কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩২ |
খেলনা গাড়ি, কুকুর আর মানুষ
খেলনার গাড়ি, তবে বেশ গাট্টাগোট্টা চেহারা। মিলিটারি গাড়ির ছাঁদে বানিয়েছে, রংটাও পাটকিলে-সবুজ। তা ফুট-দুএক লম্বা, বহরে দশ ইঞ্চি মতো হবে। গাড়িতে ব্যাটারি আছে আর একে দূর থেকে চালানো যায়। রিমোট কন্ট্রোল আর কি। চলে অসম্ভব দ্রুত গতিতে, দেখলে ভয় করে। এ জিনিস এদেশে দেখিনি তবে এতদিনে এসে গেছে নিশ্চয়ই। দেখলাম ওদেশের পার্কে। ভীষণ গতিতে খোলা মাঠে ঘুউউউ শব্দে ছুটছে। মাঠের ধারে পায়ে হাঁটার বাঁধানো রাস্তা, সেখানে টাল সামলাতে না পেরে গাড়ি উল্টে গেল। চাকা তো ঘুরছে – মনে হচ্ছে যেন সে রেগে ফুঁসছে। এমন সময় দেখলাম একটা কালো কোট পড়া লোক, লম্বা-চওড়া চেহারা, হাতে একটা ছোট বাক্স মতো, এসে পড়ল। গাড়ি উল্টে যাওয়াতে সে ভারি বিরক্ত। লাথি মেরে তাকে সোজা করে আবার রিমোট-কন্ট্রোল দিয়ে দুর্বার বেগে ছোটাতে লাগলো।
পার্কের আরেক দিকে একটা পরিবার এসেছিল – বাবা, মা, একটি বালক, একটি বালিকা আর সঙ্গে পোষা ছোট্ট লোমওয়ালা কুকুর। সকলে গাছের ছায়ায় শতরঞ্চি পেতে বসে বাড়ি থেকে আনা কফি আর খাবার খেতে খেতে হাসি-ঠাট্টা-গল্প-গুজবে মেতেছিল।
কুকুর গাড়িটা দেখে মনে করল ওটা একটা প্রাণী, তার খেলার সাথী হতে পারে। কুকুর যত ছোটে, গাড়ি তত দৌড়ে এগিয়ে যায়। যখনই কাছে এসে পড়ছে তখনই ওই কালো-কোট গতি বাড়িয়ে বা ডান-দিক বাঁ-দিকে ঘুরিয়ে গাড়িটাকে অধরা করে রাখছে। মিনিট দুয়েক কুকুরটা খুব চেষ্টা করল। খুব। তারপর বুঝল এ জিনিসটা অন্য রকম, এ তো প্রাণী নয় একে চালাচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তি। সব প্রাণীদের মধ্যেই শুভ-অশুভ ভালো-মন্দের একটা অনুভূতি থাকে, কুকুরেরও আছে। এই গতির প্রলোভন, সর্বশক্তি দিয়ে ছুটেও নাগাল না পাওয়া, এই আশ্চর্য যন্ত্রের না-বুঝতে-পারা অসীম ক্ষমতা – তার মোটে ভালো লাগলো না। সে গাড়ির পেছনে আর না ছুটে ফিরে গেল ছায়ায় পাতা শতরঞ্চিতে। বালিকাটি একটা বিস্কুট না কি যেন দিল – সে আধশোয়া হয়ে পরম শান্তিতে চিবতে লাগল।
ভাবছিলাম চারপেয়ে জীবটির ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগলো মিনিট দুয়েক।
মানুষের বুঝতে কত সময় লাগবে? হয়তো তারা বুঝেছে কিন্তু কীই বা করবে। জীবিকা আছে, পাড়া-প্রতিবেশি আছে, সংসার আছে, এক-আধটু উচ্চাশাও তো আছে। আগে তবু গাছের ছায়ায় বসার জায়গাটুকু ছিল। সে দশ ফুট বাই দশ ফুট শতরঞ্চিটা কারা যেন কেটেকুটে ছোট করে দিয়েছে। তাদের কেউ কেউ আবার শতরঞ্চি কাটার কাঁচি হাতে নিয়ে জোর গলায় বলছে শতরঞ্চিতে বৌ-ছেলেপিলের সঙ্গে অতক্ষণ বসার কী আছে? চটপট উঠে পড়ে খেলনা গাড়ির পেছনে ছুটতে থাক তোরা। থামবি না। থামলেই কিন্তু শেষ হয়ে যাবি সেটা খেয়াল রাখিস!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন