ধারাবাহিক
উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৩৯)
মামপিকে দেখে মুগ্ধ লিপিকা, সরাসরি মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকে। স্টাইলিশ চশমায় আর যেন চেনাই যাচ্ছে না মেয়েটাকে! ফেলে-আসা কয়েকমাসে কী আশ্চর্য বদল ঘটিয়ে ফেলেছে নিজের। সাজগোজ হয়ত কিছু করে থাকবে, কিন্তু ধরা যাচ্ছে না, চেহারার আদলে মিশে গেছে সেটুকু। মামপি নীচু হয়ে প্রণাম করে সোজা হয়, লম্বায় বোধহয় আরো বেড়ে উঠেছে। লিপিকা চিবুক ছুঁয়ে আদর করে ভাবে, যদি এমন একটা মেয়ে থাকত! মামপি একটু হাসে,
“মাসিমনি? চিনতে পারছ না?”
পাশ থেকে তাড়াতাড়ি বলে
ওঠে দেবিকা,
“চিনবে কী করে? এমন রোগা হইছস, খাওয়া-দাওয়া করস
না মোটেও—। দেখছস মেজদি কী চেহারা বানাইছে? আবার চশমা নিয়েছে,
অবস্থা দ্যাখ!”
মামপির ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে
দেবার্ঘ্য আপন ভঙ্গীতে ঘাড় চুলকাচ্ছে। তার মাথাতেও হাত ছোঁওয়ায় লিপিকা। পেছনে দেবিকা
ও কৌশিক—, অনেকদিন পরে ওদের দেখছে লিপিকা। কৌশিকের মাথার
চুল উঠে ফাঁকা হয়ে এসেছে, শ্রান্ত বুড়োটে ভাঙা গালে মেচেতার ছাপছোপ।
দেবিকা সামান্য রোগা
হয়েছে, তাতে আরও বয়স্ক দেখাচ্ছে। হালকা রঙের সিল্ক পরেছে, গলায়-কানে মানানসই মুক্তোর
গয়না। মা-র জন্য এনেছে মামপি, নয়ত দেবিকার পছন্দ এমন রুচিসম্মত কোনওদিনই নয়। বোনের
সাজপোশাকের দিকে প্রশংসার নজরে তাকায় লিপিকা,
“সুন্দর সেজেছিস দেবী!”
“আ-রে আমি আবার সাজি কোন কালে? মামপি আনছে হায়দরাবাদ
থেকে — সকলের জন্য আনছে, মামী, দুই
মাসী—! মামপি দে তোর মেজমাসীর মালাটা, কী সুন্দর —
এইখানে ওইসব পাবি না।”
মামপি সামান্য বিরক্তি
নিয়ে বলে,
“স-বই পাওয়া যায়, তুমি খবর রাখো না তাই—। মাসিমনি, মেসো কি করছে?”
“প্রায়ই শুয়ে থাকে রে আজকাল, যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ে।”
“আর পেইন্টিং? দেখি চলো ওঘরে।“
পেছন থেকে সমস্বরে বাকি
তিনজন বলে,
“আমিও যাই—”
মামপি মুখ ফিরিয়ে শাসনের
ভঙ্গীতে মাথা নাড়ে—না, পরে।
দেবিকা মেয়ের দিকে তাকিয়ে
আলগা চোখ মটকায়, ইশারা করে। আজ এখানে আসার আগে মেয়েকে পাখি-পড়া করে বুঝিয়েছে, মাসির
কাছে যেন বড়োসড়ো গয়নার আবদার করে। নামী দোকানে চমৎকার ডিজাইনের সীতাহার ও কানের সেট্
পছন্দ করে রেখেছে সে মামপির বিয়ের জন্য, আড়াই-তিন লাখের মধ্যে হয়ে যাবে। মামপির সঙ্গে
দেবিকা নিজেকেও বিশ্বাস করিয়েছে,
“মেজদির অনেক গয়না—! মায়ে দিছিল।”
“সব গয়না মেজমাসিকে দিয়ে গেছে দিদা?”
ভ্রূ কুঁচকেছিল মামপি।
“না না, তিন বোনেরে মনে হয় সমানই দিছে, মা-র যা
ছিল!”
মেয়ের কথার প্যাঁচে
আমতা-আমতা করে দেবিকা, মামপি রাগ সরিয়ে রেখে হেসেছে। গত ক-মাসে এই পরিবর্তন হয়েছে তার,
রাগ গিলে ফেলার ক্ষমতা। দেবিকা খানিক মরিয়ার মতো বলে,
“না তাই বলছি পরে আরো কত না জানি গড়িয়েছে। দুইজনেই
চাকরি করত, ফ্লাট কিনেছে। তার উপর তাদের মেয়ে নাই—!”
মামপি মা-র যুক্তিতে
স্তম্ভিত হয়ে যায়, সামলে নিয়ে বিরক্তভাবে শুধু বলে,
“উফ্!”
পরে আপনমনে ভাবে, মা-র
দিক থেকে মা হয়ত ঠিক। মাসী আপনজন, কিছু ঘেঁটে-থাকা সম্পর্ক হলেও। আবদার করে চাওয়াটা
কি দোষের? এরপরে অস্বস্তি হয়— ধ্যাৎ, মা রিয়েল্লি—! কোনওদিন সেভাবে বাবা-মা-র কাছে মন খুলে কিছু চাইতে পেরেছে? অবশ্য
যদি মাসী নিজে থেকে জানতে চায়, তাহলে সে—, আবার পিছিয়ে যায়, ছীঃ! মা-র ভাবনা
মা নিজের কাছে রাখুক, সে কখনও এসব বলতে পারবে না।
লিপিকার পেছনে যেতে
যেতে কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে মামপি সরাসরি দেবিকা চোখের দিকে তাকাল। দেবিকার কেমন ক্ষমাপ্রার্থীর
মতো কাঁচুমাচু মুখ। মামপির হাসি পেয়ে যায়, মুখ ঘুরিয়ে নিল সে।
খাটের ওপর ঘুমোচ্ছে
শোভন, মুখ দিয়ে ফুরর করে নিঃশ্বাস বের হচ্ছে। সাদা ঘন চুল পাখার বাতাসে এলোমেলো হয়ে
যাচ্ছে। মামপি বিছানার পাশে দাঁড়াল, কেমন শিউরে উঠল। বলল,
“কী হয়েছিল মেসোর? এরকম দেখাচ্ছে!”
“বড্ড রোগা হয়ে গেছে তাই না?”
“মেসো তো রোগাই ছিল মাসিমনি, কিন্তু কেমন দেখাচ্ছে।
ভীষণ সিক্লি — মানে, আমি বোঝাতে পারছি না।”
লিপিকা চুপ করে থাকে,
ভেতরের টানাপোড়েন বুঝতে দেয় না। রোজ দেখছে বলে হয়ত শোভনের চেহারার পরিবর্তন তত চোখে
পড়ে না। মামপির জীবনে শুভ নতুন অধ্যায় আসতে চলেছে, এখানে ব্যক্তিগত উদ্বেগের আলোচনা
মানায় না। চেষ্টা করে স্বাভাবিক থাকে সে, আলগা হাতে মামপির চুল ছোঁয়, হাসে।
“ঠিক হয়ে যাবে, ডাক্তার বলেছেন। আর হায়দরাবাদের
জল-বাতাসে মনে হচ্ছে আরও লম্বা হয়েছিস? আমরা তিন বোনই শর্ট, দিদি তবু খানিক লম্বা।
কিন্তু তুই, বাবুল — বাবাদের ধারা পেয়েছিস, ভালোই
হয়েছে!”
মামপি উত্তর দেয় না,
চশমার ভেতরের গভীর দু-চোখ লিপিকার মুখে রাখে। নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“বাবুলকে মেসোর অসুখের খবর খবর দিয়েছ? আর কাউকে না হলেও বাবুলকে কিন্তু জানানো
উচিত মাসিমনি। ও কি চারবছরের বাচ্চা যে সব কিছু থেকে সরিয়ে রাখতে হবে?
কথাবার্তায় শোভনের ঘুম
ভেঙে গেছে, উঠে তাড়াতাড়ি বাথরুমে দৌড়ায়। আজকাল তার পেচ্ছাপের বেগ এলে সামলাতে পারেনা,
ফোঁটা-ফোঁটা নামতে থাকে।
শোভন সাধারণ কিছু বলছিল, পাশে বসেছিল লিপিকা। ডাক্তারের পরামর্শমতো আজকাল কাছাকাছি থাকে। জোর করে হাসিখুশী থাকার চেষ্টা করে। অকারণে শোভনের আড়ালে শোভনের মুখ লক্ষ করে, কেন মামপি ওরকম চমকে উঠেছিল? আশঙ্কার ছায়া? লিপিকা দেখতে পায়না? বেশ খোশমেজাজে ছিল সেদিন। উঠে এসে সবার সঙ্গে গল্প করল, হাসপাতালের টুকরো-টাকরা বলল মজা করে। শোভনের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল একদিন। হাসল শোভন,
“কী দেখছ?”
“কী দেখব? কোথায়?”
“প্রায়ই দেখি—আমায় নতুন দেখছ? না থুত্থুড়ে চেহারা
আর পছন্দ হচ্ছে না? তা সমবয়সী কাউকে যদি পাও—, ওই যেমন—আমার ডাক্তারের মতো—বেশ হ্যাণ্ডসাম!”
লিপিকা বিরক্তি লুকিয়ে
স্বাভাবিক সুরে বলে,
“জানা রইল। খোঁজ করে দেখি। তা তুমি যাবে কোথায়?
বৃদ্ধাশ্রমে?”
“আমি?”
কয়েক মুহূর্তে ভাবান্তর
ঘটে শোভনের, দৃষ্টি এলোমেলো হতে হতে স্থির হয়ে যায় জানালার বাইরে। আবার চলেছে গলিপথ
দিয়ে।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন