কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

প্রশান্ত গুহ মজুমদার

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩২


বিসর্জন

এই সময়টা সুলেখার খুব প্রিয়। সন্ধ্যা যখন রাত্রিকে ক্রমে জড়িয়ে ধরছে। হালকা বাতাস। শিশির পড়বে কিনা, দ্বিধায়। এমন আবহে কিছুটা নিজেকে দেখা, সেই সঙ্গে কিছু বিষণ্ণতা। আসলে বোধহয় অতীতের অনেক  প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির স্মৃতি, এই আলোঅন্ধকার তাকে এমন। আর সুলেখা ছাদের আলসেয় ৬৫র শরীর বিছিয়ে একা একা দ্যাখে, মধ্য কার্তিকের চাঁদ উঠে আসছে।

ও অপেক্ষা করে। অপেক্ষাই তো তার এখন মূলধন। সবার জন্য অপেক্ষা করে। সকালে সবিতার জন্য, তারপর অর্কের জন্য, ক্রমে দুধ, সবজিওয়ালা, মাছ। দিন ফুরোয়। ওর জন্য কারো কোনো অপেক্ষা নেই। অর্কের এম.আর-এর কাজ। সকালে বেড়িয়ে যায়, ফেরার ঠিক নেই।

সুলেখা এই দুজনের সংসারে সারাদিন তবে কী বা করে? ও এক নেশায় ডুবিয়ে দেয় নিজেকে। ছবি  আঁকে। একই সঙ্গে কালী এবং কুন্তীর। ডিমাই সাইজের কাগজে প্যাস্টেলে, জলরঙে। কালীর, কখনো কুন্তীর। সঙ্গে গুনগুন প্রতিমা বড়ুয়া অথবা আব্বাসউদ্দীন-এর গান। সুলেখা কি ছবি সত্যিই আঁকে, নাকি এক স্বাধীন অথচ উপলব্যথিত জলস্রোতের যাওয়া! ও নিশ্চিত নয়। তবে তুলিতে, রঙে এঁকে চলে নানান সংকট, সংঘাত, সংহার। ছবিতে মিশে যায় দৃঢ স্পর্ধা।

ছোটবেলায় গান শিখতে চেয়ে বাড়িতে মার খেয়েছিল। মঞ্চে সুলেখা যে অভিনয় করতে পারে, বিয়ের পর এটা কাউকে বোঝাতে পারেনি। অর্ক ওদের দুজনের জীবনে আসার পর জীবনটা যেন কেমন আরো গন্ডীর মধ্যে ঢুকে গেল। ন'বছর পর অলক হঠাৎ চলে গেল। বত্রিশ বছর হয়ে গেল। ওর নাকি সুলেখাকে যোগ্য মনে হচ্ছিলো না। বাড়িটা অর্কের নামে দিয়ে গিয়েছিল। তবু বাড়ির জানালাগুলো ধীরে ধীরে কেমন বন্ধ হয়ে এলো।

প্রচুর বাজি ফাটছে। সারা আকাশ জুড়ে আলোর যে কতরকম কায়দা, সুলেখা অবাক হয়ে যায়। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে! দশমীর চাঁদ এতো সবের পাশে কেমন যেন ম্লান। খুব ধীরে, খুব সংকোচে উঠে আসছে কালো গালিচার একপাশে। দুটো তিনটে তারা। তার মধ্যে একটা, সুলেখা চেনে, শুকতারা। ঠাকুমা বল তো, এই পৃথিবী ছেড়ে মানুষ একদিন তারা হয়ে যায়। যতো স্বজন তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, তারা কি সবাই ঐসব তারা!

মোবাইলে দেখলো, দশটা বাজে প্রায়। অর্ক এখনো আসছে না কেন! মোবাইল তো বাজেনি! সারাদিন ধরেই আজ মাথাটা বড্ড ধরে আছে। মাঝেমধ্যে যেন অন্ধকার। সুলেখা আজ আর ছবি নিয়ে বসবে না। অর্ক এলেই খাওয়া সেরে শুয়ে পড়বে। কিন্তু অর্ক! ভাবতে ভাবতেই ফোন। অর্কের ফোন। - হ্যাঁ বাবা, বল। - নিচে। দরজাটা খোলো। -এই যাচ্ছি। একটু দাঁড়া। সিঁড়ির আলোটা আজ জ্বালতে ভুলেছে। টলমলে মাথা নিয়ে, পৃথুল শরীর নিয়ে, ৬৫ বছরের তাবত স্মৃতি নিয়ে সুলেখা ছেলের জন্য দরজা খুলতে দ্রুত নামতে চেষ্টা করলো। বড়ো অন্ধকার। ছেলে ডাকছে। বাবা! অন্ধকারে আরো একটা ফানুস উড়লো, নাকি এক নতুন তারা!

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন