কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

স্মৃতিকণা সামন্ত

 

মিঞা কি মালহার



আন্দোলিত ঋষভে উস্তাদ রশিদ খান মেঘমল্লার গেয়ে উঠলে বুকের ভেতর গুরুগুরু মেঘ। কাজল সজল বর্ষাবিন্দু জমতে থাকে মনে। কানে বেজে ওঠে রিনঝিন বৃষ্টিনূপুর। আমাদের কদমশাখ ভরে ওঠে মধুগন্ধী ফুলে। খর গ্রীষ্মের দিনে ছোটনাগপুর প্ল্যাটুর পায়ের তলায়  দীপক রাগের ঝঙ্কার। মাঠঘাট পুড়িয়ে, নদী নালা ছাপিয়ে অসাধারণ যজ্ঞ- আয়োজন। চাতক আর মানুষ দুইই আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে থাকে, চেয়েই থাকে। বৃষ্টি আসে না। তারপর একদিন হাওয়া অফিসের লাল ডাকবাক্সে কে যেন ফেলে দিয়ে যায় উড়ো মেঘের চিঠি। হাওয়া অফিসের বড়বাবু সেই চিঠি নিয়ে ঢোকেন বড় সাহেবের কাছে। বড়সাহেব লাগানের আমীর খানের মতো আগাম বর্ষার খবর পৌঁছে দেন দিকে দিকে। বর্ষা তখনও কেরলের পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে মেলট্রেনের অপেক্ষায়। তামিলনাড়ু, অন্ধ্রের কোস্টাল ট্র্যাক ধরে ছোটনাগপুরের মালভূমি ছুঁয়ে ফেলতে তাকে মেহনত করতে হয় অনেক।  অনেক যানজট, অনেক ট্র্যাফিক পার হয়ে যখন সে গেরস্তের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছয় গেরস্ত তখন হয়ত গভীর ঘুমে। বর্ষা চলে যায় আরো উত্তরে, মধ্য ভাগের দিকে।

শহর গোয়ালিয়রে রাজা বসেন কেল্লায় আর সম্রাট থাকেন তামাম আম আদমির হৃদয়-কুঠুরিতে। অন্ধকার ঘর, ছেঁড়া জাজিম আর পানের রসালো জুবান জুড়ে বসে থাকেন শাহেনশা সম্রাট, উস্তাদোকে উস্তাদ তানসেন তান্না। শেষ আষাঢ়ের গায়ে শ্রাবণঘন দিনে শহরে পা রাখলেই কথা ছিল জলতরঙ্গ বেজে ওঠার। কথা ছিল ঘনঘটায়, বৃষ্টিফোঁটায় হেঁটে যাওয়ার। মেঘ এল, হাওয়া এল, গুজরি মহলের অলিন্দে অলিন্দে ভেসে গেল মলহারি সুরের বন্দিশ। ময়ূরী নেচে উঠল সিন্ধিয়াদের উঠোন জুড়ে, হলুদ রেইন লিলিরা দাপিয়ে বেড়াল বাগান। শুধু বৃষ্টি এলনা।

বুন্দেলখন্ডের আমিরি মেজাজ আর শান ও শওকতে পরেসান পথিক নাস্তানাবুদ ঘামে। ফিকে হয়ে আসা গোধূলি আলো সন্ত ঘাউসের সমাধি ছুঁয়ে ফিরে আসছে জাফরি বেয়ে। অসংখ্য অগুনতি পায়রা উড়ে আসে বসে, আবার উড়ে যায় গোল গম্বুজের চূড়ায়। এছাড়া আর কোত্থাও কোন শব্দ নেই। নৈঃশব্দে কান পাতলে যা শোনা যায় তাই সঙ্গীত। পোকা আর পাখিরা ছাড়া কেউ কথা বলছেনা, শব্দ করছেনা। মুহাম্মদ ঘাউসের মকবরা থেকে বয়স্ক মহিলা হাত তুলে দেখিয়ে দিয়েছেন সম্রাটের সমাধি। উঁচু বেদি, খোলা চত্বর আর মস্ত  নিমগাছ বসে আছে গম্ভীর মুখে। হাওয়া তার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে থেকে থেকেই।  মিঞা তানসেন শুয়ে আছেন শব্দহীন ছায়ার বন্দীশে, বিকেলের মায়াআলো গড়িয়ে পড়ছে তাঁর সমাধির ওপর ছড়ানো চাদরে। মলহারের অপেক্ষায় হাঁটু মুড়ে বসি "হে সুরের বাদশা, হে শাহেনশা ছায়া দাও, দাও শীতল সঙ্গীত। বেহেশত চাইনা।  সুরস্নিগ্ধ এক অন্তর বাহির নসিব হোক তোমার একান্ত ওই নিম গাছটির মতো..."।

বিকেলের আলো পায়ে পায়ে পিছিয়ে যেতে যেতে জায়গা করে দেয় অন্ধকারের। ঘাউসের পাশাপাশি শুয়ে থাকা অসংখ্য সমাধি চত্বরে সন্ধ্যা নামার নোটিশ আসে। সন্ধ্যাহ্নিকের আসন পাতে আকাশ। এই সমাধির বাইরে দু'পা  দূরেই ব্যস্ত পৃথিবী। বাজার, দরদস্তুর, মুনাফা আর বেঁচে থাকার দৌড়। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে পায়ের ছাপ, কোলাহল, চিৎকার আর অবিশ্রান্ত শহুরে আবর্জনা। দূরে রাজা মানসিংয়ের কেল্লার দেওয়াল। হারজিত আর যুদ্ধের গল্প নিয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের কোলে, রাতঘুমে।

কেল্লা ফতেহ'র বাঙালি নস্টালজিয়ার দৌড় বালিগঞ্জ, রজনী সেন রোড থেকে জয়সলমির। দুর্বল মন, কমজোর হৃদয় এর বেশী  চায়নি কোনদিন। সিরাজের ফোর্ট উইলিয়াম প্রায় গুঁড়িয়ে ফেলার গল্প মারাঠা ডিচের খালে ভাসিয়ে দিয়ে বাঙালি মুকুলের স্বপ্নরা বেড়ে উঠেছে সোনার কেল্লার পাঁচিলে পাঁচিলে। ভালো ডক্টর হাজরার আর দুষ্টু ডক্টর হাজরার লড়াইয়ের চেয়ে বেশি রোমাঞ্চ কেবল ফুটবলের মাঠে।

মাছে ভাতে বাঙালির চিকেন হার্টেড হওয়ার দ্বিচারিতা ভবদেব ভট্ট যে ঠেকাতে পারেননি সে খবর সবার জানা। এদেশের ডাকসাইটে প্রেম হোক বা যুদ্ধ সবই উত্তরের কব্জায়। লায়লা মজনু, হীর রানঝা, মুমতাজ শাহজাহান, সেলিম আনারকলি, পৃথ্বীরাজ সংযুক্তা এমনকি মানসিং তোমোর যখন তাঁর রাণীর জন্য সতেরো কিলোমিটার দূরের নদীকে বইয়ে দিচ্ছেন মহলের এককোণে তখনও বাঙালির ভালোছেলে কাঁসাইয়ের ধারে বসে বিরহের কবিতা লিখেছে।

শহর গোয়ালিয়রের রাতের জানলা আর তার ফাঁক গলে উঁকি দেয় যে কেল্লার দেওয়াল তার মাঝে পড়ে থাকে পথ।  রাজা আর হরিণ-চোখ এক মেয়ের প্রেমকাহিনী বলিউডি সিনেমার প্লটের মতো সুপারহিট এক গল্প হয়ে ঘুরে বেড়ায় কেল্লার এককোণে গুজারি মহলের ফটকে, খিলানে। হা হা প্রেম, ঠা ঠা রোদ আর পুরোনো বসতির উপচে পড়া নর্দমার জলে থমকে থাকে বিন্দুবৎ ইতিহাস।

হুন রাজা মিহিরকুল থেকে গুর্জর প্রতিহার , তোমর, দাস, মোঘলের হাত বদল হতে হতে সিন্ধিয়াতে এসে ঠেকা কেল্লা আর ক্ষমতা বদলের রাজকাহিনীতে আম আদমি আর আদমসুমারির তালাশ মেলা ভার। আম আদমি বসত করে পথে। পুরানি শহরের সঙ্গে নয়া শহরের দোস্তানা আর তার আনোখি আন্দাজ টের পাওয়া যায় হাটে বাজারে, পথে ঘাটে। তানসেনের সমাধি চত্বরে দেখা ইরফান, নাসের আর প্রেমচাঁদের সাথে। ওরা বলেছিল 'মোতি মহল জরুর দেখনা।'

মহলের গায়ে, কেল্লার গায়ে পড়ে থাকা হাতের ছাপ, হলুদের দাগ আর আধপোড়া গন্ধরা হঠাৎ জেগে উঠলে ইতিহাস হয়। বুড়ো, স্থবির ইতিহাস আর পাহাড়ি চাট্টানের ফারাক খুঁজতে চিঙ্কুরাণী টু মৃগনয়নীর সুড়ঙ্গ পথ বেয়ে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া যায় কেল্লার গভীরে। পদাতিকের পথ চলে যায় মঞ্জিলের দিকে নাকি মঞ্জিল নেমে আসে পথে সে খবর রাখে শুধু গলি আর চৌরাহা। পড়ে থাকে সার সার ব্যান্ডের অফিসঘর আর রাস্তা। ব্যান্ড বাজা বারাত আর শাদির সিরিজে একটা রাস্তার সব ব্যান্ড অফিস দয়াল ব্যান্ডের নামে। যেসব ঘরের দেওয়ালে "শুভ বিবাহ" লিখে নিমন্ত্রণ পত্র উড়ে যায় প্রজাপতির পাখায়, দুলহে কে শেহরা আর দুলহন কি জোড়া ঘিরে সেইসব ঘরে বাজতে থাকে ব্যান্ড, দয়ালের নামে।

এদিকে কেল্লার দরজায় বিট্টু আর ভুনা কিছুতেই ডিসাইড করতে পারে না কী খাবে। একজন বলছে মেগি খিলা দো তো অন্যজন বলছে আইসকিরিম।  দুজনের চয়েস এক্কেবারে দুরকম। কেল্লার জাফরির ফাঁক গলে আসা রোদের সোনালী সফর আর আর ঠিক তার ফটকের বাইরে ঘিঞ্জি,নোংরা, আবর্জনার জীবনের কনট্রাস্ট কিম্বা যে এলাকার লোকের খাবারে গরুর দেদার এন্ট্রি ঠিক সেই এলাকার মাঝামাঝি ঘাস কিনে গোমাতাকে খাওয়ানোর পুণ্যার্থী হিড়িকের মতো মারাত্মক ডাইভারসিটির মিনিয়েচার বিট্টু আর ভুনা। বছর আটেকের বিট্টু বয়সে বড়। ভুনা বছর ছয়। ভুনাকে বলি , খিদের মুখে আইসক্রিম খেলে শরীরখারাপ হতে পারে, ম্যাগি খা। এই ক্রুসিয়াল পয়েন্টে ভুনা তাকায় বিট্টুর দিকে, বিট্টু দো-সেকেন্ড শোচনে কে বাদ ভূনাকে বলে "ঠিক বাত । চল মেগি খাতে হ্যায়"। বিট্টু আর ভুনার এই নিজের নিজের ডাইভারসিটি বজায় রেখেই নিজেদের ভালোর জন্য একটা মিউচ্যুয়াল সেটেলমেন্টে চলে আসার স্কিল এটা রপ্ত করে ফেললেই এদেশেও নিখরচায় একটা বিপ্লব হয়ে যেতে পারে কিন্তু হয়না। সময়ের হাত বদলে  সৌখিন মৌতাতি বিপ্লব এখন সাবেকি হুজুক। আমরা প্রত্যেকে চাই একটা বিপ্লব হোক, কেউ একটা বিপ্লব করুক। তার আঁচ রাস্তা অবধি এসে থেমে যাক। বাড়ির জানলার শার্সিতে বিপ্লবের দাগ আমরা কেউই চাইনা। অথচ বিপ্লব আর বাঙালি এই দুজনকে কেউ কোনদিন আলাদা করার চেষ্টা করেছে বলে মনে পড়েনা। স্বাধীনতার আগে বাঙালি বিপ্লব করেছে লুকিয়ে চুরিয়ে আর স্বাধীনতার পর বাঙালির বিপ্লবের ঠিকানা কফিহাউস। তেলচিটে টেবিল, পুরোনো চেয়ার আর ধোঁয়া ওঠা কাপে বাঙালির মনে বিপ্লব জাগিয়ে রাখতে কফিহাউস কম মেহনত করেনি। কেল্লার শহরে কফিহাউস দেখে বিপ্লব না হোক নস্টালজিয়া খুঁচিয়ে জাগাতে  মানা নেই। ইন্ডিয়ান কফিহাউসে শানদার পাগড়ির বেয়ারার ট্রেতে কফি ক্যাপাচিনো আর রাস্তার বেসামাল ট্র্যাফিকে সন্ধে গড়িয়ে যায় রাতের দিকে। শহরের ট্রাফিক লাইটগুলো জ্বলেনা কোথাও, গোটা রাস্তাটা গাড়ি আর পায়ে হাঁটা মানুষদের মিউজিক্যাল চেয়ার হয়ে যায়।

মোড়ে মোড়ে মহরমের তাজিয়া ঘিরে ছোট ছোট জটলা। একজন মহিলা তাঁর ঘরের ভেতর তাজিয়া সাজিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন উদাস। ভাঙ্গা গালের ওপর গাড়ির হেড লাইটের আলোয় বড় বিষন্ন দেখাচ্ছে তাঁর মুখ। বহুদূরের কারবালা প্রান্তর যেন কেউ বিছিয়ে রেখেছে মহিলার চোখের সামনে, একে একে চলে যাচ্ছে চেনা মানুষ, প্রিয় মুখ।

কচ্ছপঘটদের মন্দির চত্বরে দাঁড়ালে শহর গোয়ালিয়রকে দেখায় খেলনা বাক্সের মতো। সেই বাক্সের ভেতর স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, হোটেল, অফিস রাস্তা। হয়ত ওই মহিলার বাক্স বাড়িটাও সেঁধিয়ে থাকে তার মধ্যে। ছোট্ট ছোট্ট ছবির কোলাজে এ যেন মিনারের ওপর থেকে জীবনের ট্রেলার দেখা। কেল্লার ভেতর সিন্ধিয়াদের  স্কুল। এদেশের সবচেয়ে দামী স্কুলগুলোর মধ্যে একটা।  বর্ষার দিনে ছাদ বেয়ে জল পড়া সরকারি স্কুল থেকে যে ছাত্র তৈরি হয় এই স্কুল থেকেও তাই। বিট্টু আর ভুনা এমন স্কুলের  দরজায় উঁকি দেয়না নিশ্চয়। অন্য স্কুলেও দেয় কি?

পেছন থেকে এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করছেন কোন ভাষায় কথা বলছি আমরা। ভাষা ব্যাপারটাই ভারী গোলমেলে। ভাষা যেমন কাছে টানে তেমনিই দূরেও। তবু যাহোক এক ইংরেজিকেই মনে হত আইনস্টাইনের থিওরি মেনে চলা কনস্ট্যান্ট। কিন্তু যেদিন জেনেছি স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের ইংরেজি লোক্যাল ডায়ালেক্ট এ আলাদা সেদিন থেকে ভাষা নিয়ে আর কোন ছুঁৎমার্গ উচিত মনে হচ্ছে না। এই যেমন যে হিন্দিকে রাজভাষা বলে চোগা চাপকান এঁটে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই হিন্দিরই কত রকমফের। মিথিলা থেকে অযোধ্যা পৌঁছতে পৌঁছতে হিন্দ্দির ডায়ালেক্ট কতবার বদল হবে তা গুনে বলা মুশকিল। মধ্যপ্রদেশের হিন্দি আর রাজস্থানের হিন্দির মিল কমই। রাজস্থানের জাঠ, গুর্জর আর রাজপুতদের ভাষায় ফারাক আছে ঠিক ততটাই যতটা তাদের পাগড়ির পাকে। আবার সিলেট চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা আসতে আসতে যতবার বাংলার ডায়ালেক্ট বদলায় ঠিক ততটাই বদলায় কলকাতা থেকে বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর , পুরুলিয়া পৌঁছতে পৌঁছতে। গোয়ালিয়র শহরে ফোর্ট যেতে হলে ড্রাইভারকে কিলা না বলে ফোর্ট বললে এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাওয়ার চান্স বেশি। আবার দক্ষিণে ফোর্ট যেতে হলে বলতে হবে ফোর্টেআআ...

মোটকথা ভাষার কোন সরল গতি নেই, ভাষার কোন ধ্রুবক টুবকও নেই। যা আছে তা হলো বিশুদ্ধ রাজনীতি। নাহলে তক্ষুণি সেই মহিলার স্বামী ভদ্রলোক বাঙালি শুনেই বর্ধমানের কথা শুধোবে কেন? লক্ষ্ণৌ শহরের শাকিব আনসারীকে বর্ধমান আসতে হয় কাপড়ের ব্যবসার খাতিরে। টুকটাক বাংলার মোটিফে  উর্দু মেশানো হিন্দি জুবানের মিঠাস মিহিদানার প্রসঙ্গে এসেই কেমন বুঝি ভিজে সপসপে হয়ে গেল। কার্জন গেট, তেঁতুলতলা বাজারের রাস্তা, অলিগলি মুখস্ত তাঁর লক্ষ্ণৌয়ের ভুলভুলাইয়ার মতোই । ইন্ডিয়ার বড় ছোট সব শহরে তাঁর অল্পবিস্তর যাতায়াতে তাঁকে ট্রাভেলার বলবো নাকি ব্যবসাদার? সব জায়গার তওর তারিখার একটা মোটামুটি হিসেব তাঁর মুখস্থ– "বাঙ্গাল মে পান বড়িয়া আছে, কিন্তু বাঙালী লোক পান পসন্দ করেনা। পান তো খায় য়ুপি, বিহার, এমপিকে লোগ। " সে যাই বলা হোক, শাকিব সাহেব  'ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া'র পাক্কা সমঝদার, হিস্সেদারও । বলছেন "ইয়ে এক ইন্ডিয়া দেখনে কে লিয়ে হি এক পুরি জিন্দেগি কাফি নেহি হ্যায় তো হম দুনিয়া ক্যা দেখে?"

এইখানেই কবি চালডাল মিশিয়ে একাকার করে দেওয়ার মতো সব ভাষা, সব জিগর মিশিয়ে লিখে ফেলেছেন

"সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে"। কবিদের এই অগোছালো স্বভাবের জন্য রাজনীতিতে জায়গা হলনা কোনদিন, এমনকি মন্ত্রনা সভাতেও না। নেহাত সভাকবি হয়ে খেতাব জেতা ছাড়া  রাজকথায় কবিদের আর কোন জায়গা নেই ।

কবি আর শিল্পীর কমজোর দিল, দরদ এ জিগর থেমে থাকে আঙুলের ডগায়, চোখের তারায়। সন্ত হরিদাস কিম্বা বৈজুবাওরা বিহীন গ্রামোফোনে বেঁচে থাকে মিউজিক্যাল বনেদিয়ানা। উস্তাদ বেঁচে থাকেন তালিমে আর তেহজিবে, তানসেনের সমাধির চাদরে। গোয়ালিয়রের আকাশজুড়ে রাগ মালহার। যক্ষের খবর নিয়ে উড়ে যায় মেঘ , অলকাপুরীর খোলা জানলায় মেয়েটি বসে থাকে মেঘপিওনের আশায়, হৃদয়ে বিছানো ডাকবাক্সর লাল জাজিম। বাগী আর বেহড় আগলে পড়ে থাকা চম্বলের শুখা জমিনের তলে তলে রিমঝিম বাজে মায়ামৃদঙ্গ। ঝঙ্কৃত শাওন গগন আর  ঘোর ঘনঘটা নেমে আসে গুজারী মহলের উঠোনজুড়ে। আরো আরো উঁচুতে কেল্লার ভেতর থেকে জাফরির ফাঁক গলে গুনগুন বয়ে যায় হাওয়া। রাণী মৃগনয়নীর বীণায় ভেসে ওঠে মেঘমন্দ্র তান, কেল্লার ফটক ছাপিয়ে, প্রহরীর পাগড়ি টপকে সে তান মিশে যায় শহরের চৌরাহায়। রাজা মানসিংহের  তলোয়ারটা কিছুতেই মশানের খোপে খাপ খায়না। আঙরাখা মেলে রাণীরা ছুটে যায় ছাদে আর সব ভুলে রাজা নেমে আসেন অচ্ছুত রাণী মৃগনয়নীর  মহলে। শহরে আজ বৃষ্টি এসেছে।

বৃষ্টি আসে আমাদের মাধবীলতার ঝোপে। কটর কট ব্যাঙডাকা সন্ধ্যা নামলে খিচুড়ির বেয়াড়া গন্ধ ছুটে বেড়ায় পাড়া বেপাড়ায় "গরজ গরজ ঘন মেঘ আজ বিজুরি ছায়ো রে...."

নিন্নি নামের মেয়ে সেদিন জল আনতে যাচ্ছিল নদীর ঘাটে। সেদিনও কি এমন বাদল বরণ আকাশ? থির বিজুরির মতো মেয়ের কালো হরিণ চোখে চোখ পড়ল রাজার আর আর রেয়া নদী উজিয়ে এল বেপথে এক নয়, দুই নয়, টানা সতেরো কিলোমিটার। নিন্নি থেকে মৃগনয়িনী হয়ে উঠতে উঠতে সুরের পরতে পরতে জড়িয়ে গেল মহল, রাজ দরবার, রুখা চট্টান আর আলিশান কিলা। রাণীর ঘরের এককোণে ঝিরঝির বইতে লাগল নদী। নদীটির নাম রেয়া, নদীটি যমুনার আরজন্মের সই।

পেয়েই ঘুঙুর বাঁধা ময়ূরের স্মৃতি বুকে চেপে, রাণীর তানপুরাতে বেজে ওঠা বেহাগের তান দরজায় বিছিয়ে গুজারি মহল এখন মিউজিয়াম। শিল্পীর দুর্বল আঙ্গুল, কঠিন ছেনি হাতুড়ির নিশান নিয়ে জেগে ওঠা বিষ্ণু, ব্রহ্মা , অগ্নি, সূর্য আর মাতৃকা মূর্তির সারসার কালেকশনে ঘণ্টা মিনিটে  পেরোনো সময় এসে থামে অনন্তে।  বিশুমুদির দোকানের তেল আর চিটে গুড়ের গন্ধ পেরিয়ে যে পুরোনো গন্ধ আসে আমাদের ঘরে বাজারের থলে ভরে, তেমনই  গন্ধ চক্কর দেয় মিউজিয়ামের ঘরে, মাতৃকা মূর্তিগুলোর ঠোঁটের ভাঁজে। চৌদ্দশ শতাব্দীর ব্রহ্মামূর্তিটা মিশরীয়দের মুখের মতো ঠেকে বারবার। কিউরেটর সাহেবের মুখে  ফিচেল হাসে বিশুমুদি।

চার ফুট তিনের  চিঙ্কুরাণীর সিন্ধিয়া থাটবাটের সাক্ষী থাকে জুতো আর আখরোট কাঠের পেল্লাই খাট। ইয়াব্ড়ব মহলে  তার রূপ থৈথৈ দিন। রূপের খবর নিয়ে কুবাতাস আসে আর যায়। কবে কোন শিল্পী ডুবেছিল রূপ সাগরে অরূপ রতনের টানে সেসব খবর রেখেছিল বিদিশার রোদপোড়া দিন, বাদল গহন ছায়া।  ঘাসরঙ মেয়ে ফিরে ফিরে আসে বিদিশার অন্ধকারে। খোলা চুল মেলে দেয় হাওয়ায়। বৃষ্টির টুপটাপ ছুঁয়ে দেয় গাল, মেয়েটি মেদুর হাসে। কখনো শিল্পী,  কখনো বা কবির আঙুলে লেখা তার ঘর, শাল বীথিকার জটিল বিকেল ছুঁয়ে বর্ষা আসে। কিম্বা বর্ষা আসেনা কোথাও। খর রোদে ভেসে যায় মাঠ, জীবনানন্দ খুঁজে পান বনলতা সেন আর হাজার বছরের ওপারে কোন এক অতৃপ্ত আঙুল খোদাই করে শালভঞ্জিকা নারী, তারপর একদিন মৃগনয়নী হয়ে ওঠে আর গুজরি মহলের মাথায় বর্ষা আসে ঝেঁপে।

কিউরেটরের ঘরের ভেতর আঁটসাঁট নিরাপত্তায় রাখা শালভঞ্জিকা মূর্তি। উনি না দেখালে দেখাও হতনা। লোহার গরাদ বেয়ে চোখ থামে কাঁচের বাক্সের ভেতর। মায়াবিভঙ্গ কবিতা হয়ে যায়। সে কবিত ভেসে যায় যক্ষের দুয়ারে, কবি তখন জীবনানন্দ হয়ে ওঠেন। ঝুঁকিয়ে রাখা মুখ, ভ্রুর উচ্ছ্বাস, মদির হাসি আর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর কাপড়ের ভাঁজে এক মোহমদির নীরবতা। শালভঞ্জিকা সিরিজের মূর্তিগুলির মধ্যে তুলনাহীন। তুলনাহীন সারা দুনিয়ার পাথর খোদাই নারীগুলির মাঝে। কোটি কোটি টাকার ইন্স্যুরেন্স তাকে সুরক্ষা দিতে পারে কিনা সে বলা সহজ নয়। কোন এক গুমনাম শিল্পী আর তার বুকের ভেতর লালিত এক মুখ রূপকথা হয়ে বয়ে যায় অনন্ত প্রবাহে। ভারত এক খোঁজের থিমে ছোট্ট ছোট্ট পায়ের পথ চলা চলতে থাকে, চলতেই থাকে...


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন