বর্ণমালার সাতকাহন
পর্ব ২০
"জীবন বহিয়া যায় নদীর স্রোতের
প্রায়
ধরিতে তায় কে পারে ভাই
ধরিতে তায় সে পারে ভাই আলস্য যার
শরীরে নাই "(যোগীন্দ্রনাথ সরকার)
জীবন মানে কর্ম। তবু কর্ম করেই কি সুখী হওয়া যায়? কত মানুষের কর্ম অর্থহীন হয়ে গেছে। ছোট ছোট সুখ দাগ রেখে যায় জীবনভর। আমার শাশুড়ির কথা ভাবি। ছোটখাট গোলগাল ফর্সা মুখ। সারাজীবন বালিগঞ্জের বিশাল বাড়িতে দারিদ্র্য সহন করে স্বামি, শাশুড়ি, ননদ সকলের মন যুগিয়ে চলেছেন, কত অনাচার কত অপমান মেনে নিয়েছেন, আরও সহস্র নারীর মত যখন ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স কথাটা চর্চার বিষয় ছিলো না। ধরে নেওয়া হতো ঘরের বউ কে যা খুশী বলা যায় করা যায়, তখন নারী এবং ত্যাগ নারী এবং সংসার সুখের হয়... প্রভৃতি খুব চলত বাজারে। মেয়েদের ছোটো থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হতো নারী মানে শালীনতা লজ্জাশীলতা মুখ বুজে সয়ে যাওয়ার আদর্শ।
আমার শাশুড়ি নবদ্বীপ শহরের মেয়ে
ছিলেন। বিশ্বের প্রাচীনতম শহরের একটি। আগমবাগীসের
নবদ্বীপ চৈতন্যের নবদ্বীপ এবং অনেক অনেক অন্ধকারের নবদ্বীপ।
সাঁতরে গঙ্গার এপার-ওপার করা মেয়ে
আমার শাশুড়ি। এ ছাদ থেকে ওই ছাদ টপকে টপকে ছুটতেন। ভীষণ ভালো আবৃত্তি করতেন। সবটাই বাড়ির চার দেওয়ালের
মধ্যেই। তখন আমি কবিতা লিখি খামে ভরে কখনও সখনও পাঠাই লেখা, খুব পছন্দ করতেন আমার লেখা,
মানে উৎসাহ দিতেন। তাঁর এই আবৃত্তি চর্চার হাতেখড়ি নবদ্বীপ শহরে।
নবদ্বীপ ভারতের প্রাচীনতম শহর।
সেই প্রাচীনতার গন্ধ তখনও পাওয়া যেত। আমার শ্বশুরের পরিবার
লক্ষ্ণৌবাসী হলেও শাশুড়ির বাপের
বাড়ি, মামাশ্বশুর এবং পিসি শাশুড়ি সকলেই এই শহরে বাস করতেন। ফলে বিবাহের অনতিকাল পর থেকে অনেকবার নবদ্বীপ
গিয়ে থাকা হতো। এজমালির সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো বাড়িটি পোড়ামা তলা ছাড়িয়ে মহাপ্রভু
বাড়ির কাছেই। ঢোকার মুখে মস্ত অপরিচ্ছন্ন রোয়াক, বার বাড়ি অন্দরবাড়ি, শ্যাওলা ধরা
উঠোন ঘিরে একতলা সব ঘর মাঝে একটা গভীর কুয়ো। বাড়িটার নিচের অংশে বড় বড় কড়া লাগানো।
শোনা যায় এককালে গঙ্গার অবস্থান পৃথক ছিল, জোয়ারের সময় নৌকো বেঁধে রাখা হতো বাড়ির
গায়ে। একপাশ দিয়ে ছাদহীন সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। খোলা ন্যাড়া ছাদ, পাশাপাশি আরো
এক রকমের ছাদ ।দিনে হনুমানের লাফালাফি রাতে ছাদ ঝাঁট দিয়ে মেজ মামীশাশুড়ি আসন জোগাড়
করতে বললেন। খোলা ছাদের নিচে ওঁরা প্রায় খেতেন রাতে। আমি একটা অন্য পৃথিবীতে যেন এসে
পড়লাম। রাতের চাঁদোয়ার নিচে বসে গরম হাঁসের ডিমের ঝোল গল্প সহযোগে পাঁচিল বিহীন ছাদে
পান খেতে খেতে ভাবলাম এটাও জীবন বটে!
বিরাট সিংহ দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথম
ঘরটির নাম "আধ-সাহিত্য" ঘর। ওখানে অকৃতদার বড়মামাশ্বশুর বইঠাসা ঘরে তক্তপোষে
শোয়া বসা সিগারেট গান এবং সাপ্তাহিক কবিতার আসর। পার্টির পোস্টার ও স্তুপাকার কাগজপতির
সবই শ্রেণীহীন সমাজপন্থীদের সংগঠনের। প্রাচীনতার একটা আলাদা মায়া থাকে। বড়মামাশ্বশুর
বাংলার মাস্টারমশাই ছিলেন। শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্হার প্রতি জীবন নিবেদিত কমরেড। বিপ্লবী
হতে গিয়ে চাকরি খোয়াতে হয়েছে। কতটা সাহিত্যগুণে সর্বোত্তম সেটা বড় কথা নয় এই নবদ্বীপ
শহর যেখানে ধর্ম কেন্দ্রিক যাবতীয় ছেনালিপনাই যাপনচিত্র সেখানে বছর পঁচিশ ছাব্বিশ
আগে অবধিও উত্তরাধুনিক কবিতার আলোচনা, মার্কসীয় সাহিত্যের তর্ক বিতর্ক বেশ ব্যতিক্রম
ছিল বলাবাহুল্য।
এখানে এই গঙ্গা নদীটি একটি রিলিফ বলা যায়। সামনে গলিতে ঢুকে মহাপ্রভুবাড়ি। পাশে এক পিসি শাশুড়ির বাড়ি। এঁদের "সেবা" পড়ত পালা করে। এই সব টার্ম আমি বউ হয়ে তাঁদের কাছে গিয়ে শিখলাম। পালা পড়া-- অর্থ শ্রী চৈতন্যের জন্য ভোগ রান্না, আরতি এবং আনুসঙ্গিক পুজো আচ্চার ভার সেই বিশেষ দিনে তাঁদের উপর ন্যস্ত হয়েছে। প্রসঙ্গত সেদিনের যাবতীয় আয় তৎসহ ভক্তবৃন্দের দান নগদ ও প্রকারে যা কিছু সেদিন জমা হবে সেটাও তাঁদের প্রাপ্য।
ভোগের রসদও ভক্তদেরই দানের অর্থে
বলা বাহুল্য। আমার মেজপিসি শাশুড়ি নিজে ভোগ রান্না করতেন। কালো কুচকুচে ছিপছিপে বুড়ি
ব্লাউজহীন সাদা থান পরিহিত এই মেজ পিসির ছেলে এবং আরো বহু এরকম সেবাইত পরিবার ছিল নবদ্বীপে
যারা কেউ কিস্যু কাজকর্ম করত না। ধর্ম এঁদের পেশা, সমগ্র নবদ্বীপে কুড়ি বছর আগে অবধিও
ছিল চৈতন্যই মূলধন। ব্রাহ্মণ্যবাদ এখানে দেখেছি প্রকটরূপে। চৈতন্য দেবের শ্রেণীহীন
সমাজের স্বপ্ন এবং সমাজবাদী তত্ত্ব হয়েছে অরণ্যে রোদন। গৌরাঙ্গ বাড়ি ছাড়াও আরো অসংখ্য
চৈতন্য ব্যবসার স্থান বা "বাড়ি" ছিল যার বেশিরভাগ বাড়িতেই আমার শ্বশুরবাড়ির
জ্ঞাতিদের প্রধান ব্যবসা বা সেবা ছিল জুড়ে। বস্তুত, নবদ্বীপ শহরের অর্থনৈতিক দিকটি
প্রায় পুরোটাই চৈতন্য নির্ভর ছিল এটা আমার নিজের চোখেই দেখা। নবদ্বীপের রাসযাত্রা
আর শান্তিপুরের ভাঙা রাস দুটোই বিখ্যাত। কালে কালে তার আকার এবং প্রকার বদল হয়েছে।
আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেও নবদ্বীপে রাস উৎসব ছিল প্রধান, দুর্গা পুজোর তেমন কোনও ঘটা
ছিল না নেহাতই কয়েক জায়গায় অনাড়ম্বরভাবে পুজো হতো।
রাস উৎসবে দোতলা তিনতলা সমান দেবমূর্তি
নিয়ে শোভাযাত্রা এবং সঙ্গে খুল্লামখুল্লা মদ্যপান ও নাচ। ভারতীয় ভক্তিমার্গের এক
অন্যতম প্রদর্শন। আমার শাশুড়িটি রসিকা ছিলেন। মাঝে মাঝে দুপুরে পুরুষহীন বাড়িতে মেয়ে
মজলিসে অভিনয় করে দেখাতেন তাঁর ছোটোবেলায় কেমন করে মাতালরা রাস্তা দিয়ে নাচতে নাচতে
টলতে টলতে যেত। আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম, পেটে ব্যথা হয়ে যেত।যাইহোক, পরবর্তীকালে
শুনেছি নতুন সরকার আসার পরে প্রশাসন সতর্ক হয়েছেন এ ব্যাপারে।
নবদ্বীপ শ্রীচৈতন্যকে নেতা থেকে
ভগবানে রূপান্তরিত করেছে আপন স্বার্থে অর্থোপার্জন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। যাইহোক, নদীটি
ভারি সুন্দর লাগত। ঘনবসতীপূর্ণ মূল শহরের বাইরে গ্রাম, খেত। আমরা নৌকো করে গঙ্গা পার
করে মায়াপুর যেতাম। সেখানে পুরনো আশ্রমগুলিকে ফিকে করে সদর্পে দাঁড়িয়ে ইস্কনের চৈতন্য
মন্দির। ভেতর ছিমছাম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। বাঙালি পর্যটকরা যেত সাদা চামড়ার সাহেম মেমদের
ভজনারতি উপলক্ষ্যে উদ্বাহু নৃত্যের সাক্ষী হতে। ভক্তিরসের প্লাবন ছাড়াও ধোসা, পিজা,
স্যান্ডুইচ পাওয়া যেত। দুটি হাতি ছিল। তাদের সন্ধ্যায় সাজিয়ে গুজিয়ে বার করা হতো।
এই কৃষ্ণ নিনাদের বাইরে আরেকটি মায়াপুর, যেখানে বিস্তীর্ণ চর পড়ে আছে। নবদ্বীপের
তরুণ তরুণীরা এপারে আসত যুগলে। তারও পড়ে গরিব চাষাদের বাস। বছর বছর যারা বন্যায় হারিয়ে
ফেলে সব। আজও একই আছে তাদের দুর্ভোগ।
নবদ্বীপ শহরের অদূরে নৃসিংহদেবের
মন্দির, এখানে চৈতন্যদেবের অন্নপ্রাশন হয়েছিল, আরশোলা পরিবৃত এই বিগ্রহ খুবই জাগ্রত
বলে শোনা যায়।
নবদ্বীপ প্রকৃতপক্ষে যতটা আজ চৈতন্য
দেবের তার চেয়ে প্রাচীনতম তার পরিচয় শৈব ও তন্ত্র সাধনার পীঠস্হান হিসেবে। আগমবাগীশের
পীঠ আজও দর্শনীয় এবং প্রণিধানযোগ্য।
আমার অল্প বয়সের ঝড় ঝঞ্ঝা ও দুর্ঘটের
জীবনে নবদ্বীপ ছিল এক টুকরো খোলা বাতাস। আসলে আমরা কেউ জানতে পারিনি প্রথম গ্রাসটা
মুখে তুলতে গেলে প্রতিবারই তাঁর বিষম লাগে। জানতেন শুধু বাবা মানে আমার শ্বশুরমশাই।
যেদিন ট্যাবলেট খেতে গিয়ে গলায় আটকে রইল তিনদিন সেদিন তাঁর মনে হলো আমাকে বলা উচিত।
পুত্রের প্রতি তাঁর ততদিনে মোহভঙ্গ হয়েছিল। মাথায় বিরাট টিউমার বুকে কফ, ব্রঙ্কো
নিউমোনিয়া, মাথাটা ধীরে ধীরে জবাব দিচ্ছিল, আমার শাশুড়ি নানা পরিকল্পনা করতেন আমার
সঙ্গে তেমন কিছু হয়ে গেলে তিনি স্বাধীন হবেন, বোনের বাড়ি যাবেন, আরও নানা জায়গায়
যাবেন, কী কী মনের সাধ মেটাবেন। হঠাৎ মনে হতেই পারে এ কেমন স্ত্রী যে স্বামীর মৃত্যু
পরবর্তী দিনের উজ্জ্বলতা কল্পনা করেন! কিন্তু সেদিন বুঝেছিলাম কী করুণ অবস্থা ভারতীয়
নারীদের। গোটা জীবন পিতার গৃহে, স্বামী গৃহে পদানত হয়ে দাসবৃত্তি করতে করতে হারিয়ে
গেছে তাঁদের কত প্রতিভা, স্বপ্ন, ইচ্ছা। অন্যদিকে সারাজীবন রাজত্ব করা সশস্ত্র বিপ্লবী
আমার শ্বশুর মানসিক ভারসাম্য হারাতে লাগলেন ক্রমে শিশুর মতো, শাশুড়ি বুঝতে চাইতেন
না প্রথমদিকে, বলতেন ইচ্ছে করে করছে কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কাহিনীতে টুইস্ট
ছিল। আচমকাই দৃশ্যবদল। রেডিয়াম এক্সরে খারাপ, গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম
একা বায়েপ্সি রিপোর্ট নিয়ে, হু হু করে দিন কমতে লাগল। ডাক্তার যখন জবাব দিয়ে দিলেন,
একদিন জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার কিছু ইচ্ছে করে তো বলো"। উনি পাশ ফিরে শুলেন,
গভীর শ্বাস ফেলে আস্তে করে বললেন, "কী লাভ।" খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন
পাহাড়, তারপর হরিদ্বারের গঙ্গা, কত কী দিল্লী..." শ্বশুর সামান্য চাকরি করতেন
সঙ্গে পার্টির কাজ, নবদ্বীপের বাইরে কখনও তাঁর যাওয়া হয়নি। ততদিনে শাশুড়ি আর শাশুড়ি
নেই, সহেলি, ততদিনে মায়ের মত আঁকড়ে আমাকে শ্বশুর-শাশুড়ি পদধারী দুটি অসহায় মানুষ।
আমি মেয়েটি তখনও নেহাত তরুণী অনভিজ্ঞ। সেবার ডাক্তার সহ দুই বাড়ির সব আপত্তি অগ্রাহ্য
করে শুধু বাংলার মাস্টারমশাই খামখেয়ালি বড়মামার
সমর্থনে মা’কে নিয়ে গেলাম সপরিবার হরিদ্বার হৃষিকেশ দিল্লী।
গঙ্গারতি দেখে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটির মুখের প্রশান্তি আনন্দ আমার প্রতি তাঁর অকুন্ঠ
আশীর্বাদ আমার জীবনে পাথেয় হয়ে আছে। কিন্তু আরো কিছু কাণ্ড ঘটেছিল সেই যাত্রায়।
শ্বশুর শাশুড়ি বড়মামাশ্বশুর আমি ও আমার স্বামী সদলবলে সকলের নিষেধ অমান্য করে চড়ে
বসেছিলাম দূন এক্সপ্রেসে।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন