পরিবার ধর্ষণ ও বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত
ভুল জ্ঞান আর ভুল তথ্য এবং অবৈজ্ঞানিক
জ্ঞান আর অবৈজ্ঞানিক তথ্য মানুষের জীবনের, সমাজের, এবং সর্বোপরি মানবসভ্যতার পক্ষে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেইসঙ্গে
তা কিভাবে মানুষেরই তিল তিল করে গড়ে তোলা এই সভ্যতা-সাম্রাজ্যকে একেবারে লন্ডভন্ড করে
দিতে পারে, এ নিয়ে বোধহয় তেমন কোনও সমীক্ষা বা গবেষণা এ যাবৎকাল পর্যন্ত মানব ইতিহাসে
খুব সম্ভবত আদৌ হয়নি।
সমাজতত্বের ছাত্রী হিসেবে আমাদের পাঠ্যবইতে একটা গল্প বা কাহিনী পড়তে হত। দুজন যমজ শিশুর জন্মের পর দুজনকে রাখা হয় দুটো আলাদা আলাদা পরিবারে। একটি পরিবার একটু শিক্ষিত, সামাজিক আদবকায়দায় অভ্যস্ত, ভদ্র ও নম্র পরিবার আর অন্যটি হল রাস্তার ধারে বস্তিবাসী একটি পরিবার যার বাবা মা ততটা ভালো ভাষায় কথাবার্তা বলে না, ভালো আদবকায়দা একেবারেই জানে না এবং দিন আনা দিন খাওয়া সংসারের মানুষ। এবার জন্মের সাত আট বছর পর যখন তাদেরকে দেখা হয়, সেখানে দেখা যায় একজন খুব ভদ্র, নম্র, কথাবার্তা ও আদবকায়দায় এমনকি শিক্ষার দিক থেকেও যথেষ্ট মার্জিত রুচির মানুষ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে আর একজন ওইটুকু বয়েসেই এদিক ওদিক একা একা নোংরা জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়, কথাবার্তার মাঝখানে গালাগাল দেয়, এইরকম আর কি। আমাদের এটা থেকে এটাই শেখানো হত যে দুটো ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে থাকার ও বেড়ে ওঠার ফলে একই পরিবারের দুটো যমজ শিশুর মধ্যে তাদের বিকাশে কতটা পার্থক্য হয়। একটা বড় সড় গোটা মানুষের পরিবেশ অনেকটাই বহুধা বিস্তৃত হতে পারে। কিন্তু একটা শিশুর পরিবেশ প্রাথমিকভাবে তার পরিবার ও তার আশেপাশের খানিকটা জুড়েই হয়। সেখান থেকেই সে যা শেখবার শেখে এবং পরবর্তীকালে সেইটাই সে উগড়ে দেয় তার নিজস্ব পরিবেশে, এটাই হল মোদ্দা কথা।
না। তার মানে আমি এটা বলতে চাইছি না যে ধর্ষণ করার ব্যপারটাও একজন পরিবারের কাছ থেকেই শেখে। বরং আমি ঠিক এর উল্টো কথাটাই বলতে চাইছি। ধর্ষণ করার ব্যপারটা সব ছেলেরাই কম বেশি পরিবারের কাছ থেকেই শেখে। কিন্তু সেটা কেউ ধর্ষণ বলে চিনিয়ে দিয়ে কেউ শিখিয়ে দেয় না। বরং যা চেনানো, শেখানো হয় সেটা বস্তুত ধর্ষণের চাইতেও বেশি কিছু, বিশ্বাস করুন। আমরা সেই কথাতেই এবার যাব। তার আগে একটা ছোট্ট কথা বলে নিই। তা না হলে খুব তুমুল ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থেকে যাবে আপনাদের সঙ্গে আমার এখানে। ওপরে ওই যে বললাম না, ধর্ষণের শিক্ষাটা কম বেশি সব পরিবারেই শেখানো হয়। সেইখানে একটু ভুল হয়ে গেছে আমার। ভুলটা এইরকম যে সেটা সব পরিবারেই নয়। কোটিতে গুটি যাকে বলে, সেই কয়েকটা পরিবারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্ষণ করতে পারে এমন কোনও শিক্ষাই তাদের ছেলেদের দেওয়া হয় না। সেখানে শিক্ষা দেওয়া হয় সব মানুষই সমান। কেউ ছোট কেউ বড় নয়। তাছাড়াও পৃথিবীতে আমাদের চারদিকে বিভিন্নরকম মানুষ আছে, রুচি, পরিচয়, পছন্দ-অপছন্দ, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং অবশ্যই লিঙ্গ – এইসবের নিরিখে। যেখানে যে যেমন আছে, তাকে কোনও রকমভাবে জোর করে পাল্টাবার চেষ্টা না করে বা অবজ্ঞা না করে তেমন ভাবেই হৃদয়ে গ্রহন করতে। অর্থাৎ বহুও থাকবে, আবার তার পাশাপাশি ঐক্যও থাকবে। আমাদের দুটোকেই স্বীকার করে নিয়ে বহুর মধ্যে ঐক্যকে গ্রহণ করতে হবে। আমরা সবাই এক ও সমান। এই আর কি।
আমাদের পুরো পৃথিবীর সামাজিক কাঠামোয় প্রায় গোটা সমাজ জুড়েই অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে পরিবার বলতে সবটাই পিতৃশাসিত। আমাদের সব পরিবারেই প্রধান হচ্ছে পুরুষ। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষ। এমন কি মায়েদেরও। শিশুর জন্মের পর থেকে সে দেখে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সবার ওপর কক্তৃত্ব করে। অন্যদিকে শিশুর মা বা অন্যান্য নারী সদস্য যারা থাকে তারা দূর্বল, ছোট, অধস্তন ও অনুকম্পার পাত্রী। সেখানে মায়েদের মতামতকে কখনই প্রায় গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অন্যদিকে ভুল হোক, অন্যায় হোক, তবু বাবার কথাই শেষ কথা। পিতাকে দেখা হয় প্রভু হিসেবে। পরিবারের আয়ের জন্য মূলত পুরুষের ওপরেই নির্ভর করা হয়। অন্যদিকে ঘরের সব কাজকর্মই মায়েরা এবং মেয়েরা করে। এমনকি পরিবারের নিজস্ব প্রাথমিক নিয়মকানুনগুলো শিশু শেখে তার মায়ের কাছ থেকেই মূলত। তাই পিতৃতন্ত্রের সমস্ত নিয়ম বা শর্ত মেনে চলার শিক্ষা আমরা মায়ের কাছ থেকেই পাই। পরিবারই প্রথম শেখায় জন্মগতভাবে নারীর ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার পুরুষের আছে। আবার আমরা নির্যাতিত হই, অত্যাচারিত হই পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই। পরিবারই প্রথম নারীকে চুপ করে থাকার, মার খাওয়ার, মেনে নেওয়ার, মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা দেয়। আর শৈশব থেকে প্রতিটি শিশু এটা দেখতে দেখতে বড় হয়। এমনকি সে তার নিজের পরিবারের আশেপাশের এই লৈঙ্গিক বৈষম্য দেখতে দেখতে এটাকেই জীবনে বেঁচে থাকার প্রধান ও প্রাথমিক শর্ত হিসেবে ভাবতে শেখে। আর্থসাংস্কৃতিক বৈষম্য বা জাতি-ধর্মগত বৈষম্য ভেদেও এই লৈঙ্গিক বৈষম্য একই থাকে। কোথাও এতটুকু পরিবর্তন হয় না। কেট মিলেটের ভাষায়, ‘লিঙ্গের ক্ষেত্রে পুরুষ বুর্জোয়া, নারী প্রলেতারিয়েত’। মন্তব্যটা একেবারে যথার্থ।
এইভাবেই সেই শিশুটিই যখন বড় হয়, তখন দেখে ধর্মের নামে, অধিকারের নামে কীভাবে একজন নারী একটি পরিবারে বউ হয়ে ঢুকে বিনা পয়সার ফুলটাইম কাজের লোক ও যৌনদাসী হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষিত কিম্বা অশিক্ষিত সমস্ত পরিবারেই নারী হচ্ছে নিতান্তই ভোগ্যপণ্য। তাকে পুরুষ যখন চাইবে তখনই ভোগ করতে পারে। এমন কি তার জন্যে তার মতামত, ইচ্ছে-অনিচ্ছেরও কোনও দাম নেই সেই পুরুষটির কাছে বা সমাজের কাছেও। এর ওপরে আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারই কোনও না কোনও ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। আর ধর্মে তো নারীকে অধম, নরকের দ্বার, এসব বলে চিনহিত করাই আছে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকবে নারী। নারী স্বাধীনতার অযোগ্য। আর হাদিসে পুরুষকে নারীর দ্বিতীয় বিধাতার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কোরানে বলা হয়েছে স্ত্রীরা হল পুরুষদের জন্য শস্যক্ষেত্র। পুরুষ যেভাবে খুশি নারীকে ব্যবহার করতে পারে।
মেয়েরা সবসময়েই ছেলেদের ভয়ে ভীত থেকেছে, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে পিতৃতন্ত্রের সমস্ত অন্যায় অনুশাসন। আর পরিবারের মধ্যেই এর সবচেয়ে বেশি দর্শন ঘটে। তার ওপর এই এতসব শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে একটা ছেলে যখন বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছায়, তখন তার শরীরও ফিসফিস করে তার কানে আরও অনেক কথা বলে। আর আমাদের সমাজে তো ছেলেদের বয়ঃসন্ধিকালে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনও ব্যবস্থাই নেই, যেমনটা আছে মেয়েদের বেলায়। মেয়েরা শৈশব কৈশোর থেকেই আজীবন সংযমের শিক্ষা পেয়ে বড় হয়। কিন্তু ছেলেদের এ শিক্ষা দেবে কে? হাজার হোক পুরুষ হয়ে জন্মেছে। তাদের আবার কোথায় কিসের ডর, কোথায় কিসের সংযম বা তার প্রয়োজনীয়তা! ছেলে হয়ে জন্মেই সে জগত সংসারকে যথেষ্ট ধন্য করে দিয়েছে। তাই তাদের বয়ঃসন্ধিটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পর্ণসাহিত্য আর পর্ণচলচ্চিত্রই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তার ওপরে যদি কোথাও কোনও বেপথু জীবন হতাশায় আক্রান্ত হয় কিম্বা বারনারীগমনের তেমন সুসংহত উপায় না থাকে, না থাকে তেমন কোনও বান্ধবীও, তাহলে ধর্ষণ ছাড়া উপায় কী?
পিতৃতন্ত্রের সবচেয়ে খতরনাক অস্ত্র হল ‘বিয়ে’। এই বিয়েকে বিভিন্ন সময়ে অর্থাৎ সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সাহিত্যিক ডকুমেন্টে যেগুলো কিনা মূলত ধর্মীয় উপাখ্যান, যেখানে পরজন্মের ধারণার অস্তিত্ব আছে বা অন্য কোনও ডকুমেন্ট যেগুলো আদৌ ধর্মীয় নয়, সেসব জায়গায় ‘জন্মজন্মান্তরের বন্ধন’ বা ‘সাত জন্মের বন্ধন’ বা তিন জন্মের বন্ধন’ ইত্যাদি বলে তার গুরুত্ব ও মহানুভবতা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকই তাই? এর এক ও একমাত্র উত্তর হচ্ছে, ‘না। কখনই না’। এই যে আমি ‘না। কখনই না।’ বললাম সেটা এইজন্য নয় যে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে পরজন্মের ধারণাটার পরিসমাপ্তি অনেক আগেই ঘটেছে। কেননা প্রাচীন কালেও অবশ্য আমাদের দেশে চার্বাক মতাবলম্বীরা ছিলেন এবং তখন বিজ্ঞানের চৌহদ্দিটা এতটা বিস্তৃত হয় নি, এমনকি তার অস্তিত্বটাও প্রায় যথেষ্ট, যথেষ্ট খুদে কলেবরে ছিল।
(ক্রমশ)
আগ্রহোদ্দীপক লেখা
উত্তরমুছুন