কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

হৈমন্তী রায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


হলদে স্কার্ফ

(১)

-কমলিনী, এমন আদ্যিকালের নাম এ হেন চঞ্চলার?

-অবাক হলেন? অবশ্য নতুন কিছু নয়, প্রথমবার যেই শোনে সেই দেখি অবাক হয়!

-শুধুই অবাক হয় যারা আমি সেই সবের দলে পড়ি না।

-তবে আপনি কোন দলে?

-আমি দলছুট! হতবাক, নাহ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি নামের আড়ালের ওই

-থাক, যা যা বলবেন, সেসব এতবার শুনেছি, এতই ক্লিশে আর নতুন করে শোনার ইচ্ছেই নেই।

-স্বাভাবিক। এমন রূপে মজেনি যে সে তো পুরুষই নয়। পুরুষে যদি রূপ দেখে সঠিক শব্দে তার যোগ্য গুণগান না করতে পারে তবে সে ওই জাতির নাম ডোবালো!

-কথা বেশ বলেন দেখছি। তা কথা বলার বাইরে আর কী কী করেন?

-ঘুরে বেড়াই। আর আপনি?

-নামার সময় হলো। আমার গন্তব্য এসে গেছে।

-চলে যাচ্ছেন? উত্তরটা জানার ইচ্ছে রইল। কোনোদিন পাব আশা করতে পারি?

-আশা? হ্যাঁ, তবে পূরণ হবে কিনা সময় জানে। আসি।

ঘুমটা ভেঙে গেল। আবার ওই স্বপ্ন। আজ তার পরনে ছিল ফেডেড ডেনিম, পীচ কালার্ড সর্ট লেন্থ টপ। ঠোঁটে নিউড শেড লিপস্টিক। কমলিনী! এই নাম প্রবাল আর শোনেনি। বইয়ে কমলিনীকে যদিও পড়া হয়েছিল তার।

(২)

এবারের ট্যুরটায় অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো প্রবালের। বর্ষার জঙ্গল, তার মায়াময় সৌন্দর্যের এক অদ্ভুত নেশা রয়েছে।

ক্যামেরায় যা বন্দি হলো, যা দুই চক্ষু দেখল তার কোনও তুলনাই কি হয়, না করা সম্ভব! অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এমন রাতের সংখ্যা নেহাত কম নয়!  ঘরের আলো নিভিয়ে প্রবাল মোমবাতি জ্বালালো। আজ ঝড় ওঠেনি! ইলেক্ট্রিকের বাতি অকেজো হয়ে জবাবও দেয়নি। এই রাতটাকে সেই চেনা রাতে বদলে দিতে ওই নরম আলোই তো প্রয়োজন! দরজায় টোকা পড়ল। ঠিক সেদিনের মত! সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরটা যেন কেঁপে উঠল প্রবালের। আর সেই মুখ, সেই কণ্ঠস্বর, ‘আসব?’

-বাবুজি ডিনার মে কেয়া লেঙ্গে?

-অভি কুছ নেহি। বরফ মিলেগা?

-হাঁ জি। সাথ মে ওর কুছ? চিকেন ফ্রাই লে আউঁ?

প্রবাল ছেলেটির দিকে তাকালো। ছোটু, বেশ সপ্রতিভ ঝকঝকে চোখ দুটো। বুদ্ধি আছে। বরফ শুনেই প্রবালের হাসি পায়।

ছোটুর আনা গরম গরম চিকেন পকোড়া আর ঠান্ডা পানীয়ের গেলাস টেবিলে সাজিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল সে। জানলায় চোখ যেতেই টিপটিপ শব্দের সঙ্গে পাতা চুঁইয়ে জলের ধারায় একটা আবছা মুখ ভেসে উঠল। এখন কী করছে সে? কোথায় রয়েছে? একা, নাকি সঙ্গে

হঠাৎ বিদ্যুত চমকালো! বাজ পড়ার শব্দ। নাহ, জানলাটা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। বৃষ্টির গতি বাড়ছে, বন্ধ না করলে সব ভিজিয়ে দেবে।

বিছানায় কেউ নেই, তবু মনে হলো সে আসবে, আজ!

-অপেক্ষায় ছিলেন?

-হ্যাঁ। আমার কিছু বলার ছিল, শোনার ছিল, জানার ছিল!

-এখন নয়। পরে শুনব না হয়।

প্রবালকে এভাবেই সে চুপ করিয়ে দেয়, যতবার আসে স্বপ্নে, যখনই কমলিনীকে সে কাছে পায়, হাজার কৌতুহল ঘিরে ধরে ওকে। কে এই কমলিনী?

মোমের আলোয় ওকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে! প্রবালের চোখ সরছে না! কোনো খুঁত নেই কেন? মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা সব, কী ভীষণ নিটোল নরম, আর ওই কন্ঠস্বর ও কি আদৌ মানুষ! প্রবালের আশ্চর্য লাগে। মানুষ এত নিষ্ঠুর কী করে হতে পারে?! মায়া নেই? এতটুকু দয়া হয় না কি? প্রবাল তলিয়ে যাচ্ছে দেখেও

সমস্ত শরীরটা প্রবালের হাতের মধ্যে, অথচ ওর মন ছুঁয়ে দেখার অধিকার নেই?

এই মুহূর্তটা যে ফুরিয়ে যাচ্ছে! একটু পরেই শেষ হয়ে যাবে। মরে যাবে!  অসহ্য কষ্ট নিয়ে রাতের পর রাত ছটফট করবে সে। কেউ জানবে না, এমন কি সেও কি জানে, প্রবাল তাকে এক মুহূর্তও ভুলতে পারে না। পারেনি। কতবার চেষ্টা করেছে ওই নাম স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে! কোনও ছবি নেই, যোগাযোগের উপায় নেই! সে কে, কোথায় থাকে, এমন কত প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। তবু ওই একটি রাতের স্মৃতি কী ভীষণ টাটকা। দগদগে কিচ্ছুটি ভোলার উপায় নেই।

তবে, তার সঙ্গে দেখা হয়। যেমন এই রাতে হলো। সে এসেছিল, এই বিছানায়! নীল শিফনের শাড়ি, খোলা চুলে, তারপর একেএকে ওর সবটুকু উজাড় করে, প্রবালকে কাঙাল বানিয়ে ভোরের আলোর সঙ্গে মিলিয়ে গেল!

(৩)

বাস থেকে নেমে একটা অটো ধরল প্রবাল। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। বিকেল সাড়ে চারটে টাইম দিয়ে এখন প্রায় পৌনে ছটা!

-কিরে, কথা বলবি না? কতবার সরি বলব?

পার্কের বেঞ্চে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চুপচাপ বসে আছে বিদিশা। সেই স্কুল বেলার বন্ধু দুজনে। বেস্ট ফ্রেন্ড!

-কেন ডেকেছিস সেটা তো বল! কী হয়েছে? তুই কি কাঁদছিস নাকি? ওই এদিকে তাকা।

বিদিশা প্রবালকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে।

-ও চলে গেল, জানিস! সবটা শেষ করে দিয়ে!

-আমি আগেই তো তোকে বলেছিলাম। সাবধানও করেছিলাম। তুই

আবার কাঁদে দেখ! আরে, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।

-আমি তো ওকে আগেই সবটা জানিয়েছিলাম। কিচ্ছু লুকোইনি। তবু

-এত এক্সপ্ল্যানেশন দিচ্ছিস কেন? ও কোনোওদিনও তোকে ভালোবাসেনি। তাই চলেযেতে পেরেছে! ভালোবাসলে ছেড়ে যাওয়া যায় কি? দেখি মুখটা দেখি। ইশ, তোকে যা বিচ্ছিরি দেখতে লাগছে!

-মার খাবি।

-আচ্ছা বেশ। মার, দাঁড়িয়ে আছি। তবে এতগুলো লোকের সামনে এই ছয় ফুট দু ইঞ্চির দামড়া ছেলে একটা পুঁচকি মেয়ের হাতে মার খাচ্ছে এমন বিরল দৃশ্য দেখতে জনতা ভিড় করতে পারে কিন্তু!

চোখের জলে ভেজা মুখটায় এক টুকরো হাসি ছুঁয়ে যেতেই প্রবালের বড় শান্তি হলো। বিদিশা, ওর বিডস, এত নরম মন মেয়েটার, সে কিনা ওই লম্পট সৌগতর ফাঁদে পড়ল। কতবার প্রবাল ওকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই যে মোহ!

সময় ওকে ঠিক সামলে নেবে। আসলে সময়ের অপরিসীম ক্ষমতা। সব ক্ষত একটা সময় পর সেরে যায়! যায় কি? এই যে কমলিনী নামের ক্ষত বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে সে, তার থেকেও ঠিক মুক্তি হবে? বিদিশার জন্য বড্ড খারাপ লাগে আজকাল। কেমন চুপচাপ, মনমরা থাকে মেয়েটা। কী করে ওকে একটু ভালো রাখা যায়!

-কেমন আছে সে?

-ভালো নেই।

-একদিন বাড়িতে নিয়ে আয় না? কতদিন মেয়েটাকে দেখিনি।

-আনব। একটা কথা বলব? আবার রাগ করবে না তো?

-কী কথা?

-ওকে যদি বিয়ে করে নিয়ে আসি?

-এ তো আমার মনের কথা রে।

-জানি তো! তবে ওর একটা সমস্যা রয়েছে মা।

-কী সমস্যা? ওই সৌগত? ওসব ভাবিস না। বিদিশা বড় ভালো মেয়ে বাবু।

-জানি। তবে

-কী?

-থাক। আগে দেখি তার কী মত? বউ হতে রাজি হোক!

মা ছেলের হাসিতে খাবারঘরটা গমগম করে উঠল।

(৪)

কীভাবে যে কথাটা শুরু করবে, একটু হাসিও পাচ্ছে নিজের অবস্থা দেখে। শেষে কিনা বিদিশাকে সে প্রপোজ করবে!  মেয়েটা শুনে নির্ঘাত ভাববে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

দূর থেকে বিদিশাকে দেখতে পেল সে। আনমনে হেঁটে আসছে ওর দিকে। শান্ত, ধীর, পরনে কালো প্রিন্টেড লং স্কার্ট আকাশী রঙের কুর্তি। মুখে কোনও প্রসাধনের প্রলেপ নেই, এমন কি হাল্কা লিপস্টিক ও না। চোখ বসা, দেখেই বোঝা যায় কত রাত মেয়েটা ঘুমোয় না। বিডস ওর বিডস। নাহ, আর নয়। এভাবে ওকে শেষ হতে দেবে না সে।

-কফিটা তো কোল্ড ওর্ডার করলেই হতো। গরম কফি ঠান্ডা জল করে গেলার কী আছে?

-তুই জানিস, কি বলছিস?  আমাকে তুইও শেষে দয়া দেখাবি?

-তোর তাই মনে হলো? এতক্ষণ ধরে আমি যা যা বললাম, সব দয়া দেখানোর জন্য?

-আমি তোকে সারা জীবনেও যদি ভালোবাসতে না পারি?

-তোর ভালোবাসা কে চেয়েছে?

-তবে বিয়ে করবি কেন? কী পাবি?

-তোকে। এই যেমনটা তুই, ঠিক তেমনটা। ভাঙাচোরা, ছিচকাঁদুনে পাগলীটাকে।

-তুই ও তো আমায় ভালোবাসিস না। সত্যি করে বল। বাসিস?

-জানি না। ভালোবাসা চুলোয় যাক! আমি জানি তুই ভালো না থাকলে আমি ভালো থাকি না, আমি ভালো না থাকলে তুই ভালো থাকিস না। আমরা ভালো বন্ধু বিডস। দু’জন দুজনকে পুরোটা চিনি। এটুকুই যথেষ্ট আমার কাছে।

-আর আমি যে কোনওদিন

-থাক না। এবার বল, বিয়ে করবি আমায়?

ছ’মাস হয়ে গেল ওদের বিয়ে হয়েছে। বিদিশা বেশ গিন্নীপনা করতে শিখেছে, মায়ের সঙ্গে ওর এত ভালো বন্ডিং দেখে প্রবালের বড় আনন্দ হয়। সব ঠিক হচ্ছে আস্তে আস্তে। আজকাল রাতে বিদিশা ওকে না জড়িয়ে ঘুমোতে পারে না। প্রবালেরও ওকে ছাড়া কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ভালোবাসা কাকে বলে এই নিয়ে হাজার দ্বন্দ্ব, হাজার তর্ক চলুক। প্রবাল জানে মায়ার এক অদ্ভুত বাঁধন আছে, যাকে কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা ওদের দুজনেরই বোধহয় নেই, বরং এই বাঁধনে আরও নিজেকে জড়িয়ে নিতে বেশ লাগছে।

-জঙ্গল?

-না, পাহাড়।

-কোথায় যাবি?

-বিশেষ নাম নেই এমন কোনও ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যাবি?

-যথা আজ্ঞা দেবী।

বিদিশা প্রবালের বুকে মুখ লুকোয়। ওর মাথায়, চুলে প্রবালের আঙুল ছুঁলে আদরে বিদিশার চোখ বন্ধ হয়ে আসে!

(৫)

ও কে? এই অনামী পাহাড়ের কোলে ওই মুখ! নাহ, জানতেই হবে। এত মিল!

-কী হলো তোর? রাস্তাতেই লক্ষ করেছি। কী হয়েছে পল?

-একটা মুখ

-কার মুখ?

-কাল একটা জায়গায় যাবি?

-কোথায়?

-না বললে যাবি না?

-ওমা, যাব না কেন। তবে, তোকে বড্ড অস্থির লাগছে। বল না বাবা, কী হয়েছে? পল

-আমাকে একটু একা ছাড়বি? বলব, তোকেই তো বলব। আজ বলব তার কথা।

-আচ্ছা। আমি বরং বইটা শেষ করি। তুই রেস্ট নে।

-বিডস, তুই কি কষ্ট পেলি?

-নাহ। আমি তোকে চিনি তো। থাক, একটু একা থাক। আমাদের সকলেরই মাঝে মধ্যে একা হতে হয়। হতেই হয়।

প্রবাল দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ঘরে বিদিশা, বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে। আর প্রবাল? আশেপাশের পাহাড়টা সেই জঙ্গলের গাঢ় সবুজের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে!

-এখানে? আপনি?

-কেন? আসতে পারি না?

-নাহ, তা নয়। আসলে এটা তো ঠিক জনপ্রিয় বেড়ানোর জায়গা নয়। লোকজন বড় একটা আসে না।

-আপনি তো এসেছেন।

-আমি তো এমন সব জায়গাতেই ঘুরে বেড়াই। ভালো লাগে।

-কোথায় উঠেছেন? একটাই তো ঠিকঠাক জায়গা এখানে।

-ওখানেই।

-হোয়াট আ কোইনসিডেন্স! জানেন, ক’দিন ধরে আপনাকে এত মনে পড়ছিল! আর এখানে এভাবে

-এখানটা বড় নির্জন, সুন্দর। এখানে চুপ করে বসে থাকতেই ভালো লাগবে, বসি?

প্রবালের স্বপ্নের মতো লাগছে! কমলিনী! তার পাশে, ওর চুলের গন্ধ, ওর হাতের আঙুল, ঠিক প্রবালের হাতেরপাশটায়। মুখটায় কী যে রয়েছে! প্রবাল তার বুকের স্পন্দনের গতি অনুভব করছে বেশ! তার মুখ দেখে কি কমলিনী কিছু টের পাচ্ছে! দুর্বলতাটুকু যেন চেহারায়, কণ্ঠস্বরে ধরা না পড়ে। এই মেয়ের সামনে সে কিছুতেই হার স্বীকার করবে না।

-কোনও কথাই কি বলা চলবে না? কিছুই তো জানা হয়নি।

-কী জানবেন? কী জানা হয়নি?

-কে আপনি?

-কমলিনী।

-এটা একটা উত্তর হলো?

-আমি তো কমলিনীই।

-কে কমলিনী? কী করে? কোথায় থাকে?

-চাকরি দেবেন নাকি?

কমলিনী হেসে উঠল।

-মানে?

-এত জেনে কী করবেন?

-মানুষ মানুষকে কি চিনতে চাইতে পারে না? এটা কি খুব অস্বাভাবিক?

-নাহ। তবে আমি যে স্বাভাবিক নই। অন্যরকম, এলোমেলো। চলুন ওঠা যাক। আবার বৃষ্টি শুরু হলো।

(৬)

বৃষ্টির গতি ক্রমশঃ বাড়ছে। নাহ, মোমবাতি হাতের কাছেই রাখা ভালো। যেভাবে বাজ পড়ছে, কখন যে পাওয়ার কাট হয় তার ঠিক নেই। প্রবাল অস্থিরভাবে পায়চারী করছে ঘরটায়। এত খারাপ লাগা কিসের?  সে যখনচায় না, তাকে নিয়ে প্রবালও আর ভাববে না। মাত্র দুবার দেখা হয়েছে ওদের। প্রথমবার ট্রেনে, আর আজ জঙ্গলে। ভাবতেও কেমন লাগে, অচেনা ওই মেয়েটা কীভাবে প্রবালের মাথার ভেতর ঢুকে পড়ল, কে জানে! হয়ত কখনও প্রবালকে তার মনেও পড়ে না। মনে পড়ার মত কোনো স্মৃতিও তো তৈরী হয়নি। বড্ড ছেলেমানুষি হয়ে যাচ্ছে। এটা কি তাকে মানায়?

পাশের ঘরটায় কমলিনী। নির্ঘাত নিশ্চিন্তে বৃষ্টি উপভোগ করছে। আর প্রবাল বোকার মতো ছটফট করে মরছে। ধুর, যত্তসব ফালতু ভাবনা। ব্যাগ থেকে পছন্দের পানীয়ের বোতলটা বার করে টেবিলে রাখল সে। ঘুম যখন আসবেই না

যা ভয় হচ্ছিল, পাওয়ার গেল। মোমবাতিটা জ্বালিয়ে বসল প্রবাল। দরজায় এখন আবার কে টোকা দিচ্ছে? ডিসগাস্টিং!

-একি, আপনি?

-আসব?

-আসুন। কিছু চাই? মোমবাতি

-না না, কিছু চাইতে আসিনি। এমনিই, অসুবিধা থাকলে ‘না বলতেই পারেন। চলে যাব।

প্রবালের মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কী চায়? মোমের আলোয় ওকে কী অনন্য সুন্দর লাগছে। বাইরে ভেতরে অঝোরে বৃষ্টি। প্রবাল আজ কীভাবে নিজেকে সামলাবে?

-ঘুমোবি না?

বিদিশা কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে প্রবাল খেয়ালই করেনি।

ওর চোখদুটো কী শান্ত! ঠান্ডা কুয়াশার মতো, ঢেউহীন ঝিলের মতো!

প্রবালের বুকের ভেতরেটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে, আজ যে ঘুম আসবে না। প্রবাল জানে, যে ক্ষতটা সময়ের প্রলেপে শুকিয়েছে ভেবেছিল, আজ কে যেন সেখানটায় খুঁচিয়ে চলেছে। এতে কারুর হাত নেই। কাউকে ভোলা বা না ভুলতে পারায় কি সত্যিই কারুর হাত থাকে? অসহায় হতে হয়, যন্ত্রণায় নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়।

বিদিশার বুকে মুখ গুঁজে চুপচাপ শুয়ে প্রবাল। আজ সে বলবে। বিডস কে আজ সে বলবে তার কথা।

(৭)

পাহাড়ের কোলে কচিকাচাদের মাঝে বিডস, হাসিমাখা মুখটা বড্ড মায়াময়! সুন্দরী বলতে যেমনটা লোকে বোঝে, বিডস তেমন নয়। ও যেন নরম বিকেলের আলো, উত্তাপ নেই, সন্ধ্যে নামার ঠিক আগের মুহূর্তের মত, লক্ষ করলে চোখ জুড়োবে, অবজ্ঞা করলে সে রূপ দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতই থাকবে তুমি। আজ ওকে ভোরের সূর্যের মত লাগছে, স্নিগ্ধ, নির্মল। প্রবাল কতবার যে অবাক হয়েছে বিদিশার এই সরলতা দেখে! স্বার্থের নোংরা দুনিয়ায় ওর বিডস একটু বেমানান। অগোছালো মনটা নিয়ে যখন ও প্রবালের কাছে আসে প্রবালের বড় শান্তি হয়!

-কিরে? রাজি তো?

-হ্যাঁ। তবে অফিসিয়াল কাজগুলো মিটতে কদিন সময় লাগবে। কিছু ডকুমেন্ট পাঠাতে হবে। ভেরিফিকেশনস, এইসব।

-বিশ্বাস হচ্ছে না জানিস! এখানে যে এমন কিছু পেয়ে যাব ভাবতেই পারিনি।

-হুম।

কমলিনীকে কোলে নিতেই ও প্রবালের গলাটা জড়িয়ে ধরল। বিদিশা এই মুহূর্তটা ক্যামেরায় না বন্দি করে পারল না! অমনি মেয়ে বাবার কোল ছেড়ে মায়ের আঁচলে!

-একি! আমাকে ফেলে মায়ের দিকে?

-হুম, মা বেশি ভালো।

প্রবাল হাসতে থাকে।

-তুই জিতে গেলি বিডস।

-তা বটে!

বিদিশার মুখে দুষ্টুমির হাসি।

মা হওয়ার মত শারিরীক ক্ষমতা নেই বলেই কি ওর মনে মাতৃত্বের এক চোরা স্রোত বইত? কে জানে! প্রবালের কাছে যখন শুনল কমলিনীর কথা, ওকে দেখার তীব্র আকাঙ্খায় ছটফট করছিল বিদিশা। প্রথম যখন ছোট্ট কমলিনী ওর সামনে এল বিদিশার বুকে সেই স্রোতের বাঁধ ভাঙা প্লাবন এল যেন!

নাহ, প্রবালের হারিয়ে যাওয়া রহস্যময়ী কমলিনী এ নয়। ছোট্ট নিস্পাপ বছর আড়াইয়ের অনাথ শিশুটিকে পাহাড়ি গ্রামটার অনাথ আশ্রমের বাকি বাচ্চাদের সঙ্গে দেখেছিল প্রবাল। কাছের পার্কটায় বেড়াতে এসেছিল ওরা, রোজই  খেলতে আসে এখানে। প্রবাল আর বিদিশাও সেদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ কে যেন ডেকে ওঠে ‘কমলিনী। নামটা শুনেই প্রবালের চোখ পড়ে বাচ্চাটার দিকে। যেন ছোট্ট কমলিনী ওর সামনে! সেই মুখের আদল, সেই চোখ, সেই হাসি! কী অদ্ভুত মিল! খোঁজ নিয়ে সিস্টারের থেকেই জানে কমলিনীর গল্প। অ্যাক্সিডেন্টের পর রাস্তার ধারে ওকে কুড়িয়ে পায় লোকাল পুলিশ। সঙ্গের মহিলা স্পট ডেড! কোনও পরিচয় পাওয়া যায়নি, কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি কখনও। বাচ্চার গায়ে জড়ানো হলদে স্কার্ফে শুধু একটা নাম, ‘কমলিনী! আশ্রম কর্তৃপক্ষ সেই নামেই ওর নামকরণ করেন, হয়ত অতীতের ছোঁয়াচ ওর জীবনে রেখে দিতেই! সেই থেকে পরিচয়হীন শিশুটির ঠিকানা হয়ে যায় ওই আশ্রম।

প্রবাল আর বিদিশার অপূর্ণ জীবনে সে সবটা ভরিয়ে দিয়েছে কানায় কানায়। কেউ জানে না প্রবালের কমলিনীর সঙ্গে এই শিশুর আদৌ কোনও সম্পর্ক রয়েছে কিনা, জানা সম্ভবও নয়। তবু, ওই হলদে স্কার্ফের ওপর লেখা নামটায় হাত রাখলে কেন জানিনা প্রবালের মনে হয় কমলিনীকে ছুঁয়েছে সে! তার আদরের কমলিনীর মুখ দেখলেই মনে হয় কোথাও যেন সেই রহস্যময়ীর হাসি লুকিয়ে রয়েছে এই মুখেই। সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়! বিডস আর পল, ওদের ভালোবাসার বন্ধন হয়েই রযে যাবে কি কমলিনী?


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন