কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১৩২

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

শিবাংশু দে

 

শোলে অথবা আর্বান নাস্তিকতা

 


'কিতনে আদমি থে?

-দো সরকার!

-সির্ফ দো? ফির ভি ওয়াপস আ গয়া? খালি হাঁথ?'

এই 'দো আদমি' যেন ভবসংসারের আস্তিক আর নাস্তিক। এদের ঝগড়া যেন 'শোলে' ফিলিম। কখনও পুরনো হয় না। অপ্রাসঙ্গিকও হয় না। কিন্তু ফিরতে হয় 'খালি হাঁথ'। ফোস্কা-কাতর যে সব জনতা ঠাকুরের মাথায় জল ঢালতে যান, তাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের মতো অমন আস্তিক আর কেউ নয়। পাশের লোকটি আচমকা হেঁচে ফেললেও যাঁরা ভাবেন 'আস্থা আহত হুয়া', তাঁরাও তেমনই ভাবেন। আবার এক দল 'সফিস্টিকেটেড' আস্তিক আছেন, যাঁরা খালি পায়ে জল ঢালতে যাবার ধকল সামলাতে পারেন না, তাঁদের আস্তিকতা অন্যরকম। যে কোনও 'বিতর্কে'র সময় তাঁরা ঠাণ্ডা গলায় বলেন, 'ভক্ত নই, কিন্তু একটা 'শক্তি'তে বিশ্বাস করি। কে চালাচ্ছে সব কিছু?' সেটা আবার একটা মারাত্মক অবস্থান। 'শক্তি' বলতে তাঁরা কী বোঝেন, তার জবাব তাঁদের কাছে নেই। যাঁরা নিজেদের উচ্চকিত ভাবে 'নাস্তিক' বলে দাবি করেন, তাঁদের ব্যাপারও বেশ সন্দেহজনক। 'নাস্তিকতা' একটা মানসিক অবস্থান। চেঁচামেচি করে তাকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যাকগে, সম্প্রতি এক বন্ধু এই বিষয়ে আমার অবস্থান জানতে চেয়েছিলেন। এতো 'কোটিন' বিষয় 'টু মিনিট নুডলস' এর মতো স্মার্টলি ব্যাখ্যা করা যায় না। আমার ধারণায় এদেশে বিষয়টি নিয়ে সব চেয়ে স্বচ্ছ ধারণা ছিলো শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধের। তাঁকে উপজীব্য করে লেখা আমার নিবন্ধটি থেকে সামান্য অংশ ঊদ্ধৃত করলুম। আগ্রহী বন্ধুরা পড়তে পারেন,

‘…অস্তি, বা বিপরীতে নাস্তি শব্দের মূল রয়েছে কোনও একটি অস্তিত্ত্বের ধারণার মধ্যে। ব্যাপারটা বলা যত সহজ, অবস্থাটি তত সহজ নয়। এত বহুমুখী ও বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা, তর্ক ও অবস্থান রয়েছে এই প্রশ্নে যে, তাকে সরলীকরণ করতে চাওয়া বিপজ্জনক। যদিও পরবর্তীকালে নাস্তিকতার প্রশ্নটি যখন মূলতঃ রাজনৈতিক অবস্থান হয়ে গেল, তখন উত্তরটিও সহজ বাইনারিতে ব্যাখ্যা করা শুরু হলো। যে ঈশ্বরকে মানে, সে আস্তিক এবং বিপরীত হলেই নাস্তিক। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু যাঁরা 'ঈশ্বর' নামক সূচক দিয়ে আস্তিকতার অবস্থান বিচার করেন, তাঁদের অধিকাংশের কাছেই স্পষ্ট নয় 'ঈশ্বর' অর্থে কার বা কীসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে একটা সাধারণ ধারণা রয়েছে যে, এই দেশের মানুষ বৃহত্তরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী বা 'ধর্মভীরু'। এই প্রচারটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো আদি শংকরাচার্যের আধ্যাত্মিক মন্থনের সময় থেকে।

আমাদের দেশে ঈশ্বরভিত্তিক অস্তি-নাস্তির প্রশ্নটি নিয়ে বিশদ আলোচনা শুরু হয় বেশ দেরিতে। কারণ, এদেশের দর্শনভূমিতে সেমেটিকদের মতো একেশ্বরবাদী প্রকল্পনাটির স্থান প্রস্তুত হয়েছিলো পুরাণযুগের দ্বিতীয় পর্বে মাত্র। সময়কালের বিচারে অর্বাচীনতম দর্শন, উত্তরমীমাংসা, অন্য নাম বেদান্ত, সেখানে ব্রহ্মমীমাংসা নাম দিয়ে ঈশ্বরের পরিভাষা প্রস্তাব করা হয়েছিলো। "যাঁর থেকে এই জগতের জন্মাদি, তিনিই ব্রহ্ম" (জন্মদস্য যতঃ) -(বেদান্তসূত্র ১/১/২)

অর্থ সম্প্রসারণ করলে দাঁড়াবে, “যাঁর থেকে জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও ভঙ্গ হয়, তিনিই ব্রহ্ম।" এখানে এক অদ্বয়, সর্বশক্তিমান, সর্ব সৃজক 'ব্রহ্ম' বা 'ঈশ্বর'কে কেন্দ্রে রেখে দর্শনটি দানা বেঁধেছে। অথচ ভারতীয়  দর্শনচর্চার যে মূল ছ'টি ঘরানা রয়েছে, যাকে একসঙ্গে ষড়দর্শন বলা হয়, সেগুলি বিচার করলে ভারতীয়দের বহুবিজ্ঞাপিত 'ঈশ্বরবিশ্বাসে'র পূর্বাগ্রহটি বাতুল বোধ হয়। ষড়দর্শনের প্রায় সব প্রবক্তাই ‘সৃষ্টিকর্তা’ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। আমাদের প্রাচীনতম দর্শন কপিলমুনির সাংখ্য, বা সাংখ্যের পথে বিকশিত যোগ বা লোকায়তদর্শন, সবই দ্ব্যর্থহীনভাবে নিরীশ্বরবাদী। কপিলমুনিই সম্ভবত প্রথম মানুষ, যিনি অতি স্পষ্টভাবে ঈশ্বরতত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, "ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ", মানে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব অপ্রমাণিত। যুগে যুগে যাঁরা এই বক্তব্যটি নিয়ে তর্ক করেছেন, তাঁরা কিন্তু কেউই বলতে পারেননি 'নির্গুণ' ঈশ্বর সগুণ প্রকৃতিকে কীভাবে সৃষ্টি করলেন। পতঞ্জলি 'ঈশ্বরে'র অস্তিত্ত্ব অস্বীকার করেননি বটে, কিন্তু তাঁর ঈশ্বর বিশ্বস্রষ্টা ন'ন। বৈশেষিকদর্শনের কণাদ বা গোতম জড় পরমাণুকে বিশেষ বা নিত্য বলেছেন। ঈশ্বরকে নয়। প্রাচীন মীমাংসা বা পূর্বমীমাংসার প্রধান প্রবক্তা জৈমিনি 'ঈশ্বরে'র  অস্তিত্ত্ব অস্বীকার করেছেন।

“অপৌরুষেয় এষঃ সম্বন্ধঃ ইতি পুরুষস্য সম্বন্ধভাবাৎ।

কথং সম্বন্ধো নাস্তি। প্রত্যক্ষস্য প্রমাণস্যাভাবাৎ তৎপূর্বক ত্বাচ্চেতরেষাম।“

(জৈমিনিসূত্র ভাষ্য)

[অপৌরুষেয়, অর্থাৎ কোনও পুরুষ দ্বারা (এই বিশ্ব) কৃত নয়। কারণ সেরকম কোনও সম্বন্ধপুরুষই নেই। এরকম পুরুষের কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো নেইই, অন্য কোনও পরোক্ষ প্রমাণও নেই।]

উপরন্তু যে বেদান্তে 'ব্রহ্ম' নামক সর্বসৃজক, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই দর্শনই তো বলে জগৎ এখনও সৃষ্টিই হয়নি। সবই মায়াভ্রম। যদি সৃষ্টিই না থাকে, তবে সৃষ্টিকর্তার প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে!

সাংখ্যের সমসাময়িক বা পূর্বতন দর্শন ছিলো চার্বাকপন্থীদের। তাঁরা সর্ব অর্থে ছিলেন 'নাস্তিক'। এদেশে চার্বাককে আদর্শ নাস্তিক বলা হয়েছে। কারণ এই দর্শন একাধারে জড়বাদী (Materialist), উচ্ছেদবাদী (Nihilist), দৃষ্টবাদী(Positivist), সংশয়বাদী(Agnostic), হেতুবাদী(Ratinalist), প্রেয়ংবাদী(Hedonist), দেহবাদী, অনাত্মবাদী ও ইহসর্বস্ববাদী। সর্বদর্শনসংগ্রহে চার্বাককে 'নাস্তিক শিরোমণি' বলা হয়েছে। অতএব চার্বাকের মানদণ্ডেই বুদ্ধের 'নাস্তিকতা'র মূল্যায়ণ করা যেতে পারে। চার্বাকপন্থীদের মূল গ্রন্থ সর্বদর্শনসংগ্রহে এই মতবাদ নিয়ে যেসব চর্চা আছে তার কিছু অতি সংক্ষিপ্ত বিচার করতে গেলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে।

“ন স্বর্গো নাপবর্গোবা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ।

নব বর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকাঃ।।

অগ্নিহোত্রং ত্রয়োং বেদাস্তিদণ্ডং ভস্মগুণ্ঠনম।

বুদ্ধিপৌরুষ হীনানাং জীবিকা ধাতৃনির্ম্মিতা।।“

(সর্বদর্শনসংগ্রহ-চার্বাক দর্শন)

[স্বর্গ নেই, অপবর্গ নেই, পরলোকে আত্মাও থাকে না। ব্রাহ্মণাদি বর্ণ বা ব্রহ্মচর্যাদি আশ্রম ইত্যাদির কোনও ফলদায়ক ক্রিয়া নেই। অগ্নিহোত্র, ঋক, সাম আদি তিনটি বেদ, ত্রিদণ্ড, দেহে ভস্মলেপন ইত্যাদি, বিধাতা অবোধ কাপুরুষ ব্যক্তিদের জীবিকা অর্জনের জন্য সৃষ্টি করেছেন।]

সমকালীন অধ্যাত্মজগতে নাস্তিক্যবাদের যে পরিভাষাটি প্রভাবী ছিলো, সে প্রসঙ্গে বুদ্ধের এই বিবৃতিটি পাওয়া যায়,

“নত্থি দিন্নং, নত্থি য়িষ্টং, নত্থি হুতং, নত্থি সুকত-দুক্কানাং কম্মানংফলং বিপাকে। নত্থি অয়ং লোকে নত্থি পরো লোকো, নত্থি মাতা নত্থি পিতা, নত্থি সত্তা ওপপাতিকা, নত্থি লোকে সমনব্তাহ্মণা সম্মাগগতা সম্মাপটিপন্না যে ইমং চ লোকংপরং চ লোকং সয়ং, অভিঞঞা সচ্ছিকত্বা পবেদেস্তি।“ ...ইত্যাদি

(মজ্ঝিমনিকায়)

[চারটি ভূতের দ্বারা নির্মিত যে দেহ, সেটাই জীব। দেহের অতিরিক্ত কোনও আত্মা নেই। শ্মশানেই মানুষের সব শেষ। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিতি মাটিতে, অপ জলে, তেজঃ আগুনে, মরুৎ বায়ুতে আর ইন্দ্রিয়সকল আকাশে মিলিয়ে যায়। অজ্ঞবিজ্ঞ সকলেই দেহের নাশের সঙ্গে বিনষ্ট হয়ে যায়। ইহলোক পরলোক ভেদ করা মূর্খতা। দান-শীল-ত্যাগ-কৃত্য সবই পণ্ডশ্রম, নিরর্থক ও নিষ্ফল।]

শ্রীরামকৃষ্ণ (বুদ্ধের এই ভাষ্য প্রসঙ্গে) বলেন,

‘…নাস্তিক কেন? নাস্তিক নয়, মুখে বলতে পারেন নাই। বুদ্ধ কী জান? বোধ-স্বরূপকে চিন্তা ক'রে ক'রে, -তাই হওয়া, -বোধস্বরূপ হওয়া... নাস্তিক কেন হতে যাবে! যেখানে স্বরূপকে বোধ হয়, সেখানে অস্তি-নাস্তিক মধ্যের অবস্থা... যা'রা সংসারী, ইন্দ্রিয়ের বিষয় নিয়ে র'য়েছে, তারা বলছে, সব 'অস্তি'; আবার মায়াবাদীরা বলছে, -'নাস্তি'; বুদ্ধের অবস্থা এই 'অস্তি' 'নাস্তির' পরে’।

বুদ্ধের নাস্তিক্য বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের অবস্থানটি মূলত মহাযানী শূন্যবাদের বিকশিত রূপ। শুধু তাই নয়, বুদ্ধের নাস্তিকতা প্রসঙ্গে এটাই এদেশে সব চেয়ে প্রচলিত মত। শ্রীরামকৃষ্ণ তো স্পষ্টত মায়াবাদীদের কথাও উল্লেখ করেছিলেন। আড়াই হাজার বছর কেটে যাবার পরেও মানুষের যেন বিশ্বাস হতে চায় না শাক্যমুনি এমন একটা অধ্যাত্মদর্শনের খোঁজ দিয়েছিলেন, যেখানে আত্মিক উন্নতির জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নামক কোনও অস্তিত্ত্বের প্রয়োজন নেই।

'ঈশ্বর'বিশ্বাস না থাকলেও উচ্ছেদবাদী (Nihilist) হতে হয় না। ঈশ্বররহিত মানবধর্ম পালন করেই বুদ্ধ শ্রেষ্ঠ মানব হতে পেরেছিলেন। ‘অস্তিনাস্তি’র বালাই তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অশ্বত্থের পাতায়, শাখায়।

{'বুদ্ধ ও নাস্তিকতা' (বুদ্ধ- এক অনন্ত অডিসি) থেকে সামান্য অংশ}

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন