কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১২৭

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

শ্রেষ্ঠা সিনহা


‘জীবনে মরণে জনমে জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি’; কল্পকাহিনির প্রছন্নতায় বাংলার লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের সন্ধান




বাংলা তথা বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ‘কীর্তন’। যা সমসাময়িক সময়ের নিরিখে লুপ্তপ্রায় অথবা ধর্মীয় বাতাবরণে নিবদ্ধ। অথচ রাধাকৃষ্ণের প্রেমপর্যায় কেন্দ্রিক এই শৈল্পিক ধারাটি ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের একটি মূল্যবান সম্পদ। কীর্তন আসলে একটি প্রবন্ধগীতি যা ছন্দ, তাল, লয়, রাগ এবং ভাবাবেশের আবেশে সম্পৃক্ত। ত্রয়োদশ শতকে রচিত শাঙ্গদেবের ‘সঙ্গীত রত্নাকর’ গ্রন্থ অনুসারে জানা যায় কীর্তন ভারতীয় সঙ্গীত মার্গ থেকে উদ্ভূত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্যদেব এবং তাঁর পরিকরবৃন্দের মাধ্যমে লীলাকীর্তনের প্রচলন করেন।

চৈতন্যজীবনীকার বৃন্দাবনদাস-এর অভিমত অনুসারে জানা যায়, কলিযুগের যুগধর্ম ‘হরিনাম সংকীর্তন’। যার প্রচার এবং প্রসারের জন্য ভগবান বিষ্ণু ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ অবতারে আবির্ভূত হয়েছিলেন“সাড়ে চার’শ বছর আগে কীর্তনের তিরোধান আটকাতে নবদ্বীপে জন্ম নিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি কীর্তনের পুনর্জীবন অ যোউবন দান করে কীর্তনকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন। শ্রীচৈতন্য নাকি বলতেন- ‘ঘরে ঘরে প্রবর্তাইমু নাম সংকীর্তন’’ ‘কীর্তন’-এ সমর্পণ এবং ভক্তি একাধারে মিলিত হয়। সনাতন গোস্বামীর মতে, “সংকীর্তনম্‌ নামোচ্চরনম্‌ গীতম্‌ স্তুতিশ্চ নামময়ি।’’অর্থাৎ যে ভক্তিগীতিতে শ্রীকৃষ্ণের লীলা বর্ণিত হয় তাই কীর্তনরূপে পরিচিত। তবে কীর্তন কয়েকটি প্রকারভেদে বিভক্ত যেমন;- পদাবলী কীর্তন, পালাকীর্তন, নগরকীর্তন এবং নামসংকীর্তন। তবে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পদাবলী কীর্তন যোগ অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্‌’ এবং বড়ুচণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে রাধাকৃষ্ণের ঐশ্বরিক প্রেমলীলা প্রতিভাত হয়। যেখানে অন্যান্য সামাজিক কিংবা শাস্ত্রীয় অনুশাসনের পরিবর্তে মানবীয় হৃদয়াবেগ প্রকটিত হয়। পদাবলী কীর্তনের মূল উৎস রূপে ‘গীতগোবিন্দম্‌’কে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীকালে চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি প্রমুখ পদকারের রচনা প্রস্ফুটিত হয় বৈষ্ণব পদাবলীতেরস এবং ভাব পদাবলীর প্রাণ।

প্রাচ্য আলংকারিক ভরত মুনি ‘রস’কে নটি ভাগে বিভক্ত করেন, যথা- শৃঙ্গার, হাস্য, করূণ, রৌদ্র অদ্ভুত, বীর, ভয়ানক, বীভৎস এবং শান্ত। আবার প্রতিটি ক্ষেত্রে এক বা একাধিক বিভাব-সঞ্চারীভাব রয়েছে; “কিন্তু বৈষ্ণবদের রস হল পাঁচটি-শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর।  পদাবলীতে সখ্য আর বাৎসল্যরসের পদ খুব বেশি নেই, কিন্তু রাধার বয়ঃসন্ধি, পূর্বরাগ থেকে শুরু করে মাথুরের বিরহগীতি পর্যন্ত হাজার হাজার মধুর রসের পদ লেখা হয়েছে। এই মধুর রস হল রসিক বৈষ্ণবদের কাছে সবচেয়ে প্রধান রস। আর এই রস রূপ গোস্বামী উজ্জ্বলনীলমণিতে ব্যাখ্যা করেছেন।’’

পদাবলী কীর্তন তথা বাংলা লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য কীর্তনের বিস্তৃত ইতিহাস প্রতিফলিত হয়েছে প্রীতম বসুর ‘প্রাণনাথ হৈও তুমি’ শীর্ষক উপন্যাসে। সমগ্র কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে পদাবলী কীর্তনের নানা ইতিহাসকে কেন্দ্র করে; সেই সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন। আসলে ঔপন্যাসিক যেন সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন আলোচ্য ক্ষেত্রে। কাহিনির সূত্রপাত ঘটেছে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৩১ সালে। ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতবর্ষ যখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পদভরে শোষিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। প্রধান চরিত্র প্রাণনাথ বোস একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, চন্দননগরের একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য। ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসার ড্যানিয়েল সাহেবের ভাইকে হত্যা করে সে। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে প্রাণনাথ বোস কীর্তনিয়ার ছদ্মবেশে আশ্রয় গ্রহণ করে বন্ধু মৃদঙ্গম দাসের করতালতালীর বাড়িতে।

করতালতলী নামক এই অঞ্চলটির বাংলার ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক যোগসূত্র বহুদিনের। শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণের পর নীলাচলে তাঁর জীবনের শেষ পর্যায় অতিবাহিত করেন। তবে বৃন্দাবনযাত্রা কেন্দ্রিক নানা সময়ে তিনি গৌড়ে যাতায়াত এবং পরবর্তীতে জলাকীর্ণ স্থানটির নামকরণ করেন ‘করতালস্থলী’, যা লোকমুখে করতালতলীতে পরিণত হয়। আসলে জলাভূমির মধ্যে অবস্থিত স্থলটি করতালের পিঠের আকৃতি তাই এরূপ নামকরণ করেন চৈতন্যদেব; “উনি দেখেন পথের পাশে জলা ডহরের মধ্যে করতালের পিঠের আকৃতির মত দু’জায়গায় কিছুটা স্থল জেগে রয়েছেপ্রভুর মনে হল ওখানে উনি শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পেলেন। প্রভু এক পার্ষদকে বললেন, তাঁর ইচ্ছে ওই দ্বীপের মত জায়গাতে গিয়ে কিছুক্ষণ নামসংকীর্তন করবেন। পার্ষদরা পার ডিঙি নিয়ে মহাপ্রভুকে নিয়ে গেলেন জলের উপরে জেগে ওঠা জলের উপরে জেগে ওঠা ওই স্থলে প্রভু ওই জলায় স্নান করেন, আর তারপর মহাপ্রভু এখানে হরিনাম কীর্তনে বিভোর হয়ে যান ভক্তরা প্রভুকে দই-আতপচিঁড়া খাওয়ায়তৃপ্ত মহাপ্রভু তারপর জলার জল অঞ্জলি ভরে খান তার থেকে এই জলাশয়ের নাম চৈতন্যপুখুরী।’’

এই করতালতলীর অধিষ্ঠিত দেবতা নীলমাধবের মন্দিরে বিগত কুড়ি বছর যাবত মাঘী সপ্তমী তিথিতে ‘ধুলট’ অনুষ্ঠিত হয়; “ধুলট হল বৈষ্ণবদের এক প্রধান উৎসব। মাঘ মাস হল বৈষ্ণবদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাঘের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে অদ্বৈতপ্রভুর জন্ম, শুক্লা ত্রয়োদশীতে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর জন্ম, আর মাঘী পূর্ণিমাতে শ্রীচৈতন্য কাটোয়াতে কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ নিয়েছিলেনএই তিনটি দিন স্মরণ করে মাঘের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে থেকে মাঘী পূর্ণিমা পর্যন্ত বৈষ্ণবরা অত্যন্ত সমারোহের সঙ্গে এই ধুলট উৎসব করে”সমগ্র দেশ তথা বাংলার প্রতিটি জনপদ থেকে জাত-বর্ণ-ধর্ম বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটে এই  উৎসবে। অধিবাসের সময় নীলমাধবের সম্মুখে ‘সনাতন কীর্তন’ গীত হয়। লোককথা অনুসারে এই ‘সনাতন-কীর্তন’ যথাযথভাবে আত্মস্থ করতে পারলে কীর্তনিয়া নীলমাধবের মধ্যে বিলীন হয়ে  যায়। ধুলটে উৎসবে প্রাণনাথ কীর্তনীয়া সাড়ে তিনহাজার মানুষের সামনে কীর্তন গাইতে গাইতে নীলমাধবের মন্দিরে বিলীন হয়ে যায়। প্রসঙ্গতই এক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান রহস্যের ছোঁয়া পাওয়া যায় তবে উপন্যাসের ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু প্রাণনাথ কীর্তনীয়ার অন্তর্ধান থেকে ‘সনাতন-কীর্তন’-এর রহস্যের সঙ্গে উঠে আসে বাংলা কীর্তনের এক বিস্তৃত ইতিহাস, যা আমাদের আলোচনার মূল উপজীব্য।

ভারতীয় সংগীতশাস্ত্রে তানসেনের নাম বহুল সমাদৃত। সম্রাট আকবরের রাজসভার অন্যতম রত্ন তিনি। যিনি কখনো দীপক রাগে আগুন জ্বালিয়ে আবার মল্লার রাগিণীতে বৃষ্টি নামানোর ক্ষমতা রাখতেন। অথচ তাঁর সমসাময়িক নরোত্তম ঠাকুর যিনি খেতুরি মহৎসবের প্রণেতা তাঁর কথা বাঙালির স্মৃতিপটে আজ ধূলা-ধূসরিত হয়ে পড়েছে। সংগীতজ্ঞ হরিদাস স্বামীর শিষ্য ছিলেন তানসেন ও নরোত্তম ঠাকুর; “তানসেন ধ্রুপদী সংগীতকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছিলেন, আর শ্রীনরোত্তম ঠাকুর বাংলা কীর্তনে ধ্রুপদ প্রভাবিত এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করলেন। তার নাম হল গরাণহাটি।’’৫৬ এটি ব্যতীত আরোও চারটি ঘরানায় কীর্তন বিভাজিত। চৈতন্যদেবের মাধ্যমে কীর্তন বাংলার প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়ে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ কীর্তনের সুরে একত্রিত হয়। সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে বাংলার মানুষ কীর্তনের জোয়ারে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে- “যত ছিল নাড়া বেনে সব হল কীত্তুনে/ কাচি ভেঙে গড়ালে কর্তাল।’’অথচ শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পর বৈষ্ণব সম্প্রদায় নানান দলে ভাগাভাগি হয়ে যায়। অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দ, গদাধর পণ্ডিত প্রভৃতি দলের সৃষ্টি হয়। এই সকল বিভাজিত দলগুলিকে এক সূত্রে আবব্ধ করার উদ্দেশ্যে “নরোত্তম ঠাকুর ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে নিজের জন্মস্থান খেতুরিতে এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায় শ্রীগৌরাঙ্গ, শ্রীবল্লভীকান্ত, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীব্রজমধু, শ্রীরাধারমণ ও শ্রীরাধাকান্ত এই ছয়টি বিগ্রহ স্থাপন করে মহাসমারোহে এক বৈষ্ণব মহাসম্মেলনের অনুষ্ঠান করলেন। এটাই বাংলার বিভিন্ন বৈষ্ণবগোষ্ঠীর সর্ব্বপ্রথম মহাসম্মেলন। বাংলার সমস্ত কীর্তনের দলকে ওখানে নিমন্ত্রণ করলেন।’’ গরাণহাটি ঘরানার সূত্রপাত এই সম্মেলনের মাধ্যমে ঘটলেও বাকি ঘরানাগুলি রাঢ়ে উদ্ভূত। “বর্ধমানের শ্রীখণ্ডের মনোহরসাই, আর রাণীহাটিতে রেনেটি কীর্তনের জন্ম, মন্দারণে মন্দারিনী ঘরানা, আর পুরুলিয়ার সেরেগড়ে ঝাড়খণ্ডী ঘরানার জন্ম।’’

পদাবলী কীর্তনের মূলভাব বিন্যাসিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রাধিকার প্রেমানুভূতি থেকে সমর্পণের মধ্যে।  যদিও তাদের এই প্রণয় ‘পরকীয়া’ হিসাবে চিহ্নিতযেখানে এই ‘পরকীয়া’ প্রেমের বীজ নির্দেশিত রয়েছে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে। সেখানে কবি বলেছেন ‘পরকীয়া ভাবে রতিরসের উল্লাস/ ব্রজ বিনা ইহার অন্যত্র নাহি বাস।’’ মূলত দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমলীলা ব্রজধামেই অতিবাহিত হয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শন মতে, শ্রীকৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ অর্থাৎ ‘সৎ’, ‘চিৎ’ এবং ‘আনন্দ’ শক্তির ধারক। ‘আনন্দ’ শক্তিজাত ‘হ্লাদিনী’ অংশ থেকে রাধিকার সৃষ্টি অর্থাৎ পরমাত্মা কৃষ্ণ, জীবাত্মা রাধিকাকে সৃষ্টি করেন। রূপ গোস্বামী প্রণীত ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ অনুসারে রাধিকা কৃষ্ণের উপপতি, কারণ তিনি বিবাহসূত্রে আইহনের স্ত্রী অথচ কৃষ্ণের প্রতি সমর্পিত-প্রাণা। ফলত রাধাকৃষ্ণের প্রেম ‘পরকীয়া’ হিসাবে পরিচিত। ‘পরকীয়া তত্ত্ব’ ব্যতীত কৃষ্ণের প্রতি রাধার দুর্বার আকর্ষণের পর্যায়গুলি ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। রক্মিণী, সত্যভামা, শৈবা প্রমুখের পতি শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ তারা ‘স্বকীয়া’। তাই পতি সঙ্গে তাদের সহাবস্থান খুবই স্বাভাবিক বিষয়। সেখানে কৃষ্ণের বিরহে রাধার আর্তি কিংবা কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিলাষে রাধার দুর্দমীয় মনোভাব প্রতিভাত করার উদ্দেশ্যে তাকে পরকীয়া নায়িকা হিসাবে নির্দেশিত করা হয়েছে। কিন্তু ব্রজধাম ব্যতীত অন্য স্থানে এই ‘পরকীয়া প্রেম’ গ্রহণীয় নয়। তাই রাধাকৃষ্ণের প্রণয় ঐশ্বরিক, লোকজ ‘পরকীয়া প্রেম’-এর সঙ্গে তার সাদৃশ্যতা নেই।

‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে তাই প্রেমপর্যায়গুলি শৃঙ্গার বা মধুর রসসিক্ত। যা বিপ্রলম্ভ এবং সম্ভোগ নামক দুটি বিভাগে বিভাজিত। প্রতিটি বিভাগ দশটি সঞ্চারীভাব বিশিষ্ট এবং বেশ কয়েকটি উপবিভাগে বিভাজিত। আবার প্রতিজন নায়িকা তথা রাধিকার প্রেমদশা আটটি বিভাগে বিভাজিত; যেমন- অভিসারিকা, বাসকসজ্জা, উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলদ্ধা, খণ্ডিতা, কলহন্তরিতা, প্রোষিতভর্ত্তৃকা, স্বাধীনভর্ত্তৃকা। গণিতের যেকোনো সমস্যার সমাধানের জন্য সূত্র নির্দেশিত রয়েছে অনুরূপভাবে কীর্তনের মূলভাব বিকশিত রয়েছে ‘উজ্জ্বলনীলমণি’তে; কারণ “কীর্তনে মোট চৌষট্টি রস আছে। এজন্য কীর্তনীয়াকে শুধু সংগীতজ্ঞ হলেই চলে না, তাকে রস আত্মস্থ করতে হয়। গুণীজনে বলে বৈষ্ণব পদাবলী হল মন্ত্র, আর উজ্বলনীলমণি হল সেই মন্ত্রপ্রয়োগ পদ্ধতির আকর গ্রন্থ। ভালো কীর্তনীয়া হতে গেলে বৈষ্ণবতত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে।’’১০  অর্থাৎ বৈষ্ণবতত্ত্ব ব্যতীত কীর্তনের রস আস্বাদন করা সম্ভবপর নয়।

একজন ভালো কীর্তনিয়া সুকণ্ঠের মাধ্যমে শ্রোতা সহ কীর্তনদলের অন্যান্য সদস্য যেমন বাদক, দোহার, শির প্রমুখের শরীরে অষ্টসাত্ত্বিক ভাবের সমন্বয় ঘটে। এই প্রকারের ভাব বিকারের মারফত তারা রস্বাদন করেন, “কীর্তনের আসরে সেই ভাববিকার হওয়া তো বৈষ্ণবদের পক্ষে পরম সৌভাগ্য’’১১শ্রীচৈতন্যের নীলাচলে অতিবাহিত সময়পর্বে নামসংকীর্তনের সময় এই ভাববিকারের কথা জানা যায়। আসলে “কীর্তন শুনতে শুনতে ভাবের ঘোরে কেউ কেঁদে ওঠে, দু-চোখে অশ্রুধারা ঝরতে থাকে, কেউ পুলকে বিহ্বল হয়ে যায়, কেউ মাটিতে শুয়ে ভক্তিতে ভাববিকারে গড়াগড়ি দিচ্ছে এসব দৃশ্য ভাল কীর্তনগানে দেখা যায়- এই অশ্রু, কম্প, স্বেদ, পুলক, বৈবর্ণ, স্তম্ভ, স্বরভঙ্গ ও মূর্ছা হল অষ্টসাত্ত্বিকভাব।”১২

গবেষকদের মতানুসারে কীর্তন দুই প্রকার শুক কীর্তন এবং নারদ কীর্তন। শুক কীর্তনে কৃষ্ণের নাম ও লীলা বর্ণিত হয় শুকদেবের কথিত কথকতার মাধ্যমে। অন্যদিকে লীলাকীর্তনের অন্যতম নাম নারদকীর্তন। যা সুর, তাল, ছন্দের মাধ্যমে পরিবেশিত হয়। এছাড়াও দুই প্রকারের কীর্তনের মধ্যে নিয়মগত প্রভেদ রয়েছে। শুক কীর্তনের যে কোনো গান ইচ্ছেমত দিনের যে কোনো সময় গাওয়া যায়। তবে “যে সময় যে লীলা হয়েছিল সে সময়েই সেই লীলার গান গাইতে তবে। রাসলীলা গাইলে রাতেই গাইতে হবে আর গোষ্ঠলীলা দিনে, উত্তর গোষ্ঠের গান অপরাহ্নেই গাইতে হবে। তাই লীলাকীর্তনের গানের পদ শুনে বলে দেওয়া যায় এখন দিনের কোন সময়। কুঞ্জভঙ্গ ও খণ্ডিতা গাইতে হলে শুধুমাত্র সকালেই গাইতে হবে, মান বা কলহান্তরিতা কখনো বিকালে গাওয়া যাবে না। তাছাড়া ভোরে ভৈরবী, সন্ধ্যায় পূরবী এসব তো আছেই।’’১৩ অথচ সকল ক্ষেত্রে সকল ক্ষেত্রে এই মানা হয় না, কারণ নারদের মতানুসারে, “দশদণ্ডাৎ পরে রাত্রৌ সর্ব্বেষাং গানমীরিতম্‌ অর্থাৎ রাত্রি দশ দণ্ডের পর সব রকমের গান করা যাবে, কিন্তু অনেক কীর্তনীয়া এ ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে হন।’’১৪ ফলে তারা সময়ভেদ অনুসারে আসরে কীর্তন গায়; “পালা শুরু হত রাধার পূর্বরাগ থেকে, রসপর্যায় অনুসারে পরের কীর্তনীয়ারা একে একে গাইবে অনুরাগ, অভিসার, মান, কলহান্তরিতা, প্রেমবৈচিত্ত্য, আক্ষেপানুরাগ, মাথুর”১৫ এবং ‘লীলাকীর্তন’-সমাপ্ত করতে হয় রাধা-কৃষ্ণের মিলনমূলক পদের মাধ্যমেভাব ও রসের সমন্বয়ে রচিত ‘কীর্তন’ পাঁচটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বিভক্ত; যেমন- কথা, আখর, তুক, ছুট এবং ঝুমুর। কীর্তনের মধ্যে মধ্যে গায়ক যখন নিজের কথায় মূল বিষয়টি শ্রোতাকে বুঝিয়ে দেয়, তা হল ‘কথা’এখানে সুর এবং তালের সমাবেশ হয় না। সুর ও তালের মাধ্যমে গীত অংশটির বর্ণনা যখন কীর্তনিয়া করেন, তাকে বলা ‘আখর’; “এই আখর দেখা যায় ঠুংরী ভজন আর হিন্দুস্থানী ক্লাসিক্যাল গানে। বাংলা লীলাকীর্তনে আখর সম্ভবত সেখান থেকেই এসেছে।’’১৬ মূলত ব্রজবুলি ভাষায় রচিত নানান পদ যেমন ‘অপরূপ পেখুলুঁ রামা/ কনকলতা অবলম্বনে উওয়ল হরিণী হিম ধামা’’১৭ বাঙালি শ্রোতা কাছে বোধগম্য নয়। তাই কীর্তনের আসরে গায়ক আখরের মাধ্যমে পদের ব্যাখ্যা করে বলেন “এমন রূপ কে দেখেছে? যেন স্বর্ণলতায় চাঁদের ছবি এঁকেছে। ভাগ্যে ছিল দেখলাম তাই, মনে আর দুখ নাই। দেখেছে-এঁকেছে, তাই-নাই এভাবে মিলিয়ে বলা।’’১৮ অনুরূপভাবে ‘তুক’-এর মাধ্যমেও আসরে গীত কীর্তনের অর্থ সহজ-সরলভাবে ব্যক্ত করা হয়। অন্যদিকে ‘ছুট’ একটি হালকা চালের গান। আসরে গায়ক যখন ভারী পদের মধ্যবর্তী অংশে তুলনামূলক সহজ পদ গায়, তাকে ‘ছুট’ বলা হয়। আসরে কীর্তনীয়া যখন নিজের অংশের পদাবলীর গাওয়ার শেষে মিলনের পদ দুই পঙক্তি পয়ারের মাধ্যমে সমাপ্ত করে, তাকে ‘ঝুমুর’ বলা হয়।

তাছাড়া চৈতন্যদেবের আর্বিভাবের পরে বৈষ্ণব পদাবলীতে চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র নানা পদ রচিত হয়। তবে কীর্তনের আসরে রাধাকৃষ্ণের প্রেমালম্বিত পদের পূর্বে সেই পর্যায়ের ভূমিকা স্বরূপ গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া হয়। যার ফলে শ্রোতার সহজেই অনুমান করতে পালায় কোন পালাটি গাওয়া হবে। উদাহরণ প্রসঙ্গে বলা যায় ‘রাধামোহন ঠাকুর’ বিরোচিত “আজু হাম কি পেখলুঁ নবদ্বীপচন্দ।/ করতলে করই বয়ন অবলম্ব’’১৯ পদটির কথা বলা যায়। আসরে গায়ক এই পদটির মাধ্যমে পূর্বরাগের ইঙ্গিত প্রদান করেন এবং তার পরবর্তী পদস্বরূপ ‘চণ্ডীদাসের’ “ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার’’২০ পদের অবতারণা করে।

আসলে কীর্তন কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমায়িত প্রকরণ নয়। এটি জনসাধারণকে একত্রিত করার অন্যতম অবলম্বন। শ্রীচৈতন্যের সমকালীন সময়ে কাজীর শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল কীর্তনগানের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের মতানুসারে, “চৈতন্যের আর্বিভাব বাংলাদেশে বৈষ্ণবধর্মে যে হিল্লোল তুলিয়াছিল সে একটা শাস্ত্রছাড়া ব্যাপার। তাহাতে মানুষের মুক্তি পাওয়া যায়, চিত্ত ভক্তিরসের আবেগে আত্মপ্রকাশ করিতে ব্যাকুল হইল।...কীর্তন সঙ্গীত আমি অনেককাল থেকে ভালোবাসি। ওর মধ্যে ভাবপ্রকাশের নিবিড় ও গভীর নাট্যশক্তি আছে, সে আর কোন সঙ্গীতে এমনসহজভাবে আছে বলে আমি জানিনে... য়ুরোপীয় সঙ্গীতের সুর পর্যায় যে রকম একান্ত বিদেশি, কীর্তন তো তা নয়। ওর রাগরাগিণীগুলিকে বিশেষ নাম দিয়ে হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে উপদ্রব করা হয় না। কিন্তু ওর প্রাণ, ওর ভঙ্গি, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।”২১

পরিশেষে বলা যায় ‘কীর্তন’ হল বাংলার নিজস্ব সম্পদ। সেখানে মানবমনের গভীর আন্তরিকতার সঙ্গেসঙ্গে ঈশ্বরের প্রতি আকুলতা থেকে ব্যাকুলতা সহ হৃদয়াবেগ প্রতিধ্বনিত হয়। ভক্তিরসের সঙ্গে প্রেমানুভূতি সংমিশ্রিত হয়েছে সেখানে। অথচ সময়ের প্রবাহমানতায় স্মৃতির মলিনপটে সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতি ধূসরিত হয়ে পরেছে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ব্যতীত ‘কীর্তন’-প্রচার এবং প্রসারের গতিও অবরুদ্ধ হয়েছে।

তথ্যসূত্র

 

1.   বসু, প্রীতম, ‘প্রাণনাথ হৈও তুমি, কলকাতা, গ্রাফিক এন্টারপ্রাইজ, পৃষ্ঠা ১১২

2.    তদেব, পৃষ্ঠা ১১২

3.    তদেব, পৃষ্ঠা ২৮৬

4.    তদেব, পৃষ্ঠা ৬১

5.    তদেব, পৃষ্ঠা ৯০

6.    তদেব, পৃষ্ঠা ৫৭

7.    তদেব, পৃষ্ঠা ৫৭

8.    তদেব, পৃষ্ঠা ৩২৩

9.    তদেব, পৃষ্ঠা ২৮০

10. তদেব, পৃষ্ঠা ২৮৫

11. তদেব, পৃষ্ঠা ৩১১

12. তদেব, পৃষ্ঠা ২৮০

13. তদেব, পৃষ্ঠা ২১০

14. তদেব, পৃষ্ঠা ২৮০

15. তদেব, পৃষ্ঠা ৯৭

16. তদেব, পৃষ্ঠা ১৮৫

17. তদেব, পৃষ্ঠা ১৮৬

18. তদেব, পৃষ্ঠা ১৮৬

19. গিরি, সত্য, ‘বৈষ্ণব পদাবলী’, কলকাতা, রত্নাবলী, পৃষ্ঠা ১৪৬

20. তদেব, পৃষ্ঠা ২০২

21. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ‘সঙ্গীতচিন্তা, কলকাতা, নবযুগ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২০১

  

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন