সমকালীন ছোটগল্প |
শিবাজিবাবুর ছাতা
বাড়ি থেকে বেরনোর মুখেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল শিবাজিবাবুর।
বাঁজখাঁই গলায় পথ আগলে হাতে ছাতাটা
গুঁজে দিয়েছেন গিরিবালা। গিরিবালা শিবাজিবাবুর ৩৮ বছরের পুরনো বউ। ছাতাটার মতো নতুন
নয়। তবে গুমর, ঝাঁজ আর মেজাজে এখনও ছাব্বিশের তরুণীটি। পাটভাঙা ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবিটা
গায়ে গলিয়ে রুমালে একটু কড়াগোছের এসেন্স মাখিয়ে সবে পকেটে পুরেছেন শিবাজিবাবু। আষাঢ়
সবে শুরু হয়েছে, তবু মেঘের তেমন দেখা নেই। আজকাল কোনওটাই সময়ে হয় না। আষাঢ়ে বৃষ্টি
হয় না, মাঘে শীত পড়ে না, টাইমকলে ঠিক সময়ে জল আসে না, ঠিকে কাজের লোকের কামাইয়ের কোনও
ঠিক থাকে না, সময়ে ঠিক কথা বলা হয় না, ঠিক কাজ করা হয় না। মোটকথা কোথাও কিছু ঠিক হয়
না।
আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই দেখে খুশিই হয়েছেন শিবাজিবাবু। নেমন্তন্নর দিন ঝড়জল পোষায় না। খুশি খুশি মনে মুখে কয়েকটা মৌরি ফেলে ঝুতির মালকোঁচা সামনে বেরচ্ছিলেন। হঠাৎই সামনে স্ত্রী গিরিবালা, হাতে একটি ছাতা। আজকাল স্ত্রীর চেয়েও এই ছাতাটাকে বেশি ভয় পান শিবাজিবাবু। এছাতা জীবনে আসা ইস্তক তাঁর সব সুখশান্তিই প্রায় ঘুচেছে। এমনিতে ছাতা হারনোয় বেশ সুনাম ছিল শিবাজিবাবুর। তাই একটা বয়সের পর আর ঘূণাক্ষরেও ওই বস্তুটি সঙ্গে রাখেননি। বর্ষায় বর্ষাতি আর গ্রীষ্মে রুমালটুমাল দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছেন।
গন্ডগোলটা হয়েছে মাস তিনেক। ছোট শালার ছেলে নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরার পর। পিসেমশাইকে ভালোবেসে একটা বিলিতি ছাতা কিনে এনে দিয়েছে বুকুন। আর সেই ছাতা বাড়িতে পোঁছে দেওয়ার পর থেকে গিরিবালার গুমর আরও বেড়েছে। প্রতিবেশীদের ডেকে ডেকে ছাতা দেখানোর পালা একটা সময় অবধি চলল। তারপর খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেতে শুরু করলেন শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়রা। সঙ্গে ছাতাদর্শন ফ্রি। ছাতার গুণপনা বাড়িয়ে বলতে বলতে কল্পনার সব সীমারেখা মাঝে মাঝেই হারিয়ে ফেলছেন গিরিবালা। নো-ম্যানস ল্যান্ডে পৌঁছে আর ম্যানেজ দিতে না পারলে হাল ধরতে হচ্ছে শিবাজিবাবুকে। এই হাল ধরার কাজটা মোটেই ভালোবেসে করছেন না তিনি। তবু দীর্ঘদিনের দাম্পত্যে এমন অনেক কাজই করতে হয়, যা না করলে ঝড় ওঠে, বৃষ্টি হয়। তারপর অতিবৃষ্টির মতো সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সে কথা আটষট্টিতে এসে বিলক্ষণ জানেন নিঃসন্তান শিবাজি চাটুজ্জে। তবে সেদিন শিবাজিবাবুর মেজদি’কে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর ছলে ছাতাখানাকে ‘বিশ্বের এক নম্বর’ বলে ফেলায় একটু জোরে কেশে ফেলেছিলেন শিবাজিবাবু। ওটি ছিল সিগন্যাল। ‘এবার থামো, লাইন ক্রশ করে যাচ্ছ,’ বলার উপায়। কিন্তু গিরিবালা দুর্বার। কোনও সিগনালেরই ধার ধারেননি। যথারীতি ছাতার শিক থেকে শুরু করে কাপড়-ডাঁটি সবেতেই ইউনিক কিছু খুঁজে পেয়েছেন।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বউকে বাড়াবাড়িটা বুঝিয়ে বলবেন বলে ভাবলেন শিবাজি। ‘গিরি, বলছি কি, ছাতা না আমেরিকানরা ভালো বানায় না, ওটা আসলে জাপানিদের কাজ।’
ব্যস! আগুনে ঘি পড়তে ওইটুকুই যথেষ্ট ছিল।
খনখন করে বলে উঠলেন গিরিবালা, ‘তা তো বলবেই! আমার বাপেরবাড়ির লোক দিয়েছে কি না! এখন তো আমেরিকার চেয়েও ভালো ছাতা জাপানিরা ওই কুঁদে কুঁদে চোখ নিয়ে বানাবেই।
‘আহা কুঁদে চোখ তো কী? অন্ধ তো নয় যে বানাতে পরবে না!’
‘সেই তো, এখন তো এসব যুক্তি দেবেই। কোনওদিন তোমার দিকের আত্মীয়দের তো একটা দামি কিছু দিতে দেখিনি। এই তো সেবার বড়দিরা সবাই মিলে পুরী গেল। কী এনেছিল? না, খাজা আর সম্বলপুরী একটা ব্লাউজ পিস!’
‘গিরি তুমি বুঝতে পারছ না, পুরী থেকে ছাতা কী করে আনবে? ওখানে তো খাজা আর ওই সম্বলপুরীই বিখ্যাত। না মানে, এগুলো ছাড়া রথও বিখ্যাত। কিন্তু রথ তো আর অত দূর থেকে টানতে টানতে আনতে পারবে না বলো!
কথাটা গিরিবালার মোটেই ভালো লাগল না। আরও দ্বিগুণ ঝেঁজে বলে উঠলেন, ‘থাক থাক, বুঝেছি। আমার বুকুন যে মনে করে পিসের জন্য একটা বিদেশি ছাতা এনেছে, সেইটেই সহ্য হচ্ছে না তোমাদের। দেখলে না, মেজদি কেমন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে গেল, ‘আমাদের টুম্পাও তো আগেরবার দার্জিলিং থেকে একটা ইমপোর্টেড ছাতা এনে দিয়েছিল ওর বাবাকে।’ হুঁহ্! কোথায় আমার বুকুনের নিউ ইয়র্ক আর কোথায় তোমাদের টুম্পার দার্জিলিং!’
শিবাজি বুঝলেন, এভাবে লাভ হবে না। এ কেস জাত্যভিমানের দিকে গড়িয়ে গিয়েছে। একটু পরেই ফ্যাঁচফেঁচে কান্না তারপরেই একটানা গজরগজরের দিকে ব্যাপারটা গড়াবে। তাই তা ঠেকাতে আরও নরম স্বরে বউয়ের দিকে খানিক ঘেঁষে শান্ত হয় আরও দু’-চার কথা বলতে গেলেন শিবাজি।
‘তা বেশ তো, ভালো ছাতা বলছ, বলো। কিন্তু মসলিন কাপড়-টাপড় বোলো না লোকের সামনে। মানে, ইয়ে, ছাতার কাপড় মসৃণ হতে পারে গিরি, কিন্তু মসলিন কখনওই নয়।’
ভেবেছিলেন নরম স্বরে বললে গিন্নির মেজাজে একটু জল পড়বে। কিন্তু গিরিবালা পাকা গোলকিপার। অ্যাটাকিং কোনও প্লেয়ারেরই ডিফেন্স দেখে ভেবেলে যান না। কোমরের ব্যথা ভুলে এক ঝটকায় উঠে বসে বললেন, ‘মসলিন নয় মানে? আলবাত মসলিন। বুকুন যেদিন বাড়িতে এল, সেদিন তুমি তো গুপ্তিপাড়া গিয়েছিলে। আমাকে ও বারবার বলে গিয়েছে, মসলিন কাপড় পিসি, আর সুইচ টেপা শিক। এমনকী, এই ছাতা প্রয়োজন অনুযায়ী ছোট-বড়ও করা যায়। আর রংখানা দেখেছে? যেন গোটা আকাশ নেমে এসছে ছাতায়।’
‘এই, এইখানেইআমার ঘোর আপত্তি গিরি। এ ছাতা ঠিক আকাশি নয়, পুরো তুঁতেপানা। এই বয়সে অমন ছাতা আমার মতো বুড়োদের মোটেই মানায় না। মেয়েরা চেয়ে চেয়ে দেখে আর মুখ টিপে হাসে।’
শেষ বাক্যে কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন গিরিবালা। কিন্তু জাত খেলোয়াড় তো! বল বুঝতে দেরি হয় না। ‘তা মেয়েরা তাকালে তাকাক, তুমি তাকাবে না। মিটে গেল!’ সপাট সমাধান গিরিবালার।
‘কিন্তু না তাকালে তো বুঝতে পারব না, ওরা ছাতাটা দেখে প্রশংসা করতে চাইছে, না ভীমরতিতে ধরেছে ভাবছে!
‘আ মোলো, ভীমরতি ভাববে কেন? আমার বুকুনের দেওয়া ছাতা বলে কথা! অমন আশমান রঙের ছাতা জম্মে চোখে দেখেছ?
‘না গিরি, দেখিনি। ছাতার যে অমন রং হতে পারে তা আমি কেন, আমার চোদ্দোগুষ্টিতে কেউ জানত না।’ কথাটা বলার সময় তেতে ওঠাটা কিছুতেই আড়াল করতে পারলেন না শিবাজি।
এরপর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। হঠাৎই কাঁদো কাঁদো গলায়, ছলোছলো চোখে গিরিবালা বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ গো, ছাতাটা তোমার পছন্দ হয়নি, না? বুকুন বলছিল বটে, পিসের হয়তো ভালো লাগবে না পিসি, হাজার হোক বিলিতি ছাতা তো, আর পিসে তো আবার স্বদেশি করা বাপের ছেলে!’
এই রে একদম ভুল পথে বল গড়িয়েছে। এক্ষুনি না থামালে রাতের ঘুমের বারোটা। গিরিবালা কিন্তু বাপ-ঠাকুরদাতেই থামবে না। তুরন্ত বল আটকালেন শিবাজিবাবু। ‘ছি ছি গিরি, অপছন্দ হবে কেন? বুকুন হল আমার সন্তানতুল্য। শুধু এই তুঁতেরঙা ছাতা কি না! আর ছাতা তো সাধারণত অবসরের দিন বা শ্রাদ্ধে দেওয়া হয়। তা আমার তো অবসর হয়েই গেছে, পরে আছে শুধু শ্রাদ্ধটুকু। নইলে জ্যান্ত মানুষকে হঠাৎ করে ছাতা দিচ্ছে কেউ এমন তো শুনিনি!’
কী মোক্ষম এগচ্ছিলেন শিবাজিবাবু! কাঁচিয়ে দিলেন শেষদিকে এসে। শোওয়া থেকে প্রায় লাফ দিয়ে সটান উঠে বসলেন গিরিবালা। ‘কী বললে, আমার বুকুন শ্রাদ্ধের জিনিস দিয়ে গেছে? অ্যাঁ! এত বড় কথা! তোমার এত ছোট মন? কে বলল তোমাক যে শুধু ওই দুটো দিনই ছাতা দেয় লোকে! হুবহু নিজের মায়ের মতো হয়েছ! যত্তসব হাড়জ্বালানে যুক্তি!’ এতেই থামলেন না গিরিবালা। শিবাজিবাবুর মা কবে কবে কোথায় কোথায় কী কী ‘কুযুক্তি’ দিয়েছিলেন তা নিয়ে একটা অতীতসফর সেরে খানিক দম নিলেন। দু’-চারটে শ্বাস ভেতরে পুরেই ফের ফুল ফর্মে। ‘আমি কালই বাপেরবাড়ি চলে যাব..., না না তা কী করে হয়? আমি বাপেরবাড়ি চলে গেলে তুমি তো বেঁচে যাও। আমি আর কক্ষনও বাপিরবাড়ি যাব না। কিছুতেই না।’এই অবধি বলে দুমদুম পা ফেলে পাশর ঘরে গিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন গিরিবালা। একটু পরে ফুরুৎ ফুরুৎ নাকও ডাকতে শুরু করলেন। শিবাজিবাবুর বাকি রাত বিনিদ্র ও নিশ্চিন্তে কাটল।
ছাতাখানা নিয়ে মুশকিল শুরু সেই সেদিন থেকেই। তাই আজ বেরনোর আগে ওটা গিরিবালা গছিয়ে দিতেই সতর্ক হলেন শিবাঝিবাবু। মিনমিন স্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন শিবাজি।
‘আজ নয় গিরি, আকাশে একদম মেঘ নেই, বৃষ্টি তো হবেই না। শুনলে না আবহাওয়ার খবর?’
‘বলুক, ওরা দিনরাত ভুল বলে।’
‘আরে না, না সে তো এককালে বলত।
এখন তো সবই মিলিয়ে দেয়।’
‘দিক গে। শোনো, বর্ষায় ছাতা আর
শীতে কাঁথা কখনও হাতছাড়া করবে না।’
বেরনোর আগে ঘরোয়া দুর্যোগে পড়তে চাইলেন না শিবাজি। বললেন, ‘আচ্ছা বেশ তো, তাহলে দাও না, আমাদের বিয়ের ওই পুরনো ছাতাখানাতো রয়েইছে, ওটাই না হয়...!’
কথাটা শেষ করার আগেই গিরিবালা এমন একটা মুখ করে শিবাজির দিকে তাকালেন যেন অবোধ শিশু না বুঝে কীসব বলে ফেলেছে।
‘ওই মান্ধাতার যুগের শিক বের করা ছ্যাকরা মার্কা ছাতাটা? না ব্যবহার করে করে তো ওটাকে যমের বাড়িতে পাঠানোর দশায় নিয়ে গেছ। বৃষ্টি এলে খুলতে খুলতে তো বৃষ্টি থেমে যায়।’
শিবাজির রাগ হচ্ছিল খুব। কিন্তু অপোনেন্ট যতই রাগিয়ে দিক, এসব ট্রেন ধরার দিনেরাগলে চলবে না। রাগলেই দেরি, আর দেরি হলেই ট্রেন মিস। গলার আওয়াজ যতটা সম্ভব মিহি করে শিবাজিবাবু বললেন, ‘না না যাহ্! যতটা বলছ, ততটা মোটেই নয়। এই তো সেদিন হলধরবাবু ছাতাখানা ধার নিলেন। কই তেমন কিছু তো বললেন না। বরং ছাতাটা বেশ পছন্দ হয়েছেবলে গেলেন!’
ওসব হলধরটরকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনলেন না গিরিবালা। তাঁর স্পষ্ট জবাব, ‘হলধরের শালার ছেলে তো আর আমেরিকায় থাকে না, তাই তোমার ওই ধর্মতলার ছাতা উনি বুকে বেঁধে রেখেছেন। আমেরিকার ছাতা হাতে পেলে না, তোমার ওই ছাতা উনি কুকুর তাড়াতেও নিতেন না।’
মাথাটা ধাঁই করে তেতে উঠল শিবাজির। ইচ্ছে করল বলেন, তোমার ওই বুকুনের ছাতা না কুকুর তাড়াতেও কাজে আসবে না, উল্টে ওই ক্যাটকেটে তুঁতে দেখলে কুকুর উল্টে তাড়া করতে পারে। কিন্তু না থাক, এখন এসব বললে বেরনো তো হবেই না, উল্টে যাওয়াটাই কেঁচিয়ে যেতে পারে। শেষ চেষ্টা করলেন শিবাজি।
‘কিন্তু গিরি, ট্রেনে করে এতটা যাব, তারপর আবার অটো... বুঝতেই তো পারছ, আর আমার যা ছাতা হারানোর স্বভাব, এত ভালো বিদেশি ছাতা, শেষে একটা কেলেঙ্কারি না করে বসি!’
ঠিক এই কথাটার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন গিরিবালা। ঠিক যেন চেনা পাশ পেয়েই গোলের মুখ খুলে দিলেন। একগাল হেসে বললেন, ‘ওসব চিন্তা কোরো না গো, আমি আছি কী করতে? আমি মাঝেমধ্যেই তোমাকে ফোন করে ছাতার কথা মনে করিয়ে দেব।’
শিবাজি বুঝলেন কপালে আজ আরও দুঃখ
আছে।
বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে ট্রেনে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। সারা দিন যা ধকল গেল! গোটা দিনে বার কুড়ি ছাতার জন্য ফোন ধরেছেন বাড়ির। লক্ষ করেছেন, ওঁর বন্ধুর ছেলে-ছেলের বউ সহ নিমন্ত্রিত আরও অনেকেই ওঁর ছাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছে। নইলে ফিসফিস করে কীসব যেন বলেছে। খাওয়ার সময় যাতে খাবারের তেলঝোল একটুও ছাতায় না পড়ে তার সাবধানতা প্রতি পলে আউড়ে গিয়েছেন গিরিবালা। ফোন ধরার ঠেলায় তো মাংসের নলিটা জুত করে টানতেও পারলেন না শিবাজি। পায়েসটাও আর একটু নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। ফোন আর ছাতা সামলাতে সেসবে আর মন দেওয়া যায়নি। ফোন যে অফ করে দেবেন, তাতেও বিপদ। বাড়ি ফিরলে তবে আর রক্ষে থাকবে না। তাই প্রায় সব ক’টা ফোনই হুঁ, হ্যাঁ করে সারলেও ধরতে হচ্ছিল শিবাজিকে। তাই দেখে অধীরের বউ হেসে-হেসে বলছিল, ‘কী দাদা, বউদি বুঝি এখনও খুব মিস করে দাদা? এ তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন!’ অধীরও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, একঘর লোকের মাঝেইহা হা করে হেসে উঠল। শিবাজির মনে হচ্ছিল, ধরণী দ্বিধা হও। এসব পরিস্থিতিতে মনে যাই আসুক, মুখে একটা হেঁ হেঁ ভাব বজায় রাখতে হয়। শিবাজিও তাই করলেন।
ট্রেন সবে বেলুড় ছেড়েছে। বুকপকেটে পিরিং পিরিং শুনতে পেলেন শিবাজি। তাচ্ছিল্য নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ভুরু কুঁচকে গেল। ফের গিরিবালা!
‘হুঁ’।
‘ও মা, হুঁ আবার কী? ছাতাখানা সামলে রেখেছ তো? যা ভুলো মন তোমার!’
‘হুঁ রাখছি।’ ইচ্ছে করেই ফোনটা কেটে দিলেন এবার। তবু আড়চোখে একবার বাঙ্কে দেখে নিলেন, যেমনকার ছাতা, তেমনই আছে। ট্রেনের দুলুনিতে ফের চোখটা লেগে এল শিবাজির। চোখ খুললেন যখন ট্রেন তখন হাওড়া ঢুকছে। এই সময়টায় নামার ভিড় কম, বরং ওঠার চাপ বেশি। বাঙ্ক থেকে ছাতা হাতে নিয়ে স্টেশনে পা রাখলেন শিবাজি। এবার একটা ট্যাক্সি ধরলেই বাড়ি। একহাতে ছাতাটা নিয়ে ভালো করে উল্টেপাল্টে দেখলেন। ক্যাটকেটে তুঁতের জায়গায় ম্যাড়মেড়ে কালো। শিক বের করা। খয়াটে ডাঁটি।
নামার সময় বাঙ্ক থেকে ছাতা নিতে গিয়েই গণ্ডগোলটা টের পেয়েছেন শিবাজি। হুবহু তাঁর বিয়ের ছাতার মতো একটা ছ্যাকরা রং মজে যাওয়া কালো ছাতা। কোনও সুইচ টেপার ব্যাপার নেই, একেবারে গায়ের জোরে কসরত করে খোলা আদ্দিকালের ছাতা। গা থেকে যেন পুরনো যুগের গন্ধ বেরচ্ছে। বাঙ্কের এককোণে অবহেলিত প্রেমিকার মতো গুটিসুটি মেরে পড়ে রয়েছে। ছাতাটা হাতে নিতেই বুকে যেন আনন্দধ্বনি বাজছে শিবাজির।
ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়িয়েই মোবাইলটা বন্ধ করলেন শিবাজি।এই প্রথম ছাতা জিনিসটাকে ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন