কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

তৃষ্ণা বসাক

 

সমকালীন ছোটগল্প


লেখো আয়ু

অরণি সে সময় বইয়ের তাক গুছোচ্ছিল। সে ঠিক করেছে একেকটা রবিবার একেকটা তাক গুছবে। আজকে যে তাকটাকে সে গুছোবে, তার শিরোনাম ভ্রমণ ও স্মৃতিকথা। সাজাতে গিয়ে অরণি দেখল তার কাছে যা বই আছে তার ৯৯ ভাগই হয় ভ্রমণ, নয় স্মৃতিকথা। তাকগুলো  আলাদা করে গুছোতে হবে না, তারা নিজেরাই গুছিয়ে আছে। শুধু ধুলোঝাড়ার জন্যে তাকে রবিবারগুলো রাখতে হবে।

কিন্তু এত ভ্রমণ? এত স্মৃতিকথা? সে তো বিজয়নগরম ছাড়া তেমন কোথাও যায়নি। আর স্মৃতি? সে নিজেই একটা স্মৃতিপ্রবণ পেশায় রয়েছে। অন্যের স্মৃতি নিয়ে তার কীসের কৌতূহল? সে জুটমিলের কর্মী। স্মৃতির তন্তু আঁকড়ে তাকে বেঁচে থাকতে হয়।

এখনো তার যে বই গোছানো, তা কেবল স্মৃতিতে। একবার সে এরকম একটা লাইব্রেরি দেখেছিল এক ব্যস্ত ডাক্তারের বাড়িতে। তাদের বাড়িতে কিছু বই ছিল বটে, ইঁট দিয়ে উঁচু করা ট্রাংকের মধ্যে - খানকতক পুরনো উল্টোরথ, আর বড়দির বিয়েতে পাওয়া কয়েকটা বই। একটার নাম মনে আছে ‘ভালবাসা এল জীবনে’। শুধু নামটা  পড়েই তার গা শিরশির করত। উল্টোরথগুলো হারিকেনের আলোয় বাবা পড়তেন। তারপর রাত গভীর হলে তাঁর খড়মের শব্দ বাইরের ঘর থেকে ভেতরের শোবার ঘরে মিলিয়ে যেত। খড়মের শব্দ আর মার চাপা গলায় ‘আসুন বড়বাবু’ এ দুটো উল্টোরথের লেটারিং-র মতোই তার  মাথায় গেঁথে আছে। লাইব্রেরি দূরের কথা, তাদের বাড়িতে একটা বইয়ের তাক অব্দি ছিল না।

তাহলে এতক্ষণ সে কোন তাকগুলো গুছোচ্ছিল? আবার রবিবার একেকটা তাক মানে? রবিবারও তো সে ভোর চারটেয় উঠে সাইকেলে চেপে জুবিলি ব্রিজের নিচ দিয়ে গরিফা স্টেশন যায়। সেখান থেকে ট্রেনে জগদ্দল। না, না, এখন তো সে বিজয়নগরমে, সেখানেও কোন রবিবার নেই। থাকলেই বরং ভয়াবহ হত। সমুদ্রের ধারে একা দাঁড়ালে বড্ড  মান্তুর কথা মনে পড়ে। ঢেউয়ের নিষ্ফল অধ্যাবসায় কেবলই মান্তুর মুখ সামনে নিয়ে আসে।

প্রশ্ন হচ্ছে বইগুলো কার, তাকগুলো কোন বাড়ির, রবিবারই বা কার উপার্জন? এতগুলো কথা একসঙ্গে ভেবে ফেলবার কথা নয় তার এখন। খুব ঠান্ডা একটা ঘরে, একা একা শুয়ে, তার এখন ঘুম অথবা মৃত্যুর কথা ভাবা উচিত। ঘুমের জন্যে যত সাধনা, মৃত্যুর জন্যে তার সিকির সিকি দরকার নেই। তবু সে মৃত্যুর কথা ভাবতে পারছে না। এখন মৃত্যুর কথা ভাবা নেমকহারামি হবে মনে হচ্ছে তার। গত পনেরোদিন ধরে মান্তু নৈহাটি-কলকাতা করছে। বাড়ি ফিরতে দশটা, সাড়ে দশটা বেজে যাচ্ছে ওর। পরেরদিন আবার সকাল থেকে আসার প্রস্তুতি। ওর চোখগুলো আবার পঁচিশ বছর আগেকার আলোয় জ্বলে উঠেছে, বাড়ির পেছনের খিড়কি পুকুরের মতো শিরিশ, কলকে ফুলের ছায়া-ছায়া স্নিগ্ধতা তার দু চোখে - এখন কি মৃত্যুর কথা ভাবা যায়?

মৃত্যুর বিপরীত শব্দ হিসেবে সে ভাবতে পেরেছে - লাইব্রেরি। তার বাবার না হয় একটা ট্রাংক ছিল, গান শেখানোর উপার্জনে নয়, ওটা এসেছিল মার সঙ্গে, বিয়ের যৌতূক হিসেবে। বাবার কিছু উল্টোরথ আর বড়দির বিয়েতে পাওয়া বই দিয়ে তার কিছুটা অন্তত ভরা ছিল। কিন্তু, সে কী করতে পেরেছে? লামা একদিন ক্লাস ফোরে পড়ার সময় পৌরসভার হস্তাক্ষর প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে একটা আলোর ফুলকি পেয়েছিল। সেই বইটাকে নিয়ে মান্তু স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। তার ছোটবোন নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাবার সময় পুরনো কিছু ফার্নিচার একে তাকে বিলিয়ে দিচ্ছিল। মান্তু একটা প্রায় ভাল বইয়ের র‍্যাক নিয়ে এল। তিনফুট বাই দু ফুট র‍্যাকের প্রথম তাকে আলোর ফুলকি, পরের দুটো তাক পুরো  ফাঁকা দেখে সে কিন্তু মুষড়ে পড়েনি। মেয়েদের ব্রতকথা, গুপ্তপ্রেসের পাঁজি সুন্দর মলাট দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিল। তারও বিয়েতে পাওয়া দু চারটে বই ছিল- চৌরঙ্গী, পথের দাবি, নগরপারে রূপনগর আর ভারত প্রেমকথা। পুরসভা একবার একটা স্মারক সংখ্যা বার করেছিল, আশপাশের দর্শনীয় জায়গা নিয়ে-সেটাও রাখল একপাশে। ফাঁক তবু থেকে গেল, সে ফাঁক বোজাতে মান্তু দীঘার শাঁখ, পুরীর চকখড়ির গণেশ, গ্যাঙটক থেকে কেনা তিব্বতি ঘণ্টা, আর টুকিটাকি রাখল।

ভোর চারটেয় মশারির দুটো খুঁট সাবধানে খুলে সাইকেল বার করার সময় অরণি কেমন স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে ওই র‍্যাকটার দিকে তাকাত। ভোররাতের অন্ধকার ছানা ঘরে ঘন্টার গায়ে আঁকা চোখটা ধকধক করছে মনে হত তার। জুবিলি ব্রিজের নিচ দিয়ে যাবার সময় তার বুকের মধ্যে বাজত ‘ঢং ঢং ঢং’।

আজ সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের মহার্ঘ বিছানায় শুয়ে সে স্পষ্ট শুনতে পেল ঘন্টার শব্দ। গ্যাংটক থেকে ফেরার পরের মাসেই পিরিয়ড মিস করল মান্তু। তাই সুশোভন বসুর ডাক নাম লামা। ওকে প্রথম কোলে নিয়ে অরণি স্পষ্ট ঘন্টার শব্দ শুনেছিল। রুমটেক মনেস্ট্রির ধর্মচক্র ঘোরাতে ঘোরাতে ওরা দুজনেই কি এইরকম একটা কারো হাতের দাগ না পড়া, না খোলা নতুন বইয়ের মতো নবীন প্রাণ চায়নি? সে বইয়ের পাতায় পাতায় কত বিস্ময়, উন্মোচন, জগদ্দল জুট মিলের পাট-পচা গন্ধ যাকে ছুঁতে পারবে না? এই স্বপ্ন থেকেই গৌরবর্ণ বিরলকেশ সদ্যোজাত শিশুটি লামা নাম পেয়ে গেল। সেই লামা তাকে যে হসপিটালে ২৪ ঘণ্টার আবাস দিয়েছে, সেই হসপিটালটাও রুমটেক মনেস্ট্রির মতো লাগছিল তার। সে এবার নিজের বুকের শব্দে মনোযোগ দিল। এর গতি এখন কিছু স্বাভাবিক হয়েছে কি? মহার্ঘ  বিছানায় শুয়ে বুকের মধ্যে বসানো মহার্ঘ যন্ত্রটাকে চামড়ার ওপর দিয়ে একটু ছুঁতে ইচ্ছে করল তার। পারল না। তার দুহাত নানা নল আর তার দিয়ে বাঁধা।একবার সরস্বতী পুজোর আগের রাতে বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল তাদের। তারা চার ভাই, আর পাড়ার বন্ধুরা মিলে সাত আটটা ছেলে বাইরের ঘরে মণ্ডপ সাজানোর পর প্রতিমার সামনেই শুয়ে পড়েছে। ডাকাতরা এসে সেই ইলেক্ট্রিক তার দিয়েই তাদের পিছমোড়া করে বেঁধেছিল। বাড়ির সব বাসনপত্র পর্যন্ত এমন চাঁচাপোছা করে নিয়ে গেছিল যে পরেরদিন কলাপাতায় খেতে হয়েছিল। বাবার উপার্জনের  একমাত্র পারানি হারমনিয়ামটা নিয়ে যাবার সময় ওদের মধ্যে একজন বাবার পা ছুঁয়ে বলেছিল ‘আসি মাস্টারমশাই’। মুখ গামছায় ঢাকা থাকলেও গলার স্বরে গিরীন্দ্র শেখর বুঝেছিলেন সে খালেদ। ওরা চলে যেতে তিনি বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘বাগেশ্রীটা বড় ভাল তুলেছিল’।

সেদিনের হাত পা বাঁধা অসহায়তা থেকে কখনো মুক্ত হতে পারেনি অরণি। সারাজীবনই তো সে চোখ বেঁধে সাইকেল চালাচ্ছে। যে সাইকেল বারবার একটি বৃত্তে ঘুরে চলে।

বাগেশ্রী শেখেনি অরণি। সে নাক দিয়ে সানাই বাজতে পারত। বন্ধুর বিয়ের বাসরে সেই সানাই শুনে মুগ্ধ হয়েছিল মান্তু।তারপর থেকে সে তার অন্ধ যাত্রার পিলিয়ব রাইডার। কখনো কখনো মনে হয়েছে আসলে মান্তুই চালাচ্ছে, অরণি পরম নিশ্চিন্তে বসে আছে পেছনের সিটে।

ইন্ডিয়ান মিল। শালিমার, জগদ্দল জুট মিল - এগুলো কয়েকটা বিচ্ছিন্ন নাম নয়, ইতিহাসের আদল পাওয়া যায় পরপর সাজালে। পাট তো দীর্ঘকাল ধরে জলে পচে, তাদের জীবন সামান্য অশ্রুর আভাসেই পচে গলে গেছে। ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে, লামার ইস্কুলে মাইনের লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে, ছোটবোন আর ভগ্নীপতির জন্যে বাজারে বহু স্পর্ধায় ইলিশ মাছ বাছতে বাছতে, রেডিও, টিভি বা খবরের কাগজের চেয়েও দ্রুতগামী মুখের খবরে সে জেনেছে মিল বন্ধ হয়ে গেছে। হৃৎস্পন্দনে কি সাময়িক ছেদ পড়েছে তাতে? সেই ঋণাত্মক সংখ্যাগুলো যোগ হতে হতে তার আজ পেসমেকার দরকার হল?

এই মিল বন্ধের ইতিহাসের মধ্যে বেঁচেও তার কি একটা গোটা হৃৎপিণ্ডের দরকার ছিল না? পুজোর অষ্টমীতে ভোরের ট্রেন ধরে মগরাহাট যেতে হত, বাবা-মার কাছে।কী খেয়ে যাবে লামা, ছ বছরের লামা, কী খেলে সে বমি করবে না রাস্তায়, পুষ্টির ঘাটতি হবে না তার - এই নিয়ে সে কি রথযাত্রা থেকে কাঠামো পুজোর মতো ভাবনার প্রস্তুতি শুরু করে দেয়নি? মান্তুও তো আস্ত হৃদয় নিয়েই ভেবেছে। নিজেরা রুটি-বেগুন ভাজা দিয়ে রাতের খাওয়া সারলেও, শিশু লামাকে রোজ সকালে সে দুধে একটা কাঁচাডিম গুলে খাইয়েছে।

বাবা-মার চিন্তাপুষ্ট লামা দৈর্ঘ প্রস্থে যে হারে বেড়েছে, তার মাথাটা সেভাবে বাড়েনি, অন্তত মান্তু যে আশায় বোনের বাড়ি থেকে পুরনো বইয়ের র‍্যাকটা নিয়ে এসেছিল, সে ভেবেছিল, একদিন লামার মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং, নিদেন পক্ষে অর্থনীতির মোটা মোটা বই এসে দীঘার শাঁখ, পুরীর চকখড়ির গ্ণেশ আর গ্যাংটকের তিব্বতি ঘণ্টাকে সরিয়ে দেবে। কিন্তু লামা যত উঁচু ক্লাসে উঠছিল, তত তার বইয়ের প্রয়োজন কমে যাচ্ছিল। ক্লাস টুয়েল্ভে ইংরেজি আর অংকে কম্পার্ট্মেন্টাল পাওয়ার পর সে আর কোনদিন না পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে সময় তাকে আবার বুঝিয়ে পড়াশোনায় ফেরানোর জোশ কার ছিল? জগদ্দল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। বাজোরিয়াদের ঝোলানো গাজর গিলে বিজয়নগরমে যাবে কি যাবে না তাই দিনরাত ভাবছে অরণি। কত কম গ্যাসে ও তেলে কী কী রাঁধা যেতে পারে, এসব ভাবনার চেয়েও ধারালো বঁটিতে নিজেকে ফালা ফালা করে ফেলছে মান্তু। কোন সিদ্ধান্তটা  বেশি শক্ত ছিল- লামার পরা ছেড়ে দেওয়া, না তার বাংলা ছেড়ে চলে যাওয়া?  এই সময়ও কি তার হৃদয়, দৌড়ে আর একটু পিছিয়ে পড়েনি?

সমুদ্রের ধারে বিজয়নগরম, বেশিরভাগই গরিব খ্রিস্টান আদিবাসীদের বাস। এত সস্তায় শ্রমিক পাবে না পাটশিল্প ভূভারতে। সেখানকার নতুন খোলা বাজোরিয়া জুট মিলে শ্রমিক ছাড়া যে একমেবাদবিতীয়ম সাদা কলারেরর পদটি, সেটি অরণির। প্রথম দু এক মাস তার রোমাঞ্চ ছিল, কৌতুকও। ‘ঝিংগা কী করে রাঁধবে’এর মত জিজ্ঞাসু রাঁধুনীকে সে অবলীলায় বলে দিল - ডুমো ডুমো করে কেটে পোস্ত দিয়ে, শুধু মুখের ভাষায় নয়, শরীরি মুদ্রায়। সেই নির্দেশ তার গালে থাপ্পড় হয়ে ফিরে এল খাবার টেবিলে। তার ভাতের পাতে অতি লোভনীয় গলদা চিংড়ি কুচিয়ে কেটে পোস্ত দিয়ে রেঁধে একেবারে নৈরেকার করে ছেড়েছে অন্ধ্রের রাঁধুনী।

আর ছিল সমুদ্র, জুবিলি ব্রিজের নিচের গঙ্গা যা হতে পারত না। তবু তার হৃদয় সামান্য ধনাত্মক রাশিও সঞ্চয় করতে পারল না। হয়তো তার কারণ, বয়স ষাট পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তার নাকে আর সানাই বাজে না। অন্যভাবে সানাই বাজতে পারত। কি্তু লামা তো তখন গোসাবা থেকে গোবরডাঙ্গা বিস্কুট বেচে বেড়াচ্ছে। বিস্কুট, তারপর ডোর ক্লোজার, তারপর চেন সুতো, শেষপর্যন্ত এই ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। তিনদিনের জন্যে বাড়ি এলেও সে বোঝায় একটা হসপিটালের কত ধরনের বর্জ্য থাকে, তার ফেলার ব্যবস্থা, কত হাইটেক কারিকুরি তার মধ্যে। অরণি শোনে আর কেন যেন পচা পাটের গন্ধ পায়। তার গা গুলিয়ে ওঠে। সে আড়চোখে বইয়ের র‍্যাকের দিকে তাকায়। ওখানে এখন নতুন সংযোজন ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের একটা ঝকঝকে ম্যানুয়াল। তার পাটের কোন বই নেই কেন? বনগাঁ হসপিটালে বর্জ্য অপসারণ বোঝাতে যেতে লামা যখন ভোররাতে মশারির খুঁট দুটো খুলে সাইকেল বের করে, তখন তিব্বতি ঘণ্টার চোখটাকে ধকধক জ্বলতে দেখে ও।

অরণি অবসন্ন হয়ে চোখ বোজে, আবার খোলে। এখানে যারা কাজ করে, তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ পিন পড়ার থেকেও নিচু, সেইরকম একজন নীল পোশাকের কর্মী, তার বুকের ওপর ঝুঁকে বলে-

‘হাউ ডু ইউ ফিল স্যার?’

উচ্চারণ আর কালো মেঘের মতো রং দেখে অরণি বোঝে এও তেঁতুলম। এর উত্তরে তার নাক দিয়ে সানাই বাজাতে ইচ্ছে করে। কর্মীটির নীল পোশাকের ওপর কেমন এক ছায়া পড়ে হঠাৎ। মান্তু, তার শিরিস ফুলের পাপড়ি ছড়ানো চোখে ছলছল ধবনি নিয়ে তাকে দেখতে এসেছে। এখন কি তাহলে ভিজিটিং আওয়ার? বিষণ্ণতা ঘিরে ফেলে অরণিকে। মহার্ঘ ২৪ ঘণ্টার মেয়াদ আর কতটুকু? আবার কি তাকে ই এস আই হসপিটালে ফিরে যেতে হবে? সামাজিক দায়বদ্ধতার ঘরে টিক মেরে এই হসপিটাল ফিরে যাবে তার দুর্গমতায়?

মান্তু কেমন খুশি, উদবেগ, উত্তেজনা মিশিয়ে বলে ‘শুনছ, লামার সেই ডাক্তারবাবু, যার জন্যে তুমি এখানে চান্স পেলে, তোমাকে দেখতে আসছেন। আমি গেলেই আসবেন। একজন একজন করে ঢুকতে দিচ্ছে তো। লম্বা ফর্সা, টাক মাথা, লামার মতোই প্রায় চেহারা, বয়সও কাছাকাছি হবে। তুমি একটু হেসো কিন্তু’ মান্তুর ছাপা শাড়ি, রূপোর হার, ময়লা শাঁখা থরথর করে কাঁপে। অরণি দেখে ওর ব্যস্ত হয়ে চলে যাওয়া।

ও তাকিয়েই থাকে। তিনি আসবেন। সূর্যের জ্যোতির্বলয় যার বিরলকেশ মাথা ঘিরে। ওর চোখ ঝলসে যায় সেই আলোয়। চোখ বুজে ফেলে অরণি। চোখ বোজা অবস্থায়, হঠাৎ অনেকদিন পর, শুনতে পায়, ঘণ্টা বাজছে। রুমটেক মনেস্ট্রি থেকে দূর দূর পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেই ঘণ্টা ধ্বনি। ও চোখ খোলে। ইনিই কি সেই ডাক্তারবাবু? তা কী করে হবে?

এ তো লামা!

লম্বা ফর্সা, টাকমাথা লামা তার মুখের ওপর ঝুঁকে  পড়ে বলছে ‘বাবা ডাক্তারবাবুর হঠাৎ একটা এমারজেন্সি কল এসে গেল। উনি একদিন আমাদের বাড়ি আসবেন তোমাকে দেখতে। আমাকে খুব ইয়ে করেন। আসলে একদিন একটা রাগ নিয়ে তর্ক হচ্ছিল। আমি বললাম ওটা বাগেশ্রী না হয়ে যায় না’।

হাত খোলা থাকলে অরণি লামার মাথার ওই জ্যোতির্বলয় ছুঁতে পারত। তার বদলে মান্তু যেমন বলেছিল, সে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে লামার দিকে, আর বলতে চায় ‘একেকটা রবিবার, আমি আমাদের লাইব্রেরির একেটা তাক গুছোই। আজ শুধু ভ্রমণ আর স্মৃতিকথা’।

 

 

 

 

 

 

 


1 কমেন্টস্: