![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
আলোকচূর্ণ
মাথা থাকলে ব্যথা হবে। মাথাব্যথা নেই মানে তুমি গোবর মস্তিষ্ক। কথাটা অন্য কেউ বললে উদোম কেলানি দিতে শুরু করতাম আমি। কিন্তু এমন নাজুক মানসিক অবস্থায় যিনি কথাটি বলেছেন তার পায়ে চুমু খেতেও আপত্তি নেই আমার।
বুনোর
শহরে এসে আমি একেবারে বন্য হয়ে উঠেছি। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। ভোররাত অবধি জেগে
থেকে কখন চোখ লেগে গেছে জানি না। তারপর একটু পর দরজায় ধমাধম শব্দ হতেই ঘড়িতে দেখি
নটা পঞ্চাশ মিনিট। এমনিতে আমি আর্লি রাইজার। এই অসময়ে বিচ্ছিরি ঘুম দিয়ে জেগে উঠে
টের পেলাম কেউ ঘাড়ের ওপর চেপে বসে মাথার দুপাশ থেকে এদিক ওদিক করাত চালাচ্ছে।
রুমে তালা দিতে দিতে রামধমক লাগিয়েছি হীরককে। ঘিয়ে রঙের
পাঞ্জাবিতে আর ক্লিনশেভে ওকে নতুন বরের মত দেখাচ্ছিল। তাতে কি! জন্তুর মত স্বভাব
তো বদলাবে না ছেলেটার! আমার ধমক খেয়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ফুঁসে উঠল সে।
ডাকাতের মত না ধাক্কালে উঠতি তুই? গাড়ি
দুটোই ছেড়ে দিচ্ছিল প্রায়। শালার ভালোমানুষির দামই নেই এ দুনিয়ায়! তোর মতো লোকের
জন্য এরকম ম্যানুয়াল অ্যালার্মই প্রযোজ্য।
ছ্যাঁত করে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেই নিজেই নিজের কৌতুকে হেসে ফেলে
সে।
দু'নম্বরের কথা বলে দশ মিনিট ধরে ওয়েট
করাচ্ছি। লতা-আপা নির্ঘাত খেপে বোম হয়ে গেছে এতক্ষণে! মেয়েগুলো পর্যন্ত শাড়িটারি
পরে সেজেগুজে হাজির। বলি প্রেস্টিজটা থাকল আর?
ওহ, রাগের কারণ তাহলে এই!
নে, নে, আর
দেরি করলে ওদের মেকআপ টেকআপ গলে যাবে। যা লাগছে না একেকজনকে! উফ! আগুন! আগুন!
হীরক তরল গলায় কথা বলছিল। ওর স্বভাবটাই এমন। বেশিক্ষণ রাগ ধরে
রাখতে পারে না। মিনিটে মিনিটে মেজাজ বদলে যায়।
তার একটু পরেই হিজিবিজি গাছপালার ভেতর দিয়ে সবুজ রঙের জিপটা
ছুটতে শুরু করে। আমরাও ছুটি ওটার পিছু পিছু।
স্যাঁতস্যাঁতে পাতার ঘ্রাণ মাখা বনের পথে গাড়িগুলোর শরীর সাপের
ছলংয়ের মতো দেখাচ্ছিল।
আমার কানের কাছে তখনো কেউ গুনগুন করছে। এর একটু আগেই গাড়িতে ওঠার
সময় জানালা দিয়ে মরালীর মত গ্রীবা বাড়িয়ে সে বলেছিল- 'মাথা
থাকলে ব্যথা তো হবেই রে!' শুনে আমি মনে মনে বলেছিলাম- ওগো
তুমি বলেছো যখন মেনে নিলাম কথাটা। ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে এ গাড়ির সহযাত্রীদের কাছে
যখন প্যারাসিটামল খুঁজতে শুরু করলাম তখন সে ওষুধটাও নিজের ব্যাগ থেকে বের করে
এগিয়ে দিল।
বৃষ্টি নামার কথা ছিল যেকোন সময়। এ নিয়ে আমাদের কারোর মনেই
দুশ্চিন্তা ছিল না। গতকাল রাতে জানা গেছে
প্রোগ্রাম অডিটোরিয়ামের ভেতরে হবে। 'বাষ্পের সনে আকাশে
উঠিব, বৃষ্টির সনে ধুলায় লুটিব।' কিন্নরকণ্ঠে সমবেত গান ভেসে আসছিল জলো হাওয়ার সাথে সাথে।
'মলয় বাতাসে ভেসে যাব' দিয়েই অনুষ্ঠানের
শুরু। ওদের গানের সঙ্গে হাঁটুতে ক্রমাগত তবলার ঠেকা দিচ্ছিল হীরক। সামনের গাড়ির খোলা
অংশটা থেকে নজর সরছিল না ওর। সবাই একই রকম টেম্পল পাড়ের শাড়ি পরেছে। বুনোর মতো
অন্য সবার চুলেও হয়ত থোকা থোকা ফুলের গাজরা।
চোখাচোখি হলে মাথা দোলাতে দোলাতে হীরক চোখ মারল আমায়। আমি শুধু
দেখতে পেলাম ঐ তো সে খোঁপার চুলটায় হাত
রাখল, 'স্বর্গের পরী হবে সহচরী, দেবতা
করিবে হৃদয়দান' আওড়ানোর সময় কাঁধের আঁচলটা আরেকটু গুছিয়ে
নিল। আমার মাথার ভেতরে দুপাশে কেউ তখনো করাত চালাচ্ছে। বুকপকেটে হাত রাখতে রাখতে
আমার মনে হচ্ছিল থাকুক না এ ব্যথা! মাঝেমাঝে নিরাময়ের উপায় হাতের মুঠোয় থাকলে আরো
দীর্ঘক্ষণ যেকোন ব্যথা পুষে রাখা যায়।
এখানে বনলতার মামাবাড়ি। এর আগে বেশ কয়েকবার প্রোগ্রামের আলাপ হয়ে
গেলেও এবারই প্রথম এলাম আমরা। ললিতকলা একাডেমির কর্ণধার ছিল ওর জ্যাঠা। এরা সবাই
পারিবারিকভাবে গানের লোক। একমাত্র ওর বরটাই ছিল অন্য ঘরানার।
মনটা বিক্ষিপ্ত থাকায় সব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে আজ। আমার আবৃত্তিও
মনমতো হয়নি। গলা বুজে আসছিল থেকে থেকে। কোনোক্রমে শেষ করেই চা খেতে ছুটলাম। টানা
আরো কিছু প্রোগ্রাম আছে। এসময় গলা খারাপ হলে বিপদে পড়ব। গিয়ে দেখি ছেলেরা সব
আগেভাগেই ভিড় করে ফেলেছে। চায়ের সঙ্গে সিঙ্গাড়া খেতে খেতে আলাপ চলছে। বনলতার মামা
বেশ আড্ডাবাজ লোক। নানাবিষয়ে অগাধ জ্ঞান তার। ছেলেরা সে আড্ডায় মজে গেল। ভেতর থেকে
কয়েকবার করে ডাক পাঠালেও কেউ গ্রাহ্য করল না।
একটু পর বুনোকে বেরিয়ে আসতে দেখে আমিই এগিয়ে গেলাম।
ব্যথা কমেছে তোর?
কমবে।
মেঘলা দিনে হয় এমন অনেকের।
হয় তো এমন! সাথে আকুলতাও থাকে।
বলতে বলতে বুকপকেটে হাত রেখেছি আমি। সে অবশ্য ততক্ষণে পাশ কাটিয়ে
গিয়েছে আমাকে। দেখলাম গরম চায়ের গ্লাসে ফুঁ দিতে চুলের গোছাটা কানের পেছনে আলগোছে
সরিয়ে দিচ্ছে।
'ভুলিয়া তুলিয়া রেখো তোমার অলকবন্ধনে' গুনগুন
করতে করতে আমি নিজেকেই মনে মনে ধমকাতে থাকি। খোসা ছাড়ানো প্যারাসিটামলটা তখনো
বুকের সঙ্গে লেপ্টে ছিল।
বুনোর মামাবাড়িতে দুপুরে খেতে গেলাম আমরা। ফ্রকপরা বুনোর মাথায় দুটো
বেনি দেখতে এত আদুরে লাগছিল! মনে হয়েছে ওর গাল দুটো ছুঁয়ে দিই। সেই বুনো আর এই
বুনোর মাঝে অনেক তফাত। তবু যখন ছবির
অ্যালবামটা হীরকদের হাত থেকে কেড়ে নিচ্ছিল ওকে দেখতে গাল ফোলানো অভিমানী
বাচ্চামেয়ের মতোই লাগছিল।
বুনো আমার কাছে ঠিক লতা নয়, একটা
আলোকচূর্ণ ফুল। তা সবাই ওকে যতই লতা বলে ডাকুক, সে কাগজে
লিখুক বনলতা ইসলাম। লতার মত সে জড়িয়েও রাখে সবাইকে। শুধু আমার বেলায় ওর কৃপণতা
দিনকে দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এর বিহিত না হওয়া অবধি আমি আজকাল রাতে আর ঘুমাতে পারছি না। খুব
শিগগিরি ওর মুখোমুখি বসবার, গোল টেবিল বৈঠক হওয়া এখন
সময়ের দাবি।
ভোরে উঠে এসব ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কাল এত বেশি ঝড়
হয়ে গেছে যে আমাদের ফেরার কথা থাকলেও ফেরা হয়নি। মেয়েরা বুনোর মামা বাড়িতে উঠেছিল
শুরুতেই। আর শহরের অন্য প্রান্তে দলছুটের মতো একাবোকা এই বাংলোতে আমরা জনা পাঁচেক
ছেলে, দুটো রুমে ভাগাভাগি করে ঘুমিয়েছি।
এই একটু আগেই বৃষ্টি থেমেছে এখানে৷ রাতভর ছাদের বুকে বৃষ্টির সোম,
তাল, ফাঁক শুনে শুনে এখনো হ্যালুসিনেশনে
আছি। জলে ধোয়া পাতাগুলো নতুন পয়সার মতো ঝকঝক করছে। ওদের শরীর বেয়ে আমার মাথার উপর
চুঁইয়ে পড়ছে বৃষ্টির স্মৃতিচিহ্ন।
আর্লি রাইজার হলেও মর্নিং ওয়াকের অভ্যাস নেই আমার। আমার দিন শুরু
হয় পড়াশোনা দিয়ে।
কিন্তু জায়গা বদল হওয়ায়, হয়ত বুনোর
অঞ্চলে এসেছি বলেই আমার স্থির হয়ে বসবার মন নেই। কতদিন পর এমন সকাল দেখা হল! এমন
সকাল যে সকালে বুনোকে লেখা যায়- একবার আসবে? তারপর পথে পা
রাখতেই ঝলমলে সবুজের শামিয়ানা মাথায় করে আলোকচূর্ণ ফুল এগিয়ে আসে আমার দিকে।
এগিয়ে এসে আমাকে বলে- তোর হয়েছেটা কী?
আমি ওকে বলি- তাতে কিছু যায় আসে তোমার, বুনো?
বুনো রেগেমেগে লালচে হয়ে ওঠে। এসব ন্যাকাবোকা কথা শোনার নাকি
আগ্রহ নেই তার।
আমি বললাম- তবু এসব শুনতেই ছুটে এলে তো?
মারব এমন এক চড় যে মাথা থেকে সব ভূত নেমে যাবে তোর। এদিক দিয়ে
যাচ্ছিলাম বলে এলাম।
বুনোর দিকে এক পা এগিয়ে গিয়ে বলি- প্লিজ গায়ে হাত দিয়ে দেখো,
আমি জ্বরে কাঁপছি!
মরিস না কেন তুই? ওষুধ খাসনি নিশ্চয়ই?
ও জানে না এ জ্বর এভাবে সারবার নয়। পকেট হাতড়ে ওষুধটা বের করে
ওকে দেখালাম- এই দেখো, দেবীর প্রসাদ নিয়ে ঘুরছি কবে থেকে!
থ্যাবড়ানো প্যারাসিটামলটার দিকে তাকিয়ে বুনোর ঠোঁট দুটো একটু গোল
হয়ে যায়। তারপর খুব বেশি রেগে উঠতে গিয়েও হাসতে শুরু করে সে।
আমি যে বয়সে তোর বড়ো, ভক্তি শ্রদ্ধার
কথা অন্তত মাথায় রাখতে পারিস তো! এসব ছেলেমানুষি দেখলে মাথা গরম হয়ে যায় খুব।
আমি বললাম - শ্রদ্ধা করি বলেই তো দেবী বলে ডাকলাম!
বুনোর মুখে হাসির রেশ রয়ে গেছে তখনো। তারপর আমাকে আর কিছু বলতে
না দিয়ে সে বলে ওঠে- শোন রে তুহিন, তোকে আমি স্পষ্ট করেই
বলি, আমার হেঁয়ালিতে খুব অরুচি। তুই ভাবছিস আমার দাম্পত্য জীবন চুকে গেছে বলেই
আবার নতুন করে ভাবব এখুনিই? মোটেও তা নয়। আমি এই এখন যেমন আছি এভাবেই থাকতে পারি আরো বহুদিন।
বহুদিন
মানে কতদিন?
যতদিন এই একলা বেলা দুঃসহ হয়ে না ওঠে। কিংবা হয়ত শেষদিন
পর্যন্তও।
হেঁয়ালিতে অরুচি হলেও হেঁয়ালি করেই বুনো চলে যায়। ওর ফিরে যাওয়া
দেখতে দেখতে আমার মনে হয় ওর এই একলা বেলার দিনগুলি ফুরাক বা না ফুরাক আমি এবার
একটা কাজের মতো কাজ পেলাম। ওর একলা বেলার দুঃসহ হয়ে ওঠার অপেক্ষায় থাকা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন