ণতা সহ বিক্রমের কাহিনি। তবে ‘রামায়ণ’-এর আদি কবি রূপে বিশ্বসাহিত্যে বরেণ্য হয়েছেন কবি বাল্মীকিতাঁর প্রায় সহস্রাধিক বছর পরে রচিত হয় রাজকবি কম্বন প্রণীত ‘রামাভতারম্‌’। যা আবার ‘কম্ব-রামায়ণ’ নামেও পরিচিত সাহিত্যের দরবারে। ভিন্ন সময়ে দুটি সাহিত্যিক নিদর্শন রচিত হওয়ায় যুগগত প্রভেদের পাশাপাশি বিষয়বৈচিত্র্যেরও পরিচয় পাওয়া যায়।  

বাল্মীকি তাঁর কাব্যটিকে কাহিনিগত বিভাজন অনুসারে সাতটি পৃথক ভাগে বিভাজিত করেছেন, যথা; বাল কাণ্ড, অযোধ্যা কাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড, সুন্দর কাণ্ড, যুদ্ধ কাণ্ড এবং উত্তর কাণ্ড। অন্যদিকে কম্বনের ‘রামায়ণ’ বাল কাণ্ড, অযোধ্যা কাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড, সুন্দর কাণ্ড ইত্যাদি ৬টি বিভাগে বিভক্ত। আদি কবির রচনা অনুসারে অযোধ্যারাজ দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামের সঙ্গে মিথিলাপতি জনকের কন্যা সীতার বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় ‘হরধনু ভঙ্গ’-এর মাধ্যমে। বিবাহের পূর্বে উভয়ের সাক্ষাতের পরিচয় উল্লেখিত হয়নি কবির বর্ণনায়। অথচ ‘কম্ব রামায়ণ’-এ কবি রাম-সীতার এই বিবাহটিকে সম্পূর্ণরূপে প্রণয়ের জয়গাঁথা হিসাবে উপনীত করেছেন। ‘উজ্জ্বলনীলমণি’তেবর্ণিত ‘পূর্বরাগ’-এর উল্লেখ স্বরূপ পাত্র-পাত্রীদ্বয়ের প্রাক্-বিবাহ জনিত সাক্ষাতের কথা বলা হয়েছে।বিশ্বামিত্র মুনির অনুরোধে রাম যখন মিথিলায় যান সেই সময় সীতার সঙ্গে তাঁর সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ ঘটে। যা কম্ব-রামায়ণে নতুন উপকাহিনির সঞ্চার করে। অবশ্য বাল্মিকীর সঙ্গে কম্বনের সময়গত প্রভেদটিও এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। ‘রামাভতারম্‌’ রচনাকালে ‘রাম’ চরিত্রটি মহাকাব্যের গণ্ডি পেরিয়ে জনমানসে দেবতার ‘অবতার’ হিসাবে গৃহীত হয়েছে। নারায়ণের অবতাররূপী অযোধ্যার শাসক সেই সময় মানুষের আরাধ্যে রূপান্তরিত হয়। সম্ভবত সেই কারণেই এহেন কাহিনিগত রূপান্তর দেখা যায়। যার ফলে ‘সীতাহরণ’ এর ক্ষেত্রে ঘটনাক্রমের পরিবর্তন দেখা যায়। কবির সমসাময়িক কালে যেহেতু রাম নারায়ণ রূপে মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে ফলে তার স্ত্রী সীতাও,ক্ষ্মী দেবীর অবতার রূপে আরাধ্য হয়ে ওঠে তাই রাক্ষস কর্তৃক দেবী সীতার অপহরণ অথবা তার অঙ্গস্পর্শ সম্ভব নয়; ফলত কম্ব-রামায়ণেরাবণ কর্তৃক র্ণশালা সহ  সীতাহরণের বিবরণ পাওয়া যায়। আবার আদি কবি জটায়ুকে রামের অনুগত হিসেবে চিত্রিত করলেও কম্বন রামানুজরূপেজটায়ুকে দেখিয়েছেন এছাড়া অশোক বনে বন্দীনী সীতার মন-পরিবর্তনের জন্য রাক্ষসরাজ ‘মায়া-জনক’ও নির্মাণ করেন। আদি কবির বর্ণনায় এই হেন কোনো ঘটনার পরিচয় পাওয়া যায় না। বাল্মীকবির কলমে দশরথ পুত্র রাম পুরুষোত্তম হিসেবে চিত্রিত  হলেও তামিল ভাষায় রচিত কম্ব রামায়ণে দেবতা রূপে প্রতিবিম্বিত হয়েছে রাম  

প্রাগানুধিকযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি জনপ্রিয়তম শাখা অনুবাদ সাহিত্য যার সূত্রে রচিত হয় বাংলা রামায়ণ তথা কবি কৃত্তিবাস বিরচিত 'শ্রীরাম পাঁচালী' তুর্কি-বিজয় পরবর্তী সময়কালে অনুবাদ সাহিত্যের জন্ম হয়। নানান সংস্কৃত গ্রন্থাবলী, সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য অনূদিত হয় রামায়ণ, মহাভারত এবং ভাগবত সহ নানাম পৌরাণিক রচনা বাল্মীকি রামায়ণ রচিত হয়েছিল সমগ্র ভারতবাসীর জন্য তবে কৃত্তিবাসী রামায়ণ রচিত হয়েছিল বাঙালির জন্য। ফলত কাহিনি ক্রমের পাশাপাশি রাম চরিত্রের পরিবর্তনও দেখাযায়পূর্বে সংস্কৃত সাহিত্য বা রামায়ণ মহাভারত পাঠ করার জন্য কথকঠাকুরের প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য রচিত কৃত্তিবাসী রামায়ণে কবি লোক-শিক্ষার্থে কাব্য রচনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন,  

মুনি মধ্যে বাখানি বাল্মীকি মহামুনি

পন্ডিতের মধ্যে বাখানি কৃত্তিবাস গুণী।।

বাপ মায়ের আশীর্বাদ গুরুর কল্যাণ

বাল্মিকী প্রসাদে রচে রামায়ণ গান।।

সাত কান্ডের কথা হয় দেবের সৃজিত

লোক বুঝাইতে হইল কৃত্তিবাস পণ্ডিত।।'

অর্থাৎ সাধারণ জনমানসে রামকথা প্রচারিত করার জন্য তিনি গ্রন্থটি রচনায় অগ্রসর হয়েছেন বলে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন।  

এছাড়া সমকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে মানুষের পরিত্রাণের একটি পথও নির্দেশ  করতে চেয়েছিলেন কৃত্তিবাস;

মরা মরা বলিতে আইলো রাম নাম

পাইলে সকল পাপে দস্যু পরিত্রাণ।।

তুলা রাশি কেমন অগ্নি ভস্ম হয়

একবার রাম নামে সর্ব পাপ ক্ষয়।।

ম্বনের রামায়ণের ন্যায় কৃত্তিবাসী রামায়ণেও বিষ্ণুর অবতার হিসেবে রাম চিত্রিত হয়েছেযদিও অনুবাদের পরিবর্তে কবির স্বকীয় ভাবনার প্রগাঢ়তা সমগ্র কাব্য জুড়ে লক্ষ্য করা যায়।  মূল রামায়ণ থেকে কাহিনি গ্রহণ করলেও বাঙালি জাতির ভাবনাকে মর্যাদা দান করতেই কৃত্তিবাস বাংলা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য প্রতিবিম্বিত করেন রাম চরিত্রের মাধ্যমে

তাই সংস্কৃতেরপুরুষোত্তমরাম বাঙালির কাছে দেবতারামে পরিণত হয়। আদি কবি  রামায়ণে দেখা যায় রচয়িতা সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর কাব্য রচনা করেছেন অথচ কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুসারে রাম জন্মের ষাট হাজার বছর আগেই বাল্মিকী রামায়ণ রচিত হয়েছিল বলে জানা যায়,

রাম জন্ম পূর্বে ষাটি সহস্র বৎসর

অনাগত পুরাছিল মুনিবর।।



তাছাড়া বাংলার রামায়ণে বাংলার লোকসাহিত্যের নিজস্ব ছন্দ স্বরূপ পাঁচালীর প্রয়োগ দেখা যায়। আসলে কৃত্তিবাসী রামায়ণে ভক্তিরস এবং হাস্যরসের মেলবন্ধন ঘটেছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ভক্তি রসের প্রাবল্য দেখা যায় শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবাসী যেন রাম ও কৃষ্ণের নানান পৌরাণিক কাহিনি মাধুর্যে মোহিত হয়ে কালযাপন করত পরে রাজা গণেশ এবং তাঁর পুত্রের শাসনকালে বিজাতীয় শাসকের আগ্রাসন এবং ধর্মান্তরিতকরণের বিষয়টিও লক্ষ্যণীয়। তাই সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষকে একত্রিত করার একটি প্রয়াসও দেখা যায়। যার ফলে দেশীয় পাঁচালী ছন্দে রামকথা জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাঙালির নীতিকথা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিচয় স্বরূপ অহল্যার শাপমুক্তিকিংবা লক্ষণের গণ্ডিদান প্রসঙ্গের কথা বলাই যায়। সংস্কৃত রামায়ণে অলংকার এবং উপমার গাম্ভীর্য দেখা যায়। তবে কৃত্তিবাসী রচনায় বাংলার চিরায়ত ঘরানার পরিচয় মেলে; ‘কলার বাগুড়ি’ এবং ‘কুমোরের চাক’ ইত্যাদি প্রসঙ্গের সংযোজন তার স্বপক্ষেই যুক্তি দেয়। বাংলা ছন্দ রীতির বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মেলে যখন কবি রামের পদাপর্ণের কথা বলেন-

‘শ্রীরাম আইল দেশে পড়ে গেল সাড়া।

ঝা গুড়গুড় বাদ্য বাজে নাচে চণ্ডাল পাড়া।।

অথবা,

‘ডাল ভাঙ্গে হনুমান শব্দ মড়মড়ি।

আতঙ্কে রাক্ষস সব উঠে দড়বড়ি।।”

এক্ষেত্রে উভয় পঙ্‌ক্তিতে অনুপ্রাস এবং ধন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কাহিনি বর্ণনা প্রসঙ্গেও কবির স্বকীয় ভঙ্গিমা প্রকাশিত হয়েছে। গ্রিক তাত্ত্বিক অ্যারিস্টটল গুরু প্লেটোর বিরোধিতা করে সাহিত্য বা কাব্যকে অনুকরণের পরিবর্তে ‘পূরণকারক সত্য’ রূপে নির্দেশিত করেছিলেন। তাঁর মতানুসারে মানব জীবনে যে কোনো বিষয়ে আয়ত্ত করার প্রথম এবং প্রধান মাধ্যম হল অনুকরণ, যা তাঁর মতানুসারে ‘মাইমেসিস’ নামে অভিহিত। ফলত কবি বা সাহিত্যিক বাস্তবিক জীবনে ঘটে যাওয়া কিংবা অতীতে ঘটে কোনো ঘটনার থেকে উপাদান সংগ্রহ করে সাহিত্য রচনায় অগ্রসর হন। এক্ষেত্রে ঘটনাবলীর মধ্যে থাকা ঈষৎ ফাঁক-ফোঁকর অথবা তথ্যের পরিপূরণ করেন কবিরা তাঁদের অর্ন্তদৃষ্টির মাধ্যমে। ফলত ইতিহাসের তথ্যের পরিবর্তের কাব্যের সত্য ‘পরিপূরক’ রূপে প্রতিভাত হয়। তাই হয়তো কৃত্তিবাসী রামকথা অনূদিত গ্রন্থের পরিবর্তে স্বতন্ত্র কাব্য হিসাবেই সমাদৃত হয়েছে। কবি-প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসুর মতে, “বলা বাহুল্য, কৃত্তিবাস বাল্মীকির বাংলা অনুবাদক শুধু নন, দেব দানব রাক্ষসেরা শুদ্ধু মধ্যযুগীয় গৃহস্থ বাঙালি চরিত্রে পরিণত হয়েছেন, গ্রন্থটির প্রাকৃতিক এবং মানসিক আবহওয়া একান্তই বাংলার। এ-কাব্যে বাঙালির মনের মতো হতেও পারে, এমনকি বাংলা সাহিত্যে পুরাণের পুনর্জন্মের প্রথম উদাহরণ বলেও গণ্য হতে পারে, কিন্তু এর আত্মার সঙ্গে বাল্মীকির আত্মার প্রভেদ রবীন্দ্রনাথের ‘কচ ও দেবযানী’র সঙ্গে মহাভারতের দেবযানী-উপাখ্যানের প্রভেদের মতোই, মাপে ঠিক ততটা না-হলে জাতে তা-ই।’’

সংযোজনের পাশাপাশি বেশ কিছু বিয়োজনও লক্ষ করা যায়। আদিকবি কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ডে  বর্ষা এবং শরৎ ঋতুর প্রসঙ্গ বিবৃত করেছেন। আসলে সীতাহরণ, বালিবধ এবং ভাবী যুদ্ধের বার্তাবাহী ক্রমালাপের মধ্যে একটু দিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা ছিল; ‘বনবাসের দুঃখ, সীতা-হারানোর দুঃখ, বালীবধের উত্তেজনা ও অবসাদ—সমস্ত শেষ হয়েছে, সামনে পড়ে আছে মহাযুদ্ধের বীভৎসতা; দুই ব্যস্ততার মাঝখানে একটু শান্তি, সৌন্দর্য-সম্ভোগের বিশুদ্ধ একটু আনন্দ। এই বিরতির প্রয়োজন ছিল সকলেরই—কাব্যের, কবির এবং পাঠকের, আর সবচেয়ে বেশি রামের।’’ সেক্ষেত্রে ‘নরোত্তম রাম’-এর বিষয়টিও স্মরণযোগ্য। কৃত্তিবাসের বর্ণনায় রামের মধ্যে দৈবিক সত্তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাই এহেন বিরতিজনিত বিষয়টিকে বিধৃত করার পরিবর্তে বিয়োজনকেই নির্বাচন করেছেন কবি।

তারপর ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’-র কবি রূপে দ্বিজ বংশীদাস সুতা চন্দ্রাবতীর পরিচয় পাওয়া যায়প্রাগাধুনিকালে তাঁর কলমেই ‘রামায়ণ’-এর নতুন বিবরণ পাওয়া যায়। বস্তুত রামায়ণের  মূল কাহিনির পাশাপাশি নারীর দৃষ্টিতে ‘সীতায়ন’-এর পরিচিতি মেলে। যদিও অসম্পূর্ণভাবে গ্রন্থটি পাওয়া যায়। সেখানে সীতার জন্ম, রামের জন্ম এবং সীতার বনবাসের বিশদ বর্ণনা  পাওয়া যায়।

ভূমিজা সীতার জন্মবৃত্তান্তটিও অভিনব ভঙ্গিমায় তুলে ধরেছেন চন্দ্রাবতী। স্বপ্নদর্শনের মাধ্যমে কবি জানান সতা নামক এক ধীবর রমণী কৌটের মধ্যে রাখা ডিম্বটি ভেদ করে এক অপূর্ব সুন্দরী কন্যার জন্ম হয়। ধীবর বধূর নামানুসারে সেই কন্যা সীতা নামে পরিচিত হয়।মঙ্গলকাব্য ধারা অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রূপে সমাদৃত বারামাস্যারও পরিচয় মেলে এক্ষেত্রে। বনবাসে থাকাকালীন নানা সময়ের সাপেক্ষে বয়ে চলা নানান সুখদুঃখের ইতিকথা সীতার জবানীতে উল্লেখিত হয়েছে। মূলত স্বপ্ন-দর্শনের মাধ্যমেই ঘটনাপ্রবাহ সঞ্চারিত হয়েছে;

“মাঘ মাসেতে আমি গো দেখিনু স্বপন।

রণে মরে ইন্দ্রজিত গো রাবণ নন্দন।।

স্বপন সফল হইল গো লঙ্কা ছারকার।

সাগরের কূলে শুনি গো রাক্ষসের হাহাকার।
ফাল্গুন মাসেতে আমি গো দেখিনু স্বপনে।

সবংশে মরিল রাবণ গো শ্রীরামের বাণে।

স্বপন সফল হইল গো দুঃখের দিন যায়।

বানর কটক শুনি গো রামগুণ গায়।।

চৈত্র মাসেতে সীতার গো দুঃখ হইল দূর।

পোহাইল দুঃখের নিশি গো আইল সুখ ভোর।।

অন্ধেতে পাইল যেমন গো নয়নের মণি।

তেমতি দুঃখিনী সীতা গো পাইল রঘুমণি।।

সীতার বারোমাসী কথা গো দুঃখের ভারতী।

বারোমাসের দুঃখের কথা গো ভনে চন্দ্রাবতী।।’’

এছাড়াও ‘কুকুয়া’ নামক কৈকেয়ী কন্যার সংযোজনও লক্ষ করা যায় চন্দ্রাবতীর লেখনীতে। একজন নারীর দুঃখ-যাতনা জনিত দুর্বিপাকের ক্ষেত্রে যে অন্য নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য সেটি এক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। কুকুয়ার অনুরোধে সীতা তালপাতায় মন্দোদরীপতি রাবণের চিত্রাঙ্কন করেন। অসাবধানবত সেটি নিজের কাছে রেখে নিদ্রাগত হন সীতা। সেই সুযোগে কুকুয়া রামের কাছে ভাতৃবধূর চরিত্রগত স্খালন তুলে ধরেন। ফলশ্রুতিতে গভীর বনে নির্বাসিত হন জানকী। কবির ব্যক্তি-জীবনের ছায়ায় প্রতিফলিত হয়েছে এক্ষেত্রে। রামায়ণের রাম ও সীতার প্রণয়ের অপূর্ণতা যেন চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দের প্রণয়ের অসম্পূর্ণতাকেই নির্দেশ করে। পরমারাধ্য রামের দৈবি প্রভাব যেন এক্ষেত্রে খণ্ডিত হয়েছে। চিরায়ত পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এক নারীর কথালাপ বিধৃত হয়েছে কাব্য সমগ্রে। কবি নবনীতা দেবসেন এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন; ‘বিবৃতিকার রূপে সীতা এবং চন্দ্রাবতীর প্রভেদ এই যে, কাহিনির চরিত্র, অপরজন বহিরাগত। দুটি স্বতন্ত্র ভূমিকা ও দৃষ্টিকোণ ছাড়াও, তাঁদের জগত-সম্পর্কিত নীতিও পৃথক। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মূল আদর্শের যোগ্য প্রতিনিধি সীতা, কিন্তু চন্দ্রাবতী একজন বিদ্রোহী নারী।”১০ ফলত নারায়ণরূপীর রামের শৌর্য-বীর্যের ক্ষীণ প্রভাব ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণে’র অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক।

এছাড়াও ষোড়শ শতকে রচিত অদ্ভুত আচার্যের ‘রামায়ণে’ বাল্মিকীকে ভগবান বিষ্ণুর রাম রূপ প্রদর্শনের কথাও পাওয়া যায়। আবার রামানন্দ ঘোষের ‘নূতন রামায়ণ’ গ্রন্থে বুদ্ধরূপে প্রদর্শিত হয়েছে ‘রাম’ চরিত্রটি। আবার রঘুনন্দন বিরোচিত ‘রাম রসায়ন’ গ্রন্থে পরাক্রমী রামের পরিবর্তে প্রেমিক রামের পরিচয় পাওয়া যায়। সীতার বিরহ অংশে বৈষ্ণবীয় বিরহজাত ঘটনার পরিচয় মেলে। তবে বাংলা তথা বাঙালির রাম-ভাবনায় ‘নীলাম্বুজশ্যামকোমলাঙ্গ’ রাম পরিণত হয়েছে ‘নবদূর্বাদল শ্যামের’ গাত্রবর্ণে। এছাড়া বাঙালি জাতিগত দৈহিক লক্ষণও প্রত্যক্ষ করা যায় এক্ষেত্রে।



পরবর্তী সময়ে উত্তর এবং উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন ভাষা, যেমন- অসমীয়া, ওড়িয়া, হিন্দি ইত্যাদির পূর্বে দক্ষিণ ভারতের তিনটি প্রাদেশিক ভাষায় রামায়ণ রচিত হয় জৈন ঐতিহ্য অনুসারে প্রথম প্রাদেশিক ভাষার রামকথা কর্ণাটক ভাষায় পম্পা রামায়ণ হিসাবে রচিত হয়। তেলেগু ভাষার রাম কথার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় তিক্কনের নির্বাচনত্তোর রামায়ণ গ্রন্থে অসমীয়া  ভাষায় মাধব কন্দলি এবং শংকরদেবের রামায়ণের কথাও প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য আবার ওড়িয়া ভাষায় রামকথা পুরাণ এবং কাব্য দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে রচিত হয় সংস্কৃত রামায়ণ অবলম্বনে মহাকবি সারলা দাস, বলরাম দাস, কৃপাসিন্ধু দাস প্রমুখ রামায়ণ রচনায়  অগ্রসর হন পরবর্তীতে কৃষ্ণচন্দ্র রাজেন্দ্র কৃষ্ণচরণ পট্টনায়ক প্রমূখ কবি সাহিত্যিকদের কলমে রামায়ণের অমর কাহিনি

ভারতীয় আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট সহ জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গস্বরূপ রামায়ণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অবশ্যই প্রসঙ্গে বাল্মিকী রামায়ণের ব্রহ্মা কর্তৃক বাল্মীকির আশীর্বাদ দানের প্রসঙ্গটিও উল্লেখযোগ্য

যাবত স্থস্যান্তি গিয়ঃ সরিত মহীতলে

তাবৎ রামায়ণ কথা লোকেষু প্রাচরিষ্যতি।।১১ 

অর্থাৎ পৃথিবীতে পাহাড়-পর্বত সহ নদ-নদী যতদিন থাকবে ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে রামায়ণের কাহিনি, লোকমুখে প্রচারিত অপসারিত হবে

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রামায়ণকে ভারতীয় যুব সমাজের চরিত্র গঠনের অন্যতম সহায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় স্বতন্ত্রভাবে রচিত রাম গাথা তার স্বপক্ষেই সাক্ষ্য দেয়রামায়ণের এহেন বিশেষত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন, 'রামায়ণের প্রথম বিশেষত্লেছেন্‌ তা ঘরের কথা কে অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখায়ইছে। পিতা-পুত্র-ভ্রাতায়-ভ্রাতায়-স্বামী-স্ত্রীতে যে ধর্মের বন্ধন, যে প্রীতির সম্বন্ধ,  রামায়ণ তাহাকে এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে তা অতি সহজে মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছেদেশ-জয়, শত্রুবিনাশ, দুই প্রবল বিরোধী পক্ষের প্রচন্ড আঘাত-সংঘাত এই সমস্ত ব্যাপারে সাধারণত মহাকাব্যের মধ্যে আন্দোলন ও উদ্দীপনা সঞ্চার করিয়া থাকে। কিন্তু রামায়ণের মহিমা রাম-রাবণের যুদ্ধকে আশ্রয় করে নাই, সে যুদ্ধ ঘটনা রামসীতার দাম্পত্য-প্রীতকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষ্যমাত্র; পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যত, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, পতি-পত্নীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও রাজার প্রতি রাজার কর্তব্য কত দূর পর্যন্ত যাইতে পারে রামায়ণ তাহাই দেখাইতেছে। এইরূপ ব্যক্তি-বিশেষের প্রধানত ঘরে সম্পর্ক গুলি কোন দেশের মহাকাব্যে এমন ভাবে বর্ণনীয় বিষয় বলে গণ্য  হয় নাই১২  

ফলত নরোচন্দ্ররাম পুরুষোত্তম রাম চরিত্রটি যুগে যুগে সময়ের কালপ্রভা অনুসারে বিষ্ণু অবতার বা দৈবি-শক্তির আধারে পরিণত হয়েছে। সেই সূত্রেই সাহিত্যের বিভিন্ন স্তরে বিধৃত হয়েছে রাম বৃত্তান্ত। যার মাধ্যমে আদি কবির রচনা থেকে উত্তর কালের কবিদের রচনায় রাম চর্চার এক প্রবাহমান ধারার পরিচয় পাওয়া মেলে 

 

তথ্যসূত্র;


1.    https://hindi.webdunia.com/ram-navmi-special/ram-stuti-117040100037_1.html

2.    বেণীমাধব শীল(সম্পা), ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’, কলকাতা, অক্ষয় লাইব্রেরি, পৃ ২৯

3.    তদেব, পৃ ৩৫

4.    তদেব, পৃ ৩৮

5.    তদেব, পৃ ৬৭

6.    তদেব, ৩৩৮

7.    বুদ্ধদেব বসু, ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ সঙ্কলন’, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, পৃ ১০

8.    তদেব, পৃ ১২

9.    হিমেল বরকত(সম্পা), ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ও প্রাসঙ্গিক পাঠ’, ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, পৃ ৩৮

10. হিমেল বরকত(সম্পা), ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ও প্রাসঙ্গিক পাঠ’, ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, পৃ ১২২

11. ড. প্রদ্যোত বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস’, কলকাতা, নিউ আদ্যাশক্তি প্রিণ্টার্স, পৃ ৩৬  

12. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘প্রাচীন সাহিত্য’, কলকাতা, বিশ্বভারতী, পৃ ৯