কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

ভার্জিনিয়া উলফের অণুগল্প

 

প্রতিবেশী সাহিত্য

 

ভার্জিনিয়া উলফের অণুগল্প

(অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী) 

 


লেখক পরিচিতি: এ্যাডেলিন ভার্জিনিয়া স্টিফেন বিয়ের পরে এবং লেখক হিসেবে ‘ভার্জিনিয়া উলফ নামেই বেশি পরিচিত। বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক লেখকদের একজন এবং লেখ্য রীতি হিসেবে ‘চেতনা প্রবাহ রীতি ব্যবহারের অন্যতম পথ-প্রদর্শিকাও তিনি। লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনের এক সমৃদ্ধশালী পরিবারে জুলিয়া প্রিন্সেপ জ্যাকসন এবং লেসলি স্টিফেন দম্পতির উভয়েরই আগের পক্ষের সন্তান সহ মোট আটটি সন্তানের ভেতর ভার্জিনিয়া ছিলেন সপ্তম। তাঁর জন্ম ১৮৮২ সালের ২ শে জানুয়ারি। আধুনিকতাবাদী চিত্রশিল্পী ভানেসা বেলও এই দম্পতির দুজনারই দুপক্ষের মোট আট সন্তানের একজন ছিলেন। অল্প বয়স থেকেই ভার্জিনিয়া ধ্রুপদী ইংরেজি সাহিত্য এবং ভিক্টোরিয় যুগের সাহিত্যে দীক্ষিত হন। ১৮৯৭ থেকে ১৯০১ সাল নাগাদ লন্ডনের কিংস কলেজের ‘লেডিস ডিপার্টমেন্ট-এ তিনি পড়াশোনা করেন যেখানে তিনি ধ্রুপদী সাহিত্য এবং ইতিহাস পড়তেন এবং এসময় মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষা ও নারী অধিকার আন্দোলনের প্রাথমিক যুগের সংস্কারকদের সংস্পর্শে আসেন। বাবার প্রেরণায় ১৯০০ সাল থেকে পেশাগত ভাবেই লেখালিখি শুরু করেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বইগুলোর ভেতর রয়েছে মিসেস ড্যালোওয়ে (১৯২৫), টু দ্য লাইট হাউস (১৯২৭), আ রুম অফ ওয়ান্স ঔন (১৯২৯) এবং দ্য ওয়েভস (১০৩১)। ১৯৪১ সালে খুবই প্রেমময় জীবনসঙ্গীকে ঘরে রেখে, কোটের পকেটে নুড়িপাথর ভরে নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করেন। ‘সোমবার অথবা মঙ্গলবার ১৯২১ সালে প্রকাশিত ভার্জিনিয়া উলফের একমাত্র ছোটগল্প সংকলন যা তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য এই গল্পগ্রন্থটি  ‘একটি পোড়ো বাড়ি এবং অন্যান্য গল্প নামে ১৯৪৪ সালে পুন:প্রকাশিত হয়। পুন:প্রকাশিত সংস্করণে মূল আটটি গল্প থেকে ছয়টি গল্প রাখা হয়। 

ভার্জিনিয়ার বর লিওনার্ড উলফ এই বইটিকে তাঁর স্ত্রীর প্রকাশিত বইগুলোর ভেতর অসংখ্য মুদ্রণ প্রমাদের কারণে সবচেয়ে মন্দ বই হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে বইটির পরবর্তী সংস্করণগুলোয় এই বানান সমূহ সংশোধিত হয়। আন্তর্জালে ‘প্রজেক্ট গুটেনবার্গ থেকে এই বইটির গল্পগুলো থেকে খুবই মিতায়তণ দুটো গল্প  অনুবাদ করা হলো। দুটো গল্পেই ‘নির্দিষ্ট আখ্যান বস্তর বদলে ‘চেতনা প্রবাহ রীত-তে লেখক তাঁর বক্তব্যকে সাজিয়েছেন)।

 

সোমবার অথবা মঙ্গলবার

অলস ও নির্বিকার, যেন বা মহাশুণ্যকে নিজের ডানা থেকে সহজেই ঝেড়ে ফেলে, নিজস্ব গতিপথ জেনে, সারস পাখিটি আকাশের নিচে গির্জার উপর দিয়ে উড়ে গেল। শুভ্র ও সুদূর, যেন নিজেই নিজেতে মগ্ন, মহাকাশ নিজেকে একবার মেলে ধরছে আবার লুকিয়ে ফেলছে, যেন এই নড়ছে আবার পরমূহুর্তেই স্থাণু। যেন বা একটি হ্রদ? যেন বা সব কলঙ্কচিহ্ন শুষে নিচ্ছে! একটি পাহাড়? আহা, নিখুঁত একেবারে- পাহাড়ের ঢালে সোনালী সূর্য। তার নিচেই ডানা ঝাপটে পড়া। সে হোক অপুষ্পক সবুজ লতা, অথবা সাদা পালক, চিরদিনের জন্য এবং চিরকালের-

সত্যকে কামনা করে, সত্যর জন্য প্রতীক্ষা করে, যেন ভারি পরিশ্রম করে কয়েকটি শব্দ পরিশ্রুত করে আনছে, চিরদিনের জন্য কামনা করছে- (একটি কান্না বাঁ থেকে শুরু হয়, আর একটি আর্তনাদ ডান দিকে। চাকাগুলো নানা ভাবে আঘাত করে। সঙ্ঘর্ষের সময় সবকিছু জড়িয়ে-মরিয়ে যেন পিন্ডি পাকায়)- চিরদিনের জন্য আকাঙ্খা করে- (ঘড়ির কাঁটা বারোটি পৃথক, সশব্দ আঘাতের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করে যে এখন বারোটা বেজেছে বা মধ্যাহ্ন; আলো যেন স্বর্ণালী দাড়িপাল্লার মত বিভা ছড়ায়; শিশুরা ঝাঁক বাঁধে)- চিরদিনের মত সত্যকে তারা আকাঙ্খা করে। রক্তিম গম্বুজ; গাছের ডালে মুদ্রারা ঝুলছে; চিমনী থেকে ধোঁয়ার গতিপথ; গর্জন করে, চেঁচায়, চেঁচিয়ে বলে ‘বিক্রির জন্য লোহা- আর সত্য?

পুরুষ এবং মহিলাদের পায়ের পাতা অবধি আলো বিকীরণ করে, কালো অথবা সোনালী পাতে যেন মোড়ানো- (এই কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া- চিনি চলবে? না- ধন্যবাদ তোমাকে- ভবিষ্যতের রাষ্ট্রমন্ডলী)- ফায়ারপ্লেসের আগুন জ¦লে উঠে গোটা ঘরকে যেন লালাভ করে তুলছে, শুধু কালো শরীরগুলো এবং তাদের উজ্জ্বল চোখগুলো ব্যতীত, যখন বাইরে একটি ভ্যানগাড়ি নামাচ্ছে তার মাল-পত্র, মিস থিংগামি তাঁর পড়ার টেবিলে বসে চা পান করেন, র‌্যাকে পশম কোট রাখা---

প্রফুল্ল, পাতার মত নির্ভার, কোণায় কোণায় প্রবাাহিত, চাকাসমূহের চারপাশে বয়ে যাওয়া, রজতোচ্ছাস পূর্ণ, ঘর আছে অথবা ঘর নেই, জড়ো হওয়া, ছত্রভঙ্গ, পৃথক পৃথক মাপনীতে তছনছ, ভেসে যাওয়া, দুর্দশাগ্রস্ত, ছিন্ন, ডুবে যাওয়া, একত্রিত- এবং সত্য?

এখন মর্মর পাথরের সাদা চত্বরের উপর আগুনের পাশে বসে স্মরণ করা। যেন বা গজদন্ত গভীরতা থেকে শব্দসমূহ উত্থিত হচ্ছে তাদের যাবতীয় অন্ধকার নিয়ে, প্রস্ফুটিত হচ্ছে এবং প্রবেশ করছে। বই পড়ে গেছে; আগুনের শিখায়, ধোঁয়ায়, মূহুর্তের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে- অথবা এখন সমুদ্রযাত্রায়, মর্মরের বর্গাকার দুল, নিচের মিনাররাশি এবং ভারত সমুদ্র, যখন নীলাভ মহাকাশ যেন ছুটে আসে এবং তারাগুলো ঝিলমিল করে- সত্য? অথবা এখন, নৈকট্যের সাথে আধেয়?

অলস এবং নির্বিকার সারস পাখিটি ঘরে ফেরে; মহাকাশ তার নক্ষত্রগুলোকে ঘোমটায় লুকিয়ে রাখে; পরে তাদের আবার অনাবৃত করে।

 

নীল ও সবুজ

সবুজ

কাঁচের সূক্ষ আঙুলগুলো নিচের দিকে মুখ করে ঝুলছে। কাঁচের নিচে আলো সরে গিয়ে যেন সবুজ এক হ্রদের বিভা ঝরায়। যেন সারাদিনমান ধরে দীপ্তিময় সবুজের দশটি আঙুল ফোঁটায় ফোঁটায় মার্বেল পাথরের উপর জমা হয়। টিয়া পাখির সবুজ পালক - তাদের কর্কশ কান্না - তালগাছের তির্যক পাতা - সে-ও সবুজ; সূর্যের আলোয় চকচক করছে যেন যত সবুজ সূঁই। তবে শক্ত কাঁচের বিন্দু মার্বেলে জমা হয়; মরুর বালুরাশির উপর হ্রদের মরীচিকা; উটের দল তারই মাঝ দিয়ে জলযানের মত পথ করে চলে; মার্বেলেই যেন জমা হয়েছে সবুজ হ্রদ; মার্বেলের কোণায় কোণায় যেন হ্রদের সবুজ উচ্ছাস; যেন বা শৈবাল আচ্ছন্ন করে রেখেছে; এখানে সেখানে শ্বেতাভ প্রষ্ফুটন; ঝপ করে ব্যাঙের লাফ দেবার শব্দ; রাতে আকাশে অভগ্ন নক্ষত্রমন্ডলী। সন্ধ্যা আসে, চুল্লীর পাশের তাকে ছায়াটি যেন সব সবুজকে ছড়িয়ে দেয়; মহাসাগরের এলোমেলো তলদেশ। কোন জাহাজ আসে না; লক্ষ্যহীন ঢেউগুলো শূন্য  আকাশের নিচে পাক খায়। এখন রাত; সূঁইগুলো নীল বিন্দু ছড়িয়ে দিচ্ছে। সবুজ আর কোথাও নেই।

নীল

খেঁদা-নাকের দৈত্যটি সমুদ্রের পৃষ্ঠদেশে জেগে ওঠে এবং তারপর তার ভোঁতা দুই নাসারন্ধ্র দিয়ে দুই ধারায় জল নির্গত করে, কেন্দ্রবিন্দুতে এই জলধারা আগুনে সাদা হলেও দূরে সে ছড়িয়ে পড়ছে নীল পুঁতির মালার মত। 

দৈত্যটিকে লুকিয়ে রাখা কালো তেরপলে নীল রেখার দাগ। মুখ ও নাসারন্ধ্র থেকে জল বের করে দিয়ে সে গান গায়, জলে ভারি স্ইে গান; আর তার চোখের ঝকঝকে নুড়ি পাথরকে চারপাশের নীল যেন ছেয়ে ফ্যালে। সমুদ্র তীরে নিক্ষিপ্ত এই দানো যেন মিথ্যেবাদী, ভোঁতা, অসাড়, শুকনো আর নীল দাঁড়িপাল্লার যোগান দিচ্ছে। তাদের এই   ধাতব নীল সৈকতের উপর পড়ে থাকা মরিচা পড়া লোহাকেও যেন নীল দাগে দাগিয়ে দেয়।

নীল যেন ঝড়ে ধ্বস্ত, দাঁড় টানা নৌকার পাঁজর। নীল ঘন্টার নিচে একটি তরঙ্গ যেন আছড়ে পড়ে। কিন্তু গির্জার রয়েছে ভিন্ন ধাঁচের, শীতল, ধূপের ঘ্রাণে ঠাসা, ম্যাডোনার অবগুণ্ঠনের মত ঝাপসা নীল।  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন