কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(৪০)  

কখনও হৃদয়ের মা বলেন, একবার অন্তত বাড়ি যা বাছা। তোর মা-বাবা চিন্তা করবেন।

বিহান হাসে। বলে, এখানে থাকলেই ওরা বরং নিশ্চিন্ত থাকেন। বাড়িতে গেলেই তো সেই ...

বিহান চুপ করে যায়। হৃদয় ওর মাকে বুঝিয়ে বলে, ওর বাবার চাকরি নেই। বাড়িতে খুব অভাব। ওদের বাড়িতে গেলেই যেভাবে ওরা অভাবের কথা বলতে বসেন, বিহানকে আমার আর ছাড়তে ইচ্ছা করে না। জ্যাঠারা পাশেই থাকে, সচ্ছল অবস্থা। কিন্তু ওদের দিকে ফিরেও তাকায় না। ছেলেটার মনে সেই নিয়েও অনেক দুঃখ ...

আহা, বেচারা বড়ো দুঃখী, ও বরং আমাদের সঙ্গেই থাক। তুই দ্যাখ, ওর জন্য যদি কিছু করতে পারিস।

হৃদয় সত্যিই চেষ্টা করে। কিন্তু ওর সাধ্যই বা কতটুকু? এদিকে বিহানের ভালোবাসা প্রায় অত্যাচারের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। পরদিন হৃদয়ের পরীক্ষা – বিহান পাশে বসে আছে। হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলে চলেছে। বাধ্য হয়ে হৃদয় বলে, আজ আমাকে একটু ছেড়ে দে বিহান। পরীক্ষা আছে না...

বিহান বলে তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না যে। অনেক কথা থাকে আমার।

তবু হৃদয়ের চাপাচাপিতে সে অন্য ঘরে যায়। ছাদে যায়। সমুদ্রের ধার থেকেও ঘুরে আসে। শেষে মুখ কালো করে এসে বলে, তোকে আমি বিরক্ত করব না হৃদয়। তুই শুধু আমাকে এই ঘরে থাকতে দে।

হৃদয় আর না বলতে পারে না।

পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে হৃদয় দেখে, বিহান ওর ঘরে অপেক্ষা করছে। ঠিক যেন একটা পোষা কুকুর। প্রভুর আসার অপেক্ষায় বসে আছে আর ঘন ঘন লেজ নাড়ছে। অভুক্ত, মন খারাপ। হৃদয় ওকে সান্ত্বনা দেয়।

কী হয়েছে বিহান? ওভাবে বসে আছিস কেন?

আর কেন? এত দেরী হল তোর? কী হবে এই পরীক্ষা দিয়ে?

চাকরি পাবো। হৃদয় সংক্ষেপে বলে।

চাকরি? কত বয়স তোর? এই বয়সে চাকরি? মাইনে। বোনাস। ইনক্রিমেন্ট। পদোন্নতি। বিয়ে। প্রতিষ্ঠা। কী মসৃণ জীবন তোর।

একটু যেন চমকে ওঠে হৃদয়। বিহানের গলায় কি সামান্য শ্লেষ ধরা পড়ল? ঠিক বুঝতে পারল না। এক মুহূর্তের জন্য কী একটা উঁকি দিয়ে গেল। তারপরেই ভুস করে ডুবে গেল জলের তলায়। হৃদয় আর খুঁজে পেল না। ওর চোখে শুধু জল আর জল। আনুগত্য, বাধ্যতা, বশ্যতা। সন্দেহ করার, প্রশ্ন তোলার কোনও জায়গাই নেই।

সাঁঝ পরে দিশারীকে বলেছিল, হৃদয়ের সর্বনাশ করেছিল ওর দয়ালূ মন। সোনা দিয়ে বাঁধানো একটা অন্তঃকরণ। মেধা, সারল্য, উদারতা – কী ছিল না সেখানে? দয়া, করুণা, সমবেদনা দেখাতে গিয়ে কোনওটাই কাজে এল না। কে যে ওর ওই নাম রেখেছিল, হৃদয়! হৃদয়সর্বস্বতাই ওকে ডুবিয়ে দিল। ওকে ঠেলে দিল একের পর এক ভুলের দিকে। লোকে সহজেই ওকে ধরে ফেলত। বুঝতে পারত, একে অনায়াসে পটিয়ে ফেলা যায়। বিশেষ করে মিষ্টি মিষ্টি কথায় এ একেবারে গলে যায়। তখন আর আত্মরক্ষাও করতে পারে না। নিজের সম্পদগুলিকে কেউ যদি ঠিকভাবে রক্ষা না করে, ব্যবহার না করে, নিজের দুর্বলতাগুলোকেই প্রশ্রয় দিয়ে যায়, কে তাকে রক্ষা করবে? লোকে তো সুযোগ নেবেই। দুর্বলতা দেখালে কে তাকে নিজের স্বার্থে কাজে না লাগিয়ে ছাড়বে? সেই উদারতা ক-জনের থাকে? হৃদয় সেই সব লোকের জন্য নিজের শ্রম, অর্থ, ভাবনা, সময়কে নষ্ট করছিল। নিজেকে নিংড়ে দিয়েছিল। যাদের অন্য কেউ হলে অনেক আগেই ধরে ফেলত এবং নিজের জীবন থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিত। এরা শুধু হৃদয়কেই নষ্ট করে গেছে, নিজেরা কিছুই হয়ে উঠতে পারেনি। নিজেরা কিছু হয়ে ওঠার যোগ্যতাই যেমন এদের ছিল না, তেমনই ছিল না হৃদয়কে বোঝার কোনও দূরদর্শিতা। এইসব মানুষ খুব ধূর্ত প্রকৃতির হয় এবং চালাকি করেই সব জায়গায় সফল হতে চায়। অন্যের উৎকর্ষকেও এরা নিজেদের পাপ ও ইতরতা দিয়ে বিকৃত করতে চায়। হৃদয় এদের সীমাবদ্ধতা ও সঙ্কীর্ণতাকে বুঝেও বুঝত না। সেগুলো এড়াতে চাইত আর আত্মপ্রতারণার শাস্তি পেত নিজেই। এদের সঙ্গে জড়িয়ে সে যতই সৃষ্টিশীলতার দোহাই দিক, আসলে ততই তার নিজের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত হচ্ছিল।

সেই দিনগুলোয় শ্রমণ মাঝে মাঝেই আসত হৃদয়ের কাছে। সে আসত ঝড়ের মতো, অসম্ভব আবেগতাড়িত হয়ে, প্রায় ছুটতে ছুটতে। হাতে থাকত কোনও একটা ফুল। বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই বলত, মা কোথায়, আমার মা? এই দ্যাখো, তোমার জন্য আজ কী ফুল এনেছি। মনে রেখো, তোমার জন্যই। হৃদয়ের জন্য নয়। কোথায় সাজাবে মা এই ফুলটা? কোন ঘরে? আমার সামনেই রাখতে হবে। আমি দেখব।

হৃদয়ের মা ওকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। তারপর শ্রমণ এমন সব কথা বলতে শুরু করত যা নিঃসঙ্কোচে বলা বেশ কঠিন ব্যাপার। কিন্তু শ্রমণ অকপটেই কথাগুলো বলত।

হৃদয়ের মা-র দিকে তাকিয়েই সে বলে উঠত, একটু চা খাওয়াবে না মা?

সে তোকে আমি এক্ষুণি খাওয়াবো। হৃদয়ের মা বলতেন। কিন্তু তুই এত হাঁপাচ্ছিস কেন বাছা?

শ্রমণ হেসে উঠত। তারপর বলত, হাঁপাব না? কাল সারারাত সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটেছি। বাড়ির লোকের সে কী চিন্তা! আমি বারবার ফোন কেটে দিচ্ছি, আর ওরা ফোন করছে। কিছুতেই বোঝাতে পারছি না, ওই হাঁটাটা আমার কতটা দরকার ছিল।

তুই এখনও বাড়ি ফিরিসনি? তাছাড়া হৃদয়ের মা ভুরু কুঁচকে যোগ করতেন, কাল রাতে তো খুব ঝড় হয়েছিল। আমরা তো ঘরে বসেই আঁতকে আঁতকে উঠেছি। আর তুই বাইরে, সমুদ্রের ধারে, সারারাত...

ওই জন্যই তো। শ্রমণ বলত। ঝড় বলেই তো বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্যিস তেমন একটা বৃষ্টি হয়নি। হলেও কিছু যায় আসত না। ভিজতাম। এখনও বাড়ি ফিরি নি। একটু চা...

হৃদয়ের মা চা করতে চলে যেতেন। পরে হৃদয়কে বলতেন, ছেলেটা পাগল। কিন্তু মনটা সোনার মতো খাঁটি। তা, ওর হঠাৎ অত কী দরকার পড়েছিল?

মা, সে অনেক কথা। ও একটি মেয়েকে ভালোবাসে। তুমি চিনবে। মেহুলী। সমধার বাড়িতে আলাপ। মেহুলীকে ও সব উজাড় করে দিয়ে আসে। যখন যে গান কবিতা গল্প গান উপন্যাস ওর ভালো লাগে ছুটে গিয়ে সব দিয়ে আসে। মেহুলী হাত পেতে সব নেয়। কিন্তু কিছুই প্রায় বলে না। গম্ভীর হয়েই সব গ্রহন করে। কিছুদিন আগে একটা দামী মোবাইল মেয়েটিকে উপহার দিয়েছে শ্রমণ। মেহুলী শুধু বলেছিল, ওর আগের মোবাইলে ঠিক মতো কথা শোনা যাচ্ছে না। আর কথা শোনাতে না পারলে শ্রমণের চলবে কী করে? মাঝে মাঝে দু-জনে ঘুরতে বেরোয়। শ্রমণই সব খরচ দেয়। মেহুলী পছন্দমতো জুতোজামা কেনে। সবই শ্রমণের খরচে। শ্রমণই বক্তা। মেহুলী শুধুই শ্রোতা। শব্দ খরচ করার ব্যাপারে মেয়েটি খুবই কৃপণ। অথচ মেহুলী কম কথা বলে, আমরা কোনওদিন দেখিওনি, শুনিওনি। শ্রমণ মোটামুটি নিজের অনুমানের ওপরেই আছে। যেদিন ওর বেশী আনন্দ হয়, ওর কোনও হুঁশ থাকে না। নেশা করে বেরিয়ে পড়ে। তারপর সারারাত ধরে সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটে।

বিহান সব শুনছিল। পরে সে হৃদয়কে বলেছিল, পুরো ব্যাপারটাই একপেশে। শ্রমণ একতরফাভাবে ইনভেস্ট করে যাচ্ছে। কোনও রিটার্ণ নেই। কোনও একনলেজমেন্ট নেই। অন্য কেউ হলে হতাশ হয়ে যেত। শ্রমণ ফুটছে...

হৃদয় জানে, মেহুলীর সঙ্গে বিশ্রুতর একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আগ্নেয়র সঙ্গে খেলা বন্ধ হয়ে গেছে তার আগেই। এখন মেহুলীর নতুন কাউকে দরকার। কিন্তু শ্রমণ অমন বোকামি করছে কেন? নাঃ বোকামি নয়। এটাই শ্রমণ। নিজের মনের কথা ছাড়া আর কোনও কথায় সে তো কর্ণপাত করে না।

হৃদয়ের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, ছেলেটার সব ভালো। শুধু অসম্ভব বাউণ্ডুলে।

এর কিছুদিন পর মেহুলীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যায় শ্রমণের। হৃদয় জানতে চেয়েছিল, কেন?

আগ্নেয়কে জিজ্ঞেস করে দেখিস। বলেছিল শ্রমণ।

হৃদয় বলেছিল, তুই কিছুদিন আগে ওকে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিস না? তার আগে একটার পর একপ্টা ফুলদানি। বই। জুতো। জামা। আমি হলে সহ্য করতাম না। যা দিয়েছি সব গিয়ে ফেরত চাইতাম।

আমি পারব না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রমণ বলেছিল। যা ওকে দিয়েছি তার একটাও ফেরত চাইতে পারব না। সে সবই ওর। আমার কোনও দাবী নেই। ওগুলো নিয়ে ওর যা ইচ্ছে তাই করুক...

ঠিক যেমন তোর ভালোবাসা নিয়ে করেছে। তাই তো? বাঁকা সুরে বলে উঠেছিল হৃদয়। নিজেকে খোলা মাঠ করে তুলিস না শ্রমণ। যে যেমন ইচ্ছে খেলে যাবে, তোর কিছুই করার থাকবে না? তুই খুব উদার। মেয়েটিকে অসম্ভব ভালোবাসিস। সবই বুঝতে পারছি আমি। তবুও...

হৃদয়, ভালোবেসে যা দিয়েছি তা ফেরত চাইবার ক্ষমতা আমার নেই। ওকে পালটা আঘাত দিতে পারব না।

হৃদয় যেন ফুঁসে উঠল। তারপর বলল, যা উপহার হিসেবে দিয়েছিস সেগুলোর কথা থাক। যা সাময়িকভাবে পড়তে বা ব্যবহার করতে দিয়েছিস, সেগুলো তো চাইতে পারিস। সেগুলো তো তোরই।

পারতাম। এখন আর পারব না। বিহান নিজের জায়গায় স্থির।

পরে বিহান হাসতে হাসতে ওকে বলেছিল, তুই ওকে বাজিয়ে দেখছিলি, না?

ঠিক তাই। হৃদয়ও হেসে উঠেছিল। যে ভালোবাসা অর্থহীন, তারও গভীরতা মেপে দেখবার দরকার আছে...

বিহানের মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। বলে ওথে, কী পেলি তুই?

আর কী! প্রত্যাখান ওর ভালোবাসায় সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারেনি। নিজের ভালোবাসায় ও একেবারে একরোখা। কিন্তু ওকে আমি জানি। বেশিদিন এসব ও সহ্য করবে না। নতুন কোনও আনন্দের উৎস খুঁজে নেবে। তাতে ডুবে যাবে একেবারে। নতুন সেই জীবনে এই মেয়েটির কোনও চিহ্নই থাকবে না।

বিহান আরও গম্ভীর হয়ে ওঠে। ঈর্ষায় জ্বলে যায় ভেতরটা।

(ক্রমশঃ)

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন