কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

শময়িতা চক্রবর্তী

 

চেক কমিউনিস্ট আগ্রাসনের নিন্দার জন্য দেশ ছাড়লেও আপোস করেননি

(৯৪ বছর বয়সে প্যারিসে প্রয়াত মিলান কুন্দেরা)




শ্লেষ আর হিউমার, তীর্যক ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় অসাধারণ গদ্য। বারবার নোবেলের জন্য মনোনীত কিন্তু পুরস্কার মেলে না। বিখ্যাত চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্দেরা নোবেল প্রাইজকে যেন ঠাট্টা করেই প্রয়াত হলেন ৯৪ বছর বয়সে। তাঁকে পুরস্কৃত করতে না পারায় যেন খর্ব হল নোবেল কমিটির সম্মান। চেক  প্রজাতন্ত্রের মোরাভিয়ান লাইব্রেরি বুধবার তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানায়। কুন্দেরার ব্যক্তিগত সংগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই মোরাভিয়ান লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির মুখপাত্র আনা ম্রাজোভা বলেছেন, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে কুন্দেরা মঙ্গলবার প্যারিসে মারা গিয়েছেন।

কাফকাকাম্যুসার্ত্র-এর পর পশ্চিমের যে ঔপন্যাসিক ত্রয়ী গোটা বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত, তাঁদের অন্যতম ছিলেন কুন্দেরা। ইতালো ক্যালভিনো এবং টমাস বার্নহার্ডের পাশাপাশি। অবশ্য কুন্দেরা শুধু একজন মহৎ ঔপন্যাসিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বমানের একজন উপন্যাসতাত্ত্বিকও। কুন্দেরা সারাজীবন ধরে যা লিখেছেন, তা লিখে কখনই নোবেল পাওয়া যায় না। নোবেল না পাওয়ার জন্য যে  ধরনের লেখা জরুরি, কুন্দেরা ঠিক তাই লিখে গিয়েছেন আজীবন।

শুরুর দিকেও কুন্দেরা গল্প লিখেছেন, তাঁর দেশের কমিউনিস্ট স্বৈরাচারকে প্রকাশ্যে, গোটা বিশ্বের নজরে নিয়ে এসেছেন, এই অব্দি ঠিকই ছিল। কিন্তু প্রথম বইটির পরই, ঠিক ক্যালভিনো এবং বার্নহার্ডের মতোই তিনি গল্প বলার রাস্তা থেকে পুরোপুরি সরে এলেন।

তিনি ফর্ম এবং কনটেন্ট নিয়ে যথেচ্ছভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেন। রাজনীতি এবং যৌনতা হয়ে উঠল তাঁর লেখার মূল দুটি বিষয়। তাঁর লেখা ক্রমেই হয়ে উঠল আরো বেশি করে সেরিব্রাল। তিনি ভোলত্যের বা দিদেরোর মতো ফিলোজফিক্যাল ন্যারেটিভ লিখতে শুরু করলেন। এই ধরনের পরীক্ষামূলক লেখা কখনই নোবেলের জন্য বিবেচিত হতে পারে না। অন্তত নোবেলের ইতিহাস তাই বলে। নোবেল যাঁরা উপন্যাস লিখে পেয়েছেন, তাঁরা গল্প বলেই পেয়েছেন, গল্পকে ভেঙেচুরে তছনছ করে নয়।

১৯২৯ সালে কুন্দেরার জন্ম চেকোস্লোভাকিয়ার বার্নো শহরে। তাঁর বাবা লুডভিক কুন্দেরা ছিলেন খ্যাতনামী পিয়ানোবাদক ও সঙ্গীততত্ত্ববিদ। বাবার হাত ধরেই সঙ্গীতশিল্পে হাতেখড়ি তাঁর।

প্রাথমিক ভাবে সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করলেও পরে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন লেখালেখিতেই। আধুনিক কাফকা আখ্যা দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯৪৮-এ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন কুন্দেরা। কিন্তু  ১৯৫০-এই পার্টি থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা হয় কমিউনিজ়ম-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য। সেই সময়  প্রাগে পাঠরত ছিলেন মিলান। স্নাতক হওয়ার পর সেই শহরেই অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। ১৯৫৬-এ তাঁকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হলেও ১৯৭০ সালে আবার তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৭৫ সালে দেশ থেকেও বিতাড়িত হন তিনি এবং ফ্রান্সে বসবাস করতে শুরু। পরে চেক নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হলেও নিজেকে ফরাসি লেখক হিসাবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করতেন কুন্দেরা।

কুন্দেরা কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ-সহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তাঁর অবদান রেখেছেন। তবে, তাঁর প্রসিদ্ধি মূলত ঔপন্যাসিক বা আখ্যানকার হিসেবেই। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দ্য জোক' প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। সেখানে তৎকালীন চেকোস্লোভাক কমিউনিস্ট শাসনের রূঢ় ছবি তুলে ধরেন তিনি। ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের সমালোচনা করার জন্য তাঁকে একঘরে করা হয়। ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সে চলে আসেন তিনি। প্রথমদিকের লেখালিখিতে তীব্র রাজনৈতিক বক্তব্য থাকলেও আর্ট  অফ দ্য নভেল গ্রন্থে নিজেকে তিনি ইউরোপীয় নবজাগরণ পর্বের সাহিত্যের উত্তরাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেন।

১৯৮৪ সালে 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং' উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে বিশ্ব-সাহিত্যমহলে আলোড়ন পড়ে যায় তাঁকে ও তাঁর লেখা নিয়ে। ১৯৮৮ সালে তাঁর এই উপন্যাস নিয়ে হলিউড ছবিও বানায়। কুন্দেরা পরিচিত হতে শুরু করেন ‘দার্শনিক লেখক’ হিসাবে। তাঁর পূর্ববর্তী রচনা ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ থেকেই রেনেসাঁসের আমলের লেখক সেরভান্তিস, জিওভান্নি বোকাচ্চিও বা  ৱ্যাবলের প্রভাব তাঁর রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। তিনি নিজে সে কথা স্বীকারও করেন। আর এক ফরাসি ঔপন্যাসিক বালজাকের মতো জীবনের নানা দিককে ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেছেন তিনি। ‘ইম্মর্টালিটি’, ‘আইডেন্টিটি’ বা ‘ইগনোর‌্যান্স’ উপন্যাসে তিনি এই আখ্যান কৌশল এবং দর্শনকেই আরও  বিস্তীর্ণ এলাকায় নিয়ে যান। লেখালিখি তো বটেই, প্রকাশনা নিয়েও বেশ খুঁতখুঁতে ছিলেন। একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদও এঁকেছেন কুন্দেরা।

কুন্দেরার রচনায় স্বৈরশাসন বা স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তবে সেই প্রতিবাদ কখনই সরব ছিল না। নিজের আদৰ্শ পাঠকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং নিস্পৃহ ভঙ্গীতে স্বেচ্ছাচারের বিবরণ দিতেন। ২০০৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের চরবৃত্তির অভিযোগও ওঠে। তবে তাঁর রচনার মতো এই সব অভিযোগকে তিনি শ্লেষের সঙ্গেই উড়িয়ে দেন। ২০১৯ সালে তাঁকে চেকোস্লোভাকিয়ার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর নিজের শহর বার্নোতে মিলান কুন্দেরা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু জন্মভূমিতে আর কোনোদিন ফেরেননি কুন্দেরা। জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন কুন্দেরা। ১৯৮৫ সালে তিনি জেরুজ়ালেম পুরস্কার পান। ১৯৮৭তে পান তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দি আর্ট অফ নভেল-এর জন্য পান অস্ট্রিয়ার স্টেট প্রাইজ ফর ইউরোপিয়ান লিটারেচার। ২০২০ সালে তাঁকে ফ্রান্জ কাফকা পুরস্কার প্রদান করে তাঁর দেশ চেকোস্লোভাকিয়া।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন