কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২০


অনল

রাস্তায় অর্ধেক পোস্টে আলো নেই। আলো লাগালেই দু’তিনদিন বাদেই চুরি হয়ে যায়। অনল নামটা তার বাপ রেখেছিল। কী জন্য এ নামটা রেখেছিল তার বাপ, সে তার বাপও জানত না।

'সবসময় বাপ বলিস কেন! বাবা বললে কী হয়?' মা ঠোঁট চেপে বলে মাঝেমধ্যে।

মা শালা কী বস্তু দিয়ে তৈরি কে জানে! দিনরাত ওই নিঘিন্নে সংসারে কলুর বলদের মতো খেটেই যায়, তবু্ কী করে ওরকম শান্ত থাকে, কে জানে! অবশ্য সেই বা জ্বলতে জানল কই?

শীতকালে তাদের গলিতে হারু-বাবলুরা টায়ার পোড়ায়। উৎকট গন্ধ। ধিকিধিকি জ্বলা আগুন দেখতে দেখতে খপ করে  আগুনটা ধরতে ইচ্ছা করে। সত্যিকারের পুড়লে কেমন লাগে খুব জানতে চায়। তার শরীরের ফোসকা দেখা যায়না। মায়ের তবু চেহারা কেমন ঝোড়ো কাকের মতো হয়ে গেছে। সামনের চুল উঠে কপাল চওড়া। ফর্সা রঙটা তামাটে। তার তো চেহারায় কোন কিছুতেই ছাপ পড়েনা। আধাঅন্ধকারে, ড্যাম্পধরা ঘরে থেকে সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরেও কেমন চকচকে চেহারা! বাড়ি-বাড়ি ডোরবেল বাজালেই দরজা যে খোলে, তার চোখ দেখেই বোঝে চোখ আটকে গেছে তার চেহারায়।

'লাইটার বা দেশলাই হবে?'

পিছন ঘুরে গাঢ় অন্ধকারে ছায়া-ছায়া একজনকে দেখে চমকে যায় অনল।

'হবে? দেশলাই?'

অনল পকেট থেকে নিঃশব্দে দেশলাই বের করে দেয়। তখনই মনে পড়ে, সে গঙ্গায় ডুব দেয়নি। সকলেই বলেছিল। শোনেনি।

লোকটাকে সিগারেট খেতে দেখে নিজেরও ভেতরটা আনচান করে উঠল। পকেট থেকে দোমড়ানো প্যাকেটে একটাই সিগারেট। লোকটা পাশে চলে এসেছে তার।

'বাইক নিয়ে হুশ করে চলে যাও হিরোর মতো। জোম্যাটো না সুইগি?'

'আপনি কি আমাকে ফলো করেন!'

'নাহ। রাজুদার পার্টনার ছিলাম আমি'।

'মানে? কিসের?'

'বোমা বাঁধার।'

অনলের মুখটা তেতো হয়ে উঠছে।

'সব পার্টিতেই আমাদের মতো লোক থাকে, বুঝলে। যতদিন লোক জানতে পারেনা, ততদিন আমরা সক্রিয় পার্টিকর্মী। রাজুদার ডানহাতটা বোমায় উড়ে যেতেই গ্রামে আর থাকতে পারলাম না আমরা। এই কলকাতার এঁদো গলির পাঁকে এসে পড়লাম। খুব ছোটো তখন তুমি'।

'এসব শুনেছি আমি। ফুটুন তো!'

'তোমার বাবা কেমন হয়ে গেল। কোনো কাজ আর করল না। পার্টি তো আর চিনতেই চাইল না আমাদের। ভোটের ডামাডোলে সব কেমন পাল্টে গেল। আমি তারপর থেকেই রিক্সা টানি। দেখি তোমাকে। রাজুদার চেহারা ঠিক তোমার মতোই ছিল, বুঝলে! আজ রাজুদাকে শেষদেখা দেখতে গিয়েছিলাম। লুকিয়ে। রাজুদাকে দূর থেকে নজর রেখেছি বরাবর। রাজুদা জানত না। আসলে, সেদিনও আমি সিগারেট খাচ্ছিলাম। বোমাটা…’

লোকটা দ্রুত অনলকে ছাড়িয়ে মিশে গেল অন্ধকারে। মা দরজা খুলেই বলল, 'গঙ্গা চানটাও করলি না!'

সাদা থান জড়ানো মা’কে দেখে কেমন অশরীরী মনে হচ্ছে। কলতলায় যায় অনল। বালতির তোলাজল ঢালতে থাকে মাথায়।

মাটিতে মোড়া বাপের নাভিটা ছুঁড়ে গঙ্গায় ফেলে দেওয়ার সময়, সব ঘেন্না-রাগ-অশ্রদ্ধা সঙ্গে নিয়েই ফেলেছে।

হঠাৎ গলার কাছে ব্যথা নিয়ে চোখ ফেটে জল নামল অনলের।

অস্ফুটে ডাকল, বাবা!

 

 

 

'


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন