কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 


উড়াইয়া দেখো ছাই

সমকালীন ছোটগল্প


 

(এক)

কাজে গিয়েছিল সুকান্ত অবশ্য এমনিও সে যায়। গরমে ঘোরাঘুরি, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। রাস্তাতেই বমি হল, ডিহাইড্রেশন মতো। জুনিয়ার কলীগ ইমন যুতসই জায়গায় গাছের নীচে শুইয়ে দিল,

“রেস্ট নিন স্যার। আমি এগিয়ে দেখছি—

পুরনো ঝাঁকড়া বড়ো ছাতার মতো গাছটাসুকান্ত ওপরে তাকিয়ে আরামে চোখ বোজেঅল্প মাথা ঘুরছিল কত রকমের শব্দ-গন্ধ চারদিকে কলকাতায় ভাবা যায় না। গাছ থেকে কুটোকাঠি, পাতা-টাতা গায়ে পড়ছিল। ঠাণ্ডা-গরম চৈতী বাতাসে ঘুমিয়ে পড়েছিল ডাকাডাকিতে চোখ মেলল উদ্বিগ্ন গলা ইমনের,

“স্যার! স্যার! কেমন ফিল করছেন?”

সে উঠে বসল। বলল,

“ভালো

ইমনের পাশে লুঙ্গি-ফতুয়া পরা মাঝবয়সী লোক বেঁটে, শক্তপোক্ত শরীর। থুতনিতে কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় টাক। চিকন গলার স্বর।

“কেমন লাগছে স্যার? সুকান্ত-স্যার? ভাইটি গিয়ে ডেকে আনল সরকারি অপিসর এখেনে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, না এসে পারি? ওঠেন, ডাব এনেছি খেয়ে দেখেনআমার গাছে ডাবের পানি খুবই মিঠা।”

সুকান্ত অস্বস্তিতে পড়ল। সামান্য বিরক্তি নিয়ে ইমনকে দেখল। লোকটিকে বলল,

“আপনি—? চিনতে পারলাম না...!”

“আমি জাহাঙ্গীর মণ্ডল— এইখানে ঘর, কাছেই।”

ডাব কেটে হাতে দিল,

“দুই কিলোমিটারের মধ্যে হেল্‌থ্‌ সেন্টার আছে স্যার। যান, প্রেশারটা মাপিয়ে আসেন। আমি ঘুরে আসছি

এসব দিকে পল্লীবাংলা বেঁচে আছে। ছোটো-বড়ো পুকুর। হাঁস ভেসে চলা, স্নান-কাপড়কাচা মাঠ-ঘাট, সবুজ গাছপালা। পথঘাট পাকা করেছে সরকার, যদিও তত চওড়া নয়। খানিক এগিয়ে হেল্‌থ্‌ সেন্টার, একতলা সামনে ন্যাড়া মাঠআউটডোরে লেডি ডাক্তার বসেছিল। রোগীর জন্য দুটো চেয়ার পাতা সুকান্ত বসল, পাশে ইমন মন দিয়ে কী পড়ছিল ডাক্তার মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল,

“কে পেশেন্ট?”

মৃদু নরম স্বর, বয়স অল্প। কচি মুখের ডাক্তারণী সুকান্ত অন্যমনস্ক,

“আমি, আমি—ই।”

ডাক্তারের মুখখানা কেন যেন চেনা ঠেকে। দেখেছে বুঝি আগে—! ডাক্তার তার হাত ছুঁল,

“কী হয়েছে, বলুন?”

সুকান্ত অসুখের কথা জানাল। ডাক্তার প্রেশার ইত্যাদি বলল,

রোদ্দুরে থাকবেন না। ও-আর-এস, না পেলে চিনি-নুনের জল খাবেন। ওষুধ লিখে দিচ্ছি নাম আর বয়স বলুন।”

বেরিয়ে দেখে বাইরে দাওয়ায় জনাদুই রোগী অপেক্ষা করছে। এখানকারই মানুষ। একটু দূরে মাঠে কাঠবাদাম গাছের ছায়ায় জাহাঙ্গীর দাঁড়িয়ে। পাশে সাইকেল। সুকান্ত এগিয়ে এল। হাত জুড়ে বলল,

“খুবই কৃতজ্ঞ হলাম। আমাদের অনেক সাহায্য করলেন। তবে এবার যাব

“আমি বলি কী, বেলা খানিক পড়লে যাবেন’খন! আজ আপনেরা আমার অতিথি। আমার ঘরে চলেন, খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নেন। রোদ নামলে রওনা দিবেন।”

“না না! আমরা যাবো এবার।”

“না বললে ত হবে না সুকান্তসাহেববাড়িতে বলে এসেছি। আমার শামিমাবিবি রাঁধেন ফাস্টক্লাস, পরীক্ষা প্রার্থনীয়।”

সুকান্ত চমকে উঠল। ক-যুগ পর যেন নামটা শুনল!

“দ্যাখ গো কাদের ধরে এনেছি।”

ডাকল জাহাঙ্গীর। শামিমার ছোটোখাটো চেহারায় আজ বয়সের ক্লান্তিহাল্কা নীলরঙের ফুলছাপ শাড়ি আঁচলে মাথা ঢাকা। চিকচিকে কালো চোখ চশমার ভেতরে আস্তে করে বলল,

“কেমন আছো?”

বিষম খেল সুকান্তঅগোছালো গলায় বলল,

“এ-ইই, ভালোই। তুমি ভালো তো?”

“যেমন রেখেছেন ইনি—

জাহাঙ্গীরের দিকে চোখ সরু করে হাসল শামিমা।

“খানিক বসো, তোমরা গল্প-টল্প করো। আমি খাবার জোগাড় দেখি।”

ছড়ানো একতলা, বড়ো বাড়িবারান্দা-ঘেঁষে জামগাছ। একজোড়া টোটো-রিকশা দাঁড়িয়েজাহাঙ্গীর বলে,

“ওই দেখেন, ওই দু-টা ভাড়ায় খাটাইমাছধরা ট্রলারও আছে, তবে ওই! ইছামতীতে মাছ কমে গেছে—হাজার সরকারি বিধিনিষেধ! সেগুলা মেনেই চলা ভালো, কী বলেন? খেয়ে ওঠেন, আমার বাগানখান দেখাবো। কত ভালো গাছ লাগাইছি দেখবেন খালি বাইশ বিঘা চাষজমি আছে, ফলন ভালো। কিন্তু সেইটা আজ আর দেখান যাবে না। জায়গাটা একটু দূর, এই আর কী

অবস্থাপন্ন ঘর, দিব্যি সমৃদ্ধির ছবি। ইমন এমন জায়গায় আগে আসেনি। কানের কাছে বলে,

“দারুন ব্যাপার! না স্যার?”

“আমি বুঝলেন কিনা, পরের উপকার না করে থাকতে পারি না।”

নিজের কথা বলে জাহাঙ্গীর। লোকে চায় সে ভোটে দাঁড়াক। পরের পঞ্চায়েত ইলেকশনে টিকিট নেবে। সুকান্তর দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে,

“আপনার বন্ধুনিরে কষ্টে রাখি নাই, কী বলেন?”

“অ্যাঁ? হ্যাঁ— মানে?”

“জানি স্যার, জানিআপনারে একটিবার দেখার ইচ্ছা ছিল। আল্লা মনের সাধ মিটায়ে দিলেন।”

“মানে, তেমন কিছু—তো—! আমাকে চিনলেন কী করে?”

সুকান্তর কথা আটকে যায়। জাহাঙ্গীর হাসে,

“আপনার নাম, টাইটেল সবই ত জানি।”

“ও—! তা—,”

“বিবি শাদীর পরই বলে দিয়েছে সে আপনারে ভালোবাসত কচি বয়সের আকর্ষণ। তার বয়সই বা কত তখন? একুশ-বাইশ! কচি মেয়ে

মাঝে বত্রিশ-তেত্রিশ বছর কেটে গেছে সুকান্ত খবর রাখেনি শামিমার। জাহাঙ্গীর আপন মনে বলতে থাকে,

“শাদীর পরপর দেখি বিবির মুখে হাসি নাই। ভাবতাম বর পছন্দ হয় নাই। একে বয়সে আমি অনেক বড়ো, তার উপর শুধু ইস্কুল-ফাইনাল পাশ। দেখতে অবশ্যি হ্যাণ্ডসাম ছিলাম। আর সে কলেজে পড়ত, সুন্দর না হলেও চটক ছিল। এখন আরও বিউটিফুল হয়েছে। একদিন জিগ্যেস করলাম, বিবি মন খুলে বল দেখি কী ঘটেছে? লুকাল না, বোঝলেন? বলে দিল। সরল মন, রোম্যান্সে টুসটুস

সুকান্তর বলার কিছু নেই। ইমন কী ভাবছে সে-ই জানেজাহাঙ্গীরের উদাস স্বর,

“কে যে কার খোঁজে ফেরে, কে যে কার রঙে মন মিলায়, কেউ কি আগে থাকতে জানতে পারে? বলেন? ভালোবাসা-টাসা নিজের ইচ্ছায় হয়। কিন্তু শাদী-বিয়া কি সব সময় হয়? আল্লা যেখানে চাল মেপে রাখে, বাপ-মা ঠিক খুঁজে বার করে ওই আমার মেয়েটা, দেখে এলেন হেলথ সেন্টারে – তিতাস ডাক্তার?”

“আপনার মেয়ে?”

“হ্যাঁ স্যার। ছাব্বিশ পার হল। সে নাকি শাদীই করবে না! কী করি, বলেন!”

শামিমার আদল তাদের মেয়ের মুখে। সেজন্য চেনা লাগছিল।

খাওয়ার শেষে পান দেয় শামিমা, মশলা দেয় ক-বার এসে ঘুরে যায়কিছু বলার ছিল শামিমার? আড়াল পেলে হয়ত বলত, হয়ত বলত না। সুকান্তর মনের ভুল সবটাই!

(দুই)

ডিপার্টমেন্ট আলাদা। সুকান্তর অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্স, শামিমার বাংলা। উত্তর কলকাতার রোগা-লম্বা-ফর্সা সুকান্ত। ছোটোখাট শামিমা, নীল-হলদে শাড়িতে গ্রামের গন্ধ। চুলে আলগা বেনী বা খোঁপা ঢালু কপাল নেমে উজ্জ্বল কালো চোখলোক্যাল ট্রেনে কলেজে আসে“তুমি” করে বলত ক্লাসের ছেলেদেরসুকান্তর সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে যায় স্টেশন পর্যন্ত, দুচারটে কথা হয় সে সময়ে। থার্ড ইয়ারের শেষদিকে একদিন বলল,

“যাবে আমাদের বাড়িতে?”

“যাবো। কোথায়?”

“আমতলা, বারুইপুর—নাম শুনেছ?”

“ঠিক আছে। বাড়িতে বলেছ?”

“বলেছি ক্লাসের বন্ধু আসবে আব্বা-আম্মা খুব উদার। অসুবিধা হবে না।”

দুপুরবেলাটায় ট্রেনে ভীড় ছিল না। সিটে-বসা চেক-শাড়ি মাথায় খোঁপা দু-তিনজন সবজিমাসী আনাজের ঝুড়ি রাখা নীচে, পায়ের কাছে। ক-জন আধাবুড়ো ফাটা পা বেঞ্চে তুলে চাষ-জমি, পাট্টা, মামলা-মকদ্দমা নিয়ে গলা নামিয়ে আলাপ করে। সবজি-মাসীরা শামিমার দিকে তাকিয়ে হাসলওদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। ওদিকের বেঞ্চে লালপাড় শাড়ি, সাদা জামা, লালফিতে স্কুলের মেয়ের দল। ওখানে ঠেসে বসল শামিমা। কত হাসিঠাট্টা, সংসারী গল্প কানে আসে সহজ জীবন! সুকান্তর অ্যাকাউন্টেন্সির অঙ্কগুলোর মতো রসকষশূন্য নয়। যত দিন যাচ্ছে সাবজেক্টটা বেশী খারাপ লাগছে। ভুল নির্বাচন হয়েছে, সে আজকাল ভাবে। অনার্স থাকবে কিনা কে জানে!

শামিমার পাড়া। গাছপালা ঘেরা, শান্ত ছায়ামাখালম্বাটে পাকা বাড়ি, মাথায় টালির ছাদ। বাড়ির চওড়া উঠোন। বাড়িতে দাদী, আব্বা-আম্মা, ভাইবোন। কলেজের বন্ধু, শহরের ছেলে, একরকম গর্বই ওদেরশামিমা বড়ো মেয়েতার আব্বা বলে,

“শামিমা ছাড়া আর কোনওটার লেখাপড়ায় মন নাই।”

শামিমা ক-দিন কলেজে আসছিল নাখবর নিতে হলে বাড়িতে যেতে হয়। যাবে কি না ভাবছিল সুকান্ত শামিমার ডিপার্টমেন্টের বন্ধু নন্দিতা এল হন্তদন্ত হয়ে স্মার্ট মেয়ে, রাগী রাগী চোখ। একটা চিরকুট দিল,

“শোন, সামনের রোববার শামুর বিয়ে। কিছু যদি করতে চাস, হাতে সাত-আটদিন আছে। আমাকে নেমন্তন্ন করতে এসেছিল ওর বোন। শামু এটা পাঠিয়েছে। পড়ে দ্যাখ।”

খুব তাড়াহুড়োয় দু-ছত্র লিখেছে শামিমা। ‘নন্দুর কাছে শুনে নিয়ো। বাড়িতে তোমার কথা বলেছিলাম। ফেমিলির কেউ, এমনকী আব্বা-আম্মা পর্যন্ত বিরুদ্ধে। আমার বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল! যদি বলো, এক কাপড়ে বেরিয়ে আসব নন্দুর হাতে তোমার জবাব পাঠিয়ো।”

সুকান্ত চিরকুট ফিরিয়ে দিয়েছিল। মাথা নেড়েছিল,

“যা হতে যাচ্ছে সেটাই ঠিক

“ও, তাই? কিচ্ছু করার নেই?”

নন্দিতা কতগুলো কড়া কথা শুনিয়ে গেলসুকান্ত চুপ করে শুনেছেবলেনি যে সে শামিমাকে কথা দেয়নি। বিয়ের কথাই ওঠেনিকাকা-জ্যাঠা নিয়ে তারও গোঁড়া পরিবার সংসারে বিধবা মা। দাদা আর সে ছাত্র এর মধ্যে শামিমাকে তার বাড়িতে আনা কী করে সম্ভব?

শামিমার ছোটোখাটো চেহারা মস্ত ছায়া হয়ে মাসখানেক দাঁড়িয়ে রইল তার দরজায়ভোমরা-চোখ, ঢালু কপাল, সাপের মতো বেনী জেগে রইল আরও ক-সপ্তাহ। কবে একসময় সরে গেল খেয়াল হয়নি। সে তখন ফাইন্যাল পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।

দাদার ভালো চাকরি হল। সুকান্ত মাঝারি মাপের সরকারি চাকরি পেল। নতুন-আসা সমবয়সী বউদির সঙ্গে আলগোছ ভাব হল। ছলছলে মেয়ে পূর্না, হাসিখুশী সুকান্ত পছন্দ করত বউদিকে। মা আর বউদি মিলে বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছিল।

“সুকু, তোমার স্পেশাল কেউ আছে? আমরা মেয়ে পছন্দ করছি, বিয়ে করবে এবার

বিয়ের ইচ্ছে ছিল না সুকান্ত কিছুদিন টালবাহানা করল। প্রতিবাদ করল,

“না গো বউদি। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবো?”

“বাজে বোকো না!”

“কিন্তু আমার ঘাড় বড্ড লগবগে, বউদি— মেয়েটা কষ্ট পাবে। আমিও কি ভালো থাকবো?”

অফিসের কাজে গ্রামে-গঞ্জে যেতে হয়সরকারি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি পৌঁছে দিতে যায়। জলের কল নেই, কত গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনিসুকান্ত স্বেচ্ছায় যায়। অনেক সময়ে ছুটি-ছাটায় গিয়ে থাকে। লোকজনের সঙ্গে সময় কাটায়ওদের রোজকার ঝামেলা, অভাব-অভিযোগ, ঘরের সমস্যা শোনে।

কদাচিৎ ঘুমের মধ্যে শামিমার গ্রাম ছবি হয়ে ভেসে আসেঘুম ভেঙে যায় সুকান্তর সে বিরক্ত হয়,

“ধুর—ফালতু কী সব এগুলো!”

দোয়েল পূর্ণার জ্যেঠির বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়। মা নেই, বাবা অথর্ব—বিছানায় দাদারা বিয়ে দিল। বেশ লম্বা, গায়ের রঙ ময়লা, স্বাস্থ্য ভালো। সুকান্তর কাছাকাছি বয়স। শান্ত, নির্লিপ্ত মেয়ে বিয়ে নিয়ে ভেতরে চাপা ভয় ছিল সুকান্তর। মাসকয়েক পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রোজ একভাবে দিন ফুরিয়ে রাত হয় সুকান্ত, তার দাদা যে যার অফিস সেরে নিজের সময়ে ফেরে। দোয়েল মা-র পায়ে-পায়ে ঘোরে। পূর্ণার ছায়া হয়ে ঘরে থাকে।

সুকান্ত-দোয়েলের দাম্পত্যে মান-অভিমান নেই। কালে-ভদ্রে খুবই সাধারণ কথা কাটাকাটি, মনোমালিন্য হয়। ছোট্ট ঢেউ ওঠে পড়ে যায় কেউ টের পাওয়ার আগেই সুকান্ত এতটা আশা করেনি। বাঁধনহীন পিছুটানহীন একটা সম্পর্ক। দোয়েল বলে একদিন,

“আমাদের ওবাড়ির কাছে একটা কোচিং-এ সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস নিতাম। আবার জয়েন করছি।”

“করো। ভালো খবর। কী পড়াতে? কখন যাবে?”

“নাইন-টেনের ম্যাথস্‌। বিকেলে ক্লাস, পাঁচটা থেকে সাড়ে ছ-টা।”

“বাঃ!”

দু-বছরের জন্য অন্য জেলায় সুকান্তর টেম্পোরারি ট্রান্সফার হল দোয়েলকে জিজ্ঞেস করল,

“যাবে তুমি আমার সঙ্গে?”

“একা ওখানে কি তোমার অসুবিধে হবে?”

“না নাকিসের অসুবিধা?”

“তাহলে? মানে আমি গিয়ে আর—?”

“ও আচ্ছা। ঠিক আছে।”

অনেক সাহস নিয়ে শামিমা তাকে বাঁধতে চেয়েছিল। সে সরে গেছে। সুকান্তর মনে হয়, ভালোবাসার ক্ষমতাই নেই তার। প্রথম-প্রথম জানতে ইচ্ছে করত শামিমা বিয়ের সময়ে কেঁদেছে কিনা। অবশ্য অচেনা সংসারে ভর্তি হতে গিয়ে মেয়েরা কাঁদেই। পূর্ণা, দোয়েল বাবার বাড়ি ছেড়ে আসার সময় প্রচুর কান্নাকাটি করেছে।

বিয়ের পর থেকে পূর্ণাই সংসারের ভালোমন্দ দেখে। সুকান্তকে খোঁচায়,

“কী গো, আরো দেরি করবে? কীরে দোয়েল?”

সুকান্ত যেন শুনতে পায় না দোয়েল হাসে। আসলে তারা নিজেরাও জানে না, তাদের বাচ্চা চাই কি না। দু-জনে ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, কারও দোষ নেই। কোনও এক সময় নিশ্চয়ই হবে। ওরাও ভাবে, কিসের তাড়া!

দাদার ছেলে-মেয়ে বড় হয়, সুকান্ত ভালোবাসে ওদের।

ক-বছর পর সুকান্ত দোয়েলকে বলে,

“তুমি ইচ্ছে করলে যেতে পারো।”

“আমি? কোথায় যাবো?”

“যেখানে তুমি যেতে চাও—

“কেন? যাবো কেন?”

সুকান্ত প্রথমবার মন দিয়ে দোয়েলের মুখ দেখে। কাটাকাটা নাক-চোখ, ধারালো, গম্ভীর গত ছ-সাত বছরে ক্লান্ত, অবসন্ন। দু-একটা সাদা চুল উড়ছেশ্বাস টেনে চাপা গলায় দোয়েল বলে,

“তুমি যেতে চাও আর কোথাও?”

“না তো

“তবে? আমি কেন যাবো?”

“তোমাকে আটকে রেখেছি! মনে হচ্ছে।”

“তাই?”

“ক-মাস ধরে ভাবছিবউদির চাপাচাপিতে বিয়ে— যদি আর কারও সঙ্গে, মানে তোমার এক্স কেউ যদি থেকে থাকে —! তোমাকে আটকাব না—তাহলে।”

ভেঙেচুরে সুকান্ত বলতে থাকে। দোয়েল টানা চোখে কাজল পরে। ওড়না দিয়ে মুখ মোছে। হালকা করে পাউডারের পাফ্‌ বোলায়। চিরুনির ডগায় সিঁদুর নিয়ে সিঁথিতে ঠেকায়। ছোট্ট মেরুন টিপ বসায় ভ্রূর মধ্যেটায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু হাসে,

“বাড়িটা এখন আমারও। আমার জন্য ভেবো না। ক্লাস আছে, বেরোচ্ছি।”

দোয়েল বেরিয়ে গেলে সুকান্ত জানালা দিয়ে রোদ-ঢলা আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। শীতের বিকেল নামল তাড়াতাড়িগেল মাসে বাদুর কাছাকাছি এক গ্রামে গিয়েছিল। রাস্তার মোড়ে ছোটো চায়ের দোকান। চা-বিস্কিট, চপ-মুড়ি-বেগুনী, পাঁউরুটি-ঘুঘনি বিক্রি হয়। খিদে পেয়েছিল সুকান্তর। বাইরের কাঠের তক্তায় বসলদোকানি মহিলার প্রায় তার মতো বয়স। পাঁউরুটি-ঘুঘনি, বোঁদের লাড্ডু সাজিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়বলে,

“মুখখান শুকনা ক্যান বাবু?”

“খিদে পেয়েছে মাসী।”

“তাই বল! সংসারে কেও নাই নাকি?”

“আছে মা, বউদি, দাদা—,”

“বউ নাই?”

“আছে।”

“সে যতন করে না? মুখরা? ঝগড়া করে?”

“না, না, ওসব করবে কেন?”

মহিলা আপনমনে হাসে। আঁটসাঁট শরীর, পানের রসে লাল দাঁত। উনুনের সামনে মোটাসোটা লোকটি বসা। ফতুয়া পরণে, ফর্সা ধুতি। প্লেটে পাতলা-পাতলা বেগুন কেটে রেখেছে স্টিলের বড়ো গামলায় বেসন ফেটাচ্ছে। মহিলা লোকটির দিকে তাকায়,

“অমনিই কইলাম। সংসারে মন লাগে নাই, না? ছেলেপুলে নাই?”

“না।”

“তাই টানও নাই। তা বেরইয়ে পর না এক্কেরে ঘরদোর ছেড়ে—,”

“যাহ্‌ সে আবার হয় নাকি?”

“কেন, হবে নে কেন? একটাই জেবন গ, কত আদরেরতুমি যেমনধারা চাইবে তেমনধারা হবে। বাঁধন চাইলে বাঁধন হবে, ছাড়ান চাইলে ছাড়ান।”

“বড়ো জ্ঞানের কথা বলছ যে গো মাসী!”

সুকান্ত অবাক হয়ে শোনে ছোটোছোটো স্রোত মাথায় কিলবিল করে মহিলা বলে,

“গ্যান পাব কই? লিখ-পড়া শিকেচি নাকি? জেবন ঝা শিকিয়েচে তাই বলিতবে সংসারে মন ছিলনি আমার।”

“কী রকম?”

“হ্যাঁ গ। তাই ত সাতপাকের সোয়ামী ফেলে, ছ-মাসের খোকারে নিয়ে ঘর ছাড়লুম।”

“কেন? মারত নাকি তোমাকে?”

“না গ মিছা বলব নাই, কুনওদিন গায়ে হাত তুলে নিকিন্তুক কেমনধারা জানি—মনে ধইরল না। পাইলে এলাম। বহরমপুর ইস্টিশনে এই ইনার সঙ্গে দেখা। কে যেন মিলায়ে দিল। বাঁধা পড়লাম, ছাড়ানও হইল। সে পচিশ-ছাব্বিশ বচ্ছর আগে। হ্যাঁ গ, তাই না গ?”

উনুনের সামনে বসা লোকটি সাড়া দেয় না। হয়ত শোনে নি। একমনে বেগুনী ভেজে চলেছে। ফেটানো শেষ, তেলে ছাড়ছে। ধোঁয়া উড়ছে। মহিলাটি বলে,

“উ আইজকাল কানে কম শুনে!”

“তুমি মুর্শিদাবাদ থেকে এখানে চলে এলে? বাড়ির লোক খোঁজ করল না?”

“করেচে বোধায় দ্যাখ বাবু, মন যেখানে বাঁধার সেখানে বাঁধবেইউনি ছিল মুরারইতে আমার ঘর নূরপুরে। দেখা হইল কী করে, কও! কিন্তু হইল ত! আর ত পলানর ইচ্ছা হয় নাই।”

“ভালো থাকো গো মাসী। উঠি আমি

“আস গ বাবু। মন তমার বুঝি কুথাও বাঁধা পড়ে নাই। মনডার সাতে একলা কথা কয়ে দেখ দিকি!”

ফেরার পুরো রাস্তা সুকান্ত থম ধরে ছিল। ফিরতে অনেক রাত হয়েছে দোয়েল কারণ জিজ্ঞেস করল। সুকান্ত জবাব দিল নাএমনিই ওরা আছে পাশাপাশি বাঁধন ছেঁড়েও না, শক্তও হয় না। সুকান্ত রাগ করে না, অভিযোগ নেই। দোয়েল নিঃশ্বাস ফেলে না, অভিমান নেই।

(তিন)

কলীগের মেয়ের বিয়ে জামশেদপুরে। সুকান্ত দোয়েলকে আসার জন্য বলেছিল। দোয়েল এল না।

ট্রেন-জার্নি সুকান্তর বড়ো প্রিয়, উঠলেই মন ফুরফুরে লোকজন, হাঁকডাক, চেঁচামিচি। এবছর এপ্রিলেই সাঙ্ঘাতিক গরম পড়েছে এ-সি কামরা ভর্তি। জানালার ধারের আধবুড়ো বিহারী লোকটি বিরক্তি নিয়ে উঠে কপাল কুঁচকে ঘুমিয়ে পড়েছে। পেছনদিকের সীট থেকে তুমুল হুল্লোড়, গান-গীটারের আওয়াজ। সুকান্তর অন্য পাশে বসা সুন্দর যুবকটি দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে ডাকে,

“সৌম্য আরও জোরে – লাউডার –!”

“পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে — বোকা বাক্সতে বন্দী,,”

সৌম্যর গান ঘুরে বেড়ায় বন্ধ কামরায়ছেলেটির দরাজ গলাপরপর আরও গান টুকরো, গোটা। ভোরে উঠেছে বলে সুকান্তর চোখ বুজে আসছে। চা-ওয়ালার আনাগোনা। খাবারের গন্ধ। যুবকটি টোকা দেয় সুকান্তর হাতে,

“আঙ্কল, নিন

কাগজের প্লেটে ভেজ-স্যাণ্ডউইচ, কলা, সেদ্ধ-ডিম, মিষ্টি।

“আরে! এসব কী?”

“খান না। আমরাও খাচ্ছি।”

“থ্যাঙ্ক ইউ। কদ্দূর যাবেন আপনারা?”

“নোয়ামুণ্ডি। বন্ধুর বিয়ে আছে

প্লেট হাতে নিয়ে সুকান্ত হাসেযুবকটির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেজানতে চায়,

“বাঃ বেশ। আপনার কী নাম? কী প্রফেশন?”

“আমি আবাহন সেন। আমরা এই গ্রুপে প্রায় সবাই ডাক্তার।”

“তাই নাকি? বর কই?”

“ও আছে অন্য কামরায়। বাড়ির লোকের সঙ্গে।”

টুকটাক কথা এগোয়পেছন থেকে সুগন্ধি মেয়ে একহাতে আবাহনের গলা জড়িয়ে ধরে,

“স্যরি, স্যরি বলছি তো! অনেকক্ষণ একা বসে আছি, চল প্লিজ।”

আবাহনের পাশ দিয়ে মেয়েটিকে দেখতে পায় সুকান্ত। বলে ওঠে,

“ডক্টর তিতাস! না?”

তিতাস মিনিটখানেক ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে,

“আপনি! আমার সেই পেশেন্ট। কবে দেখেছিলাম? একবছর পেরিয়ে গেল, না?”

“গেল বছর মার্চের শেষে গিয়েছিলাম আপনাদের ওখানে—।”

“হ্যাঁ— আবু শোন না, প্লিজ পেছনে গিয়ে একটু বোস না!”

“কী ব্যাপার ম্যাডাম? উনি তোর চেনা?”

“হ্যাঁ রে। আঙ্কলের সঙ্গে একটু দরকার আছে।”

“ঠিক হ্যায়!”

আবাহন মাথা নেড়ে গুনগুন করতে করতে চলে যায়আবাহনের খালি সিটটায় সুকান্তর গা ঘেঁষে বসে তিতাসএখন ওকে ডাক্তার মনে হয় না। অকারণ অপত্যস্নেহ ভিজিয়ে দেয়সুকান্ত প্রশ্ন করে,

“কলীগ?”

“বন্ধু। একসঙ্গে এম-ডি করছি।”

“ভালো, খুব ভালো ট্রেনটা আজ দেখছি লেটে যাচ্ছে?”

“হবে হয়ত। আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে

“আমারওতোমার মা-বাবা সুস্থ আছেন?”

সুকান্তর চোখে সোজাসুজি দৃষ্টি রাখে তিতাস,

“আছেআঙ্কল, আপনার কথা আমি শুনেছি আম্মির কাছে। সেদিনও বলেছিল, যেদিন আপনি গিয়েছিলেন। যদিও আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি আর। তাই এখন চিনতে পারছিলাম না

সুকান্তর নীরব মুখের ওপর জানালার কাচের আবছায়া আলো খেলা করেতিতাস বলে,

“আপনি কি জানতেন আম্মি লুকিয়ে কবিতা লিখত? খাতার পেছনে ছোট্ট করে আপনার নাম লিখেছিল! সুকান্ত মজুমদার। বি-কম, অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্স।”

“আরে আমি খুব পাতি একটা লোকএখনও তাই।”

সুকান্ত অল্প হাসে। এসব ছোঁয় না তাকে। তিতাস আবার কিছু বলেসে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো করে হেসে ওঠে,

“জেনে কী হবে ডাক্তার-ম্যাডাম? ধরিনি কারেও আপন বাসনা মুঠিতে—রবীন্দ্রনাথ। পড়ো তুমি?”

“নাঃ সত্যিই আপনার জেদ, সাহস কিছু ছিল না? না কি—?”

“ছিল না। ঠিক।”

“তবুও আম্মি—? আম্মি ভুল ছিল? জানেন, আমার নাম দিয়েছিল তিতাসনদী। আমার আব্বা চায় নি কোনও দিন

“উঁ? কী?”

“চায় নি আম্মিকে বুঝতে। সারাদিন রান্না করুক, ঘরের কাজ—আর কিছু না। কলেজও শেষ করতে পারল না। আচ্ছা, সব মেল-রাই এরকম হয়?”

“তোমার আব্বা কি তোমার আম্মিকে খুব কষ্ট দিত?”

সুকান্তর মনে প্রশ্নটা ঘোরে-ফেরে। কিন্তু জানতে চায় না। সাহস করে তিনটে আঙুল তিতাসের মাথায় রেখে আস্তে আস্তে চাপড় মারে,

“তোমার বন্ধু বোধহয় ওয়েট করছে।”

“স্ট্রেঞ্জ!”

“স্ট্রেঞ্জ আমি? না তিতাস, আমার মধ্যে কোনও রহস্য নেই। ইন ফ্যাক্ট কিছুই নেই। ওই বয়সে তোমার আম্মির ইনফ্যাচুয়েশন ছিল সাহিত্যের ছাত্রী তো, ইমোশন্যাল।”

“আপনার মধ্যে মিনিমাম রিঅ্যাকশনও দেখলাম না! একটা খবর দিই, নেক্সট মাসে আবাহন আর আমি রেজিস্ট্রি করছি। এখনও বলিনি কাউকে। আম্মিও হয়ত মেনে নিতে পারবে না।”

সুকান্ত বুকের মধ্যে খুশীর ছোট্ট ফোয়ারা। তেমনভাবেই বলে,

“খুব ভালো খবর মাতুমি না ডাক্তার? কারও ওপর রাগ জমিয়ে রেখো না। জানো কী, ঠিক মানুষটি খুঁজে পাওয়া মস্ত সাধনার কথা! আনন্দে থেকো মা

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন