কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

নীতা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


নাটক

গ্রামের বাড়িতে এসে একটু অবাকও হয়েছে শঙ্কর! ভেবেছিল গেঁইয়া পাড়া-পড়শীদের মুখে ঠেস মারা কথার চাষ চলবে তাকে দেখে! তার বদলে প্রশংসা! এতদিন ধরে উলটোটাই তো শুনে এসেছে, দূরে চাকরি করা ছেলেদের সম্বন্ধে! এরাই বলে, বাইরে পড়তে গিয়ে দিব্যি সে দেশেই রয়ে গেলে চাকরি নিয়ে! এদিকে ঘরে একা মা! এত টাকা খরচ করে পড়ালো বাবা, নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শংকর ভাবে, ছেলেমেয়ের খাওয়া পরা পড়াশোনার জন্য বাবা-মা’ই তো টাকা-পয়সা খরচ করবে, স্যাক্রিফাইস করবে! এ আর নতুন কথা কি! এটাই তো নিয়ম। ওরাই তো আমাদের পৃথিবীতে এনেছে! আমিও তো আমার সন্তান মানুষ করবো। তারা আবার তাদের সন্তান মানুষ করবে! এর মধ্যে আবার বাপ-মায়ের কাছে ঋণি হওয়ার কি আছে? তাহ’লে বাবা-মা কি ছেলে-মেয়ে বাবাদ টাকা খরচ করে, আখেরে সন্তান তা সুদে-আসলে শোধ করবে সেই ভেবে! এটা কি কোনো ইনভেস্টমেন্ট নাকি? বাবা মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ হলে কি তার জন্য সন্তানরা দায়ী! যত্তোসব বাজে গেঁইয়া কনসেপ্ট আর কি!

মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছেলে গাঁয়ের বাড়িতে মা’কে দেখতে এসেছে শুনে সারা গাঁয়ে ততক্ষণে  শঙ্করের নামে ধন্য ধন্য পড়ে গেছে। গর্বে আনন্দে মা চোখে জল ধরে রাখতে পারছে না। এই তামাশার মাঝে মায়ের কাছে বসে সোমনাথ নিয়োগীর ছেলে শংকর নিয়োগী উটপটাং ভাবছে। ভাবছে, চিরকেলে অসুখে ভোগা মা এবার বুড়ো হয়েছে, আর নিজেকে টানতে পারছে না, এবার তো চলে যাওয়া উচিত মায়ের! কিন্তু এই যে তার নামে গ্রামের লোক ধন্য ধন্য করছে, তার মানে তো মায়ের চিকিতসা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না! মার আর কি কাজ আছে সংসারে, এবার শান্তিতে স্বর্গে যাক—এই ন্যাজ্য কথাটাও তার মানে বলা যাবে না! আবেগকে বেশী মান্যতা দিয়ে, ফালতু টেনশন নেওয়ার জমানা চলে গেছে, একথা ওদের বোঝাতে গেলে কেলেঙ্কারী হবে মনে হয়! শংকর ওদের প্রত্যাশা মতো ভালো নার্সিংহোমেই ভর্তি করালো মা’কে।  এ দেশে যে নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া বয়ঃবৃদ্ধদের মিথ্যে বাঁচিয়ে রাখার খেলা নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে কি পরিমান টাকা খিঁচে নেওয়ার ম্যানিপুলেশন চলে তা সবার জানা আছে। তবু পরিস্থিতির প্যাঁচে পড়ে ভর্তি করাতেই  হয়! শংকরের মা মায়া নিয়োগীকেও ভর্তি করানো হলো।

নার্সিংহোমের চাকচিক্য দেখে অবাক হন মায়াদেবী! ছেলেকে নিয়ে মনে মনে গর্বে বুক ফুলে ওঠে তাঁর। ভাবেন শংকরের বাবা তো বেঁচে থাকতে তাঁর জন্যে এত ভালো চিকিতসা ডাক্তার ওষুধ কিছুই করতে পারেনি! এবার ছেলের দৌলতে সব অসুখ সেরে যাবে তাঁর! তিনি ঠিক সেরে উঠবেন! বেডে শুয়ে ছেলের হাত ধরে বলেন, ক্ষিরের পুর দেওয়া পাটিসাপ্টা, রাঙাআলুর পুলি খেতে তুই কি ভালোবাসতিস রে শঙ্কু। এবার সেরে উঠে সব করে খাওয়াবো তোকে। এসব ফালতু বিষয়ে মায়ের চোখে জল দেখে শঙ্কর মনে মনে বলে, এসব এখন আমি আর একটুও ভালোবাসিনা। তখন এর বাইরে আর তো কিছু খেতে দাও নি, তাই এগুলোই খেতাম। দুনিয়ায় এর থেকে আরও কত ভালো খাবার পাওয়া যায় তখন জানতামই না। পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন আর বাইরের  লোকের সামনে নাটক করে বলে, এসব নিয়ে ভেবে শরীর আরও বেশী খারাপ কোরো না তো মা! এই তো, এবার সেরে উঠলে তোমার হাতে বানানো এসব তো অনেক খেতে পাবো বালো! শুনে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় মায়া দেবীর। নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুখী মা মনে হয় মায়া নিয়োগীর। মায়ের শরীরের আঁশটে গন্ধে কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে ছেলের।

*      

গাঁয়ের কিছু ছেলে রেডি হয়ে এসেছে ওদের গ্রামের গর্ব শঙ্করকে সাহায্য করতে। ওরাও যাবে শঙ্করের সাথে মায়া কাকিমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে। এই গ্রামের কিছুই তো চেনে না ছেলেটা। এই বিপদে এটুকু সাহায্য করা ওদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে বলে মনে করে ওরা! এই গায়েপড়া ছেলেগুলোর সামনে ভালো করপোরেট হসপিটাল বা নার্সিংহোমে না ভর্তি করলে ওর ইমেজ মারত্মক জখম হয়ে যাচ্ছে। অতএব…

জীবনে এই প্রথম মায়াদেবী এইরকম ঝকঝকে বিছানা দেখলেন। এত পাট পাট করে পাতা পরিচ্ছন্ন বিছানাতে শুতেও যেন কেমন সঙ্কোচ হচ্ছে তাঁর। অসুস্থতা ভুলে অবাক হয়ে নার্সিং হোমের তকতকে মেঝে ঝকঝকে দেওয়াল দেখছেন তিনি।

*

ডাক্তার হাজার রকম টেস্ট লিখে দিয়েছিল। টেস্ট-রেজাল্ট আর বিশাল অঙ্কের বিল হাতে নিয়ে  শঙ্কর ভাবছে, যা অসুখ বাধিয়েছে মা, তাতে আর ফেরার চান্স নেই। ডাক্তার তো বলেই দিলেন ম্যালিগনেন্ট কেস। এখন আর আর্লি স্টেজে নেই! বেশ ছড়িয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে। বায়োপ্সির রেজাল্ট কাল-পরশু চলে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমাদের যতদূর সাধ্য আমরা করবো! আফটার অল মা বলে কথা। আমারও মা নেই, জানেন! মা না থাকা কি অনুতাপের সে আমি জানি মিঃ নিয়োগী! পেশেন্ট পার্টিকে আবেগে খেলাতে থাকেন অঙ্কোলজিষ্ট। বিলের অঙ্ক বাড়াবার এ  একটা নয়া তরিকা, শঙ্কর নিয়োগী নামের আবেগহীন ছেলেটা জানে। তবুও দুপক্ষের এরকম নাটক চলতেই থাকে। এইজন্যই বলে দুনিয়া এক রঙ্গমঞ্চ, আমরা জীবনভর এই মঞ্চে নাটক করে যাই! কিন্তু ‘অনুতাপ’ কথাটা বললো কেন ডাক্তার মল্লিক! তাহলে কি ডাক্তারও তার অসুস্থ মাকে নিয়ে নাটক করেছিল কোনোও একদিন! এখন অনুতাপে আছে! কিংম্বা অনুতাপ একটা নাটুকে শব্দ নয়তো! এটাও ডাক্তারের একরকম নাটক কি….!

*

মা নামের একরাশ সেন্টিমেন্টের কাছে বসে আকাশ পাতাল চিন্তা করে যাচ্ছে শঙ্কর নিয়োগী। ভাবছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর কাছে কাজ করতে করতে আবেগকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। বাবা-মায়ের শ্মসান যাত্রার কালেও ল্যাপটপে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। এদের কাছে কাজ করলে মানুষের সামাজিক জীবন ফক্কা হয়ে যায়। দুঃখের হরমোন গুলো শুখিয়ে যায়। শঙ্কর সেই মূহুর্তে ভাবছে,  একবার এসেছি যখন, মায়ের কাজ, গ্রামের  বাড়ি বিক্রি সব একসাথেই সেরে ব্যাঙ্গালোরে চাকরির জায়গায় ফিরবো। ভেবে নিজেকে কিছুটা হাল্কা লাগে। এবং সকালের ভিজিটিং আওয়ারে ডাক্তার মল্লিক সুখবরটা শোনায় শঙ্করকে। হাসিমুখে বলে মা’কে নিয়ে বাড়ি যান মিঃ নিয়োগী। রিলিজ অর্ডার আর ঢাউস ওজনের বিল হাতে নিয়ে স্তব্ধ বসে থাকে শঙ্কর নিয়োদী। ডাক্তার বলে চলেন, অন্ততঃ এক-দেড় মাসের আগে আসতে হবে না মাকে নিয়ে। এই ওষুধগুলো  নিয়মিত খাওয়াবেন। উইকনেসের জন্যও কয়েকটা ওষুধ লিখে দিয়েছি।

কিছু কিছু ডাক্তার ঈশ্বরের মতো, কিছু কিছু আবার খেলুড়ে। দরকারী ওষুধের থেকে অদরকারের ওষুধ বেশী প্রেসক্রাইব  করেন।। এই মূহূর্তে এসব কথাও শঙ্কর ভাবতে পারছে।

ঝাঁকানিটা খুব জোর লেগেছিল শঙ্করের। যে রোগে আজ নাহয় কাল মৃত্যু নিশ্চিত, তাকে ওষুধে দাবিয়ে দিয়ে আরো কয়েকটা দিন বাঁচিয়ে রাখা যে এখনকার কিছু অর্থলোভী ডাক্তারদের বিজনেস পলিসি ও জানতো। তা যে ওর সাথেও হবে ঠিক ভাবতে পারে নি। ডাক্তার ওদিকে বলেই চলেছে খুব মুষড়ে পড়েছিলেন তো? একটু ডাক্তারদের ওপরও বিশ্বাস রাখুন ভাই!

*

মায়ের খুশি খুশি মুখটা দেখে শঙ্করকেও একটা খুশির মুখোশ পরে নিতে হয়। বিশেষ করে মায়াদেবীর রিলিজের খবর পেয়ে যে দুজন ছেলে ওদের পলাশপুর গ্রাম থেকে সাহায্য করতে  এসেছিল, তাদের সামনে মুখোশের প্রচন্ড দরকার যে! মোটা টাকার এমবুলেন্স জোগাড় হয়ে যায় ওদের ততপরতায়!  শঙ্কর ভাবে, এরা নিজেদের মায়ের জন্য এইসব কোনও দিন করতো কি! আসলে পরকে খেলাতে সবাই পছন্দ করে।

এ্যামবুলেনসে মায়ের বেডের সামনে বসে ভাবছে, আমি আর কতদিন এখানে থাকবো! এদের  কাছেই এই রুগীকে রেখে  যেতে হবে। আফটার অল, চাকরীই তো সকলের ফার্স্ট প্রেফারেন্স হওয়া উচিত এযুগে। বিদ্যাসাগরের যুগ চলে গেছে। এখন এই মৃত্যুমুখী মহিলার জন্য দিন-রাতের এটেনডেন্টের খরচ কতদিন যে টানতে হবে, কে জানে! মায়ের সুপুত্রের নাটক আরো কতদিন যে…! নিজের কাছে নিয়ে যাবার কথাই নেই! উঃ! এভাবে ফেঁসে যাবো বুঝি নি! ভাবতে ভাবতে কিছু  বুঝে ওঠবার আগেই দারুণ জোরে আরেকটা ঝাঁকানি…  

মানুষের জীবনে এই ঝাঁকুনিগুলো একেকবার একেক রকম রেজাল্ট নিয়ে আসে। সামনে যমদূতের মতো একটা হেভি লোডেড ট্রাককে ছুটে আসতে দেখে ড্রাইভার ভয়ে এতজোর ব্রেক দিয়েছে যে পেসেন্ট মায়া দেবী এ্যামবুলেন্সের বেড থেকে ছিটকে পড়ে আর বুকে স্টিয়ারিঙের জোর আঘাতে সুস্থ  ড্রাইভারটি… দুজনেই… একদিনে একসাথে...

শঙ্কর নিয়োগী বড় ধাঁধায় পড়ে যায়, বুঝতে পারে না তার আনন্দ হওয়া উচিত না দুঃখ পাওয়া! এ সময়েও কি নাটক চালিয়েই যেতে হয়!     

 

                

 

                

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন