কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


চশমাগুঁড়ো

আমি তাঁর দোকানে ঢুকে খুব সাবধানে খবরের কাগজের পুঁটলিটা তার দোকানের টেবিলের উপর রাখলাম। তারপর খুব সাবধানে সেটা খুলে তার ভেতরের বস্তুগুলো ওনাকে দেখালাম।

উনি চোখের চশমাটা নাকের ডগায় টেনে এনে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেগুলো দেখলেন। তারপর ঘন ঘন মাথা নেড়ে নিজের অক্ষমতা জাহির করে বললেন।

- উঁহু। I can't understand. এগুলো কি?

- চশমা।

ভদ্রলোক আবার নিজের চশমাটা নাকের ডগা থেকে নিজের চোখে ঠেলে তুলে দিলেন এবং আমার দিকে তীক্ষ্ণ  দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভয়ানক অবাক গলায় বললেন।

- চশমা! এগুলো চশমা?

- ঠিক চশমা নয়। চশমাগুঁড়ো।

- চশমাগুঁড়ো? How strange! আপনি খামোকা চশমাগুঁড়ো করতে গেলেন কেন? চশমা কি গুঁড়ো করার জিনিস? চশমা কি হলুদ? না গরম মশলা?

- আমি করিনি তো। গিন্নী করেছেন।

- আহা তিনিই বা চশমা গুঁড়ো করতে যাবেন কেনো? চশমাগুঁড়ো আবার কোন্ রান্নার রেসিপিতে লাগে? কখনো শুনিনি তো!

- আমিও শুনিনি। তবে এটা ষোলোআনা সত্যি। এটা চশমাগুঁড়ো, আর গুঁড়োটা উনিই করেছেন।

- উনি কি পাগল?

- কি বললেন!? ভাগ্যিস উনি কাছে নেই। থাকলে চশমার মতো আপনাকেই গুঁড়ো করে দিতেন।

ভদ্রলোক পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের মুখটা মুছে নিলেন। তারপর বললেন।

- You must tell me the whole story. I must know the গোটা ব্যাপার।

- সময় লাগবে।

- আমার তাড়া নেই।

- আমারও তাড়া নেই।

আমি চেয়ারে আরাম করে বসে বললাম।

- চা বলা যায়? মানে দামটা আমিই দেবো।

- না না। তা কেনো। আমি দাম দেবো।

এই নিবারণ দুটো চা দিতে বল। তা কেমন চা? উইথ চিনি, উইথ আউট চিনি?

- আধা চিনি। মানে half tea spoon full sugar.

- OK.

- নিবারণ শুনেছো তো! দুকাপ চা। আমারটা আমার মতো। ওনারটা ওনার মতো। সাথে?

শেষেরটা আমাকে প্রশ্ন।

- বিস্কুট হলেই চলবে।

- ঠিক আছে নিবারণ, দুটো করে থিন আরারুট।

নিবারণ নিষ্ক্রান্ত হলে উনি বললেন।

- নিন শুরু করুন। চশমাগুঁড়োর ঘটনাটা আমার আগাগোড়া জানা দরকার। So start একদম শুরু থেকে।

- শুরুতে তো ভোরবেলা হলো। ধপাস করে ব্যালকনিতে শব্দ হলো। তার মানে নকুল খবরের কাগজের গার্ডার জড়ানো বান্ডিলটা ছুঁড়ে ব্যালকনিতে ফেলে দিয়েছে। আমার জন্য বিছানা ছাড়ার ওটাই স্যিগনাল। আমি পা টিপে টিপে উঠে পড়েছিলাম। You may ask why পা টিপে টিপে? কারণ আমি চাই না শব্দ হোক। এবং গিন্নীর সকালের sweet sleepটা ভেঙ্গে যাক।

ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি not big but স্লাইট সব্বোনাশ। টবের রজনীগন্ধার ডাঁটিগুলো একপাশে অনেকটা হেলে পড়েছে। তবে ভাঙ্গেনি।

That means not much damage done.

ঝুঁকে পড়ে দেখে বুঝে নিলাম। This slight disorder can be easily rectified.

তাই করলাম। ভুলটা আমারই। রজনীগন্ধার ফুলসহ ডাঁটিটা যখন এতোটা উঁচু হয়ে গেছে, তখন টবটাকে সরিয়ে রাখা উচিত ছিল। তাহলেই সেটা নকুলের নিউজ পেপার মিসাইলের ট্রাজেকটরির বাইরে থাকতো। আজ রাতে অতি অবশ্যই সেটা করে রাখতে হবে। এখন শুধু টবটা ঘুরিয়ে দিতেই হেলে পড়া রজনীগন্ধার ফুলসহ ডাঁটিটা ব্যালকনির রেলিংএর গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি পড়ে থাকা নিউজ পেপারের বান্ডিলটাকে তুলে নিলাম।

আমি একজন নিষ্ঠাবান সুগভীর সংবাদপত্র পাঠক। সকালে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাগজ পড়ি। From head line to foot note including বিজ্ঞাপন।

একবারে একটানা এতোটা সম্ভব হয় না। তাই এটা আমি ধাপে ধাপে করি। এবং করি বিভিন্ন লোকেশনে। ইজিচেয়ার থেকে শুরু করে টিভির ঘরের সোফা পর্যন্ত। শুধু জায়গা বদলের প্রয়োজনে নয়। আরো নানা কারনে আমার নিরবিচ্ছিন্ন সংবাদ পত্রপাঠ কখনোই সম্ভব হয় না। যদিও আমাকে বলা হয় ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো। কিন্তু এই সংসার ঘন ঘন ছাই ফেলার দরকার পড়ে। আর I am the ভাঙ্গা কুলো বারবার ব্যাবহৃত হই। গাছে জল দিচ্ছেন গিন্নী, ঝারিতে নল থেকে জল ভরে দাও। ছাদে ভেজা কাপড় মেলে দিচ্ছে মালতী, তার সাথে ঘুরে ঘুরে ক্লিপ লাগাও। উঁচু তার বেঁটে মালতীর হাত যায় না। রাজেন রুবুর জুতো পালিশ করে ফিতে পড়িয়ে দিয়েছে। সেই ফিতের লেন্থ এডজাস্ট করে দাও। যাতে সবকটা প্রান্তের লেন্থ সমান সমান থাকে। এবং যতোবার ডোরবেল বাজবে ততবার উঠে দরজা খুলে দাও। এবং চাপা গলায় চেঁচিয়ে জানিয়ে দাও কে এসেছে। চাপা গলায় চেঁচাতে হবে, কারণ ওটাই atiket. এরকম সব ছাই ফেলার যাবতীয় কাজ exclusively done by me, the one and only ভাঙ্গা কুলো in this hous.

নাতি রুকুর বয়স ছয়। কিন্তু সে নয় ছয় করতে ওস্তাদ। আমায় খুব ভালোবাসে কিন্তু সবার ধারণা আমার সঙ্গে বেশি মিশলে ও একদম spoil হয়ে যাবে।

এতো দূর পর্যন্ত বলা হয়েছে, নিবারণ মারফতে চা বিস্কুট এসে গেলো।

চায়ে চুমুক দিয়ে উনি বললেন।

But why you are telling story of ভাঙ্গা কুলো? I want to listen the story of ভাঙ্গা চশমা. Sorry not ভাঙ্গা but গুঁড়োচশমা।

চায়ে চুমুক দিয়ে আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম।

- আসছে। সেসবও আসছে। One after another.

- আমার নাতি রূবুর সব কিছু ভালো। তবে ঘরের লোকের মতে, ওর একটাই মারাত্মক দোষ। ও মোট্টে খেতে চায় না। ওকে খাওয়ানোর দায়িত্বটা আবার exclusively আমার গিন্নীর। উনি অসীম ধৈর্য, অনেক ছোটা ছুটি, অনেক আদর, অনেক ঘুষ ঘাস এবং অনেক বকাবকি ইত্যাদির সহযোগে তাকে খাওয়ান। তাতে ঘন্টা খানেক লাগেই। কখনো তারও বেশি।

সেদিনো তিনি সেই food input সংগ্রামই করছিলেন। আমি তখন সোফায়। আমি তখন খবরের কাগজে নিমগ্ন। ডোরবেল বাজলো। খবরের কাগজটা হাত থেকে নামাতে হলো। এমনিতেই আজকালকার নিউজ পেপারে প্রচুর পাতা। এটা আবার রবিবারের, তাই পাতার সংখ্যা তিনগুণ। আমি কতো দূর পড়া হয়েছে সেটার পেজ মার্ক দিতে আমার চশমাটাকে ইউজ করলাম। তারপর চশমার পেজমার্ক সহ পেপারটা সোফার উপরে রেখে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখলাম অচেনা নতুন লোক। হাতে একটা ছোটো প্লাস্টিকের ওল্টানো ছাতা মতো বস্তু। চটপটে সে  ছোকরা বললো।

- uncle আমি সানি। Home global এর door to door campaigner.

- তা আমাদের doorএ তোমার কি দরকার?

- আমি বলতে এসেছি আপনারা ডিসটা পাল্টান।

- Why? আমার কোমরের ডিস তো ঠিকই আছে। X ray রিপোর্ট একদম Ok.

- না না uncle। Not that disck. আমি বলছি TVর dish এর কথা।

- তাও বা কেনো? আমাদের টিভির ডিস তো দিব্যি কাজ করছে। পরিষ্কার ছবি। ক্লিয়ার সাউন্ড।

- কিন্তু সেটা তো বিইইইগ।

ছোকরা দু হাত ছড়িয়ে bignessটা বুঝিয়ে দিল।

আর আমাদের এই ডিসটা দেখুন। কেমন কিউট। স্মল আর স্লিম।

- তাতে কি?

- আপনার কি স্লিম ফিগার ভালো লাগে না। তাছাড়া জোরে হাওয়া দিলেই বড়ো ডিস টলমল করে। খুব জোরে হাওয়া দিলে তো ভেঙ্গেও পড়ে।

আমাদের স্মল এন্ড স্লিম ডিসে সে সবের ভয় নেই।

ভেতর থেকে গর্জন শোনা গেলো।

- কে এসেছে? দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে আড্ডা মারছো?

এই এই এই রূকু। আর আমি ছুটতে পারছি না।

দ্বিমুখী বান।

একটা আমার জন্য আর একটা  নাতি রূকুর জন্য।

সানি ফ্রম হোম গ্লোবাল উঁকি দিয়ে ওনাকে দেখে নিয়ে বললো।

- Uncle আমি না Fit and fine এর সাথেও যুক্ত আছি। Fit and Fine Unisex gym। বৌদি চাইলে যেতে পারেন। Good gym. আমাদের USP হচ্ছে। Quick result Less charge. বৌদি bigger figer থেকে right figureএ ফিরে আসবেন। With in 15 days.

- Wow. এ Sunny তো দেখছি একজন রিয়েল সেলস ম্যান। এক সাথে একাধিক প্রোডাক্ট নিয়ে ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন করছে। এবং কি সুক্ষ তার বাস্তব বুদ্ধি। আমি uncle! গিন্নী কিন্তু  বৌদি।

কিন্তু গিন্নী কিছু না শুনেই বলে দিলেন

- লাগবে না বলে দাও। আর চলে এসো।

এদিকে ওনার দুটো থিন এরারুট বিস্কুটই শেষ। কথা বলছি বলে আমার এখনো দেড় খানা বাকি।

উনি আবার অধৈর্য হয়ে বললেন।

- এতো আবার ডিসের গল্পো শুরু করে দিলেন আপনি। চশমা কোথায়?

- ঐ তো বোল্লাম নিউজ পেপারের ভাঁজে।

ওনার টেবিলের ওপরে রাখা নিউজ পেপারটার এক কোনা তুলে দেখিয়ে বললাম। এই দেখুন আজকের ডেট। এটাই তো সেই নিউজ পেপার।

তারপর আমি স্টোরিতে ফিরে গেলাম।

গিন্নীর নির্দেশ মেনে ক্যাম্পেনার সানিকে বিদেয় করে দরজা এঁটে দিয়ে ঘরে ফিরে দেখলাম গিন্নী সোফার উপরে আমার রেখে যাওয়া নিউজ পেপারটার উপর বসে আছেন। তার এক হাতে একটা পাত্রে রুকুর পরিজ। আর এক হাতে একটা চামচ। তাতেও পরিজ। রুকু নাগালের মধ্যে এলো তিনি উঠছেন। রুকু ছুটে নাগালের বাইরে গেলো। তিনি ধপ করে বসে পড়ছেন। তার এরকম ওঠা বসা নিশ্চয় অনেকক্ষণ ধরেই চলেছে। আর তার end result এই চশমাগুঁড়ো।

গিন্নী মানেন না কিন্তু truth is that. ওনার বর্তমান ওজন একশো বিশ কেজি। কদিন আগে অনেক পটিয়ে পাটিয়ে একটা ওজন মাপার মেশিনের ওপর ওনাকে তোলা গেছিলো। টিকিটে পরিষ্কার একশো বিশ লেখা। উনি টিকিটটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বলেছিলেন। খালি এক পিঠ দেখলে হবে? এ পিঠে যে জিরো ফিগারের করিনা কাপুরের ছবি রয়েছে সেটাকে কেনো বাদ দিচ্ছো। সিদ্ধান্ত তো দু পিঠ দেখেই হবে।

সে যা হোক একশো বিশ কেজির হামাম দিস্তায় গুড়ো করলে চশমা তো এরকমই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। এমন গুঁড়ো গুঁড়ো যে একদম beyond recognition. আপনি চশমার দোকানি হয়েও চিনতে পারলেন না।

এতক্ষণে উনি হাঁফ ছেড়ে হাসলেন। অবশেষে চশমা গুঁড়োর রহস্য জানা হয়ে গেছে তার। কৌতুহল নিবৃত্তি হয়েছে।

কিন্তু তারপরেই পরবর্তী তীব্র কৌতুহল নিয়ে আমায় বললেন।

- কিন্তু কিন্তু কিন্তু!

এই চশমা গুড়ো নিয়ে why you came to my shop?

- মানে যদি এটার কিছু একটা করা যায়?

- Impossible.আমরা ভাঙ্গা চশমা রিপেয়ার করি। গুড়ো চশমা রিপেয়ার করার সাধ্য আমাদের নেই।

- এটা তো আমিও জানি। কিন্তু গিন্নী বললো। কুন্তল বাবুর কাছে নিয়ে যাও। উনি নিশ্চয় কিছু একটা করে দেবেন?

- এ্যাঁ। আপনার গিন্নী আমাকে চেনেন? Who is she?

নাম বোললাম। উনি চমকে উঠলেন।

তারপর মাথা টাথা চুলকে বললেন।

- আপনি ও ফুটের ঐ দোকানটাতে চলে যান। ঐ যে ঘুড়ি লাটাই ঝুলছে। সেই দোকানটাতে। ওদের কাছে কাঁচ গুঁড়ো পাওয়া যায়। ওদের জিজ্ঞেস করে আরো খানিকটা কাঁচ গুড়ো কিনুন। মান্জা বানাবার বাকি সরঞ্জামগুলোও কিনুন। সাথে ঘুড়ি লাটাই সুতো সব কিনুন। মান্জা দিন। নাতি রুকুকে সাথে নিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রোগ্রাম করুন।

এটাই solution.

পরামর্শটা আমার মন্দ লাগলো না।

- ইয়ে। মানে আমার চশমার কি হবে? ওটা না হলে তো নিউজ পেপার পড়তে পারবো না।

- আরে ঘাবড়াচ্ছেন কেনো? আমাদের মুল ব্যাবসা তো চশমারই। ফ্রেম লেন্স বোথ। আজ এখন ফ্রেমটা পছন্দ করে দিয়ে যান। পরে পাওয়ারটা দিয়ে যাবেন। হোয়াটসঅ্যাপ করলেও হবে। দুদিনেই আপনার নুতন চশমা রেডি।  Power same - different frame.

দোকান থেকে বের হবার সময় উনি আমায় কাছে ডেকে বললেন।

- ঘুড়ি মাঞ্জার পরামর্শটা যে আমার দেওয়া সেটা don't disclose. বৌদিকে সেটা বলার দরকার নেই।

হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করলাম।

তা আর বলতে। তাতে যে চশমা গুঁড়োর মতো দোকান গুঁড়োর সম্ভাবনা আছে, সে আমি জানি। মনে হয় উনিও জানেন। দোকান গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া সেও তো কম মারাত্মক ব্যাপার নয়!

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন