ধারাবাহিক উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(১৬)
মূল ভূখন্ডে নবদিগন্তঊন্মোচনহিসেব দলটিকে চালাবার আসল কান্ডারী যদিও এখন কর্নেল সি শ্যামাঙ্গী, কিন্তু তবুও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় শুরু থেকেই শকুন্তলা ছিল এবং এখনও থেকে যায়। যে যে জায়গায় নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব এখনও খুব একটা জোড়দাড় জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি, সেইসব জায়গাগুলোতেই নিজেদের ঘাঁটি তৈরী করবার কাজে তারা এখন উঠে পড়ে লাগল আর সজাগ দৃষ্টিতে ওরা লক্ষ্য করতে থাকল রক্ষণশীল সমাজদলের কার্যকলাপ আর যোগসাজস। ক্রমশ ক্রমশ দলটা ধর্মীয়বাতাবরণে জড়িয়ে পড়ছে এবং ধর্মভিত্তিক কাজকর্মেই তাদের বেশি উৎসাহ দেখা গেল। আর নবদিগন্তউন্মোচন হিসেব দলটি এইটাকেই ওদের প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়ে লড়াই চালাতে শুরু করে দিল। এই রকম একটা সময়ে শ্যামাঙ্গীর হঠাৎ মনে পড়ে গেল ‘অভিমানপদব্রজাসংহার’ কথাটা। আর অদ্ভুতভাবেই রক্ষণশীল সমাজ দলের ধর্মীয় বাতাবরণে ওই সংহার শব্দটাই যেন কেমন বারবার করে আসতে থাকে, শ্যামাঙ্গী লক্ষ্য করল আর সেই সঙ্গে তার শান দেওয়া তুখোর মগজে এটাও মনে পড়ল, এরকমই কোন এক প্রাচীন কাব্যে বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর আদি পিতা আসলে হলেন পুরুষ এবং বাদবাকী সমস্ত মানবগোষ্ঠী তার সন্তান সন্ততি। সেখানে স্ত্রীলোককে কোন কোন অপরাধের জন্যে কত কত ঘা চাবুক মারা হবে সেই বিধানও জানান আছে শুধু নয়, সুদূর অতীত কাল থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী বা কয়েক সহস্রাব্দ ধরে সেই বিধান মেনেই সামাজিক কাঠামো ও তার পরম্পরা চলে এসেছে।
কিছুদিনের মধ্যেই দিসন্তসেনার গোয়েন্দা দপ্তর মূল ভূখন্ডে ‘অভিমানীপদব্রজাসংহার’ বলে একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব খুঁজে বার করল আর তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে বার করল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দলটার কাজকর্ম এতটাই কুকীর্তিময় ছিল যে পরবর্তীকালে সংবিধান তৈরী করে তা রক্ষার স্বার্থে তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণাও করা হয়েছিল। পরে কোনও এক উদারপন্থী দলের ঔদার্যমুলক একটি চুক্তি ও বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধে ও অর্থানুকুল্যের কারণে তাদের ওপর থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তাই এখন দলটার এত বাড়বাড়ন্ত। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ হাতে পাওয়ার পরেও তাদের কিছুই করা বা জানানো হল না ভবিষ্যতের বিশেষ একটা কর্মসূচীর কারণে, যে কর্মসূচীর ফলে সহজেই মানুষকে তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া ও সম্প্রীতি রক্ষা করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে চৈতি সমস্ত কথা শুনে এতটাই রেগে গেল যে সে এই ক্ষমাশীলতার কোনও অর্থ খুঁজে না পেয়ে প্রতিরক্ষা দপ্তরের নানারকম ব্যবস্থায় মননিবেশ করল। অচিরেই সে উপত্যাকা সেন আর নীলনদকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরী করল যার আন্ডারে অনেক ইঞ্জিনীয়ার আর অফিসার রাখা হল। মানকো আপারু আর তুপাক ইউপানকির সংগৃহীত সোনা রুপোর মোহর ব্যবহার করে সাইত্রিসটা যুদ্ধবায়ুযান আর বেশ কিছু উন্নতমানের রকেট ক্ষেপণাস্ত্র বানানো হল যাতে যে কোনও পরিস্থিতিতেই শত্রুপক্ষকে একেবারে গুঁড়িয়ে ধূলিসাৎ করে দেওয়া যায় এবারে। খবরটা কিন্তু যুদ্ধং দেহী শ্যামাঙ্গীর কাছেও কোনও খুশির খবর বয়ে আনল না। এতগুলো টাকা মানুষের কাজে ব্যয় না করে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যবহার করাটা সে মেনে নিতে পারল না। এমনকি শকুন্তলাও এর বিরোধিতা করল আর এই প্রশ্নে ওরা দুটো দলে ভাগ হয়ে যেতে থাকল ততদিন পর্যন্ত যতদিন না প্রমাণিত হল চৈতির এই কাজকর্মের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা। শেষ পর্যন্ত চৈতির জন্যেই দিগন্তসেনা গোটা পৃথিবীর রাষ্ট্রীয় কক্ষপথে একটা বিশেষ স্থান করে নিল। সকলে সম্ভ্রমের সঙ্গে দিগন্তসেনা নামটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্যালুট ঠুকে যেতে বাধ্য হল।
ইতিমধ্যেই গোটা পৃথিবীর তাবড় তাবড় সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল ‘আনোবানি’ বলে একটা দলের কাজকর্ম ও দেশ বা রাষ্ট্র চালানোর এক অভিনব জুলুমবাজির কথা। ফাজাকিস্তান হল ওদের দেশের উত্তরপশ্চিমে একটা রাষ্ট্র যার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে উত্তর সীমান্তে অল্প একটু কাঁটা তারের বেড়া। দেশটির বেশির ভাগ অংশই দখল করে নিয়েছে আনোবানি নামক একটা প্রতিক্রিয়াশীল দল যারা নারীকে পদানত করে রাখে শেকল, বোরখা আর ঘোমটা পরিয়ে, যাদের মতে নারী কখনও স্বাধীন থাকতে পারে না বা পারা উচিত নয়। তাই তাদের বিধান অনুযায়ী শৈশবে একজন মেয়ে তার বাবার অধীনে থাকবে, যৌবনে তার স্বামী এবং বৃদ্ধ বয়সে ছেলের অধীনে থাকবে। সে একা থাকা মানেই বুঝে নিতে হবে সে স্বেচ্ছাচারী আর তখন সে পৃথিবীর বা দেশের পুরুষদের সার্বজনীন সম্পত্তি এবং যে কেউই তাকে যে কোনও সময় ভোগ করার অধিকারী। এরা মেয়েদের লেখাপড়ার চর্চাকে বলে অধর্ম। ঋতুমতী নারীর জন্য এরা একটা আস্তাকুর তৈরী করে বাড়ির এক কোনে যাতে সে সময় নারী সেখানে থাকতে পারে। এরা নারীর আয়না দেখা ও চুল আঁচড়ানোর ওপর নিষেধ জারি করে শুধু না, নারীকে বাইরের আলোয় বের করারও এরা ঘোরতর বিরোধী। ফলে কখনও সখনও যখন তারা তাদের স্বামীর কোনও প্রয়োজনে বেরায় তখন একদল স্ত্রীকে দেখা যায় শেকল পরিয়ে সেটা ধরে স্বামীটি তাদের টানতে টানতে নিয়ে যায়। সভ্য পৃথিবীর আলো সেখানে পৌঁছায় না। কমবেশি সমস্ত রাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো সব সময়ই চেষ্টা করে ওদের জগতের অদ্ভুত নিয়ম কানুন গুলোকে আরও বেশি বেশি করে পৃথিবীর সবাইকে জানাতে আর ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু সেটা প্রায় হয়েই ওঠে না বললে চলে।
দিগন্তসেনার পত্তন যেহেতু নারী নির্যাতন এবং বিশেষ করে ধর্ষণকে কেন্দ্র করে, তাই সব সময়ই পৃথিবীর কোথাও নারী অবদমন বা ওই ধরণের কোনও ঘটনা ঘটলেই সাংবাদিকরা সেই ঘটনার উল্লেখ করে তার নেতৃত্বের মতামত জানতে চায়। এক্ষেত্রেও সেইরকমই শ্যামাঙ্গীর মতামত জানতে চাইলে শ্যামাঙ্গী বলে,’এরকম একটা পরিস্থিতির কথা কল্পনাই করতে পারছি না, কী মন্তব্য করব! তবে পৃথিবীর কোথাও যদি কোনও বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে বা কোনও মানবাত্মার অপমানজনীত নারকীয় ঘটনা ঘটে তাহলে সমস্ত সভ্য মানুষের তার বিরুদ্ধে একসঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত’। এই বিবৃতিটাই ওদের পছন্দ হয় নি। প্রথমত শ্যামাঙ্গী একজন মেয়ে আর দ্বিতীয়ত সে এমন একট রাষ্ট্রের কর্ণধার যার জন্মই হল নারী অবদমনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু তার কোনও পাল্টা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি। তাই তাদের মনভাব বা ঊষ্মা কোনও কিছুই জানা যায় না যতদিন না পর্যন্ত একটি সন্ত্রাসবাদী দল, তাদেরই লালনে পালনে বড় হয়ে ওঠা, এসে দিগন্তসেনা আক্রমণ করে এই ফরমান জারি করে যে পৃথিবীর এবং ঈশ্বর বা আল্লার বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রের জন্ম। তাই তারা অবিলম্বেই এই রাষ্ট্রের দখল নিয়ে এর কর্ণধার কে হত্যা করে ঈশ্বর বা আল্লার কাছে প্রেরণ করবে তার প্রকৃত আত্মশুদ্ধির জন্যে।
মানময়ীর শরীরস্বাস্থ্য পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ল এবং কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মানময়ী যখন পড়ে যেতে লাগল, তখন সবাইকে অনঙ্গ বারবারই বলতে লাগল, ‘পাপ। পাপ! সব, সবটাই অধর্মের আধার!’ অনঙ্গের এই কথার মর্মোদ্ধার করতে পারল না কেউই। বরং সকলেরই মনে হতে থাকল যে অনঙ্গের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সকলেই মানময়ীর যথাযোগ্য চিকিৎসার জন্যে তৎপর হয়ে উঠল আর চিকিৎসার পর মানময়ী একটু একটু করে পুরো সুস্থ হয়ে উঠলেও প্রত্যেকবারই দেখা গেল সে তার আগের জায়গায় কিন্তু আর ফিরে যেতে পারছে না। সমস্ত মেঝেগুলো যেন খুব আপন হয়ে গিয়ে মানময়ীর দিকে ছুটে আসতে থাকল আর নয়তো মেঝের ওপর মানময়ী বা মানময়ীর ওপর মেঝে এসে একেবারে জুড়ে গিয়ে শুয়ে পড়তে থাকল। ছাদগুলো যেন কোন অতলে এমনভাবে তলিয়ে যেতে লাগল যে মানময়ী কোনও ভাবেই তার দিশাহুশা পেতে পারল না। শ্যামাঙ্গী এসে শক্ত করে মানময়ীর হাতটা ধরল আর তারপর তাকে সোজা পাঠিয়ে দিল খাটের ওপরের বিছানায়। হুকুম জারি হল এখন থেকে ঘরের বা সংসারের কোনও কাজে মানময়ী এলেই সেটা যেন তাকে জানান হয়। রাখা হল সর্বক্ষণের একজন দেখাশোনার লোক। তাতে পরিস্থিতিটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু শ্যামাঙ্গীকেই দরকার হতে থাকল তার রণহুংকার ছাড়বার জন্যে, যেটা শুনলেই মানময়ীও গুটিশুটি মেরে নিজেই নিয়মের শৃংখলে গিয়ে বাধ্য শিশুর মতই ঢুকে পড়ত। পড়ে যাবার সেই সব দিনগুলোতে একটা উড়োজাহাজ ভাড়া করা হত আর সেই উড়োজাহাজে করে দুই ছেলে আর অলঙ্কৃতা, অনঙ্গ আর শ্যামাঙ্গী সবাই মিলে অন্ধকারে ভাসতে ভাসতে আলোর দেশের এক নতুন একটা হাসপাতালে যেত। সেখানকার ডাক্তার অসম্ভব জাদু বলে মানময়ীকে প্রত্যেকবার সুস্থ করে বাড়ি ফেরত পাঠাত আর মানময়ী শ্যামাঙ্গী নতুন আশায় বুক বাঁধত নতুন কোনও এক ভোরে। সেই যাতায়াতের পূনরাবৃত্তি কতবার ঘটেছিল সেটা কেউ গুণে রাখেনি। তবে শ’দেড়েক বার তো হবেই। একদিন রাতে শ্যামাঙ্গী ঘুম ভেঙে উঠে দেখে পাশে মানময়ীর শোওয়ার জায়গায় মানময়ী নেই। শ্যামাঙ্গী চিন্তিত হয়ে পড়ে আর উঠে এ ঘর ও ঘর খুঁজতে খুঁজতে দেখে আরাধনার জায়গায় বসে সে এক বিশেষ উপাসনায় ব্যস্ত। কাছে গেলে দেখা যায় তার চোখ থেকে জল পড়ছে অঝোর ধারায় আর সেই জলের ধারা মেঝে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাশের ঘরে, সেখান থেকে বাইরের দালান হয়ে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলার সমস্ত ঘারদোরের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বসার ঘরের সব আসবাব আর অন্য যাবতীয় কিছুকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে সামনের বারান্দা থেকে সিঁড়ি দুটোকে পাড় করে রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে কতদূর সেটা বোঝার আগেই পেদ্রো গুয়েররেসের হাত ধরে শুভেচ্ছা এসে রাস্তার ওপার থেকে শ্যামাঙ্গীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে জানতে চায় কী হয়েছে আর মানময়ী কেন কাঁদছে। সে আরও বলে যে জলের এই ধারা ওর খাটের পাশে গিয়ে থমকে ছিল। ও উঠে দেখতে পেয়ে পেদ্রোকে সঙ্গে নিয়ে সেটাকে অনুসরণ করতে করতে এইখানে এসে পৌঁছেছে। শ্যামাঙ্গী ওদের ভেতরে নিয়ে আসে, বসার ঘরে পেদ্রোকে বসিয়ে শুভেচ্ছাকে নিয়ে মানময়ীর কাছে যায়। শুভেচ্ছা সটান বসে পড়ে মানময়ীর কোলে আর হাত দিয়ে তার গাল থেকে চোখের জল শুষে নিতে থাকে আর সমস্ত চোখের জল শুকিয়ে গিয়ে চোখের ভেতরটা যেন খটখটে হতে থাকে। তারপর তুমুল রোদ ওঠে মানময়ীর সমস্ত স্বত্বা জুড়ে। শ্যামাঙ্গী দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। এবার সে কাছে এসে দাঁড়াল। শুভেচ্ছা বলল মানময়ীর বোধের ওপর যে আগ্রাসন টা চলছিল এখন আর সেটা নেই। তার বদলে একধরণের প্রতি আগ্রাসন তার বোধের ওপরে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে যার ফলে এখন মানময়ীর ভেতরে এক নতুন মানব চেতনার জন্ম হয়েছে।
পেদ্রো গুয়েররেস শ্যামাঙ্গীকে খবর দিল কাল রাতে মূল ভূখডে ছজন প্রধানমন্ত্রী মোহম্মদ হামিম, আমীর মোল্লা, আবদুল সেলিম, শাহরুখ হোসেন, মোহাম্মদ বিশ্বাস, হাসিম সলমন হামিম, দুজন বৈদেশিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সরফরাজউদ্দীন শেখ এবং অনিল আব্দুল খান, তিনটে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী নওয়াজ ইসমাইল, করীম মোল্লা, আফতাব বিশ্বাস আর চারটে রাজ্যের শিল্প মন্ত্রী হান্নান উদ্দীন বিশ্বাস, ইরফান উদ্দীন বিশ্বাস, নিজাম মোল্লা, সরফরাজ গুরু – এই পনের জন মন্ত্রীর ওপরে রক্ষণশীল সমাজ দল শুরু করেছে তাদের নিজস্ব দলীয় আগ্রাসন যার ফলাফল হিসেবে ওদের বাড়ির লোকেরা ভয়ে চুপসে গেছে। সব কিছু শুনে শ্যামাঙ্গী পেদ্রো গুয়েররেসকে বলে আপাতত কদিন ছুটি, তাই সে যেন তার বউ আসিফা বেগমের কাছে চলে যায় সময় কাটাতে আর কোথাও পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে আসে, এই বলে তার হাতে ধরিয়ে দেয় কাপড়ের পুটুলি যাতে রয়েছে একগুচ্ছ মোহর আর গোটা কয়েক ছাপানো হরফের কাগজ নানা মাপের, লাতিন আমেরিকা যাবার জন্যে যেটা ভীষণ দরকারী।
দক্ষিনের উমাচল, রাজীবখন্ড, উজবেক, রাজপ্রদেশ, মৌলিগড়, সম্ভরাট,
বিজয়রাষ্ট্র আর পশ্চিমের অন্ধরাত, হিসেবগড়, মানুষপাল ও গান্ধারকান্না এবং উত্তরের ঝারলোপাট,
উত্তরদাস-এরসঙ্গে দূরভাষে যোগাযোগ করে জানল পেদ্রো গুয়েররেসের দেওয়া তথ্য পুরোটাই ঠিক।
ফলে সে ওই সব রাজ্যের মন্ত্রীদের আশ্বাস দিয়ে জানাল যে তাদের গায়ে একটা আঁচড় পড়া মানে
নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব দলটির গায়ে দাগ পড়া। কেননা ওরা ওদের দলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই
যে কোনও মূল্যে তাদের রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব দল ও তার কর্মীরা।
শুধু তাইই নয়, কেন্দ্রীয় কমিটির তরফে শকুন্তলা নিজে গিয়ে ওদের পরিবারের সঙ্গে দেখা
করে আশ্বাস দিয়ে এল। শ্যামাঙ্গী সঙ্গে সঙ্গে
সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সবটা জানিয়ে দিল এবং তার প্রতিবিধান হিসেবে নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব
কী কী করতে পারে সেটাও জানিয়ে দিল। সমস্ত জায়গায় সংবাদ প্রচারের সূত্রে রক্ষণশীল সমাজ
দল দায় অস্বীকার করে বিবৃতি দিল যাতে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করা যায়। কিন্তু নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব
নিজেদের কাজ করে গেল কোনও কথা পাত্তা না দিয়ে। নিহিতপাতালপুরীর নিজেদের বাড়িতে যখন
একদিন শ্যামাঙ্গী দেখল যে ফাগুন মানময়ীর হাতটা ধরে পালস মাপছে, ও তাড়াতাড়ি গিয়ে জানতে
চাইল উদ্বিগ্ন হয়ে কী হয়েছে। ফাগুন বলতে চাইল, রুটিন চেক আপ। কিন্তু কথাটা বলার সঙ্গে
সঙ্গেই দেখল শুভেচ্ছা সাসার সঙ্গে শ্রাবনের
গাড়ি চালিয়ে কোথায় একটা যাবার উপক্রম করছে। গিয়ে দেখল অভিনন্দা প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ও তাড়াতাড়ি
ওদের সরিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে অভিনন্দাকে হাসপাতালে
নিয়ে গেল। ফাগুন পৌঁছে দেখে শ্যামাঙ্গী ওটির সামনে পায়চারি করছে। ফাগুনকে চোখের ইশারায়
বসতে বলে ও পায়চারি করে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে ওদের ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা
বাচ্চাকে দেখাল। শ্যামাঙ্গী বলল,’ধৈবত’। সবার খুব পছন্দ হল। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে
শ্যামাঙ্গী অভিনন্দাকে দেখে তারপর ওদের জানিয়ে ফিরে এল বাড়িতে। কেননা এরপর ওকে দিগন্তসেনায়
ফিরে ইতালীতে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে শুভেচ্ছাও ওর সঙ্গে ফিরে এল।
দিগন্তসেনায় পৌঁছে ওরা দেখল উল্কা আর সুতনুকা ফিরে এসেছে আর থাকতে শুরু করেছে একটা ফ্ল্যাটে। খুব শীঘ্রই সুতনুকার বাচ্চা হবে। ও ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা বিমান বন্দরে গিয়ে ইতালির বিমানে চাপল শুভেচ্ছাকে নিয়ে। কিন্তু মানময়ীর চিন্তা তার মুখে এমন একটা যন্ত্রণার রেখা ফুটিয়ে তুলল যে শুভেচ্ছারও শ্যামাঙ্গীর দিকে তাকাতে তাকাতে চোখে জল চলে এল। হঠাত শ্যামাঙ্গী শুভেচ্ছার দিকে তাকাতেই দেখল ওর চোখে জল। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই শুভেচ্ছা পালটা ওকে জিজ্ঞেস করল যে ওর মুখে এমন যন্ত্রনার চিহ্ন কেন। শুনে শ্যামাঙ্গী অবাক হয়ে গিয়ে কথা বলতেই ভুলে গেল। তখন শুভেচ্ছা শ্যামাঙ্গীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল যে ও সব জানে। সেই সঙ্গে সে আরও বলল, দিদানের কথা শ্যামাঙ্গী যেন এখন আর চিন্তা না করে। শ্যামাঙ্গী শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল এমনভাবে শুভেচ্ছার দিকে তাকাতেই শুভেচ্ছা বলল যে ও আসলে শ্যামাঙ্গীর মা আর শ্যামাঙ্গী ওর মা আর কে না জানে মার কাছে কিছু লুকোতে গেলে সব কিছুই শেষমেশ ধরা পড়ে যায়। শ্যামাঙ্গী সব কথা শুনে হা হয়ে গেল। বুঝতেই পারল না হাসবে না কাঁদবে। ও শুভেচ্ছাকে অনেক আদর করল ঠিক যেমন করে মানময়ী শ্যামাঙ্গীকে আদর করত। শুভেচ্ছা শ্যামাঙ্গীকে পাল্টা আদর করে বলল যে সবাই ওদের দেখছে। শ্যামাঙ্গী সত্যিই দেখল অন্যরা ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্যামাঙ্গী একটু গাম্ভীর্যের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নিল।
ভাল দি ফাসার মত একটি ছোট্ট সামুদ্রিক গ্রামে সরকার ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছে আর তার পাশে ভাল গার্দিনা বলে অন্য একটি সামুদ্রিক গ্রামে তাদের মিটিং এবং সেই সংক্রান্ত চুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। পৌঁছানোর পরেই বিমানে আসা অন্য একটি ইতালীয় যুবকের সঙ্গে শুভেচ্ছার খুব ভাব জমে গেল। মিটিঙের দিন শুভেচ্ছা ওই ছেলেটির সঙ্গেই ভাল গার্দিনার নানা জায়গায় ঘুরে বেরিয়ে সময় কাটাল। মিটিং শেষ হলেই ও আবার শ্যামাঙ্গীর কাছে চলে এল ওর সদ্য পরিচিত বন্ধুটিকে সঙ্গে নিয়ে। পরবর্তী মিটিং পরের দিন ফ্লোরেন্সে। তাই ওখান থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্যামাঙ্গী শুভেচ্ছাকে নিয়ে ফ্লোরেন্সে এল। ওখানেও শ্যামাঙ্গীর ব্যস্ততার সময় ছেলেটি শুভেচ্ছাকে সঙ্গ দিয়ে নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখাল। তারপর পুরো সরকারি ব্যবস্থাপনা থেকে বিদায় নিয়ে রোমে গেল। ও শুভেচ্ছাকে ঘুরে ঘুরে সেখানকার নানা পুরনো স্থাপত্য কীর্তি দেখাতে দেখাতে বলতে লাগল প্রাচীন কালের রোম সাম্রাজ্যের কথা। অনেকটা ঘোরার পর ওরা একটা হোটেলে উঠল। ঘরে গিয়ে সব কিছু রেখে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে খেতে নামতেই দেখা হল সেই ইতালীয় যুবকটির সঙ্গে। শুভেচ্ছাকে ছেলেটি বিয়ের প্রস্তাব দিল। শ্যামাঙ্গী অবাক হয়ে গেল আর শুভেচ্ছা পরিস্কার জানিয়ে দিল,’না’। মার দিকে তাকিয়ে শুভেচ্ছা লাতিন আমেরিকা বিশেষ করে পেরু যাবার জন্যে প্রচণ্ড আবদার জুড়ে দিল। শুভেচ্ছাকে শ্যামাঙ্গী একান্তে ডেকে জানতে চাইল যে ওর সঙ্গে ছেলেটার কতটা ভাব বা কী হয়েছে যে ও ওকে বিয়ে করবার মত প্রস্তাব দিল। শুভেচ্ছা জানাল তেমন কিছুই নয়, মাত্র দুদিনের বন্ধুত্ব আর একবারের বিছানার সঙ্গী। শ্যামাঙ্গীর মাথাটা যেন মনে হল দুলে উঠল। ও হঠাৎ করে যেন কিছুটা অসুস্থ্ হয়ে পড়ল। শ্যামাঙ্গীকে শুভেচ্ছা দু চার বার চোখে মুখে জলের ছিটে দিতেই ও সুস্থ হয়ে উঠে বসল। কিন্তু শ্যামাঙ্গী শুভেচ্ছার সঙ্গে সবরকম কথা বলা বন্ধ করে দিল। কিছুক্ষণ পর হোটেলে খোঁজ করে দেখল, কিন্তু কোথাও শুভেচ্ছাকে খুঁজে পেল না। ও যখন পুলিশী সাহায্যের আবেদনের কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে শুভেচ্ছার দেখা মিলল। দেখল, এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের সঙ্গে হাসতে হাসতে আর কথা বলতে বলতে ও ওদের ঘরটার দিকে এগিয়ে আসছে। শ্যামাঙ্গী দেখেও না দেখার ভান করে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ও কী করবে বুঝতে পারল না। একটা সোফার ওপর বসে বসে যখন আকাশ পাতাল ভাবছে, তখন শুভেচ্ছা এসে পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরল আর বলল, ‘আচ্ছা! কী হয়েছে টা কী? একটু প্রেমই তো করেছি। আর তো কিছু নয়। তাতেই এত সমস্যা? এখন যদি প্রেম না করি, তাহলে কখন করব, তুমিই বল’। শুনে শ্যামাঙ্গীর চক্ষু চড়ক গাছ। ও কী বলবে ভেবে পেল না। কী করবে তাও ভেবে পেল না। তখন শুভেচ্ছা ওর সামনে এসে বলল,’তুমি কি একটু ড্রিংক্স নেবে? আমি বলব ফোনে ওয়েটার কে ঘরে পৌঁছে দিতে?’ বলেই ও ফোনে ওয়েটার কে ড্রিংক্স দিয়ে যেতে বলল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তা এসেও গেল। শ্যামাঙ্গীর মনে তোলপাড় চলতে লাগল। মাত্রই তো তেরো বছর বয়েস হয়েছে মেয়েটার! এর মধ্যে এত কিছু হলটা কখন যে ও একেবারেই জানতেই পারল না! ওর বয়েসে ও তো এমনটা ছিল না। তাহলে শুভেচ্ছা এমন হল কী করে? কেন? এইসব সাত পাঁচ ভাবনার মধ্যেই শুভেচ্ছা এসে জানতে চাইল যে শ্যামাঙ্গী ওকে পেরুতে বেড়াতে নিয়ে যাবে কিনা। ঠিক সেই মুহুর্তেই খবর এল অনঙ্গ অসুস্থ। ব্যপারটা শ্যামাঙ্গীর পক্ষে গেল আর শুভেচ্ছাও খুব তাড়াতাড়ি গোছগাছ করে শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল।
দিগন্তসেনায় নেমে নিহিতপাতালপুরী যাবার পথে শ্যামাঙ্গীর সেই প্রবাদটার কথা মনে পড়ল, ‘মেয়েদের চোদ্দ হাত কাপড়ে কাছা আঁটে না’। ও সেটা শুভেচ্ছাকে বলতেই শুভেচ্ছা বলল যে প্রবাদগুলোর অসুবিধে হচ্ছে যে কালে ওগুলোর সৃষ্টি হয় সে কালেই তার প্রয়োজন ফুরায়। এখন মেয়েদের কাছা আঁটার জন্যও আর কাপড়ের দরকার হয় না। কয়েকটা বড়ি খেলেই বা প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ব্যবহার করলেই ঝামেলা চুকেবুকে যায়। ইতালির হোটেল ছাড়ার আগে ও সেই ড্রিংক্সের বোতলটা নিয়ে এসেছে। তারই সামান্য একটু বোতলের জলে মিশিয়ে পাশে বসে খেতে খেতে চলেছে। তারপর একসময় শুভেচ্ছা শ্যামাঙ্গীকে জিজ্ঞেস করল যে ধর্ষণ ব্যাপারটার সঙ্গে যৌনতার যে একটা যোগাযোগ আছে, সেটা ও কখনও ভেবেছে কিনা বা সেই বেড়াটাকে ভাঙার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেছে কি না। কিন্তু বাড়ি এসে যাওয়াতে সে আলোচনা মুলতুবি রেখে ওরা ভেতরে ঢুকল। কিন্তু সেখানে গিয়ে যখন দেখা গেল অনঙ্গের সমস্যাটা শারীরিক নয়, বরং খানিকটা আচরণগত বলেই মনে হচ্ছে, তখন সেটা নিয়ে খুব বেশি ভাবার দরকার নেই বলে সঙ্গে সঙ্গেই দিগন্তসেনার জন্য রওনা দিল। গাড়িতে বসে শুভেচ্ছা পুরনো বিষয়ের অবতারণা করতেই শ্যামাঙ্গী জানতে চাইল যে প্রেম কাকে বলে আর সেটা কি বিছানায় শোওয়া। কথাগুলো ওরা ফরাসী ভাষায় বলছিল। কেননা শ্যামাঙ্গী চাইছিল না চালক সেগুলো শুনুক। শুভেচ্ছা মার কাছ থেকে ফরাসী, ইতালি, জার্মানি, লাটিন ও স্প্যানিশ ইতিমধ্যেই আয়ত্ব করেছে। উত্তরে সেও ফরাসীতেই বলল যার বাংলা হল, ’অবশ্যই। কেন নয়?’ শ্যামাঙ্গী এই সব ব্যাপার গুলোতে সত্যি সত্যিই বড্ড কাঁচা, ভেবেও দেখেনি কোনকালে। সে বেচারা চুপ করে থাকাই কর্তব্য ভেবে চুপ করে রইল। শুভেচ্ছা নানারকম যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল ওর বক্তব্য। শুনতে শুনতে শ্যামাঙ্গী ভাবল এত সব কথা শুভেচ্ছা জানল কোথা থেকে। জিজ্ঞেস করতেই উত্তর এল,’কেন? বই পড়ে!’ বলেই সে রীতিমত তার পড়াশুনো করা একটা লম্বা তালিকার মৌখিক ঘোষণা করল। শ্যামাঙ্গী দেখল যে এই বয়েসেই এত ভারী ভারী বই পড়ে ফেলেছে আর সেই মত তার জীবনটা যাপনেরও একটা শৈলী তৈরী করে নিয়েছে যে, আর যাই হোক, তাকে বকা তো যায়ই না কোনমতে। শ্যামাঙ্গী এত সেক্সোলজি আর গায়নাকোলজির বই নিজেও কোনদিন পড়ে নি। এতে করে শুভেচ্ছার ওপর ওর একটা সম্ভ্রম তৈরী হল ওর আর মা ও মেয়ের সম্পর্কটা একটা আলাদা মাত্রায় গিয়ে পৌঁছাল। যাতে দুজনেরই গর্ব বোধের সঞ্চার হতে শুরু করল।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন