কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২১

সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১২১ / দ্বাদশ বর্ষ : প্রথম সংখ্যা

 

বিগত চারমাস ‘কালিমাটি অনলাইনএর কোনো সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি। অপ্রত্যাশিত এক দুর্ঘটনার দরুন আমি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলাম। বস্তুত গতবছর সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি এই বিপত্তি ঘটেছিল। সেই মাসেই প্রথম অপারেশনও হয়েছিল। এবং তখন থেকেই হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে গেছিল। তারপর যখন একটু সুস্থ হয়ে হাঁটাচলার চেষ্টা করছি, তখনই আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসি, প্রথম অপারেশন আর কার্যকরী হয় না। সুতরাং আবার শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি। চিকিৎসা চলতে থাকে। গত মার্চ মাসে দ্বিতীয় অপারেশন হয়। এবং তারপর পুরোপুরি বিশ্রামে থাকার নির্দেশ থাকায় আর কোনো কাজই করতে পারি না। যদিও অসুস্থতা সত্ত্বেও গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এবছরের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ‘কালিমাটি অনলাইন নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। কিন্তু মার্চ মাস থেকে আর সম্ভব হলো না। ইতিমধ্যে আমি আগের থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছি, ঘরে সামান্য হাঁটাচলা করছি ওয়াকারের সাহায্যে, কিন্তু ঘরের বাইরে যাবার মতো সুস্থ হয়ে উঠিনি। বিশেষত অল্পদিনের মধ্যেই আমাকে আরও দুটো পায়ের অপারেশন করাতে হবে। তাসত্ত্বেও ‘কালিমাটি অনলাইন আর স্থগিত রাখা যায় না। তাই জুলাই মাস থেকে পুনরায় শুরু করলাম। এবং চেষ্টা করব ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত প্রকাশ করতে। আপনাদের সবার শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও সহযোগিতায় এই চেষ্টা সফল হবে আশাকরি।

মার্চ সংখ্যা থেকে ‘কালিমাটি অনলাইনএর বছর শুরু হয়। এবছর তা সম্ভব হয়নি, তাই বর্তমান জুলাই মাসে পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো বলা যেতে পারে। প্রসঙ্গত জানাই, আমাদের এই অনলাইন পত্রিকায় প্রবীণ ও নবীন উভয় পর্যায়ের কবি ও সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশ করে থাকি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেই লেখকেরা তাঁদের লেখা পাঠিয়ে থাকেন। অত্যন্ত মর্যাদার সেইসব লেখা গৃহীত হয়। এবং মনোনীত লেখা প্রকাশিত হয়। যাঁরা বাংলাসাহিত্য চর্চা করে থাকেন, তাঁদের সবাইকে ‘কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনে স্বাগত জানাই এবং লেখা পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাই। উল্লেখ করা বাহুল্য হবে, তাও জানাই সারা বিশ্ব জুড়ে বাংলাসাহিত্য চর্চা হচ্ছে অনুরাগে ও নিবিড়ভাবে। কেননা বাংলাভাষী মানুষেরা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছেন কর্মসূত্রে অথবা ব্যবসার কারণে। নিজের ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁরা সচেতন এবং দায়বদ্ধ। আমাদের ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিন সেই চর্চারই একটি অন্যতম প্রয়াস। আপনাদের সবার  যোগদান ও সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com  

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব


অদিতি ফাল্গুনী

 


অপ্রতিরোধ্য অগ্নিপাথর: শুলামিথ ফায়ারস্টোন




নারীবাদী তাত্ত্বিক ও লেখক শুলামিথ ফায়ারস্টোন যখন ১৯৭০ সালে তাঁর নারীবাদী ইশতেহার দ্য ডায়ালেক্টিক অফ সেক্স: দ্য কেস ফর ফেমিনিস্ট রেভল্যুশন প্রকাশ করেন, বইটি প্রকাশনা জগতে তীব্র আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিল। আজ অর্দ্ধ-শতাব্দী পর, কৃত্রিম জরায়ু তৈরির জন্য তাঁর আহ্বান, প্রায়ই ঠাট্টা বা উপহাসের সাথে হলেও স্মরণ করা হতো বা হয়।

তবে আজ যখন নারীর গর্ভপাতের অধিকার এবং পুনরুৎপাদন প্রযুক্তি আবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে, তখন নারীর পুনরুৎপাদনমূলক শ্রম শোষণ বিষয়ে তাঁর যুক্তি খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

কানাডীয় বংশোদ্ভুত ফায়ারস্টোন ছিলেন চারুকলার এক শিক্ষার্থী এবং শিকাগো ও নিউইয়র্কে সত্তরের দশকের নারীমুক্তি আন্দোলনে তিনি হয়ে ওঠেন প্রধান প্রবক্তাদের একজন। দ্বিতীয়-তরঙ্গ বা সেকেন্ড ওয়েভ নারীবাদের অন্যতম পুরোধা শুলামিথ উনিশ শতকের শেষ পর্যায়ে সূচিত নারীবাদী আন্দোলনের যে পুনর্জাগরণ ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে দেখা দিচ্ছিল, তারই সম্মুখসারির যোদ্ধাদের একজন অংশ হিসেবে তিনি বিখ্যাত হন। তাঁর বইয়ের প্রচুর বিক্রি হতো এবং মূলধারার ভাষ্যকার ও অন্যান্য নারীবাদীদের কাছ থেকেও তিনি প্রশংসা ও নিন্দা- দু’টোই প্রচুর পরিমাণে পেয়েছেন।

শুলামিথকে নিয়ে বিতর্কের বড় কারণ ছিল যে তিনি গর্ভাবস্থাকে বর্বরতার সূচক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং নারীর গর্ভধারণের ভূমিকাকেই নারী শোষণের মূল উৎস হিসেবে সনাক্ত করেছিলেন। এবং লৈঙ্গিক এই  বৈষম্যের সমস্যা নিরসনে যে কাল্পনিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন-চিত্র তিনি এঁকেছিলেন, সেখানে জৈবিক পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াকে তিনি এক্টোজেনেসিস বা কৃত্রিম গর্ভে ভ্রুণের বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে  চেয়েছেন- এর উদ্দেশ্য ছিল নারীকে প্রজননের অত্যাচার থেকে মুক্ত করা

১৯৭০ সালে ফায়ারস্টোনের এসব প্রস্তাবনা কল্পবিজ্ঞানের বিষয় বলে উড়িয়ে দেয়াটা সহজ ছিল। কিন্ত ২০১৭ সালে বিজ্ঞানীরা একটি বায়োব্যাগ তৈরিতে সক্ষম হন এবং এই বায়োব্যাগের ভেতর একটি ভেড়ার ভ্রুণ কয়েক সপ্তাহ রাখা হয়েছিল। মানবভ্রুণ নিয়ে এমন যে কোন সম্ভাব্য গবেষণা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নৈতিক  ও রাজনৈতিক প্রভাব গণনা করাটা শুরু হতে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিম গর্ভ কিন্ত গর্ভপাত বিতর্কের শর্তাবলী আমূল পরিবর্তনে সক্ষম হবে।

ফায়ারস্টোন প্রজনন প্রযুক্তির নতুন নানা আবিষ্কারকে নারীর প্রজনন বা পুনরুৎপাদন সংক্রান্ত পছন্দ-অপছন্দ এবং স্বাধিকারকে বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে দেখেছেন। তবে একইসাথে এই সম্ভাবনাও সমান হারে থেকে যাচ্ছে যেখানে এসব অত্যাধুনিক, নতুন প্রজনন প্রযুক্তি গর্ভবতী নারীদের দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্যের নতুন সব প্রকরণকে বৈধ করতে ব্যবহার করা হবে, যেমন গর্ভপাত-বিরোধীরা এখন যুক্তি দিচ্ছেন যে ভ্রুণ যদি কৃত্রিম গর্ভাধারে রাখা যায়, তবে গর্ভপাত করার আর দরকার নেই।

নিপীড়ন এবং প্রযুক্তি

ফায়ারস্টোন মনে করতেন যে নারীর প্রতি সমাজে বিদম্যান নির্যাতন বা নিপীড়নের ঐতিহাসিক উৎসের শেকড় রয়েছে কার্যকরী জন্ম-নিরোধক বিপুল হারে সহজলভ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত উর্বরাশক্তি সম্পন্ন মেয়েদের অনিয়ন্ত্রিত হারে গর্ভবতী হয়ে পড়ায়। সন্তান ধারণের উপযোগী বয়সের অধিকাংশ নারীকেই যে গর্ভধারণ বা গর্ভাবস্থা, সন্তানের জন্মদান এবং ছোট শিশু সন্তানকে বড় করার ধারাবাহিক চক্রে আবদ্ধ থাকতে হয়েছে বা হতো, এটাই নিশ্চিত করতো যে নারীকে তার জীবনের মৌল চাহিদা তথা খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয়ের মত মৌল চাওয়াগুলোর জন্য পুরুষের উপর নির্ভরশীল হতে হবে এবং সামাজিক আরো নানা কাজ বা সক্রিয়তা থেকে নির্বাসিত বা বিচ্ছিন্ন হতে হবে। মানবজাতির ভেতর প্রথম শ্রেণি বিভাজনের এভাবেই সূচনা হয়েছিল- পুরুষ উৎপাদক ও নারী পুনরুৎপাদক হয়ে ওঠার মাধ্যমে।

ফায়ারস্টোনের বক্তব্যের মৌল প্রতিপাদ্য ছিল যে এসব কিছুই বদলে দেওয়া বা পরিবর্তন করা সম্ভব। প্রজনন প্রযুক্তির নানা অগ্রগতি যেমন নির্ভরযোগ্য জন্ম-নিরোধ, গর্ভপাতের নিরাপদ নানা প্রক্রিয়ার আবিষ্কারের পাশাপাশি উদীয়মান আইভিএফ প্রযুক্তি নারীকে তাঁর প্রজনন সক্ষমতা বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। প্রজনন প্রযুক্তির অত্যাধুনিক এসব কৌশলের ফলে নারী তার নিজের ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী মা হবে কি হবে না সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বা পছন্দ-অপছন্দ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারছিল।

তবে ১৯৭০-এর দশকের সমস্যা ছিল যে নারীর প্রজননক্ষমতা বিষয়ে স্বাধিকারের প্রতিশ্রুতি আনতে পারতো  যে প্রজনন প্রযুক্তি, সেই প্রযুক্তি তখনো পর্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল সব শক্তির নিয়ন্ত্রণে ছিল যারা নারীকে গর্ভপাতের অধিকার ত’ দেয়ইনি অথবা শুধুমাত্র বিবাহিত নারীদেরই জন্ম-নিরোধক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল।

নারীর প্রতি চাপানো প্রকৃতির অদ্ভুত বৈষম্যের শোধ নিতেই যেন তাই ফায়ারস্টোন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক কার্ল  মার্ক্সের কথা থেকে ধার করে সব নারীকে সাময়িক ভাবে ’মানবীয় উর্বরতার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে’ আহ্বান জানান- নারীকে তার নিজের জন্য প্রজনন প্রযুক্তিকে লাগসই করে তোলার ডাক দেন তিনি, ঠিক যেমন কার্ল মার্ক্স সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েতকে উৎপাদনের হাতিয়ার দখলের ডাক দিয়েছিলেন। এই আহ্বান জানানোর মাধ্যমেই শুলামিথ বলতে চেয়েছেন যে গর্ভপাত সহ আইভিএফ প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ মেয়েদের হাতেই থাকা উচিত এবং পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর মেয়েদের নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়।

নারীকে যদি তার সনাতনী পুনরুৎপাদন বা প্রজনন দায়িত্ব বা ভূমিকা থেকে মুক্ত করা যায় বা যেতো, তবে  এক নতুন ধাঁচের সন্তান লালন-পালন প্রক্রিয়ার জন্ম হতে পারতো। আধুনিক দম্পতি-কেন্দ্রিক বা শুধুই পিতা-মাতা-সন্তানকে নিয়ে গড়ে ওঠা পরিবারকে শুলামিথ পুরুষালী ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। নারী তার চিরাচরিত প্রজনন ভূমিকা থেকে মুক্তি পেলে দম্পতি-কেন্দ্রিক পরিবার ব্যবস্থা নির্মূল হয়ে এক  বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া শিশু লালন-পালন করার অবকাঠামোয় সন্তানেরা কিছু প্রাপ্ত-বয়ষ্কের হাতে মানুষ হতে পারতো- এমন বাড়িগুলোকে ‘পরিবার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন শুলামিথ। সন্তানকে মানুষ করার দায়  ভাগ করে নেওয়াটা নারীকে তার আগের পেশা বা সত্ত্বা ত্যাগ না করেই মা হবার সক্ষমতা যোগাবে। শিশুরা  বেশ কিছু প্রাপ্ত-বয়ষ্কের হাতে লালিত-পালিত হবার সম্পর্ক থেকে অনেক লাভবান হবে, পাশাপাশি জৈবিকভাবে পিতা-মাতা হতে অক্ষম মানুষেরাও পালক পিতা-মাতা হবার স্বাদ পাবে।

আজকের দিনে ফায়ারস্টোনের পুনর্পঠন:

দ্বিতীয় তরঙ্গের পর থেকে নারীবাদী তত্ত্বের বিবর্তন ফায়ারস্টোনের কাজে গুরুতর নানা ভুল সনাক্ত করেছে। এর ভেতর একটি হলো কালো বা আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূ‚ত মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতার ঐতিহাসিক অপব্যবহার  প্রশ্নে শুলামিথের আদৌ দৃকপাত না করা এবং দেহ নিয়ে এক অসম্ভব ভয় বা ভীতিবোধ যা তাকে দিয়ে শুধুই গর্ভধারণের দৈহিক সঙ্কট বা সমস্যা বিষয়ে একমুখী ভাবে আলোকপাত করিয়েছে। সন্তানের জন্মদানকে তিনি ’কুমড়োর মত কিছু একটা মলত্যাগ করা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

তবে আজকের দিনে ফায়ারস্টোনের ইশতেহার তার যাবতীয় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হালের নারীবাদীদের পড়ার  তালিকায় ফিরে ফিরে আসছে। এটা অংশত: তাঁর কাজ ‘প্রজনন বিচার আন্দোলন’-এর নীতিমালার সাথে  সামঞ্জস্যপরায়ণ বলে, যা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শেষ করে দেবার অধিকারের পক্ষে আওয়াজ  তোলে এবং অংশত: শিশু লালন-পালনের জন্য সেসব শর্তাবলীর কথা তোলে যা শিশু এবং তার প্রতিপালকবৃন্দ- উভয়পক্ষকেই বিকশিত হবার সুযোগ দেয়।



হালে ফায়ারস্টোন ‘জেনোফেমিনিস্ট’ বা প্রযুক্তির মাধ্যমে লৈঙ্গিক অসমতা দূর করার দাবি তোলা নারীবাদীদের দ্বারা উদ্ধৃত হচ্ছেন, যারা প্রগতিশীল নানা লক্ষ্যে প্রযুক্তি ‘হ্যাক’ করা বা ছিনিয়ে নেবার পক্ষে  কথা বলেন। এবং একইসাথে জৈবিক পরিবারের বাইরে যেয়ে বা উর্দ্ধে উঠে যারা আত্মীয়তা এবং শিশুর লালন-পালনের বিষয়টি ভাবছেন তাঁরাও ফায়ারস্টোনকে দিয়ে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। এঁদের ভেতর আছেন ক্যুইর তাত্ত্বিক এবং ’পরিপূর্ণ বিকল্প মাতৃত্ব’ ত্তত্বের প্রচারকরাও। সোফি লুইসের কথা এপ্রসঙ্গে বলা যেতে পারে।

১৯৭০ সালে ‘দ্য ডায়ালেক্টিক অফ সেক্স’ প্রকাশের অল্প কিছুদিন পরেই ফায়ারস্টোন নারীবাদী আন্দোলন  এবং জন-দৃষ্টির সামনে থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। নারীবাদী আন্দোলনের পরিবর্তে একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজের কর্মজীবনের প্রতি তিনি মনোযোগী হন এবং একইসাথে বারবার ফিরে আসা মানসিক অসুস্থতার সাথেও তাঁর লড়াই চলে যার জন্য মাঝে মাঝেই তাঁকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। ২০১২ সালে নিউ ইয়র্কে তাঁর মৃত্যু হয়।

কৃত্রিম গর্ভ নির্মাণের জন্য ফায়ারস্টোনের ডাকের জন্য যদিও শুলামিথ স্মরিত হন, তবে তিনি অস্বীকার করেননি যে কিছু মানুষ ‘সেকেলে’ বা জৈবিকভাবেও প্রজনন করতে চাইতে পারে। তাঁর কাছে সবচেয়ে যেটি  গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি হলো ‘সন্তান হবে কি হবে না অথবা হলেও কৃত্রিম ভাবে তাদের পাওয়া’ যেন ‘সনাতনী’  পদ্ধতিতে গর্ভ-ধারণের মতই বৈধ হয়।

যে কারণে শুলামিথের বইয়ের কাছে আজো আমাদের ফিরে আসতে হয় সেটা হলো গর্ভধারণের সক্ষমতার কারণে নারীর প্রতি সঙ্ঘটিত বহু বঞ্চনা ও অসাম্য যা আজো সমাজে বিদ্যমান এবং এই বিষয়টির প্রতিকারে সমাজকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

১৯৪৫ সালের ৭ই জানুয়ারি কানাডার অটোয়ায় এক রক্ষণশীল ইহুদি পরিবারে শুলামিথ বাথ শুমুয়েল বেন আরি ফেউয়েরস্টেইন নামে তাঁর জন্ম। সত্তরের দশকের শুরুতেই নারীবাদী আন্দোলন ও বাম রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে তিনি চলে যান নিউইয়র্কের ইস্ট ভিলেজে যেখানে তিনি চিত্রকলায় মনোনিবেশ করেন। আশির দশকে বারবার মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন তিনি এবং ১৯৮৮ সালে দারিদ্র্য, মানসিক অসুস্থতা এবং মানসিক হাসপাতাল নিয়ে তাঁর ছোট গল্প সঙ্কলন ‘বায়ুশূন্য পরিসর’ ছাড়া মাঝখানের দীর্ঘ সময়ে তিনি আর কোন বই প্রকাশ করেননি।

২০১২ সালের ১৮ই আগস্ট তাঁর নিউইয়র্কের এ্যাপার্টমেন্টে ৬৭ বছরের শুলামিথকে একাকী, মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে পাওয়া যায়। র‌্যাডিক্যাল নারীবাদী ধ্যান-ধারণা ও ধর্ম বিরোধী, সংশয়ী বা নাস্তিক্যমূলক চিন্তামূলক ভাবনার জন্য শুলামিথ বহু আগেই তাঁর রক্ষণশীল ইহুদি পিতা-মাতা এবং ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ’গর্ভধারণ’কে বর্বরতা মনে করতেন বলে কোন বর বা প্রণয়ী ছিল না তাঁর এবং সমকামীও তিনি ছিলেন না। তবে ‘র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিস্ট’ বা ’বৈপ্লবিক নারীবাদী’দের যে গোষ্ঠি নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন শুলামিথ, সেই গোষ্ঠিই অন্তর্দ্বন্দে ও কলহে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং বিশেষত: গোষ্ঠির ভেতর যে নারীরা তাদের লেখনী শক্তির কারণে মিডিয়ার কাছে বেশি আদৃত হয়ে উঠেছিলেন (শুলামিথ নিজেই যেমন), তাঁরা গোষ্ঠির ভেতরের অ-লেখক নারীদের দ্বারা মুখে মুখে চরিত্র হনন সহ নানাবিধ ব্যক্তি আক্রমণে এত বিপন্ন হয়ে পড়েন যে সংবেদনশীল শুলামিথ পরে এই গোষ্ঠি ও নারী আন্দোলন ছেড়ে পুনরায় চিত্রকলায় মনোনিবেশ করেন, নিজেকে গুটিয়ে নেন যাবতীয় সামাজিক বৃত্ত থেকে। যে নারীবাদী আন্দোলনের জন্য তাঁর এত কিছু করা, সেই আন্দোলনেরই বহু ‘নারী সহযোদ্ধা’র হাতে ব্যক্তি আক্রমণ ও চরিত্র হননের শিকার শুলামিথ পরবর্তী জীবনে স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। তাই বলে নিজের ভাবনা ও আদর্শে জলাঞ্জলি দিয়ে তাড়াতাড়ি ‘ঘর-বর’ জুটিয়ে নিয়ে, বাইরে নারীবাদী আন্দোলন করার দ্বি-চারিতাও জীবন থাকতে করেননি; যেহেতু ‘পারিবারিক কাঠামোকে তিনি সর্বপ্রকার মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণে’র উৎস বলে মনে করতেন।

 সূত্র: 

১. জো আদেতুনজি, সম্পাদক- কনভার্সেশন ইউকে। ১২ই আগস্ট ২০১৯

২. https://jwa.org/encyclopedia/article/firestone-shulamith

 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩৭   




অনেকদিন পর আবার কলম ধরলাম। আসলে সিনেমার গলিত ধাতু নিয়ে কিছু লিখতে গেলে বাকি সব ভুলে সেই লেখার ভেতর পুরো ডুব মারতে হয়। দরজা বন্ধ রেখে, একাকীত্ব লালন করে, খাবারের থালা ‘স্টোন-কোল্ড’ বানিয়ে, দেওয়াল ঘড়ির ওপর চাদর ঢেকে মাঝরাত্তিরে সিনেমাগুলো আবার একে একে দেখতে হয় – যদি কোথাও ফাঁক রয়ে যায়, সেটা ভরাট করার জন্য। এবং তার জন্য অবশ্যই দরকার হয় কাজলদার মত এক দুঁদে সম্পাদকের যিনি প্রতি সপ্তায় একবার করে তাড়া মারবেন, লেখা কদ্দূর হল? সেই তাড়াটা মাঝে বেশ কিছুমাস না থাকার জন্য নিজের অ-লেখক সত্বাটা পেট্রলের দু’টাকা দাম কমার মত উপভোগ করেছি। তবে খারাপও লেগেছে যে কাজলদার মত এক দাদা ও সুহৃদ অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় পড়ে। অনেকদিন পর আবার কাজলদাকে সেই পুরনো সম্পাদক হিসেবে ফিরে পেয়ে এবং জীবনে আরেকবার সেই তাড়া ব্যাপারটা ফিরে আসার জন্য ভালই লাগছে।

যাইহোক, বেশি বকবক না করে লেখার প্রতিপাদ্যে ফেরা যাক। এবার দু’পর্বে আমরা ফিরে দেখতে চলেছি ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের। টি-20 ক্রিকেটের মরশুম চলছে, সুতরাং ব্যাটার হিসেবে আমার কাজটা যে বেশ কঠিন সেটা বলাই বাহুল্য। এবং আমি কিন্তু পিচ দেখব না, সব সময় ধ্রুপদী খেলব না – লেখাটা দু’পর্বে শেষ করতে হবে, তাই আমার নির্বাচনেও মাঝে মাঝে ঝোড়ো শট দেখতে পাবেন, আগেই জানিয়ে রাখলাম।

আমি ইউরোপ থেকে মোট ১২টা নাম বাছব - ড্রেয়ার, ল্যাং, বুনুয়েল, অ্যান্তনিয়নি, বার্গম্যান, ফেলিনি, কিউব্রিক, গোদার, ত্রুফো, তারকোভস্কি, অ্যাঞ্জেলোপাউলোস ও হেনেকা। এবং আমার ১৩ নম্বর ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি (যদি বাছতে হয়): কুস্তুরিকা।

এদের মধ্যে আজ যাদের নিয়ে আমার আলোচনা, তারা - বুনুয়েল, অ্যান্তনিয়নি, বার্গম্যান, কিউব্রিক, ত্রুফো, তারকোভস্কি। সামনের পর্বে বাকিদের নিয়ে। ১২ জনের মধ্যে আজ এই ৬ জনকে কেন বাছলাম, একটু অপেক্ষা করুন, বুঝে যাবেন।

স্পেন/মেক্সিকোর পরিচালক লুই বুনুয়েল (১৯০০-১৯৮৩) মানেই সুররিয়েলিজম, সিম্বলিজম। আর তার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি। সঙ্গত কারণেই বুনুয়েলকে ব্ল্যাক কমেডির প্রা্ণপুরুষ বলা হয়ে থাকে। তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলোর লিস্টে রয়েছে – লস অলভিদাদোস (১৯৫০), রিহার্সাল ফর আ  ক্রাইম (১৯৫৫), ভিরিডিয়ানা (১৯৬১), এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল (১৯৬২), সাইমন অব দ্য ডেজার্ট (১৯৬৫), বেলে দে জুর (১৯৬৭), দ্য মিল্কি ওয়ে (১৯৬৯), ত্রিস্তানা (১৯৭০), ডিস্ক্রিট চার্ম অব বুর্জোয়া (১৯৭২), দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টি (১৯৭৪) ইত্যাদি। এই লেখার ৬ নম্বর পর্বে ‘এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল’ ও ১১ নম্বরে ‘ভিরিডিয়ানা’ নিয়ে লিখেছিলাম। ১২ নম্বর শুরু করেছিলাম বুনুয়েল আর দালির এক এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা দিয়ে - ‘আন চিয়েন আন্দালু’ (১৯২৯)। অর্থাৎ এক্সপেরিমেন্টাল বলুন বা আভাঁ-গার্ড বা আর্ট-হাউজ, বুনুয়েলের ছবি সব জায়গাতেই ফিট। এবং সিনেমা নিয়ে বিতর্কও ওনার পিছু ছাড়ে না। বুনুয়েলের ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমি কাফ্‌কার কোথাও যেন একটা মিল খুঁজে পাই। যাইহোক, বুনুয়েলের ছবি নিয়ে প্রাথমিকভাবে যা যা বলতে হয়, তা হল, ওনার ক্যামেরায় ডিপ ফোকাস এবং ছবির সঙ্গে মিউজিকের অদ্ভুত মিশ্রণ। এটাও বলা দরকার, বুনুয়েল ছিলেন খুব মিতব্যয়ি। প্রতি সিনের ডিটেলিং  করে রাখতেন, সেই ডিটেলিং থেকে নড়তেন না, যে যে শট নিতেন, তার প্রায় পুরোটাই ছবিতে ব্যবহার করতেন। এবং একেকটা ছবি উনি বড়জোড় এক মাসে শেষ করে দিতেন। এ বিষয়ে ওনার সঙ্গে হিচককের দুরন্ত মিল ছিল। আসলে ওনাকে সুররিয়েলিস্ট, আইকনোক্লাস্ট, প্রোভোকেচার, কনট্রারিয়ান, যাই বলা হোক না কেন, উনি আসলে ছিলেন একজন প্রতিবাদী। প্রতি ছবিতে নিজের মত করে সেই প্রতিবাদ ফুটিয়ে তুলেছেন। কোথাও গাঁটছড়া বাঁধেননি, দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরেছেন। ওনার নিজের ভাষায়, ‘In a world as badly made as ours, there is only one road - rebellion’।

ইতালির পরিচালকদের ভেতর বেশ কয়েকজন এই লিস্টে আসতে পারেন, কিন্তু মাইকেলেঞ্জেলো অ্যান্তনিয়নি (১৯১২-২০০৭)-কে আমি প্রথমেই রাখব ওনার ‘ধাঁধাঁর চেয়েও জটিল তুমি, খিদের চেয়েও স্পষ্ট’ টাইপ থিম এবং অনবদ্য ভিসুয়াল কম্পোজিশনের জন্য। মোট ১৬টা ছায়াছবি বানিয়েছেন, তার মধ্যে বিখ্যাত - দ্য অ্যাডভেঞ্চার (১৯৬০), দ্য নাইট (১৯৬১), দ্য একলিপ্স (১৯৬২), রেড ডেজার্ট (১৯৬৪), ব্লো-আপ (১৯৬৬), দ্য প্যাসেঞ্জার (১৯৭৫), আইডেন্টিফিকেশন অফ আ ওম্যান (১৯৮২)। ওনার ‘রেড ডেজার্ট' নিয়ে আমি ইতিমধ্যেই ১৩ নং পর্বে আলোচনা করেছিলাম। সেই ভিসুয়াল কম্পোজিশন। কারখানার শব্দ, ধূলো-ধোঁয়া, দূষণ আর নোংরা হয়ে যাওয়া নদীগর্ভ থেকে পুরো লাল সেলুলয়েড – সেখান থেকে উঠে আসছে নব্য-বাস্তবতার আরেক সংজ্ঞা। কিন্তু মজার ব্যাপার, শিল্পায়ন কিভাবে প্রকৃতিকে নষ্ট করছে, তা দেখানোর জন্য অ্যান্তনিয়নি এই সিনেমা বানাননি। উনি কল কারখানার ভেতর দিয়ে গদ্যময় পৃথিবী কিভাবে দর্শকের চোখে পদ্যময় করে তোলা যায়, সেই চেষ্টা করেছেন। ওনার কথায় ‘my intention was to translate the poetry of the world, in which even factories can be beautiful. The line and curves of factories and their chimneys can be more beautiful than the outline of trees, which we are already too accustomed to seeing’। আরো বলেছেন যে উনি এই সিনেমায় রং ও ক্যানভাসের যে সম্পর্ক আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, সেইমত প্রতি সিন একে একে উঠে এসেছে। পুরোটাই ধাঁধাঁর মত। বাইরে দেখছেন এক, ভেতরে দেখানো হচ্ছে আরেক। অন্য ছবিগুলোও দেখুন, প্রায় প্রত্যেক ছবিতেই কোন না কোন ব্যক্তিগত রহস্য, যা সমাধান করতে না পেরে চরিত্রেরা চলে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে, উধাও হয়ে যাচ্ছে, ভেঙ্গে পড়ছে। এবং ওনার ছবির আরেক বিশেষত্ব স্পেসের বিমূর্ততা। দ্য অ্যাডভেঞ্চার, দ্য নাইট, দ্য একলিপ্স, রেড ডেজার্ট, ব্লো-আপ – আপনি মন দিয়ে দেখলে বুঝবেন থ্রি-ডাইমেনশনাল স্পেস কিভাবে ফ্রেম থেকে ফ্রেমে বিমূর্ততা তৈরি করতে পারে। Senses of Cinema পত্রিকা ওনার ছবি সম্বন্ধে এক অনবদ্য ছোট্ট উক্তি করেছিল – ‘aesthetically complex, critically stimulating though elusive in meaning’। তাহলে?

পাঠক, যদি মনে থাকে, এই লেখার ১২তম কিস্তিতে বলেছিলাম, আমার চোখে আর্ট-হাউজ সিনেমার উজ্জ্বলতম পরিচালক সুইডেনের ইংমার বার্গম্যান ও ব্রিটেনের স্ট্যানলি কিউব্রিক। আমি আজো সেই কথায় এঁটে আছি, এবং এটাও বলব, এই লেখার ১২নং পর্বটা আরেকবার ঝালিয়ে নেবেন, ওখানে নব্য বাস্তবতার ভিত কিভাবে আর্ট-হাউজ থেকে এল, সেই নিয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য সিনেমার আলোচনা আছে। যাইহোক, ইংমার বার্গম্যান (১৯১৮-২০০৭) অনেক ছবি বানিয়েছেন, যার মধ্যে আমি বলব – সামার উইথ মনিকা (১৯৫৩), সেভেন্থ সিল (১৯৫৭), ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ (১৯৫৭), দ্য ভার্জিন স্প্রিং (১৯৬০), থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি (১৯৬১), পারসোনা (১৯৬৬), শেম (১৯৬৮), ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পারস (১৯৭২), সিনস ফ্রম আ ম্যারেজ (১৯৭৪), অটাম সোনাটা (১৯৭৮), ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেক্সান্ডার (১৯৮২) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ওনার সিনেমাকে তকমা দেওয়া হয়েছে ‘profoundly personal meditations into the myriad struggles facing the psyche and the soul’ হিসেবে, আর ঠিক এখানেই একজন সমালোচক হিসেবে আমি আঠার মত আটকে যাই। এই ব্যাপারটা আমি আর কোনো পরিচালকের মধ্যে আজো পাইনি। যাইহোক, ওনাকে নিয়ে আজ বেশি কিছু আমার বলার নেই কারণ বিশদ আলোচনা আমি  ইতিমধ্যেই ২৮ নং পর্বে করেছি। হ্যাঁ, এটাই বলার, যতদিন না ওনার থেকেও গভীর মনস্তাত্ত্বিক কোনো পরিচালকের সিনেমা পাব, ততদিন আমার এক নম্বর ভোট ওনার দিকেই যাবে।

স্ট্যানলি কিউব্রিক (১৯২৮-১৯৯৯) আমেরিকা ছেড়ে ব্রিটেনে আসার পর যে যে মনে রাখার মত ছবি বানিয়েছেন - লোলিটা (১৯৬২), ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ (১৯৬৪), 2001: এ স্পেস ওডেসি (১৯৬৮), এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ (১৯৭১), ব্যারি লিন্ডন (১৯৭৫), দ্য শাইনিং (১৯৮০), আইজ ওয়াইড শাট (১৯৯৯)। কিউব্রিককে নিয়ে কিছু বলার আগে কিলার্স কিস (১৯৫৫) থেকে এক ছোট্ট ডায়লগ দিয়ে শুরু করি। যুবক-যুবতী। ‘Something’s happened. Do you know?’ ‘Yes, you kissed me.’ ‘Is that all?’ ‘That’s all I saw and I was watching all the time’। এখান থেকে ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ। অ্যালেক্সের সঙ্গে মন্ত্রী আর গার্ডের কথা। ‘What crime did you commit?’ ‘The accidental killing of a person, sir.’ ‘He brutally murdered a woman, sir, in furtherence of theft. Fourteen years, sir!’ ‘Excellent. He’s enterprising, aggressive, outgoing, young, bold, vicious. He’ll do.’। এখান থেকে কিউব্রিকের শেষ ছবি, আইজ ওয়াইড শাট। সাধারণ মুডে স্বামী-স্ত্রীর কথা। ‘But you know,  there’s one thing we need to do as soon as possible.’ ‘What’s that?’ ‘Fuck.’। এই হল কিউব্রিক। বিতর্ক যার সঙ্গী। তবুও অনবদ্য যার স্যাটায়ার। ধরতে না পারলে যা অবধারিত মাথার ওপর দিয়ে যাবে। এবং এর উল্টোদিকে 2001: এ স্পেস ওডেসি দেখুন। ব্রিটেন নিয়ে আলোচনার সময় আমি ইতিমধ্যেই এই মাস্টারপিস নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি। এক মনোলিথ দিয়ে শুরু, আরেক মনোলিথে শেষ। মাঝে ছত্রে ছত্রে বুদ্ধি আর সূক্ষ্মভাবে মানবসভ্যতা নিয়ে হতাশা। এখানেই কিউব্রিকিজম। ওনার নিজের ভাষায়, ‘you’re free to speculate as you wish about the philosophical and allegorical meaning of the film’। বোধহয় সব ছবির জন্যই সত্যি। শেষ ছবি বানানোর কয়েক সপ্তার মধ্যেই মারা গেছিলেন, নইলে আমার ইচ্ছে ছিল জিজ্ঞেস করতাম, মানসভ্রমণে এত সেক্সুয়ালিটি কেন?

যেদিন ফ্রান্স নিয়ে লিখেছিলাম, সেদিন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো (১৯৩২-১৯৮৪)-র একটা ছবি আমাদের আলোচনায় এসেছিল। 400 ব্লোজ। দর্শকরা জানেন, এই ছবি অন্য কারো নয়, ত্রুফোর নিজের কৈশোর। বলা হয়, বয়ঃসন্ধির এক কিশোরের মনস্তত্ব দেখাতে গিয়ে ত্রুফো এখানে নিজের মনস্তত্ব দেখিয়েছিলেন। নিজের বাবা অজ্ঞাত, সৎ-বাবা দয়া করে নিজের পদবী ব্যবহার করতে দিয়েছেন। কিন্তু ঐ অব্ধি। সৎ-বাবা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। দিদার কাছে মানুষ হতে হয়। সেদিনের জেলে বসে থাকা সেই কিশোর একদিন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো হয়ে ওঠেন শুধু সিনেমার প্রতি ভালবাসার জন্য। সমালোচক হিসেবে বিভিন্ন নামকরা পত্রিকায় লিখেছেন, ফ্রান্সের সৈন্যদলে নাম লিখিয়েছেন, ভাল লাগেনি বলে পালিয়ে আসতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল খেটেছেন, তারপর শ্বশুরের থেকে কিছু টাকা নিয়ে বানিয়েছেন 400 ব্লোজ। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। ওনার নামকরা ছবিগুলো মোটামুটিভাবে - 400 ব্লোজ (১৯৫৯), জুলস অ্যান্ড জিম (১৯৬২), অ্যান্টোইন অ্যান্ড কোলেট (১৯৬২), দ্য সফট্‌ স্কিন (১৯৬৪), ফারেনহিট 451 (১৯৬৬), স্টোলেন কিসেস (১৯৬৮), বেড অ্যান্ড বোর্ড (১৯৭০), টু ইংলিশ গার্লস (১৯৭১), ডে ফর নাইট (১৯৭৩), লাভ অন দ্য রান (১৯৭৯), দ্য লাস্ট মেট্রো (১৯৮০), দ্য ওম্যান নেক্সট ডোর (১৯৮১) ও কনফিডেন্সিয়ালি ইয়োরস (১৯৮৩)। ওনার বেশ কিছু সিনেমার চরিত্র অ্যান্টোইন যে উনি নিজে, সেটাও আমরা পরবর্তীকালে বুঝতে পারি। কিন্তু এইসমস্ত ছবির এক সাধারণ যোগসূত্র আছে – শৈশবের  উপস্থিতি। কেন, নিশ্চয় বলে দিতে হবে না! এবং ওনার সেরা সিনেমা, আমার মতে, ফারেনহিট 451, নিশ্চয় প্রাচীন বেদের জ্ঞান ঘেঁটে তৈরি হয়েছিল। এক ভবিষ্যত সমাজ, বই যেখানে নিষিদ্ধ - পুড়িয়ে ফেলা হয়, একেক প্রতিবাদী চরিত্র হয়ে উঠছে একেক বই। তারা একেকটা বই মনে রেখে সেটা বাকিদের সামনে আউড়ে চলেছে যাতে সেই বই তার মধ্যে বেঁচে থাকে। ভাবুন তো, ৩৫০০ বছর আগে, যখন ঋগ্বেদ তৈরি হয়েছিল, লেখা হত না, শুধু শ্রুতির মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ত। আবার দেখুন, ত্রুফোর পরের দিকের তৈরি ছবিতে, দ্য লাস্ট মেট্রো, নাৎসি অধ্যুষিত প্যারিসে এক অভিনেত্রী তার ইহুদী স্বামীকে থিয়েটারের নিচে লুকিয়ে রেখেছে। এবং রোজ সেই থিয়েটারে যাত্রাপালা হচ্ছে যাতে কেউ বুঝতে না পারে। কি অদ্ভুত জীবন ও শিল্পের প্রতি ভালবাসা। এবং পুরোটাই একেক প্রতিবাদী চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। সত্যজিৎ যে বলেছিলেন, সিনেমার কাজ হল সেলুলয়েডে জীবন ফুটিয়ে তোলা, সেটা আক্ষরিকভাবে বুঝতে গেলে ত্রুফোর ছবি দেখতে হবে, অনুভব করতে হবে। ক্যামেরাকে পেন হিসেবে ধরতে হবে। জীবন থেকে পালিয়েও কিভাবে জীবন ভালবাসা যায়, বুঝতে হবে। ত্রুফো মারা যাবার পর এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘a director who, more than loving cinema, represented it. He was cinema. He was Francois Truffaut.’। সত্যিই, যথার্থ।

আন্দ্রেই তারকোভস্কি (১৯৩২-১৯৮৬) ঠিক সাতখানা পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা বানিয়েছেন, প্রথম পাঁচটা রাশিয়ায়, শেষ দুটো দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর। ইভান’স চাইল্ডহুড (১৯৬২), আন্দ্রেই রুবলেভ (১৯৬৬), সোলারিস (১৯৭২), মিরর (১৯৭৫), স্টকার (১৯৭৭), নস্টালজিয়া (১৯৮৩) ও দ্য স্যাক্রিফাইস (১৯৮৬)। সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যাচার সহ্য করেছেন, তবুও প্রতি সিনেমায় সাহসের স্বাক্ষর রেখেছেন। মস্কো ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশনের সময় প্রথম যে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়েছিলেন, দ্য স্টিমরোলার অ্যান্ড দ্য ভায়োলিন (১৯৬০), তার থেকেই বোঝা গেছিল ভবিষ্যতে উনি কি ধরনের ছবি বানাতে চলেছেন। প্রতি ফ্রেমে কি করে সময়কে বন্দী বানানো যায়, সেই এক্সপেরিমেন্ট। যে কোন চরিত্রের আশেপাশে প্রকৃতির ফুটে ওঠা, বিশেষ করে মাটি, হাওয়া, আগুন আর জল নিয়ে তৈরি প্রকৃতি, তারকোভস্কির ছবির প্রথম ও প্রধান শর্ত। মানুষের পাশাপাশি জন্তু (প্রায়শই কুকুর) অনেকটা যেন ধাঁধাঁর মত চলে আসে। কোন প্লট নয়, বরং একেক ফ্রেমে তাৎক্ষণিক মুহূর্ত থেকে তৈরি হওয়া সিদ্ধান্ত দিয়ে সিনেমা এগিয়ে নিয়ে চলা, গদ্যময় পৃথিবীকে ওপরের উপাদান দিয়ে পদ্যময় করে তোলা – অনেকটা যেন অ্যান্তনিয়নিকে মনে পড়িয়ে দেয়।

প্রতি ফ্রেমে প্রা্ণবন্ত ছবি ছাড়াও তারকোভস্কির ক্যামেরার কাজের আলাদা করে তারিফ করতেই হয়। অভিনেতাদের ঠিক মুখের সামনে ক্যামেরা রেখে আস্তে আস্তে মুভমেন্ট, একটা ক্ষয়ে আসা ল্যান্ডস্কেপের সামনে ক্যামেরার ধীরগতি – সময়কে আপনা থেকেই থামিয়ে দেয়। লক্ষ্য করার বিষয়, উনি প্রায় প্রতি সিনেমায় লোকেশন হিসেবে বেছে নিয়েছেন গ্রাম্য ক্ষয়িষ্ণু পটভূমি। একটা সিনের ডিটেল বোঝাতে ত্রুফো যেমন ক্যামেরা আস্তে আস্তে জুম করে হঠাৎ ফ্রিজ করে দিতেন, তারকোভস্কি খুব ধীরে ধীরে ফ্রেমের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অব্ধি ক্যামেরাটা চালু রাখতেন। ফলে পাসোলিনির মত ওনার ক্যামেরাতেও অদ্ভুত অদ্ভুত পোট্রেট ফুটে উঠত, দর্শকদের নিজের মত করে ভাবাতে বাধ্য করত। ওনার দুটো কল্পবিজ্ঞানের ছবি, সোলারিস আর স্টকার, ভাল করে দেখুন। বুঝবেন দুটোই আত্ম-সমীক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে। অনেকে যদিও সোলারিস-কে কিউব্রিকের স্পেস ওডেসির সঙ্গে তুলনা করেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বলব, সেটা ভুল। কারণ কিউব্রিকের স্যাটায়ার তারকোভস্কিতে নেই, আবার তারকোভস্কির  ফ্রেমের মাধ্যমে সময়কে সীমাহীন করার চেষ্টা কিউব্রিকে নেই। এরা সবাই আলাদা, নিজের মত, দলছুট। উদাহরণ হিসেবে তারকোভস্কির মিরর হাতের সামনে রাখুন। অটোবায়োগ্রাফি, কিন্তু প্রায় কবিতার মত,  স্ট্রিম অব কনসাসনেস দিয়ে সাজানো। মনে করে দেখুন, যেদিন রাশিয়ার ছবি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, এই ছবিকে আমার লিস্টে রেখেছিলাম। বলেছিলাম, নন-লিনিয়ার ন্যারেশন, ক্যামেরার কাজ। কালার, সাদা-কালো ও সেপিয়া, এই তিন ধরনের রং নিয়ে পরিচালক ফ্রেম থেকে ফ্রেমে খেলা করেছেন। আবার একই ব্যক্তিকে দিয়ে বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়েছেন। মানুষ আর পাশে সীমাহীন প্রকৃতি, এই ফ্রেমটা নিয়ে খেলতে খেলতেই তারকোভস্কি ছবি তৈরি করেছেন। ফলে আবহে বিঠোফেনের ‘ওড টু জয়’ বাজাই স্বাভাবিক, তাই না?

ওপরের প্রত্যেকেই দলছুট হয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করেছেন, এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে সিনেমাকে নিজের মত করে এক নতুন ভাষা দিতে চেয়েছেন, ক্যামেরার লেন্সটা দর্শকের চোখের সামনে না রেখে মাথার মাঝামাঝি রেখে দিয়েছেন, ভাবতে শিখিয়েছেন। ধ্রুপদ ও আর্ট-হাউজ সংজ্ঞা দুটো নিজের মত করে ভেঙেচুরে সাজিয়ে নিয়েছেন। তাই আজ এই ছ’জন। বাকিরা সামনের পর্বে।


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরজী ছবি

(তৃতীয় পর্ব)

 


১৯৬৪-তে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি দেখেছিলাম। সেই যে প্রতি বছর জুলাই মাসে ‘রেক্টর দিবস’ উপলক্ষে আমাদের সেন্ট জেভিয়ার্সে নিয়ে গিয়ে ছবি দেখানো হতো। প্রথম শ্রেণীতে দেখেছিলাম Magic Boy, যে কথা প্রথম কিস্তিতেই বলেছি।। দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠে দেখলাম ১৯৬১ সালের The Absent-minded Professor,[1] আমার প্রথম ওয়াল্ট ডিজনি-ছবি! আমার সারা জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ছবি Mary Poppins এই ভদ্রলোকের প্রযোজনা-সংস্থা থেকেই বেরোবে ঠিক এই ১৯৬৪ বছরেই, যদিও এই দেশে সেটি আসবে আরো চারবছর পর! কিন্তু এই প্রথম-দেখা ছবিটি কিছুই বুঝিনি, এবং একেবারেই ভাল লাগেনি! পরে অবশ্য দেখে উড়ন্ত মোটর গাড়ির গল্প উপভোগই করেছি। এই ব্যাপারটি পরে এই ১৯৬৪-র  কিশোরকুমার-অভিনীত হিন্দী ছবি Mr X in Bombay-তে টুকে বসানো হয়েছিল।[2] অনেক পরে আরেক ম্যাজিক মোটর গাড়ির ছবি আমায় অভিভূত করবে – তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে ১৯৭০-এর  বড়দিনের ছুটি অবধি!

এরপর বাবা আমাদের নিয়ে নিয়মত ছবি দেখা শুরু করলেন। ১৯৬৪/৬৫-তে নিউ এম্পায়ারে, সম্ভবত ম্যাটিনি শোয়ে দেখা হল ‘থ্রী মাস্কেটিয়ার্স’-খ্যাত পোর্থস, ও তার কনিষ্ঠ সাগরেদ D’Artagnan-এর নতুন কীর্তি, ১৯৬২ সালের ছবি, The Secret Mark of D’Artagnan, যার ঘটনাকাল এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস থ্রী মাস্কেটিয়ার্স এবং দ্বিতীয় উপন্যাস টোয়েন্টি ইয়ার্স আফটার-এর মধ্যবর্তী সময়ে। প্রথম উপন্যাসে চার নায়কের প্রতিপক্ষ কার্ডিনাল রিশলু এই ছবিতে পোর্থস আর D’Artagnan-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজা ত্রয়োদশ লুইকে সিংহাসন-চ্যুত করার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করছেন। খলনায়কদের D’Artagnan চিহ্নিত করবে তরোয়াল-যুদ্ধে তাদের পরাস্ত করে তার নিজের তরবারি দিয়ে তাদের প্রত্যেকের কপালে x এঁকে দিয়ে। এটাই তার secret mark। মূল খলনায়ককে খুবই হিংস্র লেগেছিল। নায়িকা তার বিরোধিতা করাতে সে মহিলার একটি হাতের চেটো লোহার যন্ত্র দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়! কিন্তু সেই একের পর এক অস্বস্তিকর চুম্বন দৃশ্য! মা’ বুঝিয়ে বললেন, “আহা, D’Artagnan কত বীর, মেয়েটিকে কতভাবে সাহায্য করছে, তাই আর কি!”

অবশেষে আবার মেট্রোতে! পুরনো দিনের হাসির ছবি থেকে দৃশ্য নিয়ে ১৯৬৪ সালের সঙ্কলন The Big Parade of Comedy। প্রথমেই এক কাণ্ড ঘটালাম আমি! গাড়ি থেকে দেখছি মেট্রোর ঢোকবার মুখে লেখা রয়েছে, আমার চোখে, NO SHOWING! সেটা উচ্চকণ্ঠে বলতে বাবা তো চমকে উঠলেন, “সে কি!” তারপর আমাকে বললেন, “ভালো করে দেখোঃ N O W মানে NOW SHOWING! ভেবেছিলাম শো বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে!” হলে ঢুকে আবার নতুন চমক! দেখি পর্দা দু-দিকে ভাগ হয়ে সরে না গিয়ে সম্পূর্ণভাবে ওপরে উঠে যাচ্ছে! অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠতে দাদা আমায় নিরস্ত করেন। অনেক বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কৌতুক অভিনয়ের এই সমাহারে আমার মনে আছে যে দুজন আমার সবচেয়ে প্রিয় জুটি হয়ে উঠবেন, সেই লরেল-হার্ডি, আর The Three Stooges-দের।

এইরকম সময়েই পূর্ণতে পুনর্মুক্তি পায় চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত ছবি The Kid (১৯২১), সম্ভবত আমার দেখা একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘের নির্বাক ছবি। এর সঙ্গে দেখানো হচ্ছিল লরেল-হার্ডির স্বল্পদৈর্ঘের, কিন্তু সবাক, The Chimp (১৯৩২)। মনে নেই এই যুগলকে পূর্ণতে প্রথম দেখেছিলাম না মেট্রোতে। কিছুদিন পরে দাদার সঙ্গে সিনেমা দেখার অভ্যস্ত এলাকা ছেড়ে জীবনে প্রথম শেয়ালদায় যাই আরেক ঐতিহ্যশালী প্রেক্ষাগৃহ প্রাচীতে চ্যাপলিনের The Gold Rush (১৯২৫)-এর সবাক ভার্সান দেখতে। মা’র স্মৃতিচারণ অনুযায়ী সময় ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাস।

এরপর আসব একটি বিশেষ প্রেক্ষাগৃহের প্রসঙ্গে। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে কলকাতায় ৭০ মিমি প্রোজেকসানে ছবি দেখার প্রেক্ষাগৃহ একটাই ছিল। তখনকার ‘ধর্মতলা স্ট্রীট’, এখনকার লেনিন সরণীতে ‘জ্যোতি’। এখানে মূলত হিন্দী ছবিই আসত, শুধু, সাধারণত মেট্রোতেই আসার কথা (কারণ ‘মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়র’ প্রযোজিত) কোন ছবির প্রকাণ্ড পর্দা প্রয়োজন হলে, সেই ছবি মুক্তি পেত জ্যোতিতে। জ্যোতিতে এর আগে যখন হিন্দী ছবি দেখেছি, দাদা দেখিয়েছিলেন কিভাবে সাদা স্ক্রীন-ঢাকা ধূসর পর্দা পুরোপুরি দু-দিকে সরে যাচ্ছে না, অর্ধেক সরছে, কারণ হিন্দী ছবি, বাংলার মতই, ৩৫ মিমি প্রোজেকসানেই দেখানো হত (প্রথম ৭০ মিমি হিন্দী ছবি হয় ১৯৬৭ সালে)।

পর্দা পুরো সরে গেল ১৯৬৪/৬৫-তে, যে ছবির ট্রেলর দেখেছিলাম মেট্রোতে, তার জন্যঃ তিনজন স্বনামধন্য পরিচালকের (জন ফোর্ড, হেনরি হ্যাথাওয়ে, জর্জ মার্শাল) তৈরী ১৯৬২-র ছবি How the West was Won, যাতে একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে পশ্চিম আমেরিকার ইতিহাস। প্রথমে পর্দা সরে গিয়েও হল অন্ধকার রেখে কিছুক্ষণ ধরে শোনানো হলো ছবির গান ও আবহ সঙ্গীত। এরপর তারকা-খচিত মূল ছবি। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম খরস্রোতা নদীতে পড়ে হারিয়ে গেল বাবা (অভিনয়ে কার্ল মালডেন)-মা কে নিয়ে প্রেসকট পরিবারের প্রথম প্রজন্মের ভেলা। দুই বোন দ্বিতীয় প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে চলল, বড় বোন ইভ (অভিনয়ে ক্যারল বেকার) ভালোবাসার মানুষ লিনাস রলিংস (জেমস স্টুয়ার্ট)-কে - যে তাদের সবাইকে (বাবা-মাকে নদী তখনো গ্রাস করেনি) রক্ষা করেছিল একদল খুনে ডাকাতদলের হাত থেকে - বিয়ে করে সংসার পাতে। ছোটবোন লিলিথ (ডেবি রেনল্ডস) ভাল গান গায়, তার অন্য উচ্চাশা আছে, সে সেইদিকেই পা বাড়ালো। তাকে যে পছন্দ করল (গ্রেগরি পেক) তার সঙ্গে ছোটবোন লিলিথ এগিয়ে চলল পশ্চিমের অভ্যন্তরে একটি বৃহৎ দলের সঙ্গে, যাদের ওপর নেমে এল আমেরিকার আদি বাসিন্দা লাল মানুষদের আক্রমণ। তৃতীয় প্রজন্মে, বড়বোন ইভের বড়ছেলে জেব (জর্জ পেপার্ড) যোগ দিল গৃহযুদ্ধে, দাসপ্রথা বিলুপ্তির পক্ষে, এব্রাহাম লিঙ্কনের প্রচেষ্টাকে সম্মান জানিয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে তার পরিচয় হল বিপক্ষের এক সমবয়সীর সঙ্গে, যার পিস্তলের গুলি থেকে কথোপকথনরত জেনারেল শার্মানকে (জন ওয়েন) রক্ষা করতে গিয়ে জেব তাকে হত্যা করতে বাধ্য হল। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত জেব বাড়ি ফিরে দেখে শান্ত প্রকৃতির ছোটভাই চাষবাস চালাচ্ছে, কিন্তু অনেকদিন  আগে প্রয়াত বাবার কবরের পাশে আরেকটি সমাধি – তার মা ইভের! আবার প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে জেব এবার যোগ দিল গঠনমূলক কাজের রক্ষণাবেক্ষণেঃ পশ্চিম আমেরিকার বুকের ওপর দিয়ে তৈরী হচ্ছে সুদীর্ঘ রেলপথ। কিন্তু সেই রেলপথ ব্যবহার করে হানা দিচ্ছে শ্বেতাঙ্গ মোষ-শিকারীর দল, লাল মানুষদের অন্যতম খাদ্যের উৎসে ভাগ বসাতে। এর জবাবে লাল মানুষরা নির্মীয়মাণ রেললাইনের ওপর দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে ক্ষ্যাপা মোষদের দল। দম-আটকে যাওয়া দৃশ্য! তাদের পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যাবে অনেকে, তার মধ্যে এক শিশুর বাবা-মা। কেঁদে-কেঁদে বাচ্চাটি ছুটে বেড়াবে রেললাইনের চারদিকে। তাই দেখে মুহ্যমান জেবকে রেলপথ তৈরির কর্তা মাইক কিং (রিচার্ড উইডমার্ক) বলবেন, “এটা শেষ নয়, এটা নতুন জীবনের সূচনা!” আর ঠিক সেই মুহূর্তে অসহায় শিশুটিকে বুকে তুলে নেবেন আরেক মহিলা!

জেব অবশেষে বিয়ে করে সংসার পাতবে। সেখানে এসে পৌঁছবেন তার সেই মাসীমা লিলিথ। ছবির অন্তিম অংশে জেবের সঙ্গে টক্কর দেবে একদল রেল-ডাকাত, চলন্ত রেলগাড়ি আক্রমণ করে। সবশেষে ভাষ্যকার স্পেন্সার ট্রেসী বর্ণনা দেবেন আধুনিক পশ্চিম আমেরিকার, বর্তমানের দৃশ্যসহ, যা সম্ভব করেছিল এই প্রেস্কট-রলিংসদের মতো পথিকৃৎ পরিবারসমূহ।

৬৪ সালে ‘হাটারি’তে মন কেড়েছিলেন জন ওয়েন ও দুটি গণ্ডার। এখানেও জন ওয়েন, যদিও একেবারেই অতিথি শিল্পী হিসেবে কয়েক মিনিটের একটি দৃশ্যে, আর একপাল ক্ষ্যাপা মোষ! ছোট পিসেমশাই বললেন, “তা এখন অবধি তোমার সবচেয়ে ভালো-লাগা ছবি তো ‘হাটারি’ই?” ছিটকে উঠে উত্তর দিলাম, “আরে দূর! কোথায় লাগে ‘হাটারি’ এর কাছে!” How the West was Won বড় পর্দায় আরও ২ বার দেখব। প্রথমবার সঙ্গে ছিলেন দাদা। ৭০-এর দশকে ঐ জ্যোতিতেই ছবিটি পুনর্মুক্তি পায়, দেখি বাবা, মা, আর এক খুড়তুতো দাদাকে নিয়ে। সবাইয়েরই খুব ভাল লাগে। কয়েক বছর পরে আবার মিনার্ভায় (পরে ‘চ্যাপলিন’) ছবিটি এলে বাবাই আমাকে আর মা’কে নিয়ে আবার যান। তবে মিনার্ভায় ছিল ৩৫ মিমির ‘সিনেমাস্কোপ’ প্রোজেকশান।

জ্যোতিতে এরপর মূলত ৭০ মিমির ইংরেজী ছবিই দেখেছি। ১৯৬৫/৬৬-তে ডেভিড লীনের Lawrence of Arabia (১৯৬২), সঙ্গে বাবা , মা, আর দাদা (দাদা ইতিমধ্যে বোধহয় ছবিটি একবার বন্ধুদের সঙ্গে দেখে নিয়েছিলেন)। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কালের এক কিংবদন্তী চরিত্রকে নিয়ে ছবি, তবে ঐ ৮/৯ বছর বয়সে যুদ্ধের রূঢ় নৃশংসতা নিতে পারিনি, ছবি শেষের দিকে এগোচ্ছে বুঝে মনে-মনে স্বস্তি উপলব্ধি করেছিলাম। এরপর ১৯৬৭ মধ্যযুগের জার্মান মহাকাব্য Nibelungenlied অবলম্বনে Whom the Gods wish to Destroy (ছবিটি ২ পর্যায়ে জার্মান ভাষায় ১৯৬৬-৬৭-তে তৈরী হয়ে ইংরেজীতে কিছুটা সংক্ষেপিত করে ‘ডাব’ করা হয়)। ড্রাগন-বধকারী মহাবীর সীগফ্রীডের কীর্তি, এবং তারপর তাঁর বিধবা স্ত্রী ক্রীমহীল্ডের স্বামীর হত্যাকারী এবং ক্রীমহীল্ডের ভাই, বার্গান্ডির রাজা গুন্থেরের অনুগত হাগেনের ওপর নির্মম প্রতিশোধের বিয়োগান্ত গাথা, যে প্রতিহিংসার আগুন থেকে রক্ষা পান না ক্রীমহীল্ডের ভাইও! উত্তর ইউরোপের পৌরাণিক চরিত্রগুলির পাশাপাশি ক্রীমহীল্ডের দ্বিতীয় স্বামীর চরিত্রে আছেন ইতিহাসের অ্যাটিলা, হূনদের রাজা। ছবিটি দেখতে আমার সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল বাড়ির অবাঙালী কাজের লোককে।

১৯৬৮-তে পুনর্মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালের The Bridge on the River Kwai। জ্যোতিতে সপরিবারে যাওয়া হলো। চমকে উঠে দেখলাম যে পর্দা আর দু-দিকে ভাগ হয়ে সরছে না, মেট্রোর মতো সবটাই ওপরে উঠে যাচ্ছে। ছবিটি তো একেবারে সীটের ধারে এগিয়ে বসে দেখার মতো। স্যর অ্যালেক গিনেসের অভিনয় প্রশংসার অনেক ঊর্দ্ধে। তাঁর কর্নেল নিকলসন এবং তাঁর অধীনস্থ সৈন্যদের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা সেতুটি, মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম, মিত্রপক্ষের সৈন্যরা যেন ভাঙতে না পারে!

১৯৬৯-এ নীল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অ্যাল্ড্রিন অ্যাপোলো ১১-য় পাড়ি দিয়ে চাঁদের মাটিতে পা রাখার কয়েকদিনের মধ্যেই জ্যোতিতে দেখি দুর্বোধ্য কিন্তু পর্দা থেকে চোখ ফেরাতে না দেওয়া 2001: A Space Odyssey। ভিন-গ্রহের মানুষ দেখার আশা কিন্তু মেটেনি! সে সাধ পূরণ করলো ঐ একই বছরে পূর্ণ সিনেমা! রবিবার সকালে নিয়ে এল ১৯৬৪ সালের ছবি, এইচ জি ওয়েলসের উপন্যাস অবলম্বনে First Men in the Moon। বাবা সঙ্গে গিয়েছিলাম, চমৎকৃত হয়েছিলাম। Dynamation – Miracle of the Screen-এ তোলা এই ছবিতে শুধু চাঁদের মানুষই দেখলাম না, ছিল প্রকাণ্ড শুঁয়োপোকা!

এরপর সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ/আশির দশকের গোড়ায় জ্যোতিতে দেখতে পেলাম স্পিলবার্গের ১৯৭৭ সালে আমেরিকায় মুক্তিপ্রাপ্ত কল্পবিজ্ঞান কাহিনী Close Encounters of the Third Kind। এতদিনে আমার সিনেমা দেখার সঙ্গী হয়েছেন আমার মা। কিছুদিন আগেই এই জ্যোতিতেই তাঁর সঙ্গে দেখতে এসেছিলাম  আরব্য রজনীর গল্পের নাবিক সিন্দবাদকে নিয়ে ছবি, ঐ ১৯৭৭ সালের Sinbad and the Eye of the Tiger। ছবিটি ৭০ মিমির ছিল না, যদিও রে হ্যারিহাউজেনের সৃষ্ট special effects ছিল দেখার মতো, যার মধ্যে ছিল একটি প্রাগৈতিহাসিক খাঁড়া-দেঁতো বাঘ, গ্রীক পুরাণ থেকে মোষের আর মানুষের দেহ নিয়ে ‘মিনোটর’, প্রকাণ্ড সিন্ধুঘোটক প্রভৃতি। সিন্দবাদের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আমার অতিপ্রিয় জন ওয়েনের পুত্র প্যাট্রিক ওয়েন। তখনই স্পিলবার্গের ছবির ট্রেলর দেখানো হয়েছিল আর আমি ঠিক করে রেখেছিলাম ছবিটি এলেই দেখব। স্পিলবার্গ ছবির শেষ অবধি অপেক্ষা করিয়ে কিন্তু নিরাশ করেননি। অন্য গ্রহের প্রাণীরা এসে যে ছোট ছেলেটিকে নিয়ে গিয়েছিল, তাকে, এবং অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের ফিরিয়ে দিয়ে সাদরে ডেকে নিল কাহিনীর অন্যতম মুখ্য চরিত্র নেরিকে (অভিনয়ে রিচার্ড ড্রেফুস)। ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে ছবিটিতে একাধিক আছে এবং শিশুদের এমন অসাধারণ অভিনয় – অভিনয় বলে মনেই হয় না – ওয়াল্ট ডিজনির ছবির বাইরে খুব একটা দেখা যায় না। তবে স্পিলবার্গের বেশ কিছু ছবি ডিজনিকে মনে করায়, যেমন ১৯৮২ সালের E. T. the Extra-Terrestrial।

স্পিলবার্গ একাধিকবার গ্রহান্তরের জীবদের সঙ্গে মানুষের সৌহার্দের গল্প চিত্রায়িত করেছেন। এর বিপরীত ধারার গল্প, যা হয়তো শুরু হয় ঔপন্যাসিক এইচ জি ওয়েলসের The War of the Worlds (১৮৯৭)-এ মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দাদের পৃথিবী-আক্রমণ দিয়ে, দেখলাম ঐ জ্যোতিতে, ১৯৮৯ সালের Alien-এ। মহাশূন্যে যাত্রা করতে-করতে মহাকাশযান ‘নস্ট্রোমো’ অবতরণ করে একটি উপগ্রহে। এখানে এক পরক মহাকাশযানের মধ্যে তারা পায় পরপর ডিম্বাকৃতি বস্তু। এই ডিম থেকেই তাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে এক হিংস্র জীব, যার পরবর্তীকালে নামকরণ হয়েছে Xenomorph। হাড়-হিম করা, দম-বন্ধ করা ছবি, যার পোস্টারে লেখা ছিলঃ ‘মহাশূন্যে কেউ তোমার আর্তনাদ শুনতে পাবে না!’

এই ছবির আগেই আরেকটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনীচিত্রের ট্রেলর দেখানো হয়েছিলঃ ডিজনি সংস্থার The Black Hole (১৯৭৯)। সেটিও যথাসময়ে জ্যোতিতে মুক্তি পায়, এবং মা আর আমি, আগের দুটি কল্পবিজ্ঞান ছবির মতো সেটিও দেখি। ছবির সবচেয়ে বড় চমক কাহিনীর শীর্ষবিন্দুতে মহাকাশযানে করে মূল চরিত্রের কয়েকজনের কৃষ্ণগহ্বর অতিক্রম করে এক শ্বেতগহ্বর দিয়ে কোন এক নতুন বিশ্বে বেরিয়ে আসা। অভিনয়ে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন Psycho-(কু?)খ্যাত অ্যান্টনি পার্কিন্স!

৭০ মিমির বিদেশী ছবি জ্যোতিতে আর একটিই দেখেছি বলে মনে পড়ছে। স্নাত্তকোত্তর শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৭৯/৮০ সালে অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্যের কথা শুনে – তিনি শেক্সপীয়রের ‘রাজা লিয়ার’ পড়াতেন – রাশিয়ান ভাষায় ‘ডাক্তার জিভাগো’-খ্যাত বরিস প্যাস্টারন্যাকের অনুবাদ-আধারিত কোজিন্টসেভ পরিচালিত ১৯৭১ সালে তৈরী King Lear। এ ছিল আক্ষরিক অর্থে ‘জ্যোতির নির্দেশে জ্যোতির্গমন’! নিজেকে কখনই চলচ্চিত্রের ‘বোদ্ধা’ দর্শকদের দলে ফেলিনি, তাই বলতে দ্বিধা নেই যে নমস্য অধ্যাপকের প্রশংসা সত্বেও আমি আজও মনে করি যে শেক্সপীয়রের সবচেয়ে মর্মান্তিক বিয়োগান্ত নাটক কলেজ স্ট্রীটের শ্রেণীকক্ষে যেভাবে তিনি জীবন্ত করে তুলতেন, উক্ত ছবি, আমার ক্ষেত্রে, তা করতে পারেনি!

জ্যোতিতে আর যেসব বিদেশী ছবি দেখেছি, সবই ৩৫ মিমির। সত্তর দশকের গোড়ায় দাদা এবং হবু-বৌদির সঙ্গে দেখি লরেল-হার্ডির দমফাটা হাসির ছবি, ১৯৩৩ সালের Sons of the Desert, ও তার সঙ্গে ঐ জুটিরই স্বল্প-দৈর্ঘের Another Fine Mess (১৯৩০)। মা’র সঙ্গে দেখেছি কবীর বেদী, রডি ম্যাকডাওয়েল, পীটার ইউস্টিনভ, ও টেরেন্স স্ট্যাম্প অভিনীত রূপকথা The Thief of Baghdad (১৯৭৮)। আর সবশেষে, ১৯৮৮ সালে বিদেশ থেকে ফিরে একদিন ধর্মতলা অঞ্চলে ঘুরতে-ঘুরতে দেখা হয়ে গেল বয়ঃজ্যেষ্ঠা এক ইংরেজীর অধ্যাপিকার সঙ্গে। তাঁকে রাজী করালাম আমার সঙ্গে জ্যোতিতে ঢুকে জন মাল্কোভিচ, মিশেল ফেইফার, ও গ্লেন ক্লোজ অভিনীত ১৯৮৮ সালের Dangerous Liaisons ছবিটি দেখতে। এটি ১৭৮২ সালে Pierre Choderlos de Laclos রচিত ফরাসী উপন্যাস থেকে ১৯৮৫ সালের ক্রিস্টোফার হ্যাম্পটন-কৃত নাট্যরূপের চলচ্চিত্রায়ণ। বিলেতে থাকাকালীন এর নাট্যাভিনয়ের টিকিট পাওয়া ছিল দুষ্কর।

অন্তর্জালে জ্যোতির ছবি খুঁজতে গিয়ে দেখি সিনেমা হলটি নাকি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। একি কলকাতার জ্যোতি না অন্য কোন শহরে ঐ নামের কোন প্রেক্ষাগৃহ? চন্দননগরেই তো এককালে ‘জ্যোতি’ নামের সিনেমা হল ছিল!

(ক্রমশ)

 [1] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=29108868

[2] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=59481381


সুতপা মুখোপাধ্যায়

 

মেয়েদের লেখায় মেয়েদের কথা - জ্যোতির্ময়ী দেবীর এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা

 

 


‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ উপন্যাসটিকে জ্যোতির্ময়ী দেবী উৎসর্গ করেন সকল যুগের সকল দেশের অপমানিতা লাঞ্ছিতা নারীদের উদ্দেশ্যে। ইতিহাসের ভাঙ্গাগড়ার নানা কান্ড হয়ে ওঠে পুরুষের লড়াইয়ে। সেখানে মেয়েদের জায়গা কোথায়? মহাভারতের স্ত্রীপর্ব থেকে বীরের বীরগাথা ---- মেয়েদের চোখের জল, লাঞ্ছনার যে ইতিহাস তা কোথাও লেখা হল কি? কখনও কোন যুগে।  পুরুষের আত্মম্ভরিতার যে অনাবশ্যক লড়াই ইতিহাসের পাতা জুড়ে থাকে সেখানে মেয়েদের কোন জায়গা হল না। সেই অনাবশ্যক লড়াইয়ের আগুন, রক্ত কিন্তু তছনছ করল মেয়েদের। সেটা লড়াই বলে স্বীকৃত হল না কোনোদিন। সে হয়ে থাকল কলঙ্কিত অধ্যায়, যাকে চাপা দিতে হয় – যাকে সমাজ সংসারের একটা ক্ষত হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়। এমনই রক্তাক্ত প্রশ্নগুলি আমাদের সামনে জেদি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে কখনও কোনসময়আমাদের আপাত নিরীহ জীবন নাড়া খেয়ে যায় আর একবার। আমরা অনেক কিছু লুকিয়ে রাখি সুখী যাপনের অজুহাতে। জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ আমাদের রক্তাক্ত অধ্যায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

দেশভাগ ও দাঙ্গা—বাঙালি জীবনকে তছনছ করে দেওয়া সে অধ্যায়। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র সুতারার আপাত শান্ত স্বচ্ছল জীবনে এক সন্ধ্যের আগুন আর মানুষে মানুষে হানাহানির কারণে আমূল বদলে যায়। বিবাহিত দিদি, মা, বাবা হারিয়ে যান সুতারার জীবন থেকে । হারিয়ে যায় তার আজন্মলালিত চেনা ঘরবাড়ি, তার চারপাশ। দাঙ্গাবিদ্ধস্ত বাড়িটি থেকে তাকে উদ্ধার করে আনে বাবার সহকর্মী বন্ধু তমিজকাকার পরিবার। তমিজকাকার মেয়ে সাকিনা তার সহপাঠী সখী। অতি আদরে তমিজকাকার পরিবার তাকে কাছে টেনে রাখে। সুতারা দাদাদের কাছে কলকাতায় ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়। কিন্তু তমিজকাকা চিঠিতে দেখেন দাদাদের কোন আগ্রহ নেই সুতারাকে নিয়ে। বরং সুতারাকে ঘরে ফেরালে লোকে কি বলবে তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। এদিকে শিক্ষিত মানুষদের কাছ থেকেই তমিজুদ্দিনের কাছেও চাপ আসতে থাকে যাতে তিনি সুতারা কে হিন্দু রিলিফ ক্যাম্প এ পাঠিয়ে দেন। তমিজুদ্দিনের স্ত্রী সাকিনার মায়ের একটি প্রশ্ন উপন্যাসকে তার নির্নায়ক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়, যে প্রশ্ন নারীর ইতিহাসের ভিত রচনার একটি অতি গুরুত্বপুর্ণ জায়গায়। ‘তোমাদের দেশভাগ চাই, ঝগড়া করবে করো। আমাদের মেয়েদের মান-ইজ্জত-শরীর নিয়ে এত লাঞ্ছনা কেন? এ কি তোমাদের ধর্ম বলে? কোরানে আছে? তোমরা এত সব শিক্ষিত – গাঁয়ের উকিল মোক্তার মাস্টার—কেউ কারুকে কিছু বলছ না কেন?’ -- মেয়েদের শরীর আর তার সঙ্গে জড়িয়ে রাখা মানসম্ভ্রমের ধারণা --- ইতিহাসের সব লড়াইয়ে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম না হলে যেন কোন দাবি কোন লড়াই সম্পুর্ন হয় না। সেখানে মেয়েদের ভূমিকা গৌণ, অথচ সমস্ত অন্যায়ের দায়ভাগী হয়ে যায় শুধু মেয়েটি। তাই দাদার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে বৌদির মায়ের কাছে প্রথম লাঞ্ছনার ধাক্কা খায় সুতারা। তাকে যারা রক্ষা করেছিল, প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল, আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিল তাদের ঘরে পরিস্থিতির চাপে পড়ে কদিনের বসবাসে সে তার পরিচিত সমাজের কাছে হয়ে ওঠে অচ্ছুৎ। “কোন ঘরে বসবে, কার কাছে বসবে, কথা কইবে, বুঝতে পারে না। দাদারা বৌদিরা বাড়ির সকলেই তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলেকিন্তু সে যেন বাড়ির লোক নয়। কারুর আপনারও লোক নয়’’ -- এই গভীর যন্ত্রণা থেকে যে অন্বেষণ তাই উন্মোচিত থাকে উপন্যাসের পরতে পরতে। সে খাবার সময় জল পরিবেশন করতে গেলে দৌড়ে আসেন গৃহিণী। সহমর্মীতা দেখান বৌদির বাবা। বাড়ির বয়স্ক মহিলারা আড়ালে আলোচনা করেন হিন্দু সমাজে এমন মেয়েকে ফিরিয়ে নেওয়ার নিয়ম নেই। পরিবারের মধ্যে কখন যেন ‘সুতারা সমস্যা’ প্রধান হয়ে ওঠে। কলকাতা কিছুটা শান্ত হয়েছে দাঙ্গার পর এই অজুহাতে দাদা সনৎ পরিবার নিয়ে নিজের পাড়ায় ফিরতে চাইলেও তাকে সাবধান করা হয় সুতারার বিষয়ে। জ্যোতির্ময়ী লেখেন “এই অটল সমাজের মন কোনো অপহৃত লাঞ্ছিত মর্যাদাচ্যুত মেয়ের দুঃখে কখনও টলেনি।’’ কিভাবে যেন পরিকল্পিত হয়ে যায় সুতারাকে বোর্ডিং এ পাঠাবার বিষয়টি, সুতারার অজ্ঞাতে। উপন্যাস খুব সুক্ষ্ম মোচড় দেয় আমাদের মননের গভীরে --- “ সনৎ মনে মনে মুক্তির নিশ্বাস ফেললো। কিন্তু চুপ করেই রইলো। সুবোধ, সুধীরও নীরব। বিমল বললে, ‘এখনকার মতো এ ব্যবস্থা ভালোই হবে। তারপর পাশ করুক, তখন দেখা যাবে। কি দেখা যাবে—তা বিমল, সনৎ, অমুল্যবাবু কেউই জানে না। অতএব এখনকার মতো মস্ত সমাধান হ’লো আপাতত। টাকা দিয়ে বোর্ডিং এ রাখা।’’ বৌদির বাবা, অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিজের মেয়ের ঘর বাঁচাবার জন্য এই ব্যবস্থা করেও দুঃখিত হয়েছিলেন সুতারার জন্য। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগে, “নিজের ঘরের ঘটিবাটি না সামলে কে কবে পরের জন্য, বিশেষ করে একটি কুটুম্ব মেয়ের জন্য উদ্বেগ ভাবনা বহন করেছে? স্বয়ং রামচন্দ্রই স্ত্রীর জন্য পারেন নি। চকিতে মনে পড়ে যায়, কই জনক রাজাও তো সীতার জন্য এগিয়ে আসেন নি!” তবুও ব্যবস্থা হয়ে যায় সুতারার নির্বাসনের।

অভয় বাণীর ঘোষণাও হ’য়ে গেল। এদিকে বিভক্ত ভারতবর্ষেও রাজকীয় সমারোহে স্বাধীনতার সংবিধানের ভূমিকা সংরচনা ও সংগঠন হচ্ছে।’ দেশের আরও লোকের মত তমিজুদ্দিনেরও মনে হল রক্তগঙ্গার স্রোত বুঝি থামল। ভিটেমাটি ফেলে আর এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে পালাতে হবে না। সাকিনা ভাবে আবার ফিরে আসবে সুতারা। কিন্তু সাকিনার দেশ কী? কাকে বলে দেশ? সেই প্রশ্ন উঠে আসে উপন্যাসের শরীর থেকে। ‘জিন্নাসাহেব রাষ্ট্রপতি হ’য়ে দাদা আজিজের মনে প্রশ্ন থেকে যায় সুতারাকে সত্যিই গ্রহণ করবে তো পরিবার।’ ‘‘দু- বাড়ির বাগান--- আম, জাম, কাঁটাল, নারিকেল, সুপুরিবনের আড়াল  থেকে সুতারাদের অর্ধদগ্ধ বাড়ির দেয়ালগুলি, আধ- ঝলসানো গাছগুলি একটু একটু দেখা যাচ্ছিল। আবার পাতা গজিয়েছে গাছে এতদিনে। দুটি পুকুর, বাগান, গোয়াল আর খালি জমিতে এই ক’মাসে জঙ্গল হয়ে গেছে। তমিজুদ্দিন সাহেবের ভয়ে কেউ এসে বাসা বেঁধে থাকতে পারেনি।’’ সাকিনা ওরা আসবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে আজিজ বলে দেশ যখন, আসবে নিশ্চয়। অথচ কেমন করে বদলে যায় মানচিত্র অনেকের অজ্ঞাতেকাঁটাতারের বেড়া এসে রক্তাক্ত করে দেয় হৃদয়।

গান্ধীর মৃত্যু মিশনারি বোর্ডিংটিকেও গভীর শোকে মুহ্যমান করে তোলে। তবুও মেয়েরা নিজেদের মধ্যেই প্রশ্ন তোলে, দেশভাগ তিনি চাননি । আবার মেনেও নিলেন। সুতারা নিজেকেই প্রশ্ন করে, ‘তবে কে চাইল এই লাঞ্ছনা, বিপর্যস্ত নিরীহ জীবনের রক্তাক্ত স্বাধীনতা? কারা স্বাধীন হল?’ এ প্রশ্ন তো বহুজনের, এ প্রশ্ন তো অপমানে যন্ত্রনায় লাঞ্ছিত সব কালের মেয়েদের। তাদের অপমানের বিনিময়ে কাদের স্বাধীনতা এল?  কারা বিনা দোষে ঘর হারাল? ঘর যে হারায় মেয়েরা , অন্যের অন্যায়ের দায়ভাগী যে হয় মেয়েরা তা তো ইতিহাসের পাতায় তেমন করে লেখা হয় নি কোনোদিন। সুতারার মত আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসা মেয়েদের কথাও কোথাও লেখার কথা মনে রাখেন না ইতিহাসের নির্মাতারা। তবু মহিলা লেখকের লেখায় থেকে যায় তারা, যেমন করে সুতারা কে রাখলেন জ্যোতির্ময়ী তাঁর উপন্যাসে। সুতারা ভালভাবে ম্যাট্রিক পাশ করে বাড়ির আহ্বানের জন্য বসে থাকে। কিন্তু তার তো আর কোন বাড়ি থাকে না। নানা অজুহাতে দাদারা এড়িয়ে চলে।  তাকেও ছুটিতে বোর্ডিং এ থাকতে হয়। বোর্ডিং খোলাও থাকে ‘দেশত্যাগী বিপর্যস্ত পলাতক আশ্রয়চ্যুত অনাথ কিছু মেয়েদের জন্যেই।’ দেশভাগের ইতিহাসে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বুভুক্ষু মানুষ আসছে, বা ট্রেনের মাথায় গাদাগাদি ভিড়ের ছবি মানবতার গভীর অবনমনের ইতিহাসের ছবি হয়ে রয়ে যায় আমাদের যাপনেকিন্তু তার বাইরেও যে কিছু ছবি ছিল, যেগুলি ইতিহাস ধরে রাখেনি বা ধরার কোন চেষ্টা করে নি --- সেই রকম কিছু ছবি থেকে যায় আমাদের সাহিত্যে। সেই ঘর থাকতেও ঘর হারা লাঞ্ছিত মেয়েদের ছবি আমরা কোথায় পেতাম যদি সাহিত্য তাকে না জায়গা দিত!

বর্ণহিন্দু সমাজে লাঞ্ছনা ও পীড়নের ভয়ঙ্কর চেহারা তুলে ধরেছেন জ্যোতির্ময়ী তাঁর উপন্যাসে। শিক্ষিত ভদ্র পরিবারেই কেমনভাবে একটি নির্দোষ মেয়ে নীরবে যন্ত্রণার শিকার হয়েছে সুতারা তার উদাহরণ। পিতৃতান্ত্রিক সেই সামাজিক অবস্থানে মেয়েরাই কেমন  করে হয়ে ওঠে পীড়নের মুখ তা সুতারার বৌদি বিভার মা এর মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন উপন্যাসকার। এই পীড়ন মানতে পারে নি বিভা, তার বোনেরা আর ভাই প্রমোদ। শুভার বিয়েতে আমন্ত্রণ শুভাই করে সুতারাকে। বোর্ডিং থেকে বিয়েতে এসে নীরবে ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনার শিকার হয় সুতারা। সে হয়ে ওঠে ঝঞ্ঝাট – পাকিস্তানি উদ্বাস্তু ঝঞ্ঝাট। তার উপস্থিতি হিন্দুর জাত নষ্ট করে। অতএব সে সকলের সঙ্গে বসে খাওয়ার অধিকার হারায়। “প্রতিদিনের খাবারঘর আজ অনাবশ্যক একটা জায়গা। সেইখানে প্রতিদিনের মতো একটি পিঁড়ি পেতে এক গ্লাস জল না কলাপাতায়, মাটির গেলাস নয়- কাঁসার থালায় গেলাসে খাবার ও জল সাজিয়ে দিয়েছে। বউদির বোনেরা, নিজের বৌদি বিভা, এবং কয়েকজন গিন্নিবান্নি, মাসি-পিসি, জেঠিমা, খুড়িমার দল সমারোহ করে লুচি, পোলাও, মাছ, মাংস, শাকভাজা, বেগুনভাজা থেকে চাটনি, মিষ্টি, রাবড়ি অবধি সাজিয়ে খাওয়াতে বসলেন ...... সুতারা খাবারের স্তূপে হাত দিয়ে চারদিক চাচ্ছিল। খেতে হবে? হ্যাঁ, খেতে হবে। সে ছবি থেকে যায় আমাদের সাহিত্যে। সেই ঘর থাকতেও ঘর হারা লাঞ্ছিত মেয়েদের ছবি আমরা কোথায় পেতাম যদি সাহিত্য তাকে না জায়গা দিত!

বর্ণহিন্দু সমাজে লাঞ্ছনা ও পীড়নের ভয়ঙ্কর চেহারা তুলে ধরেছেন জ্যোতির্ময়ী তাঁর উপন্যাসে। শিক্ষিত ভদ্র পরিবারেই কেমনভাবে একটি নির্দোষ মেয়ে নীরবে যন্ত্রণার শিকার হয়েছে সুতারা তার উদাহরণ। পিতৃতান্ত্রিক সেই সামাজিক অবস্থানে মেয়েরাই কেমন  করে হয়ে ওঠে পীড়নের মুখ তা সুতারার বৌদি বিভার মা এর মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন উপন্যাসকার। এই পীড়ন মানতে পারে নি বিভা, তার বোনেরা আর ভাই প্রমোদ। শুভার বিয়েতে আমন্ত্রণ শুভাই করে সুতারাকে। বোর্ডিং থেকে বিয়েতে এসে নীরবে ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনার শিকার হয় সুতারা। সে হয়ে ওঠে ঝঞ্ঝাট – পাকিস্তানি উদ্বাস্তু ঝঞ্ঝাট। তার উপস্থিতি হিন্দুর জাত নষ্ট করে। অতএব সে সকলের সঙ্গে বসে খাওয়ার অধিকার হারায়। “ প্রতিদিনের খাবারঘর আজ অনাবশ্যক একটা জায়গা। সেইখানে প্রতিদিনের মতো একটি পিঁড়ি পেতে এক গ্লাস জল না কলাপাতায়, মাটির গেলাস নয়- কাঁসার থালায় গেলাসে খাবার ও জল সাজিয়ে দিয়েছে। বউদির বোনেরা, নিজের বৌদি বিভা, এবং কয়েকজন গিন্নিবান্নি, মাসি-পিসি, জেঠিমা, খুড়িমার দল সমারোহ করে লুচি, পোলাও, মাছ, মাংস, শাকভাজা, বেগুনভাজা থেকে চাটনি, মিষ্টি, রাবড়ি অবধি সাজিয়ে খাওয়াতে বসলেন ... সুতারা খাবারের স্তূপে হাত দিয়ে চারদিক চাচ্ছিল। খেতে হবে? হ্যাঁ, খেতে হবে। সে ছুটিও নিয়েছে। কিন্তু এরা সবাই তো বলছে চলে যেতে হবে। ন’টার মধ্যে। কাকে সে জবাব দেবে জানে না।’’ দেশভাগের যন্ত্রণার এই দিক গুলো ইতিহাসে গোপন থেকে যায় বা তাকে গুরুত্বহীন করে রাখা হয়। ব্যক্তিসত্ত্বার অস্তিত্ব কীভাবে প্রতি মুহুর্তে বিপর্যস্ত হয় সামাজিক নিঃশব্দ নিপীড়নের মাঝে তা আমরা বুঝতেই চাই না নিপীড়ন ব’লে। সেখানেই সাহিত্য এগিয়ে আসে । তার দর্পনে বিম্বিত হয় সে সব এড়িয়ে চলা কথা যা খুব নীরবে রক্তাক্ত করে ব্যক্তি মানুষের জীবন যা আসলে আর একা ব্যক্তি মানুষের যন্ত্রণা হয়ে থাকে না। সে হয়ে ওঠে না লেখা ইতিহাস। একটা সময়কাল। একটা সমাজের অন্ধকার দিক।

সুতারার বাড়ি থাকে না । তার পরীক্ষার ভাল ফল এ, বৃত্তি পাওয়াতে দাদারা, দিদির শ্বশুর সকলেই ভীষণ খুশি হয়। কিন্তু কেউ আর তাকে বাড়ি ফিরতে বলে না। তার ফেলে আসা দেশের থেকে ডাক আসে। তমিজ কাকা, আজিজ, সাকিনা, সাকিনার মা সবাই চান সুতারা এসে কিছুদিন থেকে যাক কারণ আর তো গোলমাল নেই। “ না, গোলমাল নেই। কিন্তু বলতে বলতেই কোথায় একটি কোন কোণে দপ করে একটা আগুন জ্বলে ওঠে।“ স্মৃতি আমাদের অস্তিত্ব নির্মাণ করে। তাকে তো মুছে ফেলা যায় না অতো সহজে। অন্তত যে আগুনের পথ পেরিয়েছে তার স্মৃতিতে রয়ে যায় সেই পথে ফেলে আসা অনেক কিছু, আপাত নিরীহ শান্ত জীবন তাকে ভুলতে দেয় না। কেউ কেউ বুঝে যায় তার ঘর আর তৈরি হওয়ার নয়। সুতারা বোঝে। দিল্লিতে অধ্যাপনা করতে গিয়েও বোঝে ঘর তার জুটবে না। “ আপাতত দাদাদের আর টাকা দিতে হবে না। এবং ভাবতেও হবে না তার কথা। তবে সে কি স্বাধীন হয়ে গেল? মেয়েরা কি স্বাধীন হয়? ...... অকারণে লাঞ্ছিতা, উৎপিড়ীতা, উপেক্ষিতা, পরিত্যক্তা নারীর সবকালের মেয়েদের প্রতিনিধি হয়ে উঠছে যেন সে মনে মনে।’’ – তাকে সাকিনার মা আহ্বান জানান, ফিরে গিয়ে মুসলমানের ঘরে ঘর বসাতেহয়ত নিজের ছেলে আজিজ এর কথাই ভেবেছিলেন তিনি। সুতারা সাড়া দিতে পারে না। সেই আগুনলাগা সন্ধ্যে সে ভুলতে পারে না। কিছু দেওয়াল কোথাও রয়ে যায় অদৃশ্য হয়ে আমাদের অবচেতনে। তাকে ভাঙতে কেটে যায় কয়েক শতাব্দীকাল। কিম্বা  তাকে ভাঙ্গাই হয়ে ওঠে না আর। আবার সেরকমই দেওয়াল একটু একটু করে ভাঙবার কালও আসে। হিন্দু স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে দাপুটে গৃহিণীর বিপরীতে গিয়ে বিভার ভাই প্রমোদ মনঃস্থির করে সুতারাকে বিবাহ করার। সুতারার সঙ্গে দেখা করে সে প্রকাশ করে তার ইচ্ছা। সুতারার মনেও কোন আশা ছিল বোধহয় একটা ঘরের, নির্ভার নিশ্চিন্ত। সে চোখের জলে ভেসে জানতে চায় তাকে প্রমোদ করুণা করছে না তো। উপন্যাস শেষ হয় একটি মেয়ের সংসার গড়বার স্বপ্ন নিয়ে। “কিছু ভাববার ভরসা নেই। সহসা মনে হলো স্কুল-কলেজের অধ্যাপিকা সুতারা দত্ত আজ আর সে নয়। এ যেন আর একজন কে কিশোরী কোনো মেয়ের মতো কিসের স্বপ্ন দেখছে! তেমনি বারবার মনে কিসের ভয় হচ্ছে—যদি স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। তার চোখে জল আসে। সহসা মনে হলো শান্ত স্নিগ্ধ যে অন্ধকারটা তার ঘর ভরে ছড়িয়ে রয়েছে, সেটা একটা যেন কার চোখের গভীর দৃষ্টি। যে দৃষ্টি তাকে বলছে, ‘আমি তোমার ভার নিলাম সুতারা, তোমাকে নিলাম।’’

ইতিহাসের এক অন্ধকার সন্ধিক্ষণে উপন্যাসের শুরু। শুধু হিন্দু ক্যাম্প বা মুসলমান ক্যাম্পেই উদ্বাস্তু মেয়েরা ছিল না। তারা ছিল স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের চৌহদ্দিতেও। ছিল তাদের কাছের মানুষ, থাকবার মতো জায়গা। তবু যে তাদের কিছুই ছিল না—এ উপন্যাস তার এক দলিল। এমন বহু অত্যাচারিত মেয়ে আর জায়গা পানি পরিবারে, তাদের বিনা কোন দোষে। লড়াইয়ের মর্যাদা দূরে থাক, তাকে অপমান ও লাঞ্ছনার ভারে নুইয়ে দিতে কুণ্ঠিত ছিল না সমাজ। কারণ মেয়েদের শরীর- সে যে বড় পবিত্র জিনিস। সেই পবিত্রতার দায় মেয়েরা বইতে বইতে পেরোচ্ছে আজও সেই আগুনপথ। আর চল্লিশের দশক কেন, আজও মেয়েদের সার্থকতা যে মাতৃত্বে আর সংসারে, সেই ধারণার দ্বারা প্রবলভাবে চালিত হয় সমাজ।  তাই শত লাঞ্ছনার মধ্যেও সুতারা কে একটা সংসার দেওয়ার কথা ভোলেন নি ঔপন্যাসিক – সে আর্থিকভাবে সফল ও স্বনির্ভর হলেও।