ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার
পাঁচালি
প্রতি,
‘মেয়েদের
মহাভারত' নিয়ে এবারের লেখা। মেয়েদের জন্যে সবই হচ্ছে তাই মহাভারত হলেও হবে এই একুশ শতকে। মহাভারতের প্লট সাবপ্লটে অনেক নারী চরিত্র।
কিন্তু তারজন্যে কখনওই মেয়েদের মহাভারত হয়ে ওঠেনি। তবে একুশ শতকের পুনঃভাবনার জোয়ারে
এমন সৃষ্টি হতেই পারে।
আমাদের
দেশের বাংলা ভাষায় স্ত্রী-পুরুষ, তারপর নর-নারী বা নারী-পুরুষ এবং মেয়েমানুষ শব্দের
ব্যবহার সামাজিকভাবে প্রচলিত। দুনিয়া ডটকমে নারী আন্দোলনের ইতিহাস এখন সমাদৃত একটি
বিশেষ আবহ। যেখানে নারী শব্দের ব্যবহারে আধুনিকমনস্কতা বোঝাতে পারা যায়। এবং, নারীবিষয়ক
প্রবন্ধের চর্চা বেড়েছে। একি জাতির উন্নতি? তাহলে রামমোহন সার্থক বলতে হবে। এদ্দিনে
মানে একুশ শতকে এসে নারী মানে মেয়েদের তিনি এক সার্থক স্থানে দেখতে পাচ্ছেন। তবে, রবিঠাকুরের
কথাটিও মনে রাখার, যা ভাল তা অল্প বলেই ভাল। এই ভাল-তে মেয়েদের দিক থেকে ধরে মহাভারত
নিয়ে একটা নাটক লিখে ফেলা সাধুবাদ যোগ্য।
আবার,
এখনও সমাজে মানে জাতিতে দেখা যায় বাস, ট্রাম রেল প্রভৃতিতে মহিলা আসন সংরক্ষণ রয়েছে।
কারণ, মহলের মেয়েরা যানবাহনে চড়ে কাছারি যাবেন। আর বিশ শতকের মতন তো আর নয়, যে মহিলা
দেখে ফিসফাস চলবে। যদিও তা নয়, তবুও মহিলা মেয়ে নারীদের সংরক্ষণ রাখতে হয়েছে। এ সদর্থক
নাকি নঞর্থক সেটাও ভাবার। একদিকে নারী প্রগ্রতির ঢালাও বিজ্ঞাপন অন্যদিকে নারীর জন্যে
সংরক্ষণ আভাস দেয় যে, ততটা উন্নতি হয়নি। যে দুই লিঙ্গকেই সমান সমান ভাবা যাচ্ছে । আসলে
উন্নতি কোন ফলাফল নয়, একটি প্রক্রিয়া যা চলতেই থাকবে। আর তাই নারীর ব্যবহার কতটা হবে
তাও অনির্ধারিত ভাবে চলতেই থাকবে।
যেমন,
বিজ্ঞাপন বেশি আর্থিক মুনাফার জন্যে নারীর স্থান পাকা, তেমন যদি জাতির ভাবনায় হয়ে যায়,
তাহলে বুঝতে হবে যে, এই জাতি বেগম রোকেয়া পড়েছে। এবং শিক্ষা নিয়েছে। এবং তারপরও নারী
যে সামাজিক গাড়ির সেই দু –চাকার একটি, এবং অপরিহার্য। ফলে নারীকে নিয়ে নতুন ভাবনাকে
স্বাগত। সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হচ্ছে যে, মেয়েদের জন্যে সবই একটু করে আলাদা হয়ে যায়
বা রাখা। যথা, জন্ম থেকেই তার সূচনা, ভ্রূণ হত্যা। এ নিয়ে বিশিষ্ট বহুমুখী নাট্যশিল্পী
নির্দেশক সুরঞ্জনাদির কথা মনে পড়ে গেল। মানে মাধবমালঞ্চী কন্যা- সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত।
বলেছিলেন, "আমরা যাঁরা ভ্রূণে হত্যা হইনি...", তাঁদের মধ্যে তিনিও একজন।
এই যে বিষয় তা নিয়ে অগুণিত আলোচনা, এবং টিআরপি-যুক্ত আলোচনা হয়ে চলে। যেখানে, মেয়েদের
জীবনের সবকিছুই পরিমাপ করে কেমন যেন আলাদা। মেয়েদের ব্যবহারের গন্ধ হবে আলাদা।
মেয়েদের
ব্যবহারের রঙ একেবারে শিশুকাল থেকেই হবে গোলাপি বা হালকা নরমগোছের। যেন মেয়ে মানেই
ওই নরম পুতলের মতন্। এমনকি মেয়েদের জন্যে পুতুলগুলো আলাদা, আর মেয়েদের শেখান সমাজে
ব্যবহারের রীতি সব আলাদা। ফলে মেয়েদের পোশাক, মেয়েদের সাজ, চুলের ছাট, চলাবলা, ফেরা,
তাঁদের শিক্ষার পরিসর – সবই আলাদা। এমনকি যখন নারীশিক্ষার সূচনা হয়, তখন অভিজ্ঞ বিজ্ঞদের মতে ছিল যে, মেয়েদের জন্যে
গণিত, ভাষা প্রাথমিক ভূগোলের সঙ্গে সঙ্গে সেলাই শেখান হবে। সেটাই মেয়েদের সিলেবাস।
শুরুর দিকে ওইসময়ে এই বিষয় যে কত ঠুনকো তার প্রমাণ তো মেয়েদের বিএ পাশ করাতেই বোঝা
যায়। মেয়েদের পেশাদারি রোজগারের জন্যেও এই জাতীয় ধারণা ছিল। মেয়েদের জন্যে সংরক্ষণ
যদিও একদিকে মেয়েদের এগিয়ে দেওয়া। আবার অন্যদিকে তো মেয়েদের একুশ শতকে এসে গতিপথ বেঁধেও
দেওয়া বটে। আগের ধারণা থেকে মুক্তি এখনও মেলেনি মেয়েদের বিষয়ে। এগিয়ে যাওয়ার ছবি-বিজ্ঞাপন
পেরিয়ে পরিবার সমাজের অন্দরমহলে এলেই এই চিত্র প্রমাণ করতে কোন তথ্যসূত্র দিতে হবে
না। কারণ এ তো সর্বজনবিদিত মেয়েদের অবস্থান। এক্ষেত্রে মেয়েদের মহাভারত বেশ জাগিয়ে
তোলা নাম।
এবারে
থিয়েটারের বর্ণনায় আসা যায়। মেয়েদের মহাভারত দেখতে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ ছিল। এ আনন্দের।
আবার কপাল কুঁচকে দেওয়াও নয়? মেয়েদের যুক্ত হতেই মহাভারত পাল্টে যাবে? আসলে বিষয়টা
মহাভারত নয়, মেয়েদের, মেয়েদের-ই।
যথার্থ
নাট্যশিক্ষা পেয়ে তবে মঞ্চে এসেছেন কুশীলবরা। এটুকু বোঝা যায়। মঞ্চ আলোর এক স্বতন্ত্র
কাজ চলে নাট্য ঘটনার প্রবাহ ঠিক রাখতে। এটাও মিলে যাচ্ছে। এত কম খরচে মানে উপাদান ব্যবহার
করে মঞ্চসজ্জা ভাবায়। কারণ, মূল্য বৃদ্ধির বাজারে তো এরও মূল্য এক নাট্যদলকেই চোকাতে
হয়।
এমত
অবস্থায়, থিয়েটারের প্লট হল আসল। যেখানে সব পেরিয়ে ঘটনাগুলো এক মালার ফুলের মতন গাঁথা
হবে। যাঁদের মহাভারত পড়া বা দেখা, তাঁদের কাছে ঘটনা চেনা। কিন্তু প্রশ্ন হল একটা মঞ্চনাটকের
ঘটনা সব জানা হলেও, মেয়েদের জন্যে দেখব – ভেবেই প্রত্যাশী দর্শক।
মহাভারতের
পাঁচ নারী চরিত্র। নাট্যকার শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়-এর নতুন ভাবনা। নারী চরিত্রদের মধ্যে
প্রথমে মঞ্চে তাই অঙ্গনার প্রবেশ। সন্তানলাভের নিয়োগপ্রথা দ্বারা রানীকে মাতৃত্ব ধারণ
করতে হয়। এক্ষেত্রে রানী নিজে না এসে, তার দাসীকে পাঠিয়ে দেয়। এও জানা ঘটনা। নাট্যকারের
দৃষ্টিতে নতুন তাহলে অঙ্গনার সংলাপগুলো। প্রথমে 'অনাম্নী অঙ্গনা' মনে পড়ে গেল। মঞ্চে
প্রবেশ করে যখন প্রথম উপেক্ষিতা হয়ে থাকা চরিত্র অঙ্গনা। দাসী চরিত্রের রূপটি মনেহয়নি
নবভাবনা। কারণ বুদ্ধদেব বসু তো আগেই লিখেছেন। হ্যাঁ, সংলাপে দুই অঙ্গনা মেলে না ঠিকই।
তবে, ধারণাটা ওইখানে ফ্রিজ করে দেয় একটা আলপিনে গেঁথে দেয় চিন্তাকে। তাহলে নাট্যকার
পরের চরিত্র কী নিলেন। মঞ্চে আসে হিড়িম্বা।
মহাভারতের
ঘটনায় কিছু চরিত্র সাব-প্লট হয়ে থাকে। তারা নারী চরিত্র হলেও গৌণ ভূমিকা। নাকি তাদের
কালের প্রবাহে উপেক্ষিতা বলেই সম্বোধন করা হবে। আলোচ্য প্লট ধরলে নাট্যকার এর উত্তর
হিড়িম্বাকে দিয়ে বলিয়েছেন। ক্লাস ডিভিশন মানে জাতি ভাগ। মানে বর্ণ ভাগ। উচ্চবর্ণ নয়
বলেই হত্যা করতে আগে পাঠানো হয় ঘটোৎকচকে। এখানে স্ত্রী-হিড়িম্বা নিজের অবস্থান বলে
যায়। তার বর্ণ অনুসারে মহাভারতের যুদ্ধে তার সন্তানকে কৌশলে মেরে ফেলতে চাওয়া। এবং
বহুবিবাহের ফলে হিড়িম্বার প্রতি ভালোবাসায় পক্ষপাতিত্ব, যা নাটকের ঘটনার গতি ধরাতে
চায়।
দর্শক
উশখুশ করেছেন আর কিছুর জন্যে। রাধা মা আসে, কর্ণ আসে। জন্ম পরিচয় থেকে আলোচনা হয়। এখানে
লাল কাপড়ের ব্যবহার, লম্বা কাপড়ের ব্যবহার অতিরঞ্জিত এবং বাহুল্য বলেই মনেহয়। নাটকীয়তা
ক্রম- এক, মঞ্চে রাধার উপস্থাপনা, দুই, কর্ণের মৃত্যুর দৃশ্য, তিন, দুধের বাটি নিয়ে
যুদ্ধক্ষেত্রে পালিত মায়ের সন্তানের খোঁজ। উপেক্ষিতা রাধা মায়ের অবদান ভুলে সমাজের
উচ্চবর্ণে ঢুকে পড়তে চাওয়া কর্ণ পর্যন্ত ঘটে যায়। এদিকে দর্শক ভাবেন কিছু ব্যতিক্রমী
হবে কিনা? গান্ধারী-র চরিত্র মূল চরিত্রের মতনই থাকে। তবে, নাট্যঘটনায় গান্ধারীর সংলাপ
থাকে মহাভারতের প্রেক্ষিতেী। সব ঘটনা জানা, দেখা চেনা। শুধু নাট্যকার এদের কীভাবে উপস্থাপন
করতে চলেছেন, সেটাই অজানা। মঞ্চে নাটক মানেই মঞ্চনাটক। সেইসূত্রের অবকাশ থাকে না। কিন্তু
যা অনুপস্থিত তা হোল নাটকের প্রয়োজনীয়তা কতটা ছিল? মেয়েদের জন্যে তেল সাবানের বিজ্ঞাপনের
পাশে – এরকম একটা মহাভারত কী ভার লাঘবের? এসব প্রশ্ন উঠবেই। কারণ, মঞ্চে কুশীলবদের
পারদর্শিতা অন্যভাবে কাজে লাগানো যেত বলে মনে করার। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হতে থাকে মেকআপের
আধিক্য। যেন মঞ্চসজ্জার আধুনিক ভাবনার বিপরীত। যেখানে মহাভারতের সিম্বল এক রথের চাকা,সেখানে
কোন বাস্তবতার সন্ধানে মেকআপ, পোশাকের এই সাযুজ্যহীনতা। প্রশ্ন, যেহেতু এ মঞ্চনাটক,
তাই নির্দেশক ত্রুটি শুধরিয়ে নেবেন। নাটকের পাঁচ উপাদানের মধ্যে পোশাক অন্যতম। যেখানে
পোশাক প্রথমেই চিনতে সাহায্য করে চরিত্রকে। এই ত্রুটি একটি ২৮ বছরে পা দেওয়া নাট্যদলের
ক্ষেত্রে প্রশ্নের। বিশেষত আলোচ্য নাটকে মঞ্চসজ্জা, আলোর অনুষঙ্গ -- ভালো নাটকের ভাবনাকে
উসকিয়ে দেয়।
নির্ধারিত
মেয়েদের সূত্রে গাঁথতে চাইলেও, মহাভারতের এইসব চরিত্রদের তুলে ধরে নাটকে প্রয়োজনীয়তা
সমাজের জন্যে কতটা ছিল? আর থাকলেও সেই ক্রাইসিস উঠে এলো না কেন, নাট্যকারের কলমে। এই
নাট্যে অতিরিক্ত প্রাপ্তি হল নাট্যকার নিজেই নির্দেশক। এবং নাট্যকার নিজেই দর্শকের
উদ্দেশ্য বলেন, নাটকে সব বলা হয়েছে। ঠিকই কিন্তু নতুন কি পাওয়া গেল? প্রশ্ন মেয়েদের
নির্ধারিত বিজ্ঞাপনের মধ্যে এই নাটকের ভবিষ্যতে স্থান কেবলই কি নাট্যকারের নাটকরূপেই?
প্রশ্ন রইল।
নাটকের
অভিনয়ে থাকা কুশীলব হলেন, অনন্যা দাস, আরতি চৌধুরী, জয়িতা বসু, মালবিকা গুপ্ত, বৃষ্টি
সান্যাল, অরিত্রী বাড়ৈ, অরুণিমা আদক, জয়ন্ত চৌধুরী, মেহেবুব বিশ্বাস, সঞ্জীব দেবনাথ,
অভিনন্দন সিনহা, উদয় মণ্ডল ও সাগর। মেকআপ সঞ্জয় সামন্ত। আলো শান্তনু দাস। অঙ্কন পরিকল্পনা
শুভেন্দু সরকার। মঞ্চ সহায়তায় নজরুল হক। আবহ সুভাষ দে, নব কুমার, নির্মাল্য পাল। অনন্যা
দাসের গান্ধারী চরিত্রের অভিনয় সাবলীল। তবে রূপসজ্জা কুশীলবদের মঞ্চ-অভিনয়ের ভূমিকাকে
সাহায্য করে না। নিষাদ মায়ের অভিনয় দর্শক করতালিতে প্রশংসিত হয়। ভীম-এর স্ত্রী হিড়িম্বা,
রাধা মা চরিত্রের শিল্পীদের অভিনয় মনে থাকার।
_
ইতি
একুশ
শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী…
মৌ চক্রবর্তীর বিশ্লেষণ খুব জোরালো। যে প্রশ্ন তিনি তুলেছেন এই স্বল্পপরিসরের মধ্যে তা নাট্যামোদী দর্শকদের ভাবায়। তবে তিনি বলেছেন নাট্যকারের প্রয়াস প্রশংসনীয়। এরকম প্রয়াস আরও জারি থাকুক।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ জানবেন
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনThanks. Need your wishes Sir.
উত্তরমুছুনসুবিশ্লেষণ।
উত্তরমুছুনসুবিশ্লেষণ
উত্তরমুছুনপ্রীত _সম্পাদক
মুছুন