কালিমাটি অনলাইন / ১৩৩ / ত্রয়োদশ
বর্ষ : ষষ্ঠ সংখ্যা
যাঁরা বাংলাসাহিত্যের, বিশেষত বাংলা নাট্যসাহিত্যের অনুরাগী, তাঁরা জানেন যে, বাংলা ভাষায় অর্থাৎ বাংলা সংলাপে যে দুটি নাটক প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল, The Disguise ও Love is the best Doctor, তা বাংলাভাষায় লিখিত মৌলিক নাটক ছিল না। বরং তা ছিল অনূদিত নাটক। ১৭৯৫ সালে শ্রদ্ধেয় রাশিয়ান নাট্যব্যক্তিত্ব হেরাসিম লেবেডেফ এই দুটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে এদেশীয় পাত্র-পাত্রীর দ্বারা অভিনয় করান। নাটক দুটি অভিনীত হয়েছিল তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ নাট্যমঞ্চে, যার অবস্থান ছিল তৎকালীন কলকাতার ডোমতলায়, বর্তমান এজরা স্ট্রিটে। বাংলাভাষায় লিখিত প্রথম মৌলিক নাটক ছিল ১৮৫২ সালে তারাচরণ শিকদার রচিত ‘ভদ্রার্জুন'। এছাড়া ১৮৫২ সালে যোগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্তর লেখা ‘কীর্তিবিলাস' নাটকের উল্লেখ পাওয়া যায় বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে। আর এভাবেই বাংলাভাষায় লেখা নাটকের জয়যাত্রা শুরু হয়। নাটক লিখতে এগিয়ে আসেন ঊনবিংশ শতাব্দীর তৎকালীন বাংলার অসংখ্য নাট্যকার ও সাহিত্যিকরা, যাঁদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখ করা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের, রামনারায়ণ তর্করত্ন, মীর মশাররফ হোসেন, মনমোহন বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজকৃষ্ণ রায়ের নাম। পরবর্তী সময়ে আমরা নাট্যকার হিসেবে পেয়েছি অমৃতলাল বসু, বিজন ভট্টাচার্য, বিধায়ক ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, বাদল সরকার, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, রতন ঘোষ এবং আরও অনেককে, যাঁদের লেখায় বাংলা নাট্যসাহিত্যের স্বর্ণযুগের সন্ধান আমরা পাই। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা জরুরি, আমার লেখা এই সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয় নিবন্ধে আমি শুধুমাত্র নাটক লেখার দিকটি সম্পর্কে আলোচনা করেছি, নাটক মঞ্চস্থ হবার দিকটি এখানে অনালোচিত। আসলে আমি বাংলা নাটকের সাহিত্যের কথা বলতে চেয়েছি, অভিনয়ের ব্যাপারে নয়। আপনারা সবাই অবগত আছেন যে, যে কোনো ভাষায় রচিত নাটকের দুটি পর্ব থাকে, একদিকে পাঠ্য অন্যদিকে অভিনয়। অর্থাৎ নাটক পাঠের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, যা সাহিত্যের অন্তর্গত, এবং সেজন্যই তা নাট্যসাহিত্য। ওপরে প্রাসঙ্গিকভাবে যেসব সাহিত্যিক ও নাট্যকারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের রচিত প্রত্যেকটি নাটক ছিল পাঠ্যের অন্তর্গত। যেমন কবিতা, গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ সবাই পাঠ করে থাকেন, অনুরূপভাবেই একসময় পড়া হতো নাটক। শুধুমাত্র পড়ার অভিলাষেই তাঁরা পড়তেন, নাটক দেখার প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে আসছে না।
যদিও আমরা জানি যে, নাটক লেখা হয় মঞ্চস্থ করার জন্যই, কিন্তু একথা জানা নেই, যত নাটক লেখা হয়, সেই সব-নাটকই মঞ্চস্থ হয় কিনা! যদি মঞ্চস্থ না হয়, যাঁরা শুধুমাত্র নাটক দেখেন, পড়েন না, তাঁরা সেইসব নাটক থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থাকেন। তবে এটা ঘটনা যে, ইদানীংকালে নাট্যমঞ্চে যেসব দর্শকরা নাটক দেখতে যান, তাঁদের তুলনায় নাটকের পাঠকসংখ্যা শুধু কম বলা ঠিক হবে না, বরং বলতে হয়, সেই সংখ্যা হাতেগোণা। সম্ভবত নাটকের কুশীলবরা ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু একটা সময়, এই তুলনামূলক সংখ্যাটা বিপরীত ছিল। সেইসময় যাঁরা নাটকের দর্শক ছিলেন, তাঁদের তুলনায় নাটকের পাঠক ছিলেন অনেক অনেক বেশি। যেভাবে তাঁরা সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগ পাঠ করতেন, নাটকও যেহেতু সাহিত্যের অন্তর্গত, তাই নাটকও সমান আগ্রহে পাঠ করতেন। এবং এই প্রাসঙ্গিকতায় ইস্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির সাহিত্যের সিলেবাসে নাটক অনিবার্য বিষয় ছিল, এবং এখনও আছে। কিন্তু ভাবতে আশ্চর্য লাগে, ইদানীংকালে একাডেমিক শিক্ষা ব্যতিরেকে সাধারণ পাঠক-পাঠিকারা নাটকপাঠ করেন না! কেন করেন না, কী কারণ আছে, তা আমাদের জানা নেই, নাটকের বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে আলোকপাত করবেন আশাকরি। আমরা কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনে ইতিপূর্বে নাটকের একটি বিভাগ শুরু করেছিলাম, যেখানে ছোট ছোট নাটকের কয়েকটি স্ক্রিপ্ট প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, বিভাগটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ, একদিকে যেমন নাট্যকাররা বিনীত অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও নাটকের স্ক্রিপ্ট পাঠাতে উৎসাহিত হননি, অন্যদিকে পাঠক-পাঠিকাদের পক্ষ থেকেও প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায়নি। বাংলা সাহিত্যের অন্তর্গত অন্যতম বিভাগ নাট্যসাহিত্যের এই পরিণতি আমরা মেনে নিতে পারছি না। বাংলা নাটকের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্বরা যদি এই সংকট মোচনে এগিয়ে না আসেন, তাহলে বাংলা নাট্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারে ডুবে যাবে, এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com
দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675