অন্য এক ফরাসডাঙা - অথবা খাইখাই
পুরাণ
ফরাসিদের সারা পৃথিবীর লোক 'ফান্টুস' বলে। শব্দটা মেঠো হিন্দি থেকে এলেও এখন অক্সফোর্ডে জায়গা করে নিয়েছে। সহজতম বাংলায় এর অর্থ হতে পারে 'আমাকে দেখুন'। 'ফাঁট' শব্দটা বাংলায় খুব অচেনা নয়। 'বহ্বাড়ম্বর' শব্দটা বোধহয় এখন বাংলায় আর চলে না। তবে যাঁরা এলেমদার লোক, আলিয়াসঁ ফ্রাঁসেজ ইত্যাদি পেরিয়ে এসেছেন, ফরাসিদের সম্বন্ধে এই সব বিশেষণ প্রয়োগ করতে তাঁরাও বিশেষ পিছিয়ে যান না।
ইংরেজ, ওলন্দাজ, দিনেমার,
হিস্পানি, পর্তুগিজদের মতো ফরাসিরাও এদেশে রোয়াব জমাতে এসেছিলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত
লালকুর্তাদের প্রতাপে সব সাহেবরা এদিকওদিক পপাত চ, মমার চ। এটা তো সবাই জানেন। বলার
মতো উপনিবেশ বলতে পর্তুগিজদের গোয়া আর ফরাসিদের পুদুচ্চেরি। আমাদের ফরাসডাঙ্গা বা শ্রীরামপুর
নিতান্ত দুধুভাতু।
ফরাসি আর পর্তুগিজ সাহেবদের
ফেলে যাওয়া দুটো উপনিবেশ নিয়ে আমাদের মতো 'দেশদ্রোহী' পাবলিকদের বেশ বাতিক আছে। তবে
দেশের পূর্ব আর পশ্চিম উপকূলের মানসিকতার মধ্যে ফারাকটা বেশ প্রকট। গোয়ার মতো উদ্দণ্ড
ফুর্তির ঠেক কেউ পুদুচ্চেরিতে প্রত্যাশা করে না। অতি রক্ষণশীল তামিলভূমির কেন্দ্রে
এক টুকরো ফরাসি মফঃসল তার নিজের মেজাজ নিয়ে কিন্তু বেশ খুশিই থাকে। সবার উপরে
আছে অরবিন্দভূমির তীর্থপ্রতিম আবেদন। অতি প্রগলভতার বিরুদ্ধে বেড়ে ওঠা এক ধরনের আধ্যাত্মিক প্রতিরোধ। তার ভূমিকা স্বীকার করতেই হয়।
ঘুরনচন্ডির খাওয়াদাওয়া নিয়ে লেখালেখি হয়নি কিছুদিন। ভাবলুম কিছু হোক। উপকূল এলাকার ভোজনরীতি পাশাপাশি রেখে বলা যায় গোয়া'র ভোজে মিশে থাকে লাতিন য়ুরোপ আর দেশের পশ্চিম উপকূলের কোঙ্কনি রান্নাঘর। আরব সাগরের দৌলতে মাৎসন্যায়ের চূড়ান্ত। 'চাপসৃষ্টি করুন' বলতে বলতে পোর্কও ঢুকে পড়ে তার মধ্যে কিছু মাত্রায়। তবে ওখানকার মশলা ও স্বাদের প্রকৃতি পূর্ব উপকূলের পুদুচ্চেরির থেকে একেবারে ভিন্ন। গোয়ার সুরসংস্কৃতির মতো ভোজসংস্কৃতির মধ্যেও একটা লোকযানী স্ফূর্তি লক্ষ করা যায়। কিন্তু পুদুচ্চেরির ভোজন রীতির মধ্যে যে দুটি সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছে, উভয়েই ক্ল্যাসিসিস্ট। তামিল ও ফরাসি।
আমার পরিচিত এক বাঙালি পর্যটক পুদুচ্চেরি বেড়িয়ে ফিরে আসার পর জানিয়েছিলেন, জায়গাটা তো ভালো, কিন্তু ডালভাত পাওয়া যায় না। মাছও যেন কেমন কেমন। কী যে বলি? 'বাঙালি' করে রেখে দেওয়া সেই বঙ্গজননীর প্রতিই ক্ষোভ বর্ষণ করি। মনে মনে। 'মানুষ' করলে আর কীই বা ক্ষেতি হতো?পুদুচ্চেরির সমুদ্র, তটভূমি, স্থাপত্য, গির্জা, মন্দির সব কিছুই বিশদ চর্চা দাবি করে। কিন্তু আজ আমার মাথায় চলছে ওখানকার খাওয়া দাওয়ার ঠেকগুলি। পুদুচ্চেরি গেলে স্কুটার ভাড়া নিয়ে নিই। তবে সেসব স্কুটার আমার ও ব্রাহ্মণীর মতো বিহারি জনতার সমবেত ভার বহনে বেশ কাতর বোধ করে। অন্যদিকে আমারও চিরকাল ভারি বাইক চালানোর অভ্যেস। তবু ওখানে স্থানীয় যাতায়াতের জন্য ভাড়া করা ফঙফঙে স্কুটারই সেরা উপায়। সেবার যখন গেলুম লুরু থেকে, কাক-না-ডাকা ভোরে বাস নামিয়ে দিলো। সরাইখানায় গিয়ে স্নান করে সোজা যাওয়া পাশে নিউ স্যান্ড বিচে। স্ট্র্যান্ড ধরে হাঁটতে হাঁটতে উত্তরের রক বিচ। সকাল আটটা নাগাদই গা-জ্বালানি রোদ। দুপুরের দিকে শুদ্ধ তামিল খানাই নসিব হলো প্রথম দিন।
ঠাণ্ডাঘরে আয়েশ করতে
করতে আমরা পরের তিনদিনের খাওয়াদাওয়া কী হবে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করলুম। আমি নিতান্ত
দেশি জনতা হলেও ব্রাহ্মণী বেশ মেমসায়েব গোছের ইয়ে আর কী? মেয়েরা পুদুচ্চেরিতে কী কী
সেবা করে গেছে ফর্দ আছে তাঁর কাছে। সে আবার অতি সায়েবি ব্যাপার স্যাপার। আমার খাতিরে
মাঝামাঝি কিছু একটা বিবেচনা করা হলো। দিনের
বেলা গরমে খুব ঘোরাঘুরি। তাই ইতালিয় ভোজন। রাতের বেলা ফরাসি কিছু। তবে পূর্ণ শুদ্ধতাবাদী
হওয়ায় চাপ আছে। কিঞ্চিৎ ভারতীয় আপোশ করাটা শরীরের জন্য উত্তম।
ঠেকগুলো সব য়ুরোপিয় পাড়ার ভিতরে পড়ে। আমাদের সরাইখানার কাছেই। সন্ধেবেলা ফুরফুরে সান্ধ্য মলয় পবন সেবন করতে করতে পদব্রজে ভ্রমণ করাটাই শ্রেয়। তবে দুপুরদিকে সেই লড়খড়ে দু-চাকার শরণ নিতে হবে। বড্ডো রোদ। সকালে সমুদ্র থেকে ফেরার সময় পথেই দেখেছিলুম একটা রেস্তোরাঁ। ছাদের উপর। নাম 'ম্যাম শ্যাথেঁস কাফে'। মনে হলো আসল নাম হবে শান্তিমাসির হোটেল। ফরাসিতে বদলানো হয়েছে। তবে রেস্তোরাঁর নামের জন্য নয়। রাস্তাটার নামের জন্য চোখে পড়েছিলো। 'রু রম্যাঁ রলাঁ'। ব্রাহ্মণীকে বললুম, চলো ওখানেই আজ সন্ধের দক্ষিণ হস্তটি সেরে আসি। দুপুরে কিঞ্চিৎ অতি ভোজন হয়ে গেছে। রাতে হাল্কাই হোক। বেড়াতে বেড়াতে ছাদের উপর উঠে দেখি খড়কুটো দিয়ে কুঁড়ে ঘরের আদল আনা সাজ। গরমের মধ্যে খোলা ছাদে সমুদ্রের হাওয়া সেবা করতে করতে খাওয়াদাওয়া করতে ভালো লাগে। অতি জটিল ফরাসি নামের কিছু একটা খেয়েছিলুম। সেটার নাম ছিলো ব্ল্যান্ডফিশ স্টেক ফ্লোরেনটাইন। নাম শুনলে মেছোভূত উল্টে যাবে। সামান্য বিয়র সহযোগে খেতে ভালো'ই লেগেছিলো। নামের মতো বিকট নয়।
ব্রাহ্মণীর আমার মতো ক্যামেরার বালাই নেই। তাই তাঁর ভোর হতে সাড়ে পাঁচটা। আমি চারটে থেকে তাড়া দিই। সূর্যের মর্জি মাফিক চলতে হয় আমাকে। পূর্ব উপকূলে সুজ্যিমামা খুব ভোর ভোর উঠে পড়েন তো। ওড়িশায় লেটেস্ট পৌনে পাঁচ। তবে অতোটা দক্ষিণে আরও মিনিট কুড়ি গ্রেস পাওয়া যায়। সাতটার মধ্যে চিড়চিড়ে রোদ। ছটা থেকে আটটার মধ্যে ঘরে ফিরে আসি। ব্রাহ্মণী আবার বিশ্রামে যান। আমি রাস্তাঘাটের ছবি নিতে বেরিয়ে পড়ি। যেতে যেতে রেস্তোরাঁগুলোর সরজমিন পর্যবেক্ষণ করি। একটা রাস্তার ক্রসিং-এ দেখি 'পাস্তা বার-ভেনেতো'। তখনও খোলেনি। বাইরে থেকে ঠিকই লাগলো। ভাবলুম ঠিকঠাক হলে দুপুরের ভোজ সারতে আসা যাবে।
আমাদের সরাইখানাটি ছিলো বুসি স্ট্রিটে। হ্যাঁ সেই ফরাসি জেনারেল মার্কুইস দ্য বুসি, পন্ডিচেরির প্রথম গভর্নর জেনারেল। তাঁর নামে। পুদুচ্চেরির সাহেবপাড়ার নাম হোয়াইট টাউন বা ইউরোপিয়ান টাউন। এই শহরের প্রধান আকর্ষণ এই এলাকাটি। বুসি সাহেবের সড়কের ডাইনে-বাঁয়ে ছড়িয়ে আছে সাহেবপাড়া। রল্যাঁ সাহেবের রাস্তার পশ্চিম দিকে সমান্তরাল যে পথটি উত্তর দিকে গেছে তার নাম রু সফ্রেঁ। ফরাসিদের বিখ্যাত সেনা নায়ক অ্যাডমিরাল সফ্রেঁ-র নামে সড়ক। এই রাস্তাটা সন্ধেবেলা বেড়াতে খুব ভালো লাগে। ছায়াঘন ব্যুলেভার। গাছের পাতার ভারে ল্যাম্পপোস্টের আলো আধো আঁধার হয়ে থাকে। দুপাশে নানান ফরাসি ভিলা আর রেস্তোরাঁ। নির্জন, নিবিড়, মেদুর। যৌবনকালে এসব রাস্তায় হাঁটার সুযোগ পেলে আত্মজীবনী লেখার পর 'নবকল্লোল' লুফে নিয়ে যেতো। সে হেন রাস্তার উত্তর সীমায় প্রথম অভিরাম ফরাসি ভিলাটি একটি নামজাদা ফরাসি খাবার ঠেক। পরের দুদিন নৈশাহার সেখানেই সেবা করেছিলুম।দুপুরের ভোজ ছিলো লঘু
ইতালিয় পদ। 'পাস্তা বার ভেনেতো'র সজ্জা ন্যূনতম। দিনের বেলা তার ছোট্টো পরিসীমা, সাদা
দেওয়াল, শান্ত আবহ, মুখর নীরবতা খুব আরামদায়ক। সন্ধের পর পর্যটকেরা সেখানে বেশ জাঁক
করেন বলে শুনেছি। কী কী সেবা করেছিলুম, তা ছবিতে লেখা আছে। দেশি জিভে সে সব ঠিক আসবে
না।
তবে এক-রু সফ্রেঁ নামক সরাইখানাটির স্থাপত্য, পরিবেশ, পরিমার্জনা এক কথায় মোহময়। আবহের মধ্যে ফরাসি মেজাজ স্পষ্ট বোঝা যায়। নৈশভোজ সম্বন্ধে বলতে পারি তার মান যে কোনও পাঁচতারা সরাইয়ের পাকশালাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। জলজ প্রাণী বিষয়ক শখ থাকলে এখানে স্বাগত। বাকি সব তো ছবিতেই দেখা যাবে। অধিকন্তু নিষ্প্রয়োজন।
যত ঘুরে বেড়াই, তত ভাবি। আমাদের দেশ জুড়ে সারা পৃথিবী থেকে কত জাতির, কত ধরনের মানুষ এসেছিলেন বলে আজ আমরা 'আমরা' হতে পেরেছি। আশৈশব 'হে মোর চিত্ত' মুখস্থ বলে এসেছি অভ্যেস বশে। এখন বুঝতে পারি, প্রতিদিন বুঝি, ভারতবর্ষ কীসের নাম।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন