কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(৩০)             

পরদিন প্রাইভেট সেক্রেটারি সবচেয়ে বেশী কথা বলেছিল হৃদয় আর অতলান্তের সঙ্গেই। বিশ্রুতর ভালো লাগেনি লোকটিকে। পরে হৃদয়কে বলেছিল, লোকটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের খাস চামচা। আদ্যন্ত ধান্দাবাজ। আমার একটুও পছন্দ হয়নি। যেন দেবতা সেজে বসে আছে। সবাইকে ওঁর পায়ে আছড়ে পড়তে হবে। অতলান্তর অবস্থা দেখেছিলি? চেয়ারে বসে সারাক্ষণ উসখুস করছিল। যেন ওঁর পায়ের তলায় বসে তবে স্বস্তি পাবে। আর কী বিগলিত ভাব! গলার স্বরে যেন মধু ঝরে পড়ছে। লোকটাকে একদম মজিয়ে দিয়েছে রে...

হৃদয়েরও যে খটকা লাগেনি তা নয়। কিন্তু অতলান্ত তার জীবনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা। এরকম মানুষ সে আগে কখনও দেখেনি। খটকা লাগলেও ব্যাপারটা কোনদিকে গড়াতে পারে তা সে অনুমানও করতে পারেনি। বিশ্রুতকে সে অন্য একটা কথা জিগ্যেস করল। বলল, এই সেই ম্যানেজিং ডিরেক্টর না, যার মেয়ে বেদপর্ণা?

আগ্নেয় তো তাই বলল। বিশ্রুতর কথায় কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল হৃদয়। কয়েকদিন পরে খটকা নয়, ধাক্কাই খেল সে।

দূরের একটা দ্বীপে ফুলের সবচেয়ে বড়ো মেলায় অংশ নিয়েছিল ওরা। এই দেশের সব কটি ফুলের বাগানই অংশ নিয়েছিল। সাতদিন ধরে চলবে এই মেলা। বাগানগুলোর সবাই এক একটা করে স্টল দিয়েছে। সেই স্টলে সাজিয়ে রেখেছে বিচিত্র রকমের ফুল। দুর্লভ সব ফুল। যে যেমন খুঁজে পেয়েছে। ফুলের সমঝদাররা সব আসছে। নানা রকম দর হাঁকছে। বাগানগুলোর সঙ্গে নানা চুক্তি করছে। প্রথম কয়েকদিন হৃদয়দের সঙ্গেও বেশ কয়েকজনের চুক্তি হল। ভালোই দাম দিতে চায় তারা। এতে ওদের আর্থিক বোঝা অনেকটা কমবে। ফুলের বাগানেরও উন্নতি হবে। ষষ্ঠদিনে স্টলটা খোলার কথা ছিল অতলান্তের। রোজই কারও না কারও ঘাড়ে এই দায়িত্বটা চেপেছে। কোনও একজন আগে গিয়ে স্টলটি খোলে। তারপর ধীরেসুস্থে কিছুটা পরে বাকিরা যায়। অতলান্ত প্রতিদিনই অনেক পরে যায়। অল্প সময় থেকে মেলা শেষ হওয়ার অনেকটা আগেই বেরিয়ে যায়। শুধু ওই একদিনই তার আগে আসার কথা। তাও এই শর্তে যে, আগে গিয়ে সে খুলবে ঠিকই। কিন্তু রোজকার মতোই অনেক আগে বেরিয়ে যাবে। কোনও মতেই সে বেশী রাত করতে পারবে না। সে অসুস্থ এবং বেশী রাত করার ব্যাপারে ডাক্তারের নিষেধ আছে। এটা একটা ব্যতিক্রম। অন্য সবাই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত থেকেছে। কিন্তু ওরও যে কিছু করার নেই।

সেদিন গিয়ে হৃদয় আর বিশ্রুত হতবাক হয়ে গেল। ওদের স্টলে তালা দেওয়া। অতলান্ত আসে নি। হৃদয় ফোন করল। কিন্তু অতলান্ত ফোন ধরছে না। ওর কাছেই চাবি। অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও গতি নেই। এ যেন এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এরকম কিছুও ঘটতে পারে, তা যেন কল্পনাই করা যায় না।

ইতিমধ্যে একটি আর্ট গ্যালারির মালিক তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর অনেক ফুলের দরকার। সেদিন বিকেলেই। স্থানীয় কাগজে সেদিনই হৃদয়দের ফুলের বাগান সম্পর্কে একটা খবর বেরিয়েছিল। হৃদয়পুর দ্বীপে গত এক বছরে কোনও ফুল জন্মায় নি। তার আগে কয়েক বছর ধরেই ফুল জন্মেছে খুব কম। আর হৃদয়রা গত কয়েক মাসে সেখানে একটা গোটা ফুলের বাগান বানিয়ে ফেলেছে। এই খবর দেখেই তিনি এসেছেন।

হৃদয় অসহায়ের মতো বলল, আমাদের কন্ট্রাক্ট পেপার স্টলের ভেতরে আছে। ফুলগুলোও। \কিন্তু আমি তো আর অপেক্ষা করতে পারব না। জরুরি মিটিং আছে, তার জন্যই...

আপনার কার্ডটা দিন। আমি পৌঁছে দিয়ে আসব।

গ্যারান্টি দিতে পারেন? লোকটি জানতে চাইল।

হৃদয়কে হার মানতে হল। অতলান্ত কখন এসে পৌঁছাবে, আদৌ এসে পৌঁছাবে কী না, সে তো সত্যিই জানে না। বিশ্রুত ফুঁসতে লাগল। অতলান্ত এসে পৌঁছাল সন্ধ্যার পর। হাঁপাতে হাঁপাতে। খুবই অসুস্থ দেখাচ্ছিল ওকে। ততক্ষণে বহু টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে ওদের।

হৃদয় খুব উত্তেজিতভাবে বলল, কোথায় ছিলি তুই? ফোন ধরছিলি না কেন?

অতলান্ত যেন একটু ঘাবড়ে গেছিল। সত্যি কথাই বলল সে। প্রাইভেট সেক্রেটারি আমাকে ডেকেছিলেন। সেখানেই ছিলাম।

অতলান্ত হয়ত ভেবেছিল প্রাইভেট সেক্রেটারির নাম শুনলে এরা হয়ত চুপ হয়ে যাবে। ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারবে। নিজেকে বাঁচাতেই সে নামটা করেছিল।

বিশ্রুত কিন্তু ফেটে পড়ল, আমাদের কত ক্ষতি হয়ে গেল তুই জানিস?

উনি না ছাড়তে চাইলে...

উনি তোকে আটকে রেখেছিলেন? তুই কিছু বলতে পারলি না? আমাদের একটা খবর দিতে পারতি না? কী হয়েছিল তোর ফোনের?

আমার ফোনে চার্জ ছিল না। ওঁর ফোনটা ব্যবহার করা যেত। কিন্তু উনি কী ভাবতেন? নিজে আগ্রহ নিয়ে ডেকেছেন আমায়, আর আমি চলে যেতে চাইছি? আমার কিছু করার ছিল না। তাছাড়া...

বিশ্রুত তখনও ফুঁসছে। অতলান্ত এবার অন্য কৌশল নিল। হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বলল, আমি খুব অসুস্থ হৃদয়। একটা ওষুধ এনে দিবি?

হৃদয়কে যেতেই হল। খুব ভালোবেসে ফেলেছে সে অতলান্তকে। কিন্তু ওষুধটা কোথাও পাওয়া যায় না। একটার পর একটা দোকান খুঁজতে লাগল হৃদয়। হাঁপাতে লাগল। কিন্তু অতলান্তের অবস্থা ভালো নয়। ওষুধতা না নিয়ে গেলে অতলান্তের অসুস্থতাকে সামলানো যাবে না। রাস্তায় গিজগিজ করছে লোক। শব্দের চোটে কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়। তার মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। পাশের রাস্তায় যানবাহনের তীব্র আওয়াজ। অসহ্য লাগছিল হৃদয়ের। তবু হাল ছাড়ল না সে। শেষ পর্যন্ত খুঁজেও পেল ওষুধটা। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা সময় কেটে গেছে। ভিড় ঠেলে ঠেলে যখন সে ফিরে এল, নিজেও তখন জোরে জোরে শ্বাস টানছে।

ফিরে এসে দেখল, অতলান্ত হেসে হেসে গল্প করছে বিশ্রুতর সঙ্গে। ওর মনও জয় করে ফেলেছে সে। বাকিরাও এসে গেছে। বেশ একটা উৎসবের পরিবেশ স্টলে। ওষুধটা হাতে পেয়ে অতলান্ত যেন কৃতার্থ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জল দিয়ে গিলে ফেলল সেটা। হৃদয় এক কোণে বসে রইল। আর্থিক ক্ষতি যা হয়ে গেছে, তা আর মেটার নয়। সেটাই তার ভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছিল। তার পাশে এসে বসল বিশ্রুত। একমাত্র এই ছেলেটাই ওর মন বোঝে। ওর মান-অভিমান-ফূর্তি-বেদনাকে টের পায়। অতলান্তের ব্যবহারে জোর ধাক্কা খেয়েছে ওরা। তবু ওকে সন্দেহ করতে পারছে না। মনে মনে দুজনেই অতলান্তের সপক্ষে যুক্তি সাজাতে থাকে। ওকে যে সন্দেহের হাত থেকে বাঁচাতেই হবে। একমাত্র তবেই নিজেদের স্বস্তি ফিরে আসবে।

এই সময় মেহুলী এসে সেখানে হাজির হল। সঙ্গে সাঁঝ। অনির্বেদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে অতলান্তের সঙ্গে সাঁঝের একটা মিষ্টি-মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। ব্যাপারটা অনির্বেদ জানত। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। অতলান্ত মুগ্ধ ছিল সাঁঝের ব্যাপারে। সাঁঝও জানত অতলান্তের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু ধনী পরিবারের মেয়ে হয়েও দারিদ্রকে কখনও সম্পর্কের ক্ষত্রে বাধা মনে করেনি সাঁঝ। এই কারণেই অনির্বেদের প্রতি সে আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অনির্বেদ তাকে হতাশ করেছিল। তার মধ্যে সে দেখেছিল চিত্তের দৈন্য। কিন্তু অতলান্তর মধ্যে সে আবিষ্কার করেছিল চিত্তের সম্পদ। কী প্রাচুর্যই না সেখানে! সাঁঝ যেন একেবারে ভেসে গেল।

অতলান্ত ও আগ্নেয়র মধ্যে সম্পর্ক যত ঘন হচ্ছিল, সাঁঝ আর মেহুলীও তত কাছাকাছি আসছিল। ওদের দেখেই অতলান্ত আর আগ্নেয় স্টলের বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল ওরা। কিন্তু ফিরে এল কিছুক্ষণ পরেই। অতলান্ত হাত নেড়ে হৃদয়কে ডাকল। তারপর বলল,

একটা উপকার করতে হবে হৃদয়...

হৃদয় অবাক হয়ে তাকায়।

ফুল নিয়ে মেহুলী একটা অ্যাডভেঞ্চারের ছড়া লিখেছে। তুই একটু দেখবি?

মেহুলী লেখে নাকি? তাও আবার ছড়া? ঠিক আছে। কোথায় সেই লেখা?

মেহুলী এগিয়ে আসে। লেখাটা হাতে নিয়ে পড়তেও শুরু করে হৃদয়। কিন্তু ওর আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হয়। ছড়াটা কিছুই হয়নি। মেহুলী ফুল সম্পর্কে কিছুই জানে না। শুধু অ্যাডভেঞ্চারটাই আছে।

হৃদয় অতলান্তের দিকে তাকায়। তারপর বলে, লেখাটা তুই পড়েছিস?

অতলান্তের মুখ কালো হয়ে যায়। হৃদয়কে সে পড়তে পারে। তবু একটা মরিয়া চেষ্টা করে, সময় পেলাম কোথায়? তবে তুইই ভরসা। একটু ঘষে-মেজে যদি ঠিক করে দিতে পারিস। সাংস্কৃতিক উৎসবের আর কয়েক সপ্তাহ দেরি। আবার আমাদের বই হবে। সেখানে যদি লেখাটা রাখা যায়! মেয়েটাও একটু উৎসাহ পায় তাহলে।

(ক্রমশঃ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন