কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় হিন্দী ছায়াছবি (দ্বিতীয় পর্বঃ ১৯৬৫-৬৬)



রাজকুমার দেখার কিছু আগেই বাবা ভারতীয় সেনাদল থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে ভোলটাস কোম্পানীতে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে যোগদান করেন। এর ফলে সৈনিকাবাস ছেড়ে আমরা উঠে আসি গোল পার্কের কাছে পূর্ণ দাস রোডে একটি ভাড়াবাড়িতে। তা সত্ত্বেও বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পে মাঝে মাঝে গিয়ে মাঠে বসে ছবি দেখা চালু ছিল। সেখানে দেখেছি ১৯৫৬ সালের তৃতীয় সফলতম ছবি, রাজ কাপুর-নার্গিস অভিনীত চোরি-চোরি যা আদতে ১৯৩৪ সালের হলিউড ছবি It Happened One Night-এর রূপান্তর; বিমল রায়ের শরৎ-কাহিনী আধারিত পরিণীতা (১৯৫৩-র চতুর্থ সফলতম ছবি), যা একেবারেই বোধগম্য হয়নি এবং সেইজন্য ভালো লাগেনি; এবং স্বামী বিবেকানন্দের ওপর একটি হিন্দী তথ্যচিত্র (জানি না এটি ১৯৬৪ সালে বিমল রায়ের করা ছবি কিনা)। সবই সাদা-কালো।

পূর্ণ দাস রোড থেকে দুটি সিনেমা হল কাছাকাছি ছিলঃ পূর্বোল্লিখিত প্রিয়া আর সাদার্ন অ্যাভিনিউতে মেনকা। এই মেনকাতে রাতের শো-তে বাবার সঙ্গে দেখলাম সেই শাম্মী কাপুর আর আমার কাছে নতুন নায়িকা রাজশ্রী অভিনীত রঙিনজানোয়ার (১৯৬৫)। ১৯৬১-তে শাম্মী হয়েছিলেন জংলী, ১৯৬৬-তে হবেন বদতমীজ! শুনেছি ১৯৬৭ সালের An Evening in Paris ছবিতে নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর নাকি নায়ক শাম্মী কাপুর অভিনীত চরিত্রটির উদ্দেশে ‘বদতমীজ, জংলী, জানোয়ার’, তিনটে অভিধাই প্রয়োগ করেছিলেন! পরে ১৯৬৮ সালের ব্রহ্মচারী ছবিতেও এই তিনটি শব্দ শাম্মী কাপুর অভিনীত চরিত্রটির প্রতি নিক্ষেপিত হবে! দাদার বোধহয় জানোয়ার ছবিটা সম্বন্ধে জানা ছিল, বলেছিলেন, “এটা তেমন জমবে না!” ঠিক তাই! এতো রাজকুমার-এর মতো মজাদার রূপকথা নয়, একেবারে পারিবারিক ‘মেলোড্রামা’ – বজ্রকঠোর ধনী পিতা (সেই পৃথ্বীরাজ কাপুর) চান দুই ছেলেই ধনী মেয়ে বিয়ে করুক, দুই ভাইই (সুন্দর-শাম্মী কাপুর, মহেন্দ্র-রেহমান) গরীব মেয়ের প্রেমে পড়ে, এক ভাই (রেহমান) বাবার বিরোধতায় এবং তার প্রেমিকা, পরে স্ত্রী, সীমা শ্বশুরবাড়ি থেকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিতাড়িত হবার পর, মদ্যপ হয়ে যায় এবং বাহার নামের এক ক্রুর বেশ্যার পাল্লায় পড়ে। সুন্দরের বুদ্ধিমত্তায় অবশেষে সব সমস্যার সমাধান হয় এবং দুই প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি (মহেন্দ্র-সীমা, সুন্দর-স্বপ্না, দুই নারী চরিত্রে যথাক্রমে শ্যামা এবং রাজশ্রী) সুখে ঘর বাঁধে। তবে রফির গলায় গানগুলো ভালো লেগেছিল, বিশেষ করে ‘লাল ছড়ি’ আর ‘মেরী মুহব্বত জওয়াঁ রহেগী’, যদিও আলোড়ন তুলেছিল তখন তুমুল জনপ্রিয় বীটলসদের ‘I wanna hold your hand’ গানের সুরে ‘দেখো, অব তো কিসী কো নহী হ্যায় খবর’, কণ্ঠে মহম্মদ রফি, আশা ভোসলে ও অন্যান্য। বক্স অফিসে ১৯৬৫-তে জানোয়ার-এর স্থান সপ্তম।

এরপর প্রিয়াতে বাবা আমার আর দাদার জন্য টিকিট কেটে দেন, একেবারে শৈশবে, তিন বছর বয়সে, বাংলা শেষ পর্যন্ত (১৯৬০) ছবি দেখে যাঁর ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম, সেই বিশ্বজিৎ, এবং দিল দেকে দেখোর নায়িকা আশা পারেখ অভিনীত রঙিনমেরে সনম (১৯৬৫) প্রিয়াতে দেখার জন্য। ছবির সুপারহিট গানগুলো তখন সবসময় মাথায় ঘুরছে, বিশেষত ‘হমদম মেরে, মান ভী যাও’। ছবিটি দেখে তো আমি আনন্দে আটখানা! দেখতে দেখতেই দাদা বললেন, “এ তো সব Come September (১৯৬১) থেকে নেওয়া,” যে হলিউড কমেডির ‘থীম মিউজিক’-এর রেকর্ড আমাদের বাড়িতে শুনেছি। তবে খলনায়ক শ্যামের (প্রাণ) কীর্তিকলাপের ফলে হিন্দী ছবিটি আর নিছক কমেডি থাকেনি। ‘ভ্যাম্প’ কামিনীর (মমতাজ) নায়ক কুমার (বিশ্বজিৎ)-কে ফাঁদে ফেলা, বিশেষ করে তারপর শ্যামের বা তার অনুচরদের হাতে তার খুন হওয়া, বেশ ধাক্কা দিয়েছিল। আর ‘ভিলেন’-এর সঙ্গে মারামারির ব্যাপারে কিন্তু বিশ্বজিৎ-কে শাম্মী কাপুরের তুলনায় অপটু লেগেছিল। অবশ্য, মজরু সুলতানপুরীর লেখা আর ও পি নায়ারের সুর দেওয়া আটটি গান এক কথায় অনবদ্য। মহম্মদ রফি এবং আশা ভোসলের কণ্ঠযুগলও দারুণ। আমার পছন্দ ছিল রফির গানগুলি (‘পুকারতা চলা হুঁ ম্যায়’, পূর্বোল্লিখিত ‘হমদম মেরে’, ‘হুয়ে হ্যাঁ তুম পর আশিক হম’, ‘টুকড়ে হ্যাঁ মেরে দিলকে’)। দাদার বেশী ভালো লেগেছিলো আশার গলায় ‘যাইয়ে আপ কাহাঁ জায়েঙ্গে’)। প্রথম, দ্বিতীয় আর চতুর্থ গানের রেকর্ড কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে একটির বিপরীত দিকে রফি-আশার দ্বৈতকণ্ঠে একটি নবম গান ছিল (‘হমনে তো দিল কো আপকে’) যেটি সিনেমায় পাইনি। ১৯৬৫-র বক্স অফিসে মেরে সনম-এর স্থান নবম।

আমি বিশ্বজিতের ভক্ত বলে এই সময়েই বাবা সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন দেখতে মেনকা সিনেমায় হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত রঙিন রূপকথা দো দিল (১৯৬৫), যার সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তখনও হেমন্ত-ভক্ত হয়ে উঠিনি, নায়কের নেপথ্যে রফির গলাই ভালো লাগলো। আর বিশ্বজিৎ চমকে দিলেন ছবির শীর্ষবিন্দুতে খলনায়কের (সেই প্রাণ) সঙ্গে তলোয়ার লড়াইতে। বাড়ী ফিরে উচ্ছ্বসিত হয়ে দাদাকে বললাম, “জানিস, শাম্মী কাপুর রাজকুমার-এ যা পারেনি, বিশ্বজিৎ তাই করে দেখালো – প্রাণের গায়ে তলোয়ার বিঁধিয়ে দিল!” এর অনেক পরে টেলিভিশনে বাংলা গড় নাসিমপুর ছবিতেও দেখেছি, বিশ্বজিৎ বেশ ভালো তলোয়ার চালাতেন – বাঙালী নায়কদের মধ্যে বোধহয় একমাত্র!

প্রসঙ্গত, পূর্ণ দাস রোডে, সম্ভবত কালীপুজোর সময়, পর্দা খাটিয়ে ১৬ মিমি প্রোজেকশানে ছবি দেখানো হতো। প্রথমবার দেখানো হয়েছিল বাংলা ডাক হরকরা, যে গল্প অষ্টম শ্রেণীতে উঠে ইস্কুলের পাঠ্যপুস্তকেই পড়ব। দ্বিতীয়বার ক্লাব সভ্যদের দাবী মেনে হিন্দী ছবির খোঁজ করা হলো। শুনলাম আমার প্রিয় শাম্মী কাপুর এবং গীতা বালী অভিনীত কফি হাউস দেখানো হবে। কিন্তু, আমাকে হতাশ করে দেখানো হলো ১৯৬০ সালের অষ্টম সফলতম ছবি, সাদা কালো ঘুঙ্ঘট। সাংসারিক মেলোড্রামা, অভিনয়ে বীণা রায়, প্রদীপকুমার, এবং, আমার সান্ত্বনা হিসেবে, আশা পারেখ!

এইরকম সময়েই দাদা আমাকে আর মাকে নিয়ে ধর্মতলার ‘প্যারাডাইস’ প্রেক্ষাগৃহে এলেন । উদ্দেশ্য অশোককুমার, রাজকুমার, ফিরোজ খান এবং তরুণ বোস অভিনীত উঁচে লোগ (১৯৬৫)। ব্যতিক্রমী কাহিনী, মূলধারার হিন্দী ছবির জগতে। বাবা চন্দ্রকান্ত (অশোককুমার) অবসরপ্রাপ্ত সেনানী, যিনি যুদ্ধে নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। বিপত্নীক মানুষটির সংসার দুই ছেলেকে নিয়েঃ বড়ছেলে শ্রীকান্ত (রাজকুমার) পুলিশ ইন্সপেক্টার, ছোট রজনীকান্ত (ফিরোজ খান)। চন্দ্রকান্ত চান ছোট ছেলের সঙ্গে প্রতিবেশী মাস্টারমশাই গুণীচাঁদের (কানহাইয়ালাল) মেয়ে পল্লবীর বিয়ে দিতে। কিন্তু রজনীকান্ত মাদ্রাজে ক্যাডেট ট্রেনিং করার সময় বিমলা নামের একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে এবং তাকে গর্ভবতী করে ফেলে। আদর্শবাদী এবং নৈতিক ব্যাপারে কঠোর বাবাকে এই কথা জানাবার সাহস না থাকায় রজনীকান্ত বিমলাকে গর্ভপাতের পরামর্শ দিয়ে পালায়। বিমলা আত্মহত্যা করে এবং তার দাদা মোহন (তরুণ বোস) রজনীকান্তকে অনুসরণ করে ট্রেনে তাকে হত্যা করে। পলাতক মোহন এক গৃহস্থের বাড়িতে আশ্রয় নেয় – ভাগ্যের পরিহাসে সে বাড়ি চন্দ্রকান্তের! মোহন চন্দ্রকান্তকে জানায় যে সে পেশায় অধ্যাপক এবং নিজের বোনের সর্বনাশকারীকে সে ক্রোধের বশে মেরে ফেলেছে। চন্দ্রকান্ত মোহনকে নিজের পুলিশ অফিসার বড় ছেলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখেন। ইতিমধ্যে টেলিগ্রামে রজনীকান্তের খুন হবার খবর পেয়ে চন্দ্রকান্ত বুঝতে পারেন মোহনই তাঁর ছোট ছেলের হত্যাকারী! শ্রীকান্ত অকূস্থলে উপস্থিত হলে দৃষ্টিহীন চন্দ্রকান্ত হাত বাড়িয়ে দেন তাঁর চাবুকের জন্য। শ্রীকান্ত ছোট ভাইয়ের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের সব কিছু জেনেও চন্দ্রকান্তকে জানায়নি কেন? তাহলে তিনি রজনীকান্তকে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে বাধ্য করতেন! শ্রীকান্তই চন্দ্রকান্তের বিচারে নিজের ভাইয়ের খুনের জন্য দায়ী। প্রতিটি কথার সঙ্গে চন্দ্রকান্ত শ্রীকান্তের পিঠে করেন একটি করে চাবুকের আঘাত। এত বছর পরেও এই দৃশ্য চোখে ভাসে! এরপর তিনি পুলিশ অফিসার ছেলের কাছে আত্মসমর্পণ করেন একজন খুনী মোহনকে সাহায্য করার অপরাধে। শ্রীকান্ত বাবা এবং মোহনকে নিয়ে থানার দিকে এগোয়।

ফণী মজুমদার পরিচালিত স্মরণীয় ছবি। ত্রয়োদশতম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অনুষ্ঠানে উঁচে লোগ দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ হিন্দী ছবির সম্মান পায়। ব্যাবসায়িক হিসেবে এটির স্থান ১৯৬৫ সালে অষ্টাদশ। তিন মুখ্য পুরুষ চরিত্রে তিন অভিনেতারই কাজ প্রশংসনীয়। চিত্রগুপ্তের সুরে মজরু সুলতানপুরীর চারটি গানের মধ্যে বিশেষ করে মন ছোঁয় ফিরোজ খানের মুখে মহম্মদ রফির ‘জাগ দিল-এ দীওয়ানা’, আর ফিরোজ খান এবং বিমলা-রূপিনী কে আর বিজয়ার মুখে মহেন্দ্র কাপুর-লতা মঙ্গেশকরের মুখে ‘আ যা রে মেরে পেয়ার কে রাহী’। মান্না দে আর আশা ভোসলের দ্বৈত কণ্ঠে বিবেকধর্মী গান, ‘পাপ করে পাপী, সহে পূণ্যবান’-ও ভালো, এবং এটির নেপথ্যে পুনরাবৃত্তি দিয়েই ছবি শেষ হয়, যখন শ্রীকান্ত পিতা চন্দ্রনাথ এবং আত্মঘাতী বোনের জন্য প্রতিশোধ নেওয়া ভাই মোহনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। ‘প্যারাডাইস’-এ এই প্রথম ও শেষ যাওয়া। মনে হয় ‘পুশ-ব্যাক’ সীট ছিল, যা সে সময়ে অভিজাত মেট্রোতেও পাইনি। ছবিটি সাদা-কালোয় তোলা।

১৯৬৫ সালে আরেকটি রঙিন ছবি প্রিয়াতে দাদার সঙ্গে দেখেছিলামঃ মহাভারত । ভীমের ভূমিকায় দারা সিং, অর্জুন প্রদীপকুমার, কৃষ্ণ হয়েছিলেন অভি ভট্টাচার্য, এবং দ্রৌপদী সম্ভবত পদ্মিনী।

এই ১৯৬৫-র অষ্টম সফলতম ছবি, আগাথা ক্রিস্টীর And Then There Were None অনুপ্রাণিত, এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্দিষ্ট, রঙিন গুমনাম (অভিনয়ে মনোজ কুমার, নন্দা, প্রাণ, হেলেন, মেহমুদ, মদন পুরী, তরুণ বোস প্রমুখ) অবশেষে দেখব আশির দশকের প্রথমার্ধে, যখন আমি ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ এবং কলেজে অধ্যাপনারত, এবং যখন বাজার শক্তির কাছে মস্তক অবনত করে, এতদিন কঠোরভাবে হিন্দী ছবি না-আনা ভবানীপুরের পূর্ণ ছবিটিকে পুনর্মুক্তি দিয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন কলেজের দুই বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী, যাঁরা তাঁদের বাঙালীত্বকে সম্মান জানিয়ে, দেখতে চেয়েছিলেন পাশেই ভারতী প্রেক্ষাগৃহে চলা নারায়ণ সান্যালের উপন্যাস-আধারিত অশ্লীলতার দায়ে! ধিক আমাকে! তাঁদের টেনে নিয়ে গেলাম দু’ দশক পুরোনো এক বাজারী বলিউডী ছবি দেখতে। তখন মূল ইংরেজী উপন্যাসটি পড়া থাকায় তার এই বিচিত্র রূপান্তর দেখে বিরক্তই হয়েছিলাম। তবে এখন, অভিযোজন তত্ত্বের নিরিখে, উৎস কাহিনী নিয়ে যা করা হয়েছে তা বেশ মজারই লাগে, বিশেষ করে এক নিপাট লৌকিক সিরিয়াল হত্যার উপাখ্যানেও সেই বীস সাল বাদ স্টাইলে মহিলা কণ্ঠে আপাত-ভৌতিক গান! তার ব্যাখ্যাটিও বেশ কৌতুকপ্রদ।

১৯৬৬/৬৭ সালে প্রিয়াতে দেখা হলো নিরূপা রায়, বলরাজ সাহনি, সেই দোস্তি-র দৃষ্টিহীন ‘মোহন’-এর ভূমিকায় অভিনয় করা সুধীরকুমার, এবং তাঁর বিপরীতে সদ্য, ১৯৬৫ সালে পুণম কী রাত ছবিতে প্রথম নায়িকা হওয়া কুমুদ চুগানী অভিনীত, সাদা-কালো ছবিলাডলা। অনেক, অনেক পরে ছোট পর্দায় মায়ামৃগ (১৯৬০) দেখে বুঝেছি যে লাডলা তারই রূপান্তর। ওপরে যে অভিনেতাদের নাম দিয়েছি, বাংলায় সেসব ভূমিকায় রূপদান করেছিলেন যথাক্রমে সুনন্দা দেবী, ছবি বিশ্বাস, বিশ্বজিৎ এবং সন্ধ্যা রায়। উত্তমকুমার রূপায়িত মহিম চরিত্রের নাম হিন্দীতে মুরলী, অভিনয়ে কৌতুকাভিনেতা জগদীপ।

১৯৬৬-র শেষে আমার এক কাকার বিয়ে উপলক্ষ্যে আমরা সপরিবার যাই, প্রথমে ডেরাডুন আর তারপর দিল্লী। দিল্লীতে রিগাল সিনেমায় কাকা আর নতুন কাকীমাকে নিয়ে দেখা হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত বাংলা নাটক এবং তার থেকে হওয়া বাংলা ছবি জয় মা কালী বোর্ডিং-এর (১৯৫৫) রূপান্তর, মেহমুদ, বিশ্বজিৎ, কল্পনা প্রমুখ অভিনীত সাদা-কালো ছবি বিবি ঔর মকান। ছবির শুরুতেই যে গান, ‘খুল সিমসিম খুল্লম খুল্লা’ শুনেই চিনলাম, বাংলায় শোনা ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’!

বিবি ঔর মকান-এ বাংলা ছবির সাধন সরকারের জায়গায় এসেছিলেন দক্ষ এবং একাধিক সফল হিন্দী ছবির পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় যিনি কাহিনীর রূপান্তরও ঘটিয়েছেন। পাঁচ পুরুষ বন্ধু এক হোটেলে ঘর ভাড়া করে একসঙ্গে থাকে, নিজেদের পরিচয় দেয় ‘পঞ্চপাণ্ডব’ বলে । এদের মধ্যে একমাত্র পাণ্ডে (মেহমুদ) বিবাহিত, কিন্তু সেও তার স্ত্রীকে গ্রামে রেখে এসেছে। পাঁচজনই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে তাদের প্রত্যেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া অবধি তাদের এই একত্রে বাস চলবে। দেখা যায় যে এদের মধ্যে অরুণ (বিশ্বজিৎ) একজন সফল গায়ক। শেখর (আশিস কুমার) চিত্রশিল্পী যে আবার কোন নারী দৃশ্যমান হলেই হেঁচকি তোলে। সুরেশ দেহচর্চা করে আর একটু রগচটা স্বভাবের, আর কিষেণ (কেষ্ট মুখোপাধ্যায়) আপাতত বেকার, চাকরীর খোঁজে ব্যস্ত এবং বারবার বিফল হয়ে হতাশায় ভুগছে। এই সময় হোটেলের কুচক্রী মালিক পাঁচজনের অনুপস্থিতিতে তাদের ঘরে দুটি মেয়ে ঢুকিয়ে তাদের দুশ্চরিত্র প্রতিপন্ন করে একদিনের মধ্যে ঘর ছাড়ার নিদান দেয়। অনেক খুঁজে সুরেশ খার অঞ্চলে একটি বাড়ীর খোঁজ পায় । বাড়ীর মালিক রোগবিলাসী, নিজের রক্তচাপ নিয়ে সর্বক্ষণ অশান্তিতে বাড়ীর দোতলায় বাস করেন, তাঁর স্ত্রী প্রায় দৃষ্টিহীন। পাঁচজন একতলায় তিন তিনটি ঘর পাবে, কিন্তু সমস্যা এই যে তাঁরা একমাত্র বিবাহিতদেরই ভাড়াটে করবেন। অতএব কিষেণকে নিজের স্ত্রী আর অরুণকে শেখরের স্ত্রী সাজিয়ে পাণ্ডে বাড়িতে প্রবেশ করে।

এরপর দিল্লী থেকে এসে পড়ে বাড়িওয়ালা দম্পতির দুই অনূঢ়া কন্যা গীতা (কল্পনা) আর লীলা (শবনম)। শেখর তো প্রথম দৃষ্টিতেই প্রেমে পড়ে লীলার। অরুণও শীলার দিকে আকৃষ্ট হয়। পাণ্ডের গ্রাম থেকে তার খবর নিতে এসে পাণ্ডের বাপের বাড়ীর চাকর শোনে যে পাণ্ডে সস্ত্রীক খারের বাড়িতে বাস করছে আর স্বচক্ষে ‘বড় বৌ’-রূপী কিষেণকে দেখে। গ্রামে ফিরে গিয়ে পাণ্ডের বাবা-মা-স্ত্রীকে এই খবর দিতে ক্ষিপ্ত বাবা বৌমাকে নিয়ে খারের বাড়ীতে উপস্থিত হন। প্রায় একই সঙ্গে অকূস্থলে এসে পড়েন শেখরের বাবা এবং ছেলে ‘লাভ ম্যারেজ’ করেছে শুনে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করতে উদ্যত হন। পাণ্ডে পুরো ব্যাপার ব্যাখ্যা করতে ঘটে মধুরেণ সমাপয়েত।

সে তো হলো। কিন্তু ততদিনে যে মুক্তি পেয়ে গেছে, এবং দারুণভাবে হিট করেছে আমার প্রিয় জুটি শাম্মী কাপুর-আশা পারেখ অভিনীত রহস্য কাহিনীচিত্র তীসরী মঞ্জিল! সে তো দেখতেই হবে! দাদা নিয়ে গেলেন দিল্লীর কোন এক হলে। দিল্লীতে আমার মতো কলকাতা-নিবাসীর পক্ষে এক বিচিত্র ব্যাপার দেখলাম। কলকাতার যাবতীয় হলে সোম থেকে শনি হতো তিনটি শো – ম্যাটিনী (৩টের বা তার কিছু আগে), ইভনিং (৬টা বা তার কিছু আগে), আর নাইট (৯টা বা তার কিছু আগে) । আর কিছু হলে থাকত রবিবার সকালে সাড়ে দশটার শো। দিল্লীতে জীবনে প্রথম দেখলাম ‘নুন শো’ – দুপুর ১২টার আশেপাশে। সেই শো-ই তীসরী মঞ্জিল-এর জন্য বরাদ্দ। দাদা টিকিট চাইতেই কাউন্টার আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উক্তি হলো, “বচ্চেলোগ নেহীঁ জায়েঙ্গে!” ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা যাতে বিদ্যালয়-পালিয়ে চলচ্চিত্রের দর্শক না হয়ে ওঠে!

অতএব কলকাতায় ফিরে অপেক্ষা করে অবশেষে তীসরী মঞ্জিল (রঙিন) বা তিনতলায় চড়লাম কালীঘাট এলাকার বসুশ্রীতে। সে গল্প এর পরের পর্বে।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন