কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

গৌরাঙ্গ মোহান্ত

 

কবিতার কালিমাটি ১৪২


 নির্বান্ধব শহর

 

হোটেলে শ্রীঘরের সরঞ্জাম। গাড়ির একটানা শব্দ আমার কক্ষটিকে দিনরাত ক্লান্ত রাখে। অপরিচিত মানুষের পাশে হাঁটতে হাঁটতে রমণীবেশী হিজড়ার চাহনি আমাকে টেনে নিয়ে আসে হোটেল প্রাঙ্গণে—এক যুবতি দীর্ঘক্ষণ ধরে স্কুটার চালনার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নির্বান্ধব শহরে অস্তিত্বের গুরুত্বহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে। প্রতীক্ষমাণ বাসযাত্রী উৎকণ্ঠায় ভুগতে পারে, আমার কোনো অধীরতা নেই। আমি ট্যাক্সিতে চেপে গ্রন্থবিপণির দিকে ছুটে চলি। কাঞ্চন আর বাঁশপাতার নৃত্যে সময় চঞ্চল হয়ে ওঠে। নারকেল ও পাম গাছের অবিশ্বাস্য শীর্ণতা আমার চোখে প্রদাহ সৃষ্টি করে; গতরাতে ট্রাভোপ্রস্ট ব্যবহার করেছি কি না মনে করবার চেষ্টা করি। কোথাও পত্রহীন বিশুষ্ক গাছে পরগাছার রাজত্ব জাগরণী গান শোনায়। নির্মুণ্ড উইপিং দেবদারুর বিমর্ষতা সে গানকে নিষ্প্রভ করে রাখে। ফ্লাইওভারে চলিষ্ণু ট্যাক্সির ঊর্ধ্বাংশ অদৃশ্য হতে না হতেই উৎসব-তোরণের জন্য দাঁড় করানো বাঁশের ফ্রেমের নিচ দিয়ে আমি এগিয়ে চলি। নজরুলের আবক্ষ মূর্তির অদূরে কবরস্থানদৃশ্যকে বিসদৃশ লাগে না। ট্রেনের চাকার শব্দ ভেসে আসে। আমার ভাবনায় শরীরী হয়ে ওঠে আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম দুটি গদ্যকবিতা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেন অন্ধকারমগ্ন রজনীগন্ধার কম্পন, রাস্তার রাঙা নিমন্ত্রণপত্র আর বৃষ্টি-গান-আঁধারে আচ্ছন্ন একটি দুপুরের হৃদয়াবেগ।

 

মাটির অদৃশ্য গ্রাস

 

অবোধ্য ভাষা হামা দিয়ে আসে। দুয়েকটি শব্দ বুঝি, সমগ্র সংলাপের অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। বক্তার উৎকণ্ঠা দেখে মনে হয় তার অসুস্থতা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। অসহায়ত্ব মানুষের দৃষ্টিকে অনুজ্জ্বল করে, চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা ছাড়া বিকল্প কিছু থাকে না। চিকিৎসিত হওয়া সহজ বিষয় নয়। টোকেন গ্রহণ করার পর কাউন্টারে টাকা জমা দিতে হয়, কনসালটেশন সুয়িটের সামনে বসে থাকতে হয়, আহ্বান এলে প্রাথমিক পরীক্ষা সম্পাদিত হয়; এরপর প্রধান চিকিৎসকের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হয়। শরীরকে সুস্থ রাখা দুরূহ। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কেউ কবর বা ক্রিমেটরিয়ামের পথে পা বাড়ায় না। মাটি মানুষকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে। মাটির অদৃশ্য গ্রাসই হচ্ছে অসুস্থতা। মাটির তীব্র ক্ষুধা মৃত্যুর পর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বস্তুত মাটি শবধারক বলে আমরা মাটিকে ভালোবাসি। মাটি মানুষের চূড়ান্ত বাসগৃহ নির্মাণ করে। সেখানে ইট-রড-শ্রমিক-এঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন নেই। মাটির দক্ষতার কাছে মানুষের সকল দক্ষতা পরাজয় বরণ করে।

 

গঙ্গাচড়ার পথ

 

মধ্যপৌষের ধুলোয় পথরক্ষী বৃক্ষের স্টোমেটা রুদ্ধ হচ্ছে। ধানের শোকে কিছু কিছু খেতে নাড়ার বিবর্ণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তামাকের চাষে ভাটা পড়েছে।আলু আর ভুট্টার চারা শীতের শক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছল্য করছে। বিপত্তি অনুধাবনের শক্তি তাদের নেই। অজ্ঞানতা শৈশবকে উৎফুল্ল রাখে। নেপিয়ার ঘাসের আঁটি নিয়ে রিক্সাভ্যান ছুটে চলেছে। ঘাসের দীপ্তিকে হরণ করছে মানুষ আর মানুষের জ্যোতির্ময় স্পন্দনকে কেড়ে নিচ্ছে দ্রুতগামী বাস। ঘাতক বাসের আকস্মিক ধাক্কায় অটোরিকশাযাত্রী দিলীপ গঙ্গাচড়ার নির্লিপ্ত পথে ছিটকে পড়ে। তার মাথা ফেটে একান্ন বছরের সেরেবেলাম বেরিয়ে আসে। পিটার ব্রুগেল ইকারাসের অন্তিম মুহূর্তের ছবি এঁকেছেন। কোনো মানুষ তাকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে আসেনি। সময় ব্যবস্থাপনার কঠোরতা ও বাসের দ্রুতির কাছে দিলীপের জীবন মূল্যহীন।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন