জ্যোতিষশাস্ত্র পারদর্শী সহদেব
ভারতীয় মহাকাব্য ‘মহাভারত’ বিনা,
ভারত-সাহিত্যের কোনো অস্তিত্বই নেই— এমনই কথাই প্রচলিত এদেশের প্রাজ্ঞ, বৌদ্ধিক ও গবেষক
মহলে। এই একই সারিতে রামায়ণের মতো একটি মহাকাব্য থাকা সত্ত্বেও কেন মহাভারতকেই এই
শিরোপা দেওয়া হয়, সেটি নিয়েও বিতর্ক আছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, চরিত্রগত দিক
থেকে এবং সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটের বিচারে এই মহাগ্রন্থটি
অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যার বাস্তব আবেদনও রামায়ণের থেকে অনেক বেশি সজীব। বলাবাহুল্য,
সেই মহাভারতের প্রতিটি চরিত্রই ব্যাসদেবের
মননে এমন এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত
হয়েছে, এবং এটাই স্বাভাবিক। তাই প্রত্যেকটি চরিত্রই হয়ে উঠেছে এক-একটি ভিন্নধর্মী
গুণের আধারে। তেমনই একটি চরিত্র সহদেব।
সহদেবকে মহাভারতে পাণ্ডবকুলের শুধু
অন্যতম একজন দক্ষ যোদ্ধা হিসাবে নয়, একজন জ্যোতিষ বিশেষজ্ঞ হিসেবেও দেখানো হয়েছে।
যদিও কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত ভারতকথার মূল লক্ষ্য ধর্মযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে
এই উপমহাদেশে ন্যায়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠা, তাই এই মহাকাব্যের গোটা পটভূমি জুড়ে ন্যায়
অন্যায় ধর্ম পালন, বীর যোদ্ধাদের গুণকীর্তন এবং সমাজ জীবনের সত্যমিথ্যার আকরের বর্ণনাই
বেশি করা হয়েছে। একমাত্র যুধিষ্ঠির, অর্জুন ও কৃষ্ণের ব্যক্তি গুণাগুণ ছাড়া আর অন্য
কোনো চরিত্রের গুণাবলি নিয়ে খুব একটা আলোকপাত করা হয়নি। কিংবা ব্যাসদেব করার কোনো
চেষ্টা করেননি। একমাত্র হস্তিনাপুরের কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেব সম্পর্কেই একটি দিকে আলোর
রেখাপাত করা হয়েছে। যদিও তাঁর চরিত্রের এই গুণের উল্লেখও এতটাই স্তিমিত ভাবে উল্লিখিত
যে, খুব সচেতন পাঠক ছাড়া সাধারণ পাঠকের দৃষ্টির গোচরেই সেটি আসে না। আর এবিষয়ে আলোচনার প্রাককালে পূর্ব
ইতিহাসের কিছুটা অবতারণা প্রয়োজন।
হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর কনিষ্ঠা
স্ত্রী মাদ্রী। কুন্তীর ঋষিলব্ধ মাতৃত্বের মন্ত্রে সিদ্ধ হয়ে কুন্তীর মতো মাদ্রিও
সেই মাদ্রী-গর্ভে দেবকুলের দুই চিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আহ্বান করে তাঁদের ঔরসে
জন্ম দিলেন নকুল ও সহদেবের। তাই এঁদের আশ্বিনেয় বলা হয়। সংস্কৃত শব্দ সহ এবং দেব যুক্ত
হয়ে সহদেব শব্দের সৃষ্টি। সহদেব শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল দেবতার সঙ্গে। যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থের
সম্রাট হওয়ার পর সহদেবকে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলো জয় করতে পাঠিয়েছিলেন। কারণ দাক্ষিণাত্যের
রাজারা অসি যুদ্ধে দক্ষ ছিলেন। অসিযুদ্ধে সহদেবও অপরাজেয় ছিলেন। ফলে সহদেব অনায়াসে
তাঁদের পরাস্ত করে ছিলেন। যুধিষ্ঠির নিজে তাঁকে দেবগুরু বৃহস্পতির থেকেও বুদ্ধিমান
মনে করতেন। পরবর্তী সময়ে যোদ্ধা হিসেবে সহদেব কয়েকজন সেরা যোদ্ধাকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে
বধ করেছিলেন।
এই সহদেব একদিকে যেমন একজন দক্ষ
অসি চালক ছিলেন, অন্যদিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর সম্যক জ্ঞান ছিল। সেই সঙ্গে জ্যোতিষ
চর্চাতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। শুধু পারদর্শী বললে কম বলা হয়, জ্যোতিষ শাস্ত্রে তাঁর
মতামত ছিল বেদ বাক্যের ন্যায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বহু আগেই তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রের
মাধ্যমে যুদ্ধের ফলাফল কী হতে চলেছে, সেটি নির্ণয় করে ব্যক্ত করেছিলেন।
পাশা খেলার পরাজয়ের সময় শকুনির
কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মনে মনে তাকে হত্যার প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন। শকুনি ছাড়াও
শকুনিপুত্র উলুকা ও ত্রিগত রাজকুমার নিরমিত্রকেও সহদেব বধ করেন। তবুও মহাকাব্যের এই
চরিত্রটি একজন বীর যোদ্ধা, একজন প্রথিতযশা ভবিষ্যত দ্রষ্টা হিসাবে আজও স্বল্প
চর্চিত। সহদেব ছিলেন বুদ্ধিমান, দূরদর্শী এবং অপার জ্ঞান-সম্পন্ন অভিজ্ঞ একজন পুরুষ।
ভাগবত পুরাণে পাওয়া যায়, সহদেব ছিলেন কৃষ্ণভক্তের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে দৈত্যগুরু
শুক্রাচার্যের অবতার মনে করা হত। ভীষ্ম, বিদুর ছাড়া একমাত্র সহদেবই বুঝতে পেরেছিলেন,
কৃষ্ণ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। সেই সময়কার অনেক রাজা কৃষ্ণকে দেবতারূপে পূজা করতে অস্বীকার
করতেন। পঞ্চপাণ্ডবের সহদেবই সর্বপ্রথম কৃষ্ণকে দেবরূপে পূজা করেন। জনশ্রুতি, কৃষ্ণ
পর্যন্ত সহদেবের কাছে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার উপায় জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে সহদেব
বলেছিলেন, কৃষ্ণকে বেঁধে রেখে দুর্যোধন-সহ সমস্ত কৌরব ও পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠিয়ে কর্ণকে
হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসালেই একমাত্র যুদ্ধ থামানো যাবে। একজন জ্যোতিষশাস্ত্র বিশারদই
এমন কথা বলতে পারেন। কৃষ্ণকে বেঁধে রাখতে হবে অর্থাৎ তাঁকে যুদ্ধ থেকে বিরত করতে হবে।
কারণ কৃষ্ণ এই যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের নির্ণায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি থাকলে
তাঁর পরামর্শক্রমে পাণ্ডবরা সঠিক পথে অগ্রসর হয়ে জয় বরণ করবেন। সহদেবের মতে কৌরব
ও পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠানো উচিত এইজন্য যে,
তাহলে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে আরোহণ নিয়ে কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে না।
এই ব্যবস্থায় উদ্ভুত সমস্যার সমাধান অতি সহজে হত। কর্ণের মতো বীর যোদ্ধা মহাভারত মহাকাব্যে
অতি অল্পই ছিল। কর্ণ হস্তিনাপুরের রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে কুরুবংশের উৎকর্ষতা গগনচুম্বী
হত। তাঁর এই ভাবনার গভীরতায় তাঁকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করাই উচিত ছিল। সহদেবের এই
সমাধানসূত্র ব্যাখ্যায় কৃষ্ণ বেশ প্রীত হয়েছিলেন।
মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব-গৃহিণী ও
দ্রুপদ রাজার কন্যা দ্রৌপদীর মতে সহদেব ছিলেন সুপুরুষ, ভবিষ্যৎ বক্তা ও প্রখর জ্যোতিষী,
যুদ্ধে পারদর্শী, অসি চালনায় সুদক্ষ। তাঁর কাছে মহারথীরা অতি সহজেই পরাজিত হতেন। এছাড়াও
সহদেব ছিলেন নৈতিক জ্ঞান-সম্পন্ন, বহুজ্ঞানী। পণ্ডিতেরা বুদ্ধি ও যুক্তিতর্কে তাঁর
কাছে পরাজিত হতেন। সহদেবের চারিত্রিক বর্ণনায়
দ্রৌপদীর বয়ানে বোঝা যায় সহদেব বেশ রাগী
প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। অথচ এত গুণ-সম্পন্ন সহদেবকে যুদ্ধ জয়ের অংশীদার হিসেবে কখনও দেখা হয় না। তাঁর
গুণগুলো জনচক্ষুর আড়ালে শুধুমাত্র মহাকাব্যের অন্তরালেই আবদ্ধ থেকে গেছে।
আগেই বলা হয়েছে, অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন
জ্যোতিষী হওয়ার কারণে তিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ফলাফল দেখতে পেয়েছিলেন যুদ্ধের পূর্বেই।
মহাকাব্যে বর্ণিত আছে যুদ্ধ শুরুর আগে শকুনি দুর্যোধনকে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধ শুরুর নির্ঘণ্ট
জানতে সহদেবের কাছে। কৌরবরা শত্রুপক্ষ জেনেও সততার সঙ্গে সহদেব গণনা করে সঠিক সময়টিই
জানিয়েছিলেন। সহদেবের জ্যোতিষ বিচারে এই যুদ্ধে যদি কৃষ্ণের হস্তক্ষেপ না থাকত, শ্রীকৃষ্ণ
কূটনীতির আশ্রয় না নিতেন, যুদ্ধ ফল অন্যরকম হত বলেই মনে করা হয়, রচিত হত কুরুক্ষেত্র
যুদ্ধের অন্য ইতিহাস। এই মহাকাব্যে রচনাকার ব্যাসদেব তাঁর লেখায় সেই ইঙ্গিত দিয়েও
যথেষ্ট সচেতন ভাবে যুদ্ধের আশু ফলাফল সম্পর্কে সহদেবকে নীরব দর্শক হিসাবেই উপস্থাপন
করেছেন। এখানে আরও একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে একমাত্র সহদেবই
চেয়েছিলেন অসামান্য সামরিক জ্ঞান এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি-সম্পন্ন বিরাট রাজাকে পাণ্ডবদের
সেনাপতি নিযুক্ত করতে। কিন্তু পাণ্ডব তনয় যুধিষ্ঠির ও অর্জুন দ্রুপদ রাজার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে
সেনাপতি নিযুক্ত করেন। বুদ্ধিমান সহদেব জ্যেষ্ঠভ্রাতাদের সম্মানার্থে বারবার নিজেকে
অবগুণ্ঠণাব্রত রেখেছেন। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের অনেক বীর যোদ্ধাদের বীরত্বের সঙ্গে পরাজিত
করে বধ করেছিলেন তিনি। পাশা খেলার সভায় গৃহীত শকুনি বধের প্রতিজ্ঞা যুদ্ধের অন্তিম
দিনে প্রায় অন্তিম লগ্নে অর্থাৎ আঠারোতম দিনে শকুনের প্রাণনাশ করে পূরণ করেন। কৌরবদের
সুপরিকল্পিত পাশা খেলায় পাণ্ডবদের পরাজয়ের
ফলাফল রূপে বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসে পাঠানো হয়েছিল পঞ্চপাণ্ডব ও
তাঁদের স্ত্রী দ্রৌপদীকে।
এই অজ্ঞাতবাসের সময় তাঁরা বিরাট
রাজ্যে লুকিয়ে ছিলেন এবং পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী
ছদ্মনাম ও ছদ্মবেশ ধারণ করেন। এই সময় সহদেব এক বৈশ্যের রূপ নেয়, নাম হয় অন্তিপথ
আবার কেউ কেউ বলেন অরিষ্টনেমি। তিনি বিরাট রাজার গোশালা দেখাশোনার ভার নিয়েছিলেন।
বাকি ভ্রাতারা এই সময় সহদেবের নাম পরিবর্তন করে করলেন জয়দেব। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের
পর যুধিষ্ঠির সহদেবকে তাঁর মামাবাড়ি মদ্র রাজ্যের রাজা নিযুক্ত করেন।
বহু গুণের আধার হওয়া সত্ত্বেও
একটি বিষয়ে তিনি ছিলেন একটু বেশিই অহংকারী। সেটি হল প্রাজ্ঞতা; এই প্রাজ্ঞতার অহংকারে
আবিষ্ট থাকার কারণেই মহাপ্রস্থানের সময় দ্রৌপদীর পরেই সহদেবের পতন বা মৃত্যু হয়।
ভাগবত পুরাণ অনুসারে সহদেব শ্রীকৃষ্ণের
অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। মহাভারতে ইন্দ্রপ্রস্থের দক্ষিণে যে সমস্ত রাজ্যগুলি যুধিষ্ঠিরের
নির্দেশক্রমে সহদেবের নেতৃত্বে জয়লাভ হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৌরসেন রাজ্য,
ঔরব রাজ্য, বিদর্ভ রাজ্য, নীলের রাজধানী মাহিষমতি, মৎস্য রাজ্য প্রমুখ। এছাড়াও তিনি
যুদ্ধ পরিকল্পনাকার হিসেবে বিশেষ দক্ষ ছিলেন। মহাকাব্যের বীর মহারথীদের বন্দনার কথা
আমরা জানি। কিছু চরিত্র আছে যাঁদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অনালোচিত চরিত্র হয়েই
রয়ে গেছেন। ফলে একথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, জ্যোতিষ পারদর্শী, যুদ্ধ পরিকল্পনায়
পারদর্শী সহদেব মহাভারতে অন্যতম অবহেলিত চরিত্র হিসেবে পরিণত হয়ে আছেন আপামর মহাকাব্যপ্রেমীর
কাছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন