কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩২ |
আত্মখোঁজ
মাসে চারটে রবিবার ছাড়াও দুটো নিজস্ব ছুটি পায় কর্পোরেট হাউসের কর্মী পারমিতা। বছরের যেকোনো সময়ই সে তার নিজস্ব ছুটি নিতে পারে অথবা বছরের শেষে একসঙ্গেও লম্বা ছুটি নিতে পারে সে। এ বছরে একটাও ছুটি সে নেয়নি। নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বাবা, মা,ভাই,বোন সবাইকে ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে সে একাই থাকে। গত দুবছর সে বাড়ি যায়নি। মন চায় বছরে অন্তত একবার কলকাতার বাড়িতে যেতে। কিন্তু দুবছর আগের অভিজ্ঞতা তাকে পিছনে টানে।
পিঠ ছাড়িয়ে কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল একেবারে ছেলেদের মতো করে কেটে বাড়িতে
ঢুকতেই তার মা আর্তনাদ করে উঠেছিল। রাশভারী বাবা তার হাত তুলে এক জব্বর থাপ্পড় মারতে
গিয়েছিল। কিন্তু বোন অমিতার চিৎকারে বাবার হাত থেমে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে
গোখরো সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে বাবা বলেছিল, এ বাড়িতে থেকে এসব চলবে না।
ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে কোরো। বাড়িতে আসতে হলে ভদ্রসভ্য হয়ে থাকতে হবে। তা নাহলে এখানে
আসার দরকার নেই।
পরের দিনই পারমিতা ব্যাঙ্গালোরের ফ্লাইট ধরে ফিরে এসেছিল তার ফ্ল্যাটে
এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেও এক গভীর যন্ত্রণায় সে কুঁকড়ে গিয়েছিল। মায়ের লুকিয়ে
লুকিয়ে কান্না, অমিতার
অসহায় মুখ আর দাদার ব্যাঙ্গাত্মক হাসির কথা মনে পড়লেই বুকের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে।
চারদিন আগে অমিতা ফোনে বলেছিল, দিদি প্লীজ এবার পূজোয় আয়
না বাড়িতে। সবাই আসবে। পিসিমনি,
পিসন, দুই
মামাও আসবে, খুব
মজা করব আমরা।
যেখানে নিজের আইডেন্টিটি এখনো শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে পারল না, সেখানে
সে যাবে কী করে! উৎসবের দিনগুলোতে সে অ্যাপ
ঘেঁটে সঙ্গীর সন্ধান করে যায় শুধু। তারপর একদিন শেষ হয় উৎসবের দিন।
বাথরুমে ঢুকে পারমিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
প্রত্যেক দিনের মতোই রেজার দিয়ে তার গাল পরিষ্কার করে নেয়। একদিন নিশ্চয়ই তার দুই
গালে নীলাভ পাতলা রেশম উঁকি মারবেই।
প্যান্ট-শার্ট পড়ে সে তৈরি হয়ে নেয় অফিস যাওয়ার জন্য। ছেলেদের প্যান্ট-শার্ট
পড়ার জন্য বাড়ির মতো এখানে ধমক দেওয়ার কেউ নেই। তার মনের অতলে যে মানুষটা লুকিয়ে
আছে, যে
নিরন্তর তার অস্তিত্ব নিয়ে ছটফট করে, নিজে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তার খবর তো
বাড়ির কেউ রাখতেই পারেনি। কেউ বুঝুক, না বুঝুক
মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক তার বাবার তো বোঝা উচিত ছিল! অথচ গত বছর কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে
গিয়ে তার বাবা ট্রান্সজেন্ডারদের পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা
দিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
পারমিতা একটা সিগারেট ধরিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। প্রয়োজনের
থেকে একটু বেশিই টাকা সে জমিয়ে রেখেছে। এবার অপারেশনটা করিয়েই নেওয়া যায়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন