কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

শৌভিক দে

 

সমকালীন ছোটগল্প


জীবনের এই স্বাদ, সুপক্ক যবের ঘ্রাণ...

সতেরো তলার ব্যালকনি থেকে দ্বৈপায়ন দত্ত রায় দেখলেন একটা নীল গাড়ি আসছে যার ছাদে মিকি মাউস আঁকা। এ রকম গাড়ি এ সংসারে একটিই আছে। কেনার পরে গাড়ির মালিক দাঁত বের করে বলেছিল -  যাতে অত উপর থেকেও মা বাবা চিনতে পারে ...  অন্য গাড়ির সঙ্গে গুলিয়ে না যায় ... তাই ছাদে ছবি আঁকিয়ে নিয়েছি। রাস্তার জন মানুষ দেখতে পাবে না। কিন্তু আকাশ থেকে ... দেখা যাবে। ছেলে বটে এক খানা। জৈবিকভাবে তারই শরীরের অংশ,  কিন্তু মাথাটি ভাড়া নিয়ে রেখেছেন মাতুল বংশ, আধা পাগল সব। মনে মনে বিড়বিড় করলেন তিনি।

এই গাড়ির পেটের ভিতরে আছে  দ্বৈপায়ন বাবুর একমাত্র ছেলের আড়াই জনের পরিবার। আমেরিকায় আজ নিশ্চয়ই ছুটি।  তাই ভারতবর্ষে - আমেরিকার ক্যালেন্ডারে জীবন যাপন করা ছেলে - মা বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসছে। গিন্নী হয়ত জানেন - কিন্তু কালকে ভাত গলে যাওয়া নিয়ে তুমুল সুনামি হওয়ার পর -   আপাতত ধ্বংসস্তূপের শান্তি। বোধহয় সেই জন্যেই ছেলে আসছে ত্রাণের ত্রিপল নিয়ে।  দ্বৈপায়নবাবু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস চাপলেন। এই শুরু হবে ঘরময় হুলুস্থুলু কাণ্ড - তিনি প্রবীণ নাগরিক বলে কোনো রেয়াত পাবেন না। তাছাড়া তার বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করে ঝাঁপতাল বাজতে লাগল, সঙ্গে রামকেলীতে বাঁশি । এটা অবশ্য এক অন্য অশান্তি।

দ্বৈপায়ন বাবু ইদানীং পরকীয়া শব্দটির উপর নিতান্ত গোপনীয় এবং ব্যক্তিগত গবেষণা করছেন। তার 'অ আ ক খ' দিনের বন্ধু ন্যায়তীর্থ ন্যায়চঞ্চু চরৈবেতি চক্রবর্তীর সঙ্গে পরামর্শ করে দেখেছেন কিন্তু তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাননি। চক্রবর্তী বলেছেন -

- ' দ্যাখ  দীনু - পরকীয়া শব্দের সহজ এবং প্রচলিত অর্থ হল স্ত্রী বর্তমান থাকতেও অন্য মহিলার প্রতি আকর্ষিত হওয়া। সেটাকে এক কথায় দোষ বলা খুব মুস্কিল কারণ কে বা কারা ... কার প্রতি আকর্ষিত হবে সেটা দেবা না জানন্তি, কুতো মনুষ্য। উদ্ভট শ্লোক বলছে - 'ব্যাতিষজতি পদার্থানান্তর কোওপি হেতুর্ন, খলু বোহিরুপাধিন প্রীতয় সংশ্রয়ন্তে।' অর্থাৎ কিনা দুটি মানুষ কেন কাছাকাছি আসে সেটার কারণ অজ্ঞাত। প্রেম কখনই বাহ্য কারণের উপর নির্ভরশীল নয়। স্বর্গে এমন অহরহ ঘটে থাকে। সত্যযুগে অমৃত সন্ধান করতে গিয়ে অসুরে, ত্রেতায় শূর্পনখার বদলা নিতে গিয়ে রাবণে, দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ ...  সে আর কি বলি ... আর  কলিতে তো শোভন অশোভন বোধ - ঝড়ে আর মিডিয়ায় উড়ে গেছে। ইন্দ্রগোপ কীটের মত ঝাঁকে  ঝাঁক  ...। আচ্ছা তোর জীব বিদ্যা ছিল না? ইন্দ্রগোপ কীট বলতে ঠিক কি বোঝায় একবার দেখিস তো' ।

= ' মাইথোলজি থেকে জুওলজি পর্যন্ত টেনে আনলি ... তুই পারিস বটে। আমি  শুধু জানতে চাইছি অন্য মহিলার কথায় ... ধর তাকে আমি বেশ পছন্দই করি ... কিন্তু তবু ... নিয়মিত গাঁট গচ্চা দেওয়া কি রীতি সম্মত'?

- 'না রীতি সম্মত বলাটা ঠিক হবে না। চণ্ডীদাস ... দেননি ... শ্রী বাসুদেব ... নাহ তেমন উল্লেখ নেই। রোমিও জুলিয়েট, হীর রাঞ্ঝা ... না তেমন কিছু তো জানি না'।

= ' তবেই বোঝ। শুধু ভালবাসাই যথেষ্ট হওয়া উচিৎ'।

- ' কিঙ্কি ফ্রিডমানের নাম শুনেছিস? তিনি আমেরিকান গায়ক, গীতিকার, ঔপন্যাসিক এবং রাজনীতিবিদ। তিনি কথা প্রসঙ্গে বলছেন - টাকা দিয়ে  একটা ভালো কুকুর কেনাই যায়,  কিন্তু ভালবাসলে তবেই সে লেজ নাড়বে। অর্থাৎ ভালবাসা  জরুরী। কিন্তু  আমি বলি  - শুধু যদি ভালবাসা থাকে  - তাহলে -  কুকুর কেনাই হবে না  - ল্যাজ নাড়বে কে?  কাজেই অনর্থ বাধাতেও অর্থ লাগবেত। তত কম্পয়েতু - ঝেড়ে কাশ দেখর'?

= ' আমি এক মহিলাকে বেশ পছন্দ করি কিন্তু তার খাঁই দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমি প্রথমে প্রতিবাদ করলেও পরে আমাকে দিতেই হয়। আপাতত এটাই আমার সমস্যা'।

- ' এই? তা ... ইচ্ছে না হলে ... দিস না'।

= ' সেটা পারছিনা বুঝলি। ও সামনে এলেই কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে '।

- ' হুঁ। আজু রজনী হাম ভাগে পোহাইলু, পেখলু পিয়া-মুখ-চন্দ। ক - দিনের চেনাশোনা'?

= ' বহু দিন । বলতে পারিস জন্ম থেকে। কিন্তু আগে চাইত না । এখন ও এলেই আমার বুক ধড়ফড় করে ... এই বুঝি কিছু দাবী দাওয়া পেশ হল '।

- ' বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ। এই বয়সে রেস কোর্স যাচ্ছিস - মানে - ঘোড়া রোগ ধরেছে - তার কিছু গুনাগার তো দিতে হবে দীনু। তোর স্ত্রী টের পেলে কিন্তু ...'।

= ' ও জানে।

- ' অ্যাঁ! বৌদি জানেন? কিছু বলেন না'?

= ' না। ভাগ পায় তো। বলতে গেলে ওই মূল ষড়যন্ত্রকারী'।

- ' রাধে মাধব। আমার কিছু বোধগম্য হচ্ছে না। তুমি চা টা শেষ করে অন্য টোল দেখো'।

তাই করলেন দ্বৈপায়নবাবু। সমস্যার সমাধান তো হলই না - আপাতত একটা বন্ধু বিচ্ছেদ হয়ে গেল। ও পরে ঠিক করে নেওয়া যাবে। কিন্তু এদিকে যে দর্শনী প্রতি দর্শনেই বেড়ে চলেছে, তার কি করা যায়?

এমন নয় যে দ্বৈপায়নবাবুর স্থাবর, অস্থাবর সম্বলে বিরাট কিছু টান পড়ছে। তার পেটে চর্বি, রক্তে চিনি, মাথায় অল্প টাক - অর্থাৎ যা দেখে  লোক বোঝে টু পাইস আছে।  টানাটানি অন্যখানে। তিনি বরাবর মিতব্যয়ী। এখন অবসরের পর আরো কিছুটা  ব্যয়কুণ্ঠ হয়েছেন। একটু দেরিতে বাজার যান। পার্শে, পাবদা, চাঁদা, চিংড়িরা দেমাক দেখিয়ে বরফে শুয়ে থাকে, রাংতার মত মৌরলা করুন চোখে দেখে। তিনি দেখেও দেখেন না। মাঝারি কাতলা আর চুনো মাছে থলি ভর্তি করেন। এতো সংসারের জন্যেই । কিন্তু বাকিরা তাঁকে খুঁচিয়ে মজা দেখে আর মুখ টিপে হাসে - মায় গিন্নীও।এখন গিন্নী ও ছেলে বৌমা জোটসঙ্গী, সংসারের ভোটে বহুমত তাদের দিকে, কাজেই সরকারও তাদের। দ্বৈপায়নবাবু বিরোধী পক্ষ।

ছেলে যখন আসে ... আগেই মায়ের সঙ্গে কথা বলে ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে আসে। গিন্নী রাঁধেন আর সঙ্গে ভুরি ভুরি ছেলের প্রশংসা আর স্নেহ মিশিয়ে দেন।  সঙ্গে দেন দ্বৈপায়ন বাবুর মিতব্যয়িতার ঝাল ঝাল চিমটি মশলা । ছেলে - বৌ ভাতে মেখে খায়। খাওয়ার পর বসে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক। জোটের ঘোঁট  নিঃশর্ত হয় না। কিছু না কিছু  জট থাকেই শেষে।  বিশেষত কর্তার ছত্রিশ বছরের বঞ্চনা, ন্যায্য অনুদান আটকে রাখা এ সব বার বার উঠে আসে আলোচনায়। অভুতপুর্ব উল্টো পুরাণ  হল - এখানে বহুমত সরকার - নিশানা করে থাকেন সংখ্যালঘু বিরোধী পক্ষকে  - অর্থাৎ দ্বৈপায়ন দত্তরায়কে। তিন দশকে কর্তা মশাই বুঝতেই পারলেন না তিনি সরকার না বিরোধী। তাই  আজ ও- ছেলের গাড়ি দেখা ইস্তক - তেমনি কোনো বদ হজম আশঙ্কা করছেন তিনি।

বাঘের কথা ভেবেছেন কি সন্ধ্যে নামল। ছেলে বৌমা গিন্নী বসলেন বৈঠকখানায়। আর সেই মহিলা এসে দাঁড়াল দ্বৈপায়ন বাবুর সামনের বইয়ের আলমারিতে ঠেসান দিয়ে। দেখব না দেখব না করেও  দ্বৈপায়ন বাবুর চোখ গেল সেদিকে। ' জনম জনম হম রুপ নেহারেলু, নয়ন না তিরপত ভেল'। বুকের মধ্যে সোঁ সোঁ হাওয়া চলল। রাগ করবেন কি,  বুকের মধ্যে রাগ রাগেশ্রীর আলাপ শুরু হয়ে গেল, বাঁশি বাজল হঠাত জংশনে। চুলোয় গেল সংযম । এর সঙ্গে অভিমান করে কি  থাকা যায়।  তা ... মহিলাটি বুঝলো কি না কে জানে ...  চোখ  নাচিয়ে বলল -

- ' হাই ডার্লিং ডি। আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বল। এই ড্রেসটা গত সপ্তাহে বড় মামা এনে দিয়েছে বার্মা থেকে'।

এসব ধরতাই শুনলেই এর পেছনে আম্ফুনের আভাষ পান  দ্বৈপায়নবাবু। মনে মনে প্রমাদ গুনে  গলা খাঁকারি দিলেন।

= ' বেশ ভালো দেখাচ্ছে। এদিকে এসো'।

- ' না। আগে বল আমরা কবে যাচ্ছি গোয়া'?

= ' গোয়া?  একেবারে গয়াতে গেলে হয় ... এই আমার পিণ্ডির জন্যেই... তবে কিছুদিন পরে'।

- ' এক মিনিট। আমার পিণ্ডি ... আমার পিণ্ডি ... না না রাওয়াল পিণ্ডি বলে একটা জায়গা আছে। কিন্তু সে তো পাকিস্তানে। সে… খা… নে যাওয়া যায়'?

= ' অত দূরে নয়। অত কঠিন ও নয়, ভারতেই আছে একটা। সেখানে কেন যেতে হয় ও ঘরে জিজ্ঞেস করে দেখো। সবাই জানে'।

- ' অত শত পারব না। ও ঘরে সবাই বসে গোয়া যাবার প্ল্যান করেছে দেখে এলাম'।

= ' ও । ক্যাবিনেট মিটিং শুরু হয়ে গেছে।  আমি কিন্তু এক টাকাও দেব না। দিদাকে বল সুইম স্যুট ছেলের পয়সায় কিনতে'।

- ' ওঃ ডি ডার্লিং । প্রত্যেক বার কেন এমন কর বল তো?   হ্যাঁ - বল শিগগির । নইলে আমি আর আসবো না তোমার কাছে'।

= ' ব্ল্যাক মেল করা বন্ধ করো'।

- ' ইমেল ... ইয়েস, ফিমেল ... ইয়েস।  হোয়াট ইজ ব্ল্যাক মেল? কালো মানুষ - তোমার মত'?

= ' না ... এই তুমি যা করছ। মানে ... যাক গে। বলছিলাম ... তুমি আমাকে একটু ও ভালোবাস না শুধু আমার ... '।

- ' শুধু তোমার ... কি '?

= ' না থাক ... তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে না'।

- ' সেটা ভেবে দেখব। এখন শুনে আসি বাকি প্ল্যানটা'।

' দুত্তোর ' বলে  দ্বৈপায়নবাবু পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন। একবার চারুর বাড়িই যাবেন । ওর ভুল ধারনাটা ভেঙ্গে দেওয়া উচিত আর সময়টাও কিছুটা কাটিয়ে আসা যাবে। যাবার সময় বৈঠক খানায় একবার উঁকি দিয়ে দেখলেন নরক গুলজার। গিন্নীর পানের ডিবে নেমেছে মেঝেয়। বৌমা চা বানিয়ে ট্রে রেখেছেন পাশে। আলুভাজা, কুড়মুড়ো সবার প্যাকেট খোলা হয়ে গেছে এর মধ্যেই । তিন মাথা গোল হয়ে বসেছে কার্পেটে। আর তার 'সুচেতনা' কিছু একটা নাচছে আপন মনে।  তারমানে মিটিং চলবে বেশ লম্বা। তিনি যে বেরিয়ে যাচ্ছেন তা কেউ খেয়াল করল বলে মনে হল না।  দ্বৈপায়ন বাবু মনে মনে ' কা তব কান্তা কস্তে পুত্র' গাইতে গাইতে বেরলেন চারুর ফ্লাটের দিকে।

নিজের বৈঠকখানায় কিছুটা আনমনা হয়ে বসে আছেন চরৈবেতি চক্রবর্তী ওরফে চারু। তাকে দেখে হাত নেড়ে বসতে বললেন, মুখে কথা নেই। দ্বৈপায়ন বুঝলেন অভিমান হয়েছে। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন -

- ' চারু। আমি সরি। কাল তোকে ঠিকঠাক বলিনি। তুই বোধহয় রাগ করেছিস। ও মহিলা আর কেউ নয় ... আমার নাতনি। জানিস তো এই ন - দশ বছর হল। আগে বুঝলি - এসেই দাদাই ডার্লিং, ডি ডার্লিং বলে ঝাঁপিয়ে পড়ত । আর এখন গিন্নী ওকে কিছু না কিছু শিখিয়ে পাঠায়।  এই চাই, সেই চাই - আর ও বাচ্চা - বোঝে না - এসেই সেগুলো উগরে দেয় । মনে করে একটা খেলা। গিন্নী - নিজে  নেমে গেছে ফুল ব্যাকে আর একে করেছে স্ট্রাইকার। স্ট্রাইক রেট একশোয় একশো। দ্যাখ চারু আমরা কি রকম ছোটবেলা কাটিয়েছি তোর ভালই মনে আছে । আজ এত কাল কলম ঘসে হয়ত দুটো টাকার মুখ দেখেছি। সে সব কি অমনি উড়ো খই বলে  উড়িয়ে দিতে আছে? থাকলে ওদেরই তো থাকবে'।

চারু তখনি মুখ খুলল না। আরো কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে দেখল। ওর ফ্লাটটা বারো তলায় । কিন্তু বসার ঘরের জানলা দিয়ে বহুদূরের একটা পাহাড় আর জঙ্গলের আভাষ পাওয়া যায়। সে দিকে তাকিয়ে বোধহয় সারা দিনটা কাটায় চারু । মিনিট দুয়েক পরে সেও গলা টা একটু সাফ করে গিন্নীকে চা দিতে বলল। তারপর বন্ধুর দিকে না তাকিয়েই বলল -

- ' এ টাকাটা জমিয়ে তুই কি করবি দীনু? কি প্ল্যান'?

= ' আরে বিপদ আপদ ...  চিকিৎসার খরচ ... এখন তো একটা হাসপাতালের এক দিক থেকে ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে গেলেই দশ হাজার খরচা ... বলি দেবে কে'?

- ' তোর মেডি ক্লেম নেই? ... আছে? তাহলে? তাছাড়া ছেলে তো ভালই রোজগার করে । সেখানেও তো ক্লেম হতে পারে '।

= ' হ্যাঁ। পারে। ছেলে তো খরচ করার জন্যে মুখিয়ে আছে। কিন্তু চাইব কেন'?

- ' আরে সব সময় কি চাইছিস । কিন্তু সে রকম দরকার পড়লে ...। তুই শেয়ারে টাকা ঢালিস তো। দ্যাখ ... আমি মনে করি ছেলে মেয়ে একরকম দীর্ঘ মেয়াদী শেয়ারে বিনিয়োগ। ওঠা নামা আছে। খুব প্রয়োজন না পড়লে বেচা নিষিদ্ধ। হয়ত সারা জীবন দরকার হলই না। কিন্তু দরকার পড়লে কয়েকটা শেয়ার ভাঙ্গিয়ে নেওয়াই যায়'।

= ' হ্যাঁ ... না ... মানে পকেটে ... আচ্ছা পকেটে না হোক ... ব্যাঙ্কে ... বেশ কিছু টাকা না থাকলে কি রকম দুর্বল লাগে ... তুই তো আবার গীতা থেকে কিছু শ্লোক ঝেড়ে দিবি ... তোকে কি করে বোঝাই  ... '।

- ' গীতায় সব কিছু নেই রে দীনু। আজ মনটা একটু ভালো নেই ' ।

= 'কেন ... কেন'?

- ' তোর সিতু কে মনে আছে? ইশকুলে আমাদের সঙ্গে পড়ত। ফুটবলে লেফট উইং ... খুব জোরে দৌড়ত ... সবাইকে কাটিয়ে বাঁ পায়ে গোলার মত শট আর ... গোল'।

= ' আরে সিতুকে মনে থাকবে না? এক সময়ে তো হরিহর আত্মা ছিলাম। আওয়ার হিরো। খেলাধুলা, শরীর চর্চায় এক নম্বর। লেখা পড়ায় মোটামুটি কিন্তু অঙ্ক, ভূগোলে ফাটাফাটি।  ইশকুল ছাড়ার পর অবশ্য বহুদিন যোগাযোগ নেই। তা সে আছে কোথায় এখন'?

- ' কোথায় আছে ... মুম্বাইতে'।

= ' বলিস কি? বিরাট কাজ কর্ম করেছে তা হলে। মুম্বাই তো গরিবের জায়গা নয়'।

- ' ঠিক কথা। গরিবের জায়গা নয়। এখন যেখানে থাকে ... ওর ঘরে বিরাট জানলা ... শুয়ে শুয়েই আরব সাগর দেখা যায় ... চব্বিশ ঘণ্টা দেখা শোনা করার লোক ... পুষ্টিকর খাওয়া দাওয়া ... একটা গাড়ি সব সময় নিচে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। প্রতিদিন খরচ করে ... তা ধর ... হাজার পঞ্চাশ'।

= ' ব্যাস ব্যাস আর বলিস না। ভগবান দিলে দেয় ছপ্পর ফাড়কে ... মন টা আই ঢাই করছে। তোরও কি সেই জন্যেই মন খারাপ'?

- ' একটু হিংসে হচ্ছে ...কি বল'।

= ' সে মানে ... তা একটু ... আচ্ছা হবে না? চৌদ্দ পোয়া সুখ যদি অন্য কেউ পায় তবে ...'।

- ' অথচ দ্যাখ ... ওর মন ভালো নেই ... ওর বউ বাচ্চার ও নয় ... '।

= ' এত পেয়েও ... আর পাওয়ার বাকি কি '?

- ' মুক্তি। ওর ক্যান্সার হয়েছে ... লাস্ট স্টেজ ... পালিয়েটিভ কেয়ারে আছে মুম্বাইয়ের একটা বড় হাসপাতালে ... যে কোন সময় ...'।

= ' কি বলছিস কি'?

- ' লাখ লাখ টাকা উড়ে যাচ্ছে  ... যদিও সবাই জানে কোন লাভ নেই '।

= ' আমি ... আমি ... মাপ করে দে ভাই। না জেনে ...'।

- ' আমি মাপ করার কে? আমাকে ফোন করেছিল। তোকেও ফোন করবে । তখন ভালো করে কথা বলিস। কি জানিস ... রোগ যন্ত্রণা নয় ...  শুধু একটাই আপসোস এখন ওর মুখে'।

= ' আপসোস'?

- ' সারা জীবন যা জমালাম সব চলে যাচ্ছে ব্যর্থ চিকিৎসায়। ভোগ করতে পারলাম না রে। সবাইকে ফোন করে ও শুধু এই কথাটাই বলে। বললি না অঙ্কে, ভূগোলে ভালো ছিল। সারা জীবন তিল তিল করে টাকা জমিয়েছিল অবসরের পর ঘুরবে বলে। ইস্কুল জীবনের সব অঙ্ক মেলাতে পারলেও -  নিজের অঙ্ক মিলল না।  নায়াগ্রার জলে ... ভেজা হল না ... অরোরা বোরিয়ালিস ... দেখা হল না ... আন্দিজ পাহাড়ের উপরে ঝুলে থাকা মেঘ ... ছোঁয়া হল না ... এমন কি আন্দামানের নীল জলের ধারেও বসা হল না । আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করেছে হ্যাঁরে আমি হিন্দু , আমার পুনর্জন্ম হবে না? এ জন্মে হল না ... পরজন্মে শুরুর থেকেই ... হ্যাঁ রে বল না ... হবে না?   দেখ আমি ...  সারা জীবন ধর্ম শাস্ত্র পড়লাম, পড়ালাম ... কিন্তু ওকে জোর গলায় ভরসা দিতে পারলাম না। গীতার ভাষ্য ... বলতে পারলাম না'।

= ' তুই পারলি না ... এত পড়লি সারা জীবন ... বেদ বেদান্ত ... তাহলে আমাদের কি হবে'?

- ' সিতুকে পারিনি। তবে তোকে বলছি দীনু। যদি কিছু ইচ্ছে থাকে ... নিজের না হোক অন্য কারু ...  পূর্ণ করে নে। মোমবাতি পুড়ে যাচ্ছে। আলো থাকতে থাকতে দেখে নে চারদিক। সবাই তো এখনও কাছাকাছি আছে। শঙ্খ ঘোষ পড়িস নি?   ... কিছুই কোথাও যদি নেই, তবু তো কজন আছি বাকি, আয় আরো হাতে হাত রেখে, আয়, আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।'

= ' ঠিক বলেছিস চারু । কিন্তু আমার ... আমার দেরি হয়নি তো'?

- ' না - যদা অহম জাগরমি তদা প্রদোষঃ ভবতি - যখন জাগবি তখনি ভোর- ।  আর চা খেয়ে কাজ নেই। তোর ছেলে এসেছে না ? ওরে ওই মিকি মাউসের গাড়ি আমি ও দেখেছি। ঘরে ফিরে যা, দেরি হবার আগেই।আর ...   উত্যিষ্ঠিত জাগ্রত। জেগে ওঠ'।

দীনুবাবু প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে সোজা বৈঠকখানায় সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। কুরুক্ষেত্রে হঠাত ধৃতরাষ্ট্রের প্রবেশ হতে সমবেত যুযুৎসব কিছুটা হতবাক। তিনি নাতনিকে কাছে টেনে বললেন -

- ' কি হল সবাই এমন ঝিম মেরে গেলে কেন? কি কথা হচ্ছিল'?

গিন্নী কর্নার্ড ক্যাটের মত রোঁয়া ফুলিয়ে বললেন -

- 'শীতে গোয়া যাবার কথা হচ্ছিল। তুমি না কি টাকা দেবে না বলেছ'?

= ' সে কত টাকা হিসেব না দিলে - হ্যাঁ - বলি কি করে'?

- ' ওঃ এই। শুধু তোমার আমার দিলেই তো হবে। তুমি তো ছেলের থেকে নেবে না। তা ধরো ... আমাদের দুজনের ... বাবু বলছিল ...'।

= ' দুজনের না। সাড়ে চার জনের হিসেব বল। এবারেরটা আমিই দিই। পরের বার বাবু দেবে ... কি রে দিবি না? অত বড় হাঁ করার দরকার নেই। মিউচুয়াল ফান্ডের কিছু ইউনিট বেচে দেবো তাহলেই হবে। পরে সুবিধে মাফিক কিনে নেওয়া যাবে। বাবু ... গোয়াতে গাড়ি ভাড়ায় নিবি ... তা হলে স্বাধীনতা থাকে ।খুব ঘুরব সবাই। আর... আর ...   একটা বড় দেখে বাড়ি নিবি, আরব সাগরের তীরে । না হোটেল না ... বাড়ি । সে বাড়ির জানলা দিয়ে  যেন সমুদ্র দেখা যায় ...। আমি ... আমার কোলে ... আমার পাশে ... সবাইকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব'।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন