কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন (পর্ব ৬)

 


ধর্ম ও বিত্ত

শূন্যতার উপলব্ধি সেই ছয় বছর বয়সে। আত্মীয়স্বজন কচিকাঁচা মিলিয়ে প্রায় দ্বারা জন্মদিনে চুনার বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল। সেই সময় সঙ্গে থাকত বেডিং নামক এক ভ্রাম্যমাণ বিছানা। দড়ি খুললেই তার ওপর টপাটপ সবাই বসে গড়িয়ে পড়ত। ট্রেনে বড়োরা তাস খেলতেন। 29 অথবা ব্রে। ছোটোরা লুডো। ওই বেডিংএ কিনা থাকত! আচারের শিশি পর্যন্ত। যা বলছিলাম। সেইসব এবং মানুষদের সকলকে ফেরার ট্রেনে তুলে দিয়ে একা বাবা প্ল্যাটফর্মে। সবার শেষে উঠবেন। চুনার স্টেশনে অল্প সময় দাঁড়ায় ট্রেন। ছেড়ে দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল। বাবা রয়ে গেলেন। ক্রমে দূরে। হয়ত কয়েক মিনিট। তারপর হৈ হৈ। চেন টেনে ট্রেন থামানো। বাবা উঠলেন। কিন্তু সেই যে বাবাকে ফেলে চলে যাচ্ছি এক ভয়ঙ্কর শূন্যতার উপলব্ধি। সেই প্রথম। বুকের ভেতর সেই অসীম শূন্যতা পাকাপাকি বাসা করে আছে সারাজীবন। বাবা চলে গেছেন দু বছরের বেশি। আমি দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে। যাইহোক, যত বড় হচ্ছিলাম ততই নাগালের বাইরে যাচ্ছিল মন।

সব রাস্তারই একটা শর্টকাট থাকে। আমাদের বাড়ি ও রেল স্টেশনেরও ছিল মূল পথ ছাড়া শর্টকাট, সরু পথ আর তারপর বিরাট একটা মাঠ পেরিয়ে পুকুরপাড় দিয়ে একটা রাস্তা। এই মাঠটা অধিকাংশ সময় ফাঁকা অব্যবহৃত থাকত, কখনো কোনো গরু বাছুর ঘাস খেতে আসতো। মাঠ পেরোলেই ট্রেনপথ, ট্রেন অনেক উঁচু দিয়ে যেন টিলার ওপর দিয়ে যেত। মাঠটির বিশেষত্ব ছিল এখানে সমস্ত গাছে অসংখ্য বাবুই পাখির বাসা ঝুলত। বাবুই পাখির বাসার মতো এত সুনির্মিত বাসা দেখা যায় না। ঠাস বুনন। একদিকে ঢোকার পথ অন্যদিকে বেরোবার। বাসার ভেতর মাটি লেপে সুন্দর দেয়াল আর তার গায়ে জোনাকি আটকানো। এমনকি একাধিক ঘরও থাকত। দেখতে উল্টোনো কুঁজোর মতো কিছুটা। সার সার বাবুইবাসা দেখতে পাব বলে ওই মাঠটায় একা একাও যেতাম স্কুল থেকে ফেরার সময় নির্জন দুপুরে। পরে আমার গ্রামতুতো এক বন্ধু একটি পড়ে যাওয়া বাসা এনে দিয়েছিল।

রাত সরগরম তক্ষক আর ঝিঁঝিঁর কনসার্টে। বর্ষাকালে ব্যাঙের ডাক। আমাদের ঘরে থপ থপ করে ঘুরে বেড়াত তারা কিন্তু সোনাব্যাঙ খুব দুরন্ত কিন্তু আকারে ছোটো। ঘরের এক কোণ থেকে আরেক কোণে লাফ দিত। সাপ সারা বছর। এবং আমার প্রিয় প্রাণী। ওরা আসলে খুব ভীতু এবং শান্তিপ্রিয়।

সেই সময় গড়িয়ায় এত কম লোক বাস করত যে সব ট্রেন দাঁড়াত না। লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যাবেলা অনেক সময়

মা-বাবা-আমি স্টেশনে বেঞ্চিতে বসে থাকতাম। অনেকটা উঁচু থেকে নিচে মহাশূন্যের মতো অন্ধকার গড়িয়া, জোনাকির ভিড়ে টিমটিম করত। যে কজন নামতেন ট্রেন থেকে বেশিরভাগই চেনা।

মা গল্প করতেন। বাবা।

🦋

ছোটোবেলা থেকে সামাজিক বিভাজন আর যাপনের ভিন্নতা দেখেছি।

সম্পর্ক তখনও distant relative হয়ে যায়নি। দুটি বাড়িতেই ছিলো অবাধ যাতায়াত। ছুটি ছাটায় ভাই বোনেরা এবাড়ি সেবাড়ি গিয়ে থাকা হতো। পড়াশোনা একটা মরণ বাঁচন ব্যাপার ছিলো না। তাই আমরা অনেক ঘটনা মনের কোঠায় এখনো সাজিয়ে রাখতে পারা গেছে। নীরবে লক্ষ্য করতাম আচার ব্যবহারের ভিন্নতা। মজা পেতাম নানা বৈপরীত্যে, কথায় ও কাজে।

এমনই একটি বাড়ি ছিল কলকাতার ভীষণ বড়লোক পাড়ায়। সে বাড়িতে ছিল বিত্তের বিকট প্রদর্শন। তাঁদের বাড়ির কর্তা উচ্চপদস্থ ছিলেন শুনতাম। রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের একেবারে ভয়াবহ ভক্ত। প্রতি কথায় নির্মোহের বাণী। তাঁর দশটি সন্তান ছিল। তিনি মেয়েদের তের ও চোদ্দ বছর বয়সে বিবাহ দেন। শৈশবে মাতৃহীন বোনের প্রথাগত শিক্ষা দেননি।

এঁরা বাবাকে মাকে আপনি বলতেন কিন্তু ভাই ভাই কলহ করতেন, মদ্যপান সহ সবই করতেন। এঁর এক কন্যার প্রাসাদে প্রথম দেখেছি সেলার। যার মধ্যে রাখা সারি সারি শিশি। আরো অনেক কিছু।

এঁদের সেই ধনীগৃহে বিবাহিত কন্যার শেষ জীবন কাটে একেবারে নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ অবস্থায়। মনে পড়ে রাত বারোটায় স্বামীর সঙ্গে অন্য রকম সেজে তাঁর রাত পার্টিতে যাওয়া।

আমাদের বনেদি এন্টালির বাড়িতে এসব কখনও দেখিনি। এসব তাই ছিল অভিনব অভিজ্ঞতা।

কয়েকদিন পর আমাদের সেই অজ পাড়াগাঁয়ে ফিরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। সেখানে গাছ থেকে ফল পাড়া। গরুর পাল, রাখালদের সঙ্গে বন্ধুত্ব। আজও মার্জিনাল মানুষজনের সঙ্গেই আমি বেশি আরাম বোধ করি।

দুটো ব্যাপার আমি উপলব্ধি যে করেছিলাম বছর দশেক বয়সের মধ্যেই যে ধর্মাচারণ বা এরিস্ট্রোকেসি কিন্তু সফিসটিকেটেড মননশীলতা গঠন করতে পারে না কিম্বা পারবেই না একথাও বলা যায় না।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন