কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


চোখের আগুন! চোখের জল!!

বহু বছর পরে নিজেদের গ্রামে এসে সুমিতা ক্রমাগত কেবলই অবাক হতে থাকলো। সবকিছুই যেন পাল্টে গেছে। আগের মতো কোনো কিছুই নেই। চাষের ক্ষেতের পরিমাণ কমে গেছে। যেটুকু আছে সেখানে ট্রাকটার দিয়ে চাষ হচ্ছে। ক্ষেত পেরোলেই গ্রামের শুরু। সেটা আগেও ছিল, তবে এখন গ্রামটা অনেকখানি  এগিয়ে এসেছে। এখন এখানে অনেক অনেক পাকাবাড়ি। দোতলা, তিনতলা। রাস্তাও বেশ ভালো। কিছুটা পিচঢালা। বাকিটা মুরুম বেছানো। পঞ্চায়েত বিল্ডিং, উচ্চমাধ্যমিক স্কুল। সব পাকাবাড়ি। দেখতে দেখতে সুমিতার মনে হচ্ছিল, তার সেই ছোটোবেলার অজ পাড়া গাঁ এখন ভোল পাল্টে রীতিমত শহর হয়ে গেছে।  তবে নামটা একই আছে সোনারগাঁ। আগে গরীব গ্রামটার এরকম নামটাকে ভীষণ রকম হাস্যকর মনে হতো। এখন আর অতটা মনে হচ্ছে না। তবে এই এলাকাটাকে গ্রাম বলে মানতেও মন চাইছে না। প্রায় বছর চল্লিশ পর সুমিতা ফিরছে তার জন্মভূমিতে। তাদের সোনারগাঁয়ে।

একদা এখান থেকেই তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল সুদূর বোম্বাই প্রবাসী ছেলের সঙ্গে। তার পেছনে অবশ্যি কারণ ছিল। গুরুতর কারণ। আর বিয়েটা সম্ভব হয়েছিল মুখ্যত সুমিতার রূপের জন্য। যদিও সেই রূপকে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করতে মুখার্জি পরিবারকে বেশ কয়েক বিঘা ধানি জমি বিক্রি করতে হয়েছিল। তবে বহু দূরে মেয়ে বিয়ে দিতে পেরে পুরো মুখার্জি পরিবার হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।

সোনারগাঁ থেকে বোম্বে অনেক দূরের শহর। সেই দূরত্ব আরো অনেকখানি বেড়ে গেছিল যখন সুমিতার বর বোম্বে ছেড়ে দুবাই চলে গেছিল। তারপর তো তাদের পাকাপাকি ভাবে সেখানেই রয়ে যাওয়া। মরুভূমির দেশে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি খুলে ফেলেছিল ওর বর। সুতরাং সুখের না হোক বিপুল বৈভবের জীবন হয়ে গেছিলো সুমিতার। সন্তানের অভাব ছাড়া আর কোনো কিছুর অভাব ছিল না। এখনো নেই। বলা হলো বটে। কিন্তু সত্যিই কি আর কোনো অভাব বা অভাববোধ নেই? না যদি থাকবে তবে এতোবছর পরে কিসের খোঁজে সুমিতা ভারতবর্ষে ফিরে বোম্বে, দিল্লি কোলকাতা ছেড়ে ছুটে এসেছে বাংলার এক অখ্যাত গ্রাম সোনারগাঁয়ে? টাকা থাকলে সবই হয়। কোলকাতা থেকে চার চাকার গাড়ি নিয়েই বাই রোড এসেছে সুমিতা। মনে মনে ভেবেছিল পুরো পথ হয়তো গাড়িতে যাওয়া সম্ভব হবে না। তবু দেখা যাক কতো দূর পর্যন্ত মোটোরেবল রোড আছে, যেখান পর্যন্ত গিয়ে আর যাওয়া যাবে না। তখন নয় অন্য ব্যাবস্থা করে  নেওয়া যাবে। চল্লিশ বছর আগে তখনকার মেঠো পথে গরুর গাড়ি চলতো। তবে ওরা নিজেরা তো হেঁটেই যাওয়া আসা করতো। তাদের পায়ের জোর অনেক ছিল। আর ছিল সাইকেল। অনেকেই সাইকেল ব্যবহার করতো। বিভাসও।

সুমিতার গাড়ি একেবারে গ্রামের ভেতরে চলে এলো। সেই পথে টোটো, টেম্পো, ছোটোখাটো ট্রাক যাতায়াত করছে। বাইক ছুটছে হুস হুস করে। সুমিতার গাড়ি সরাসরি গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়লো। একটাও চেনা বাড়ি চোখে পড়লো না। অবশেষে চেনা ঠাঁই হিসেবে দেখতে পেল বিশ্বেশ্বরীর মন্দিরটা। সে আমলেও মন্দিরটা পাকা ছিল। এখন সেটা আকারে বিশাল হয়েছে। তবে চেনা যাচ্ছে। কারণ মন্দিরের সামনে ফলকে জ্বলজ্বল করছে নাম ‘মা বিশ্বেশ্বরীর মন্দির’।

মন্দিরের সামনেই গাড়ি থেকে নামলো সুমিতা।

- হ্যাঁ ম্যাম। খুবই প্রাচীন মন্দির এটা। মন্দির নব নির্মিত তবে বিগ্রহটি প্রায় পাঁচ শত বৎসর পুরাতন। খুব জাগ্রত। লোকের মনস্কামনা পুরণ করে থাকেন।

কথাটা যে সত্যি নয় সুমিতা সেটা জানে। দেবী তার মনস্কামনা পুরণ করেননি।

ভদ্রলোক নিজেই এগিয়ে এসে সুমিতাকে খবর কটা দিলেন। নুতন মানুষকে দেখে আরো কয়েকজন এগিয়ে এসেছে কৌতুহল নিয়ে। অবধারিত ভাবে একসময় প্রশ্নটা এসে গেল।

- কাকে চান?

- কালীকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়! জীবনকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।

আমতা আমতা করে সুমিতা জ্যাঠামশাইদের নাম বললো। ইচ্ছে করেই বাবার নামটা বললো না। ঠিক অভিমানে নয় তবে সঙ্কোচে। শ্বশুরবাড়িতে থাকতেই শুনেছিল, চাষের জমিহারা হয়ে মুখার্জি পরিবার চাকরিবাকরি করতে কোলকাতা শহরে চলে গেছে।

নাম শুনে অনেকেই চিনলো না। শুধু একজন বয়স্ক মানুষ চিনতে পারলেন।

- ও। সেই বারেন্দ্ বামুন মুখুজ্যেরা? তারা তো অনেক যুগ হলো গ্রামছাড়া।

- তুমি মানে আপনি কি তাদের কেউ হন? তাহলে তো আপনার জানা উচিত ছিল।

- জানি না তো!

-  তাজ্জব বেপার তাদের কোনো খবরই আপনার কাছে নেই?

একজন বললো।

- তাদের কাউকেই তো আপনি এখানে পাবেন না।

অতিকষ্টে নিজের বিহ্বলতা কাটিয়ে সুমিতা বলেছিল,

- আমি বিদেশে থাকতাম। অনেক কাল পরে দেশে ফিরেছি। খোঁজ খবর পাইনি। তাই খোঁজ নিতে এসেছি।

- এখানে তাদের কোনো খোঁজ পাবেন না। আচ্ছা আপনি কি তাদের কেউ হন?

মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে সায় জানালো সুমিতা। এর বেশি আর জানাতে ইচ্ছে করলো না। কিন্তু আর একটা ইচ্ছে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।

- আচ্ছা। এখানে একটা ডাক্তারখানা ছিল না? কবরেজি ডাক্তারখানা?

এবার মাথা নাড়লো উপস্থিত সবাই। এরকম কোনো ডাক্তারখানার কথা তারা কেউই জানে না।

- শালুক বিলের ধারে ছিল বাড়ি মানে ডাক্তারখানাটা।

- শালুক বিল মানে তো সেই গাঁয়ের একদম দক্ষিণ দিকে। বিলটা আছে। তবে নানাভাবে ভরাট হয়ে হয়ে ছোটো হয়ে গেছে। বিলের ধারে দুটো একটা শনের ঘর এখনো আছে। সেখানে একবার খোঁজ করে দেখতে পারেন। তবে আপনার গাড়িটা তো সেখানে যেতে পারবে না। পথই নেই। যেতে হলে হেঁটেই যেতে হবে। দূর আছে। হাঁটতে পারবেন?

এবারও মাথা হেলিয়ে সায় দিল সুমিতা। ভিড়ের মধ্য থেকে একটা বাচ্চা ছেলে বলে উঠলো,

- আমি নিয়ে যাবো। আমি রাস্তা চিনি।

সুমিতা হাঁটা শুরু করতে দেখা গেল শুধু সে নয় আরো কয়েকজন বাচ্চাছেলে পথপ্রদর্শকের দলে ভিড়ে গেল।

- আপনার কালো চশমা আছে। লাল নীল ফুলছাপ ছাতা নেই? রোদ লাগবে তো!

একটি ছেলে বললো।

- আমি বাড়ি থেকে একটা ছাতা নিয়ে আসতে পারি। তবে লাল নীল নয় কালোছাতা। পাঁচুকাকার ছাতা।

- একটা ছাতায় কি হবে? আমরা তো অনেকজন।

- আরে না না। আমাদের রোদে কিছু হয় না। যদিও মা বকে?

- আমবাগান এসে গেলে ছায়া পাবেন।

- ওখানে কিন্তু গরীব লোকরাই থাকে। আপনি গরীব লোক দেখতে যাচ্ছেন?

বাচ্চাগুলো অনেক অনেক কথা বলতে চাইছিল।

সুমিতা কিন্তু তাদের এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলো না। ওর মনে হচ্ছিল। তখন তো তারা এতো গরীব ছিল না। নাকি ছিল! সুমিতা সেটা টের পেত না। বিভাসও না।

একটা শনের বাড়ির গায়ে একটা হেলানো বোর্ড দেখে চমকে উঠলো সুমিতা। জং ধরা বোর্ডটার অনেক অংশই বেঁকেচুরে গেছে। বোর্ডের গায়ের লেখাটা অলমোস্ট গায়েব হয়ে গেছে। একটা ফুলের ছবি আবছা দেখা যাচ্ছে। আর একটা আবছা অক্ষর চি...।

সুমিতার চমকে ওঠাটা বিশ্বাসের ভিত্তি খুঁজে পেল। - এটাই। হ্যাঁ এটাই। ওটাই চিকিৎসালয়ের ছিল।

আর ফুলটা পদ্ম। বিভাসের মায়ের নাম পদ্ম ছিল।

মনের তো সময় পেরোতে সময় লাগে না। নিমেষে সুমিতার মন অতীতে চলে গেল। এমন অতীত যেটা অনেক পুরনো হলেও কিছুতেই ভোলা যায় না। সুমিতা থেমে গেল।

- কই ম্যাম। আর যাবেন না। বিলে কিন্তু শাপলা আছে।

-  বকও আছে।

- না না। যাচ্ছি যাচ্ছি।

- এইদিকে বিলের রাস্তা।

- না বিলে নয়। আমি ঐ বাড়িটাতে যাবো। কে থাকে ওখানে?

একসাথে সবাই বলে উঠলো,

- একটা বুড়োলোক। নাম জানি না। আমরা কিন্তু যাবো না। লোকটা মনে হয় ভালো না। আমরা এখানেই থাকি, আপনি যান।

সুমিতা পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। শনের ঘরের দোরটা খোলা। ঘরের ভেতরে আলোর অভাব। ঘরে উঁকি দিতেই যে মানুষটাকে দেখতে পেল সুমিতা। তাকে চিনতে অসুবিধে হল না।

ঐ তো শম্ভুকাকা। সেই একই রকম কাঁচাপাকা চুল আর গোঁফ দাড়ির জঙ্গলে ঢাকা মুখ। আর একটু বেশি  ঝাঁকড়া হয়েছে শুধু। তার মধ্য থেকে জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ।

বিভাস বলতো, বাবার চোখ দুটোতে আলো জ্বলে। ঐ আলো এমন তীব্র যে ও দিয়ে মানুষের গোটা  ভেতরটাই দেখা যায়। বাবা দেখে ফেলে। আর রোগীর রোগ বুঝে যায়। একবার রোগটা বুঝতে পারলে চিকিৎসা তো সহজ ব্যাপার। জঙ্গল ভর্তি ওষুধ-বিষুধ। বাবা ঐ চোখের আলো দিয়েই সে সবও খুঁজে আনে।  তারপর সেসব বেঁটে সেদ্ধ করে ওষুধ বানায়।

অবাক সুমিতাকে বিভাস দুঃখ করে বলেছিল,

- বাবার চোখ দুটোর আলোটা যদি আগে থেকেই জ্বলতো তো মা কিছুতেই মারা যেতো না। বাবা মায়ের শরীরের ভেতরের রোগটা ঠিক ধরে ফেলতো। আর ওষুধ দিয়ে মাকে বাঁচিয়ে দিত। কিছুতেই মরতে দিত না।

- আগে কাকুর চোখের ঐ আগুন আলো ছিল না?

- না তো। ওটা তো মায়ের চিতার আগুন। চিতা থেকে বাবার চোখে ঢুকে গেছে।

নিমেষের মধ্যে এতো কথা সুমিতার মাথায় খেলে গেল। ও চাপা স্বরে ডাক দিল,

- কাকা। কাকা!

- কে?

- আমি সুমি। সুমিতা।

- কে সুমিতা?

- সেই যে আপনার ছেলে বিভাসের কাছে আসতাম পড়া বুঝতে।

- বিভাস কোন বিভাস? একজন বিভাস তো এখানে অনেক কাল আগে ছিল। সে বিভাস তো কবেই মরে গেছে।

তারপর আগুন চোখ নিচু করে শম্ভু কাকা হাত নেড়ে সুমিতাকে চলে যেতে বললো।

একটু দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমিতা বললো,

- প্রণাম শম্ভুকাকা। আসছি তবে।

- আমি তো শম্ভুকাকা নই। উনি তো আমার পিতা। অনেক বছর আগেই গত হয়েছেন।

- তবে! আপনি? কে আপনি?

- আমি কেউ না। একটা মৃতদেহ।

ঠিক সেই সময় একসঙ্গে বেশ কটা শিশুকন্ঠ বলে উঠলো,

- চলে আসুন। চলে আসুন। পালিয়ে আসুন ম্যাম।

তার মানে আমরা যাবো না বললেও ওরা ওদের শিশুসুলভ কৌতুহল দমন করতে পারেনি। ঠিক সুমিতার পিছু পিছু চলে এসেছে। তবে ঘরের ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। উঁকি মেরে দেখেছে, শুনেছে। একরকম হাত ধরে টানতে টানতেই সুমিতাকে ওরা ঐ ভুতুড়ে বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে চল্লো।

- লোকটার চোখে কেমন আগুন জ্বলছিল। দেখেছেন?

তার মানে সেটা বাচ্চাগুলোও দেখেছে।

ফিরতি যাত্রায় গাড়িতে বসে সুমিতা ভাবছিল। তার মানে শুধু শ্মশানের চিতার আগুন নয়, ভালোবাসার চিতার আগুনও চোখে ঢুকে পড়তে পারে। ঢুকে পড়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। আলো হয়। সে আলোয়  মানুষের ভেতরটা দেখে ফেলা যায়? সুমিতার ভেতরটাও কি দেখে ফেলেছে সে?

সুমিতা শিউরে উঠলো। তবে সব চোখে তো আগুন ধরে না, জল ঝরে। দেখতে দেখতে সুমিতার দুচোখ  জলে ভরে গেল। চোখ ছাপিয়ে গাল বেয়ে চোখের জল নামতে লাগলো গড়িয়ে গড়িয়ে।

তাতে অবশ্যি মসৃণ রাস্তা দিয়ে তাদের গাড়িটার ছুটে চলার কোনো ইতর বিশেষ হলো না। কিছুটা ঝকঝকে হয়ে ওঠা সোনারগাঁ থেকে পুরো ঝকঝকে কোলকাতার দিকে গাড়ি অবাধে ছুটতে লাগলো।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন