ধারাবাহিক উপন্যাস
হে নেপথ্যচারিণী
(১৮)
বিপর্যয়
সুচন্দ্রা সেরে উঠেছে অনেকটাই। ওকে ছুটি করে দিয়েছে হাসপাতাল। ঘরে ফিরে যাবার মুহূর্তে আমি আর আশুদা ছুটিসংক্রান্ত সইসাবুদ অত্রির হয়ে সারলাম। তারপর ওরা চলে গেলে সুচন্দ্রার চিকিৎসক ও আশুদার বন্ধু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিখিলেশ মালাকার আমাদের তার চেম্বারে নিয়ে গেলেন। আশুদা চেয়ারে বসতে বসতে বলল,"নিখিলেশদা। কী বুঝছ?"
দুধসাদা চুল ডাক্তারবাবুর।তার হাসির ভিতর এক উদগ্র ক্লান্তি উঁকি মেরে
যায় মাঝেমাঝে। আশুদার মুখে নিখিলেশদার কথা শুনেছি। তাঁর একটিই ছেলে। আশুদার ছেলে ঋকের
থেকে বছর পাঁচেকের বড়। বাবার মতোই উজ্জ্বল মেডিকেল কেরিয়ার। হাফ ডজন গোল্ড মেডেল। হৃদরোগ
বিশেষজ্ঞ হয়ে হঠাৎ নিজেই একদিন ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের স্বীকার হয়ে গেল। ঘরে
বৌ, দুটি মেয়ে রেখে হঠাৎ সে চলে গেল। নিখিলেশদা দমে যায়নি ঠিকই। কিন্তু তার হাসির অন্তরালে
বিষাদের গ্রহণ কখনও কখনও তার জীবনের সেই কালো ঘন নীল যন্ত্রণার পাতাগুলো একঝলক খুলে
দেয় যেন।আমাদের এই পেশা, এই জীবিকা অনেকটা পাটকাঠির মশালের মতো। জ্বালানিটুকু দিয়ে
সংসারের খাদ্যনিরসন তো হলো, কিন্তু মশালের নিয়তি সেই ছাইভস্মই। আশুদা বলল,"সুচন্দ্রার
ব্যাপারটা কী বুঝলে নিখিলেশ দা?"
নিখিলেশ মালাকার শান্ত হয়ে ডেস্ক থেকে কয়েকটা এম আর আই প্লেট বের করে
একে একে ভিউবক্সে লাগাতে লাগলেন। তারপর বললেন,"প্লেটগুলো ভালো করে দেখো আশুতোষ।"
এক এক করে নিখিলেশদা মেলে ধরছেন সুচন্দ্রার স্নায়ু, মস্তিষ্ক ও পায়ের
যন্ত্রজাত ছবি। সে ছবিতে কখনও স্নায়ু পিঁয়াজকলির মতো ফুলে উঠেছে, কখনও আবার কোষক্ষয়
হয়ে মস্তিষ্কের সাদা অঞ্চল ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে মস্তিষ্কের সেরিবেলামকে ছোট করে দিয়েছে।
স্নায়ু পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে মস্তিষ্ক থেকে জন্ম নেওয়া স্নায়ুবার্তাগুলো
সুচন্দ্রার হাত নখ , বা শরীরের অন্যান্য প্রত্যঙ্গে ঠিক মতো পৌছোচ্ছে না। আশুদা রিপোর্ট
দেখতে দেখতে বলল,"আমার সুচন্দ্রাকে প্রথম দিন দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। যদিও এই ভেরিয়াশানটা
বেশ বিরল।"
নিখিলেশদা সম্মত হয়ে বলে,"মেয়েটি সি এম টি অসুখে ভুগছে। শারকট
মেরি টুথ ডিজিজ। সাধারণত অল্পবয়সে আত্মপ্রকাশ করলেও মেয়েটির যা বয়স, সে বয়সে নির্ণিত
হতে পারে না এমন নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের হলো, সাধারণত এই অসুখে মানুষের পা হাত পিঠ বেঁকে
যায়। কিন্তু সুচন্দ্রার ক্ষেত্রে তা না ঘটে অসুখ সরাসরি মস্তিষ্ক আক্রমণ করেছে।এটা
খুব রেয়ার।"
নিখিলেশ যা বলতে চাইছে তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে সেরিবেলার এটাক্সিয়া।
সঙ্গে মৃগী। যাকে বলে মায়োক্লোনিক জার্ক। পুরো অসুখটাই জিনগত।দুই ফরাসী স্নায়ুবিজ্ঞানী
জাঁ-মারি-শারকট ও পিয়ারি মারি, ও ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড হেনরি টুথের নামে এই অসুখ।
নিখিলেশদা আন্দাজ করছিল সুচন্দ্রার ক্ষেত্রে অসুখটা যেভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে তার
'ভ্যারিয়েন্ট ৫' হবার প্রবল সম্ভাবনা। নিখিলেশদা আরও একবার থেমে হেসে বললেন।
-আরো একটা মজার ব্যাপার আছে আশুতোষ!আরও একটা আবিষ্কার বলতে পারো!
-কী সেটা?
-মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। সে কথা তাকে জানানো হয়নি। তবে মেয়েটির বর অত্রিকে
ডেকে একবার জানাতে হবে আমাদের। এই সময়টা ওকে খুব সাবধানে রাখতে হবে।
এই খবর এতো ভয়ানক সত্যর ভিতর যেন পারিজাতের মতো হিল্লোলিত এক শুভসংবাদ।সিট
থেকে উঠে আমাদের নিয়ে দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ডাক্তার নিখিলেশ মালাকার হঠাৎ গভীর
চিন্তায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আশুদা বলল।
-কী হলো নিখিলেশদা? কিছু ভুলে গেলে?
নিখিলেশদা সামান্য হেসে বলল,"তেমন কিছু নয়। একটা কাকতালীয় ঘটনা
মনে পড়ে গেল। আমার এক বন্ধুর ছিল এই রোগ। খুঁড়িয়ে হাঁটত। হাতের কাঁপুনি সারাতে মনের
জোরে বেহালা বাজানো শিখেছিল। অদ্ভুত সুন্দর বেহালা বাজাতো। জেলের ডাক্তারি করত।
আমি আর আশুদা একসঙ্গেই বলে উঠলাম,"ডাক্তার মুরারী পাল চৌধুরী!"
নিখিলেশ হেসে বলল,"ঠিক তাই। এই মেয়েটির শশুরমশাই। মুরারীর ছেলেকে
ছোটবেলায় দেখেছিলাম। আবার এতোদিন বাদে এতো বড় অবস্থায় দেখছি। ঈশ্বরের অশেষ কৃপা, ছেলেটি
ওই মারণরোগের শিকার হয়নি ভাগ্গিস! অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা। তাই না?"
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসতে বসতে আশুদা বলল,"আজ নিখিলেশদা
আমাকে চিন্তার একটা নতুন দিশা দেখিয়ে দিল। এটাও কী কম কাকতালীয়?!"কোন সে দিশা
কে জানে! সে কথা জিজ্ঞেস করবার উপায় নেই। কারণ আশুদা তার মোবাইলে মেইল খুলে কী যেন
পড়ছে মন দিয়ে। আজ আমার কলেজ নেই। জয়ন্ত দেখছে ওদিকটা। ডে অফ। বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাম
গাড়িটা, আশুদা বলল,"গাড়ি লালবাজারের দিকে ঘোরা। মুম্বাই থেকে 'অস্মিতা'র ল্যাব
অ্যানালিসিস রিপোর্ট পাঠিয়েছে অয়ন। এখনই তথাগতর কাছে যাওয়া দরকার। ওকে ফোন করি।"
-কী বলছে রিপোর্টে?
-আবার সেই কাকতালীয় ব্যাপার।সব বলব। আগে জলদি চল লালবাজার।
আশুদা ফোন করে রেখেছিল। তথাগত একটা ছোট রেইড সেরে ফিরে এল। আমরা সেসময়টুকু
লালবাজারের সামনের চেনা চাদোকানে চা খেয়ে কাটালাম। চা দোখানে আজ সেই মেয়েটি নেই। তার
বদলে একটি ছোট ছেলে চা দিচ্ছে খরিদ্দারদের। আশুদা জিজ্ঞেস করতে বলল, ছেলেটি তার ভাইপো।
পিসির লিভারের অসুখটা বেড়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তথাগত এসেই 'ত্রিনেত্র'র ফাইল
খুলে বলল,"নিদ্রা অ্যাপটা আপনার কথা মতো আমাদের সাইবার সেল ট্র্যাক করেছিল। একটা
পয়েন্টে গিয়ে সেই সার্চটা বাফার হয়ে যাচ্ছে। তবে লোকেশনটা ব্যাঙ্গালোর দেখাচ্ছে।"আশুদা
চিন্তিত হয়ে বলল,"তুমি নিশ্চিত?"তথাগত সম্মতি জানাতে আশুদা বলল,"আমাদের
এই তদন্তর স্বার্থে একটা চান্স নিতে হবে তথাগত। মন বলছে, এটা লেগে গেলে আততায়ীকে আমরা
হাতে পেয়ে যাবোই।"
-কী সেটা?
-শুভঙ্কর শাসমল আর ওই দত্তপুকুরের ওষুধের গোডাউনের জন্য ওয়ারেন্ট বের
করো। রেইড করতে হবে।
তথাগত একটু চিন্তিত হয়ে বলে, "কিন্তু সেটা আজ তো প্রায় অসম্ভব।
তবে আমি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছি। দেখছি। আজ বা আগামী কালকেই একটা আন অফিশিয়াল
রেইড করা যায় কিনা।"
-গুড। ডু ইট তথাগত। কাল রাতে তোমাকে দেওয়া অস্ত্রটায় ফিঙ্গার প্রিন্টগুলো
মিলল?
-আমাদের ফাইলে নথিভুক্ত ক্রিমিনালদের সঙ্গে মিলছে না। আততায়ী নতুন
কেউ। তার পুলিশ রেকর্ড নেই।
-বেশ।আর যন্ত্রটা দেখলে?ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট বা অর্ডিনান্স কী বলছে?
-এ ধরনের অস্ত্র আমরাই শুধু নয়, পুরো এশিয়াতে কেউ বানায়নি। অস্ত্রটার
ভিতর মাংসপেশি ভেদ দ্রুত ড্রিল করার জন্য আলাদা হিটিং অ্যাপারেটাস আছে।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,"কটারির মতো!"
আশুদা সপ্রশংস দৃষ্টিতে বলল,"ঠিক তাই।"
তথাগত বলল,"ওই বন্দুকে ম্যানুফ্যাকচারার সিগনেচার আমরা বের করেছি।
সুইডেনের একটা কোম্পানি।"
-দারুণ। বের করার চেষ্টা করো কে বা কারা ওটা অর্ডার দিয়েছিল ওদের।
তথাগত আশুদার নির্দেশ একটা সাদা কাগজে লিখে নিল।
-বেশ।আর সোহরাব?ও এখন কোথায় আছে?
-ও আমাদের প্রোটেকশনে আছে। দুটো কনস্টেবল বসিয়েছি ওর বাড়ির সামনে।
-গুড। ওকে সাবধানে রেখো। ওর ওপর আবার হামলা হতে পারে।
-ওকে।
ঘরে ফেরার পথে মাথার ভিতর কিলবিলিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে চলেছিলাম।কিন্তু
আশুদার ওই এক সমস্যা। ব্যাবচ্ছেদে মগ্ন হলে কথা বলা বন্ধ করে ধ্যানে বসে পড়ে। ঘরে ফিরে
কোনও কথাই বলল না সে। শুধু কয়েকবার প্রশ্নর মতো বলল,"কাকতালীয়?শুধুই কাকতালীয়?"
ফোটোমিটারের সামনে বসে একমনে গতরাতে মারণাস্ত্র হয়ে ওঠা আইপিস লাগিয়ে
চোখ রাখতে রাখতে আশুদা কীসব বিড়বিড় করে চলল। রাতে নিজের পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে আশুদার
আমার টেবিলে রেখে যাওয়া কালার নোটেশন চার্ট দেখছিলাম।হাল্কা হলুদ গাঢ় লালের সঙ্গে মিশে
তৈরি করল নতুন রঙ গাঢ় গেরুয়া। এই মিশ্রণের একটু এদিকওদিক হয়ে গেলেই বিপর্যয় ঘটবার সম্ভাবনা।
একটা সূক্ষ্ম ভারসাম্যর ওপর রঙের মতোই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের যুক্তি ও চিন্তাভাবনার মিশ্রণ।
কী আছে 'অস্মিতা'র রিপোর্টে? ওই 'নিদ্রা' অ্যাপটা আসলে কারা চালায়? মুরারী পালচৌধুরীর
ওই রোগ থাকলে সেও তো তার মানে খুঁড়িয়ে চলত। তবে কি শকুন্তলাদেবীর দ্বিতীয় ধর্ষক তারই
গোপন প্রেমিক? ভাবতে ভাবতে রাত কেটে গেল। সকালে কলেজে বের হতে যাব। আশুদা ফুরফুরে মেজাজে
বলল, "আজ তাড়াতাড়ি আসিস। নেমন্তন্ন আছে।"
-কোথায়?
-ডাক্তার সবিতা আগরওয়াল মেসেজ করেছে। আজ ওনার ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাদিবস।
সেই উপলক্ষ্যে উনি চাইছেন আমরা ট্রিভোলি কোর্টে আজ যাই।একটা কথা বল তো?তুই একটা জায়গার
লোকেশন কারোকে পাঠাতে পারিস?আমার এই নতুন ফোনে নিত্যনতুন অ্যাপ। কখন কোনটা ডাউনলোড
হয়। কোনোটা হয়না।পারিস?
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম,"পারি তো।"
আশুদা বলল,"ভেরি গুড।আমি যখন ইশারা করব তুই আমাদের লোকেশনটা তথাগতকে
পাঠিয়ে দিবি। ওকে বলা আছে।"
আমি "আচ্ছা" বলে বেরিয়ে পড়লাম। মন বলছিল, এ নেহাত নিমন্ত্রণরক্ষা
নয়। আজ রাতে অন্য কিছু পরিকল্পনা করছে আশুদা।কিন্তু কী সেটা কে জানে।জল্পনা আর কল্পনায়
কেটে গেল সারাদিন।কখন যে নিমেশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল বুঝতেই পারলাম না। আশুদা কলেজেই চলে
এসেছিল। সঙ্গে একটি লোক। মাথায় ক্রিকেট ক্যাপ। মুখে মাস্ক। বুশ শার্ট আর কারগো প্যান্ট।
আশুদা বলল, "ও আমাদের সঙ্গে আজ যাবে।"
-কে ও?
মাস্ক সরাতেই লোকটিকে চিনে থ বনে গেলাম।মনসুর গাজি।এই রূপে! কিন্তু
কেন?মনসুর বলল।
-আশুবাবু বললেন। আজ আসতে হবে। রেশমিকেও এনেছি।কারগোর পকেটে ও আছে।
কী ঘটছে কেন ঘটছে কিছুই বুঝছিলাম না। গাড়ি ধেয়ে চলল ট্রিভোলি কোর্ট।
পথে ফোন করল তথাগত অধিকারী। আশুদা গম্ভীর হয়ে শুনল।তারপর ফোন কেটে দিয়ে বলল,"এক্সেলেন্ট!"
-কী হলো?
-তথাগত গতরাতে একটা ছোট দল নিয়ে দত্তপুকুরের 'অস্মিতা' ম্যানুফ্যাকচারিং
ইউনিটে রেইড করতে গিয়েছিল। সেখানে অনেক খুঁজেও শুভঙ্কর শাসমলকে পাওয়া যায়নি। যদিও
'অস্মিতা'র সমস্ত বাক্স পুলিশ সিজ করেছে।
-একটা কথা বলো আশুদা। কী এমন পেলে ল্যাব রিপোর্টে, যার জন্য এতো সতর্ক
হয়ে গেলে তুমি।
আশুদা গাড়ির জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,"আজ রাতে জানতে পারবি।শুধু
শুভঙ্কর শাসমলের এই অন্তর্ধানটা আমাকে ভাবাচ্ছে! তাহলে কি লোকটা আগে থেকে বুঝতে পেরেছিল
পুলিশ আসবে? তাই পালালো? না এর পিছনে অন্য কোনও মাথা আছে!
আমাদের গাড়ি ট্রিভোলি কোর্টে ঢুকতেই চাপি স্বরে আশুদা মনসুর গাজীকে
বলল,"যেমন বলেছিলাম।মনে আছে তো?"মনসুর ঘাড় নেড়ে জানালো সে বুঝে নিয়েছে সব।কী
বুঝে নিয়েছে কিছুই বুঝলাম না।আমাকে আশুদা বলল,"তোকেও যা বলেছি।মোবাইল হাতে রাখবি।আমি
কথা বলতে বলতে সিট থেকে উঠে দাঁড়ালেই তথাগতকে আমাদের লোকেশনটা পাঠিয়ে দিবি।ওকে?"
আমিও মাথা নেড়ে বললাম "ওকে"।
ট্রিভোলি কোর্টে লিফ্ট গেটের কাছেই দুজন অ্যাপ্রনপরা লোক অপেক্ষা করছিল
আমাদের জন্য। আমি আর আশুদা যেতেই আমাদের নিয়ে তারা ডাক্তার সবিতা আগরওয়ালের বাড়ির সামনে
নিয়ে গেল। দরজা খুলতেই সবিতা ম্যাডাম 'আইয়ে আইয়ে' বলে আমাদের আসতে বলল। ঘরের ভিতর এক
আশ্চর্য নীরবতা লক্ষ্য করলাম। বসার ঘরে বসিয়ে ম্যাডাম আমাদের মুখোমুখি বসে বললেন।
-কী জানেন ডঃ আশুতোষ, এই 'অস্মিতা' আসলে আমার স্বপ্ন।সেই স্বপ্নর জন্য
কতো স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে আমাকে আপনি ভাবতেও পারবেন না।
আশুদা মন দিয়ে শুনছিল।বলল,"তার খানিকটা আমি জানি। তবে এবিষয়ে
আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।"
সবিতা আগরওয়াল হেসে বললেন,"তা হবে হবে।তার আগে আমাদের স্পেশাল
সরবত খান।"
সামনের টেবিলে দুটি মহিলা ঢাকনা দেওয়া কাঁচের পাত্রে একটা নীল রঙের
সরবত রেখে গেল। আশুদা সে সরবত ছুঁলো না। সবিতা আগরওয়াল রহস্যঘন চাহনিতে হেসে বলল,"ভয়
নেই আশুতোষবাবু। সরবতে বিষ নেই। আমি খাচ্ছি। দেখুন।"অন্য গ্লাসে সামান্য সরবত
ঢেলে সবিতাম্যাডাম খেয়ে দেখালেন। আশুদা গম্ভীর হয়ে বলল।
-আপনার ছেলে শুভাত্রেয়র ব্যাপারে মিথ্যে বললেন কেন সেদিন?
-কোন মিথ্যে কথা?
-এটাই যে আপনার ছেলে বাঙ্গালোর গেছে বেড়াতে? আমি আমার বন্ধু সর্বানন্দকে
খোঁজ নিতে বলেছি। আপনার ছেলে তো সেদিন কলকাতাতেই ছিল!
দ্রুত বদলে গেল ডাক্তার সবিতা আগরওয়ালের মুখভঙ্গি। থমথমে মুখ করে সে
বলল,"দত্তপুকুর গোডাউনের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। ওটা শুভঙ্করবাবু দেখত।"
-সেই শুভঙ্করবাবু এখন নিখোঁজ ম্যাডাম। লোকে বলছে তিনি শেষ ফোনটা আপনাকে
করেছিলেন।
খানিকটা সহজ হবার চেষ্টা করে সবিতা আগরওয়াল এবার বলেন,"চলুন।
খামোকা এইসব বাতচিতে আমরা সময় নষ্ট করছি। আমার
ঘরে চলুন। আজ আপনাদের ওখানে একটা সারপ্রাইজ দেব আমি।"
ঘরের সবকটি আলো হঠাৎ নীল রঙে বদলে গেল। আর তক্ষুণি আশুদা সোফা থেকে
উঠে দাঁড়ালো। এটা যে আমার সংকেত, সেকথা সহজেই বুঝলাম।কথামতো তথাগত অধিকারীকে আমাদের
লোকেশন পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু কেন এই সংকেত, কী হতে চলেছে, কিছুই আমার বোধগম্য হচ্ছিল
না। আমাদের দুজন দ্বাররক্ষী ভিতরঘরের দিকে নিয়ে গেল। পিঠে একটা ধাতব কিছু স্পর্শ হতেই
বুঝলাম আমাদের দুজনের দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছে ওরা। আশুদা হিসহিস করে বলল,"কাজটা
কি ভালো করলেন সবিতাজি? একটু কথা বলাই যেত তো!"
সবিতা আগরওয়াল হেসে বললেন, "কী করব বলুন, আপনারা তো সরবত খেলেন
না। গেলাসের নীচের দিকে ওষুধটা ছিল। আপনাদের ঘুম আসত। এই ঘুমটার তালাশই তো আমরা সবাই
করছি। তাই না ডাঃ মুখার্জি। চলুন ভিতরে।"
ভিতরের ঘরেও নীল আলো! সেখানে আগের দিন দেখা সেই মস্তিষ্কচুম্বকযন্ত্র
মধ্যিখানে রাখা ছিল। সেখানে কারোকে একটা শুইয়ে রাখা আছে। আলো সামান্য জোরালো হতেই চমকে
উঠলাম দুজনে। সোহরাব ! কিন্তু তার তো পুলিশ প্রোটেকশান ছিল! সবিতা আগরওয়াল হেসে বলল,"এতে
ঘাবড়াচ্ছেন কেন আশুবাবু? দুটো কনস্টেবল আমার লোকেদের আটকাবে কী করে? ছেলেটা বাড়াবাড়ি
করছিল খুব। ওর গার্লফ্রেণ্ড মরে যাবার পর মখ্খির মতোই আমার পিছনে লেগেছিল। তাই ওকে
সরাতে হতোই।
-কনস্টেবলদের কী করলেন? ঘুম পাড়িয়ে দিলেন?
-হ্যাঁ। লেকিন ইয়ে নিদ থোরা অউর গেহরা হ্যায়। ওদের কাছ থেকে পাওয়া
স্যাম্পেল আমার উপরি পাওনা।
আমি চমকে উঠলাম।'স্যাম্পেল' মানে? কীসের স্যাম্পেল! কিন্তু আশুদা বিচলিত
হলো না এতোটুকু। শান্ত হয়ে বলল। "আজ আমরাও কি আপনার স্যাম্পেল?"
সবিতা আগরওয়াল হো হো করে হেসে বলল,"ভালো বললেন। আপনাদের স্যাম্পেলটাও
লিয়ে নেব। বাইরে থেকে অর্ডার আসছে। লণ্ডন, ফ্রান্স, বেইজিং, লস অ্যাঞ্জেলেস। আমার ইনভেনশন
মারিজুয়ানাকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর কী দরকার জানেন ডাক্তার মুখার্জি?সারা
পৃথিবীর দরকার একটু ঘুম। নিশ্চিন্ত ঘুম। চায়েন কী নিদ। তাই না?"
ঘরের নীল আলো সামান্য জোরালো হয়। যেন কোনও মায়াবিনীর প্রাসাদের চোরকুঠুরিতে
চলে এসেছি আমরা। হঠাৎ দ্রুত শব্দে ভিতরের দরজা খুলে গেল। একটি কালো হুড পরা অবয়ব ঢুকে
এল ঘরে। তার ডানহাতে সাদা ব্যাণ্ডেজ। মুখ দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি। শুধু খুলির পাশে গাঢ়
কাটা দাগ। অবয়বটি তার হুডওলা কোট থেকে এবার একটি ধাতব যন্ত্র বের করল। ঠিক যেমনটি আমরা
সেদিন নদীঘাটে রাস্তা থেকে উদ্ধার করেছিল। যার নির্মাতা সুইডেনের কোনও কোম্পানি। অবয়বের
ভিতর থেকে একটা আগ্রাসী জান্তব গোঙানী ভেসে আসছিল। সে এবার সরাসরি তন্দ্রামগ্ন সোহরাবের
দিকে এগিয়ে গেল। আশুদা বলল,"ডাঃ আগারওয়াল। সোহরাবকে ছেড়ে দিন। ও নির্দোষ। এতে
আপনার আরো সমস্যা বাড়বে। ওকে শান্ত হতে বলুন।"
সবিতা আগরওয়ালকে নীলাভ আলোর ভিতর প্রলয়ঙ্করী কালিকামূর্তির মতো লাগল।
তার দুটি চোখ যেন অগ্নিগোলকের মতো ঘূর্ণায়মান উল্কার মতো দগ্ধ করছে চারিদিক। সেই প্রলয়
কীভাবে থামবে কে জানে! সে প্রলয় থামাবার শক্তি আছে যে দেবাদিদেব আশুতোষের, তার দিকেই
অসহায়ভাবে অর্পণ করলাম নিজেকে।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন