কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

কালিমাটি অনলাইন / ৪


সম্প্রতি ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের কয়েকজন পাঠক-পাঠিকা আমাকে জানালেন যে, ‘কথনবিশ্ব’ বিভাগ তাঁদের খুব প্রিয় এবং নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হলে সম্পাদকীয় পড়ার পরই কথনবিশ্বে প্রকাশিত লেখাগুলি পড়েন। তাঁদের এই ভালো লাগা নিঃসন্দেহে আমাদেরও ভালো লাগল এবং উৎসাহিত করল। আমার মনে পড়ছে, যখন আমি ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিন প্রকাশের পরিকল্পনা করি, তখন বিশেষ ভাবে চিন্তিত ছিলাম কী কী বিভাগ এই ব্লগজিনে রাখা হবে! এর আগে দুটি ব্লগজিন ‘কবিতার কালিমাটি’ ও ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ নিয়মিত প্রকাশ করছিলাম। সুতরাং এই দুটি ব্লগজিনকে পৃথক ভাবে প্রকাশ না করে নতুন ব্লগজিনের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তা আগেই ঠিক করেছিলাম। কিন্তু গদ্যের আর কী বিভাগ শুরু করা যায়, এটা ভাবতে গিয়ে একটা অন্যরকম চিন্তা মাথায় এসেছিল। যে কোনো  সাহিত্য পত্রিকায়, মুদ্রিত এবং অনলাইন, প্রবন্ধ-নিবন্ধের একটি বিভাগ অতি অবশ্য থাকে। এবং এই বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এবং সেইসব প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখে থাকেন শিক্ষিত, চিন্তাশীল ও মননশীল এবং ভাষা বিন্যাসে দক্ষ গুণীজনরা। কিন্তু আমি ঠিক করলাম, এইসব গুণীজনদের লেখার জন্য তো অবশ্যই বিনীত অনুরোধ জানাব, সেইসঙ্গে অনুরোধ করব তাঁদেরও, যাঁরা হয়তো লেখকের ভূমিকায় কখনও অবতীর্ণ হননি, কিন্তু কথাবার্তায় নিজস্ব চিন্তা ভাবনা বেশ গুছিয়ে উপস্থাপিত করতে পারেন। বস্তুতপক্ষে এই পৃথিবীতে যাঁরা জন্মগ্রহণ করেন,  তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের মনের মধ্যে বহন করেন বিভিন্ন ভাবনা ও চিন্তা। এবং প্রত্যেকের ভাবনা চিন্তা স্বতন্ত্র ও নিজস্ব। সাধারণ ভাবে বিচার করলে সাধারণ মানুষের ভাবনা চিন্তা সাধারণ বলেই মনে হয়। কিন্তু একটু যদি তলিয়ে দেখা যায় বা পর্যবেক্ষণ করা যায়, তাহলে অনেক অভিন্নতার মধ্যেও কিছু কিছু ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। এবং  বলা বাহুল্য, এই ভিন্নতার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে কিছু কিছু মৌলিক ভাবনা চিন্তাও। আর এই মৌলিক ভাবনা চিন্তাই সমৃদ্ধ ও ঋদ্ধ করতে পারে আমাদের অর্জিত জ্ঞান, মেধা, বুদ্ধি ও কর্মপ্রয়াসকে। আমার এই চিন্তা ভাবনার কথা জানিয়েছিলাম আমার একান্ত আপনজন অভিভাবকস্বরূপ অনন্য সাহিত্যিক (সম্প্রতি প্রয়াত) সমীর রায়চৌধুরীকে। সমীরদা আমাকে এই ব্যাপারে খুবই উৎসাহিত করেছিলেন ও বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছিলেন। এবং বিভাগটির শিরোনামও ঠিক করে দিয়েছিলেন তিনিই, ‘কথনবিশ্ব’।

প্রসঙ্গত আপনাদের সবার কাছে আবার বিনীত অনুরোধ জানাই, আপনারা এই বিভাগের জন্য অবশ্যই লেখা পাঠান। যে কোনো বিষয়, বস্তু, ঘটনা বা প্রাসঙ্গিকতা,  তার যদি সাহিত্য-শিল্প-সাংস্কৃতিক কেন্দ্রিকতা থাকে এবং তা যদি আপনাদের মনকে আলোড়িত করে; তাহলে আপনাদের সারা মন জুড়ে যে ভাবনা চিন্তা  আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তা নির্দ্বিধায় লিপিবদ্ধ করে আমাদের দপ্তরে পাঠিয়ে দিন। ইউনিকোড অভ্র ফন্টে ওয়ার্ড ফাইলে কম্পোজ করে পাঠাবেন। লেখার সঙ্গে লেখাটির প্রাসঙ্গিকতায় কয়েকটি ছবিও পাঠাবেন। আপনাদের সবার ব্যক্তিগত নিজস্ব ভাবনা চিন্তা নিজের মনে জমিয়ে না রেখে তা বিনিময় করুন অন্যের সঙ্গে। পারস্পরিক ভাবনা চিন্তা বিনিময়ের মাধ্যমেই আমরা খুঁজে পেতে পারি নতুনতর ভাবনা চিন্তার জগত।  

দুর্ধর্ষ গ্রীষ্মকালের সঙ্গে অসম লড়াই করে সদ্য আমরা স্নিগ্ধ হচ্ছি বর্ষার জলধারায়। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন। অযথা এবং অহেতুক জলে ভিজে নিজেদের শরীরকে বিব্রত করা থেকে বিরত থাকুন।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675
                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India


<<<< কথনবিশ্ব >>>>


তানিয়া চক্রবর্তী

জ্ঞানের মাহাত্ম্যে গঠিত সদ্‌গুণ





সক্রেটিসের মৃত্যুর পর প্লেটো যে সকল সংলাপ প্রতিষ্ঠা করেন তার মধ্যে প্রোতাগোরাসএর মূল বিষয় হল সদ্‌গুণ। খ্রি. পূ. ৪৩৩ সাল নাগাদ এটি রচিত হয়। অ্যাথেন্স নগরীতে এসে উপস্থিত হয়েছেন প্রোতাগোরাস, যিনি সেই সময়ের  এক অনবদ্য সফিস্ট বা বাগ্মী। যাঁর শিক্ষাদানের প্রতি আকুল সেই সময়ের যুবক। তিনি এসেছেন অ্যাথেন্সের সবচেয়ে অভিজাত কেলিয়াসের বাসস্থানে। তাঁকে দেখার তীব্র আগ্রহ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে যুবাগোষ্ঠী। এই খবর চারিদিকে প্রচারিত হওয়া মাত্রই সক্রেটিসের বন্ধু ও শিষ্য হিপোক্রিতিজ সেখানে উপস্থিত হয়ে সক্রেটিসকে জানান প্রোতাগোরাসের কাছে যাওয়ার প্রতি তাঁর আকুলতার কথা, তাঁর দীক্ষিত  হওয়ার আগ্রহের কথা। কিন্তু সক্রেটিস এ বিষয়ে বিচলিত হন। তীব্র ভাবে তিনি  হিপোক্রিতিজকে বিবেচনায় আসতে বলেন, একজন সফিস্ট কীভাবে অন্য ব্যক্তিকে সফিস্টে পরিণত করতে পারেন! কারণ বিষয়টি কোনো আমদানিকৃত জিনিসের মতো নয় যে নিজের আত্মা ও মনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বস্তুকে কারো হাতে তুলে দেওয়া যায়! যেখানে আমরা আর সকল জিনিস যেমন খাদ্য, বস্ত্র, ডাক্তার সব বিষয়ে এগোনোর আগে বারবার আলোচনা করি ও ভাবি, সেখানে মননের ক্ষেত্রে  তো আমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। এই পর্বের পরেই সক্রেটিস ও হিপোক্রিতিজ প্রোতাগোরাসের মুখোমুখি হন। সেখানে প্রোতাগোরাসকে সদগুণ যে শিক্ষাদানের বিষয় নয়, সেই তর্কে তিনি অবতীর্ণ করেন।  ক্রমাগত বার্তায় প্রমাণিত হয় তাঁরা কিছুতেই একই দর্শনের ধার ধারছেন না । আসলে প্লেটো  বোধহয়  প্রোতাগোরাসকে প্রশ্নবাণের মাধ্যমে সক্রেটিসের মতেরই চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন। কারণ যখন প্রোতাগোরাসের দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু হয় তখনই দেখা যায় সক্রেটিস তাঁর  পছন্দের পথে এগোতে সকলকে প্রাণিত করেন। তবে প্লেটোর প্রত্যেকটি সংলাপে যেটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা হল প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে বিষয়ের গভীর থেকে গভীরে যাওয়ার প্রবণতা। এ থেকে  সত্যের  উৎকৃষ্ট  ধারণায় এগিয়ে যাওয়া সত্যি যুক্তিযুক্ত। এই পদ্ধতির মাধ্যমেই তিনি প্রোতাগোরাসের দর্শনকে আক্রমণ করেন। এবং শেষপর্যন্ত প্রোতাগোরাসও তাঁর দর্শনের কাছে এসে মত পরিবর্তন করেন। যেহেতু এই সংলাপটি প্রধানত সদ্‌গুণ সম্পর্কিত তাই সক্রেটিস জানতে চান সদগুণ একাকী একটি একক, নাকি এটি মুখমন্ডলের বিভিন্ন অংশ তথা চোখ, কান, নাক-এর মত এক স্থানের ভিন্ন অংশ, নাকি একতাল স্বর্ণের বিচ্ছিন্ন ছোট  ছোট অংশ? প্রোতাগোরাস মুখমন্ডলের অংশটিকে উদাহরণে তুলে নেন। এবার সক্রেটিস তাঁকে ছেয়ে ফেলেন যুক্তির কাঁটায়। সক্রেটিস বলেন, সব সদ্‌গুণ কি  একই জিনিস, তারা সকলেই কি সদ্‌গুণ বলে পরিচিত হবে? প্রোতাগোরাস উত্তরে বলেন,  “আমার মত হছে এর সবকিছু সদ্‌গুণের অংশ, আর এদের মধ্যে চারটি  আছে যারা একে অপরের সদৃশ, কিন্তু সাহস বাকি চারটি হতে প্রভূত আলাদা। আমি যা বলছি তা হল, দেখা যায় অনেক মানুষ আছে যারা অন্যায়কার্যে পটু,  পাপী, অসংযত এবং অজ্ঞ; কিন্তু একইসঙ্গে অত্যন্ত সাহসী। সক্রেটিস বলেন, যারা  অজ্ঞতার সঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ী, তারা সাহসী নয় বরং উন্মাদ এবং উল্টোপক্ষে যারা জ্ঞানী তারাই সবচেয়ে আত্মপ্রত্যয়ী; এবং ফলে সবচেয়ে সাহসী, অতএব তাদের জ্ঞানই সাহস। প্রোতাগোরাস পুনরায় উল্টোদিকে চলে যান। তাঁর মতে, ক্ষমতার   মতোই আত্মপ্রত্যয় দক্ষতা থেকে জন্ম নিতে পারে, অথবা সমভাবে উন্মাদনা বা আবেগ থেকে; কিন্তু সাহস হচ্ছে প্রকৃতির ব্যাপার এবং আত্মার প্রকৃতির ব্যাপার। এভাবেই ক্রমান্বয়ে সদ্‌গুণ  যা কিনা প্রোতাগোরাসের মতো সফিস্টের কাছে আবশ্যিক ও শিক্ষাদানযোগ্য বিষয়, অপরদিকে দার্শনিকশ্রেষ্ঠ সক্রেটিস কখনোই  মানেন নি এটি শিক্ষাদানযোগ্য। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁদের বিপরীত অংশেও  অবস্থানের প্রভাব দেখা যায়। কারণ ন্যায়নীতি, সংযম, সাহস সবকিছু যদি জ্ঞান হয় তবে সদ্‌গুণ  অবশ্যই  শিক্ষাদানযোগ্য। আর এটি যদি প্রোতাগোরাসের আংশিক যুক্তি মেনে এটাকে জ্ঞান ছাড়া অন্য কিছু বলা হয়, তবে তা শিক্ষাদানযোগ্য নয়। এই কারণেই এটি প্লেটোর সিদ্ধান্তমূলক সংলাপ না বলে বিতর্কমূলক সংলাপ বলাই ভালো। প্লেটো পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সংলাপের আলোচনায় এটি আরো সুস্পষ্ট হবে আশা করা যায়...




[অংশটি গৃহীত হয়েছে ‘প্লেটো / প্রোতাগোরাস’ নামক বই থেকে। এই সংলাপটির বাংলা অনুবাদ করেছেন আমিনুল ইসলাম ভুইয়া। বইটির পরিবেশক ও প্রকাশক পাঠক সমাবেশ (কলকাতা) ভারতী বুক স্টল, ৬বি, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট,  কলকাতা ৭০০০০৯]


সুনীতি দেবনাথ

রবীন্দ্রনাটক ‘রক্তকরবী’ কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা




রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা এমনি বিচিত্র ছিলো যে, বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সর্বব্যাপি আলোকদ্যুতি নিয়ে তা একাই যেন একশো হয়ে তাঁর সমকালকে সুদূর ভবিষ্যতে প্রসারিত করেছে। রবীন্দ্রনাটকের ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। নাট্যব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ যখন নাট্যসাহিত্যে সৃষ্টিকর্মে ব্যাপৃত হলেন, চমকে দিলেন বিশ্বের নাট্যামোদী  সম্প্রদায়কে। প্রথানুসারী সৃষ্টি নয়, একেবারে নতুন এক সৃষ্টির ধারা। রূপক ও সাংকেতিক এই ধারার উদ্গাতা তিনি স্বয়ং। সৃষ্টি করলেন একেবারে নতুন কালজয়ী এই ধারায় অনবদ্য কিছু নাটক, বিশ্ব মোহিত হলো বিস্মিত হলো। প্রসঙ্গত স্বীকার করে নিতে হয় তাঁর সৃষ্ট এই নাট্যধারার উত্তরসূরি কিন্তু আর পাওয়া যায়নি। তাতে শুরু হয়ে তাতেই থেমে রইলো তাঁর সৃষ্ট নাট্যরীতি। তাঁর নাটকগুলির মধ্যে ‘রক্তকরবী’ অনেকানেক নাট্য সমালোচকের মতে শ্রেষ্ঠ সাংকেতিক নাটক। বহু  সমালোচিত, বহু অভিনীত, বহুজন বন্দিত ‘রক্তকরবী’ আজো এই একুশের শতকে জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে আছে।

সাহিত্যের নানা বিভাগের মধ্যে নাট্যসাহিত্যের একক মহিমা হচ্ছে এটি দৃশ্যকাব্য। তাই এই সাহিত্যের আস্বাদন একক ব্যক্তিত্বের সীমানায় আবদ্ধ নয়, গণসমষ্টির দ্বারা অভিনয়ের, মঞ্চায়নের নানা কলাকৌশলের মাধ্যমে অভিনেতা-অভিনেত্রীর সক্রিয়তায় তা আস্বাদনীয় হয়ে ওঠে। তাই নাটক জটিলতর সাহিত্য মাধ্যম।

'রক্তকরবীনাটকের পটভূমি ধরা হয় ইউরোপ জুড়ে মহাযুদ্ধের পরবর্তী অবস্থাকে কেন্দ্র করে। এ যেন যুদ্ধপরবর্তী পৃথিবীর এক মানচিত্র। নাটকটি প্রথম রচিত হয় ১৯২৬ সালের ডিসেম্বরে। রক্তকরবীর প্রথম নামকরণ হয় যক্ষপুরী নামকরণ নিয়ে নানা বিতর্ক আছে, বর্তমান আলোচনায় এই প্রসঙ্গ বর্জিত হবে। কারণ প্রসঙ্গটি বহুল আলোচিত। এই আলোচনার উদ্দেশ্য অন্য।  শিলংয়ের শৈলাবাসে একবার  বাসকালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন এই কিংবদন্তী সদৃশ নাটকটি।  নাট্যসমালোচক শিশিরকুমার দাশের ভাষায়, মানুষের প্রবল লোভ কীভাবে জীবনের  সমস্ত সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক যন্ত্রে ও উৎপাদনের উপকরণে পরিণত করেছে এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কী রূপ ধারণ করেছে, তারই রূপায়ণ রক্তকরবীনাটকে। অভিনেতা শম্ভু মিত্র ও তাঁর পত্নী তৃপ্তি মিত্রের ক্লাসিক অভিনয়ধন্য 'রক্তকরবী ' নাটক রবীন্দ্রসৃষ্ঠ  শ্রেষ্ঠ নাটক বলে বহু  সমালোচক মনে করেন।

গীতিধর্মী এ নাটকে একটিমাত্র বিষয় নাটকের কেন্দ্রীয় পাঠ। একটি কারাগার। রাজার নাগপাশে বন্দী একদল লোক। এরা প্রত্যেকেই প্রচলিত সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-গোত্র আর স্তরে স্তরায়িত। প্রকৃতির নিয়ম কিংবা সমাজের অপরিহার্য বাস্তবতায় এ নাগরিকবৃন্দ যেন প্রত্যেকেই লোভ-লালসা-প্রথা-সংস্কার আর ভয়ের জালে আটকা পড়া একেকটি জীব। যক্ষপুরীতে শ্রমিক দল মাটির তলা থেকে সোনা তোলার কাজে নিযুক্ত। চালানো হচ্ছে তাদের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন। জটিল আবরণের আড়ালে থেকে রাজার নির্দেশ পালনে ব্যস্ত সেনাপতি সহ অন্যরা। এই অন্ধ ভূমিগর্ভ জীবনের মধ্যেই হঠাৎ ফুঁড়ে উঠে প্রেম। এই প্রেম আসে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নন্দিনীর রূপ ধরে। নন্দিনী সকলকে হাতছানি দিয়ে আলোর পথে ডাকছে, ‘তোমরা চলে এসো, চলে এসো।নন্দিনী ও সুড়ঙ্গ খোদাই বালক-কিশোরের কথোপকথন দিয়ে শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী নাটক রক্তকরবী

যে সময়ে ‘রক্তকরবী’ রচিত ও মঞ্চস্থ হয় সে সময়টা গণনাট্য আন্দোলনের প্রখর  কাল। নাটকে রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রসভ্যতার অমানবিক নির্যাতিত মানুষের মুক্তি সম্পদের পর্বততুল্য আহরণে নয় বরং মানবপ্রেমে, এটাই যেন প্রকাশ করতে চেয়েছেন।  সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে তাই নন্দিনী প্রেমের প্রতিমূর্তি হয়ে আবির্ভূত। সবাই তাকে চায়। রবীন্দ্রনাথ যন্ত্র সভ্যতার বিপক্ষে গিয়ে কৃষিসভ্যতার জয়জয়কার গেয়েছেন। শ্রমিকের আত্মঘাতী শ্রমের বিকল্প কৃষিসভ্যতা, তার প্রতীক রক্তকরবী ফুল। সমকালের প্রেক্ষিতে তাহলে তিনি কি গণনাট্য সৃষ্টি করেছেন রূপক ও সাংকেতিক আঙ্গিকে?  প্রশ্ন জাগে। সহজ কথায় কোন কোন সমালোচকের অভিমত অনুসরণে  প্রশ্ন ওঠানো যায় ‘রক্তকরবী’ কি গণনাটক? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে প্রথমে  জানতে হবে গণনাটকের সংজ্ঞা কি, বৈশিষ্ট্যই বা কি।

গণনাটক বলতে কি বোঝায় তা বলতে গিয়ে অধিকাংশ নাট্যতত্ত্ববিদ্ বলেন, শ্রমিক  কৃষকের দুঃখ বেদনা আশা আকাঙ্ক্ষা আনন্দ ও সর্বোপরি তাদের সংগ্রাম যে নাটকে রূপায়িত হয় তাই গণনাটক। কেউ আবার বলেন যেভাবেই হোক জনগণের স্বার্থ যে নাটকে প্রতিফলিত হয় তাই গণনাটক। আবার ভিন্ন মতে গণনাটকের নায়ক হবেন আদর্শ কমিউনিস্ট। অন্যমতে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ধনতন্ত্রের যে চরম অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয়, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের স্ফূরণ দেখায় যে নাটক তাই গণনাটক। এই  বিচারে এই মতাবলম্বীরা রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’কে একটি সার্থক গণনাটক  বলেন। অবশ্যই একথা যাঁরা বলেন তাঁদের সম্পর্কে সবিনয়ে বলা যায় অন্ধ রবীন্দ্র-ভক্তিই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে, বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণী ক্ষমতা নয়।

গণনাট্যের লক্ষণগুলি বিচার না করলে তার স্বরূপ নির্ণয় সম্ভব হবে না। বিশিষ্ট তাত্ত্বিকগণ এর লক্ষণ নির্ণয় করতে গিয়ে বলেন, গণনাট্যের লক্ষণ হবে ১) শোষিত বা সর্বহারা শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি, ২) শ্রমজীবী মানুষের নিজ অভিজ্ঞতার উপর প্রযুক্ত বোধগম্য বিষয়বস্তু, ৩) এই শ্রেণীর বোধগম্য আঙ্গিক এবং ৪) তাদের  বোধগম্য ভাষা। এই লক্ষণগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে।

শোষিত বা সর্বহারার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে নাট্যকারের সেই বোধ যার দ্বারা তিনি অনুভব করতে পারেন সমাজের মূল দ্বন্দ্ব কি এবং সেই দ্বন্দ্বের দু’পক্ষে কাদের অবস্থান।  অর্থাৎ কোন শক্তি কোন অবস্থানে আছে। কেনই বা সমাজের শোষিত শ্রেণী শ্রমিক কৃষক এবং এই জোট কেন সমাজের জীর্ণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন ব্যবস্থা গড়ার চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। কিভাবেই বা শোষণ বিহীন নয়া সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, উৎপাদন ও বন্টনব্যবস্থা, শাসকশ্রেণীর চরিত্র এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর চরিত্র না জানলে নাট্যকারের স্বচ্ছ বোধ গড়ে ওঠে না। তীব্র সংকটপূর্ণ বর্তমান সমাজব্যবস্থা আর ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র অবক্ষয়ের যুগে সর্বহারার দৃষ্টিভঙ্গি ও বোধ না থাকলে সৃষ্টিকর্ম আবর্জনা হতে বাধ্য। চেতনা সমৃদ্ধ নাট্যসৃষ্টি জনমানসে চেতনা ও বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে। বিষয়বস্তু হতে হবে জনসমাজের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাযুজ্য যুক্ত। গণনাটকের বিষয়বস্তু জনজীবন থেকেই আহৃত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ, না হলে তা গণমানসে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে কৃত্রিম পণ্যে পর্যবসিত হয়। তাই গণনাটকের বিষয়বস্তু গণমানুষের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে।

গণনাট্যে বিশাল পুঁজিপতি নায়ক হতে পারে কিনা প্রশ্ন উঠতে পারে। যেহেতু পুঁজিপতি সমাজের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তি নয়, তাই অবশ্যই হতে পারে। সাধারণ মানুষ ও পুঁজিপতির জীবনে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। গণমানুয ও পুঁজিপতির  যুগ্ম সম্পর্কে একটা উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। এতে পুঁজিপতি সমস্ত সম্পদের অধিকারী হয় আর জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্গতি ও বিড়ম্বনা। আর এই অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের জীবন বহির্ভূত নয়।

গণনাট্যের আঙ্গিক সহজ সরল হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু গণমানুষের জন্য নাটক, তাদের শিক্ষার মান নিম্ন, তাই আঙ্গিকে সহজ সরলতার দরকার। ইংরেজিতে একটা কথা আছে 'Form reflects a way of life' অর্থাৎ শিল্পের আঙ্গিকের মাঝেই আছে এক বিশেষ জীবনধারার প্রতিফলন। তাই আঙ্গিক জটিল হলে জনমানসে তার প্রভাব তেমন মর্মস্পর্শী হতে পারে না।

গণনাটকের ভাষাও হবে সহজ সরল অনাড়ম্বর। সহজ সরল অনাড়ম্বর আটপৌরে ভাষা, এই ভাষা সহজবোধ্য হবে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ জটিল ভাষা জনমানসে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট ভাষা বর্জনীয়। সৃজনশীল ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ ও তাৎপর্যবহ সুমিত ভাষার ব্যবহার সহজ সরল হলেও জনমানসে অর্থবহ ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবেতখন নাট্যকারও শিল্প সৃষ্টিতে সার্থক হবেন।

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় গণনাট্য সম্পর্কিত লক্ষণসমূহের  সার্থক প্রয়োগের মাত্রার উপরই নির্ভর করে গণনাট্যের সর্বোচ্চ সফলতা বা ব্যর্থতা। ‘রক্তকরবী’ গণনাট্য কিনা, এর সাফল্য বা ব্যর্থতা কেমন তা বিচার করার আগে  এই নাটক নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথা প্রথম শুনে নেওয়া যাক। এই নাটকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি বলেছেন, "কর্ষণজীবী ও আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে এ সম্বন্ধে বহু মহলে আমি প্রায়ই আলোচনা করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলই উজাড় করে দিচ্ছে। তাছাড়া শোষকজীবী সভ্যতার ক্ষুধা তৃষ্ণা স্বেদ হিংসা বিলাসবিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষুষেরই মত।... নবদূর্বাদল রামচন্দ্রের বক্ষলগ্ন সীতাকে স্বর্ণপুরীর অধীশ্বর দশানন হরণ করে নিয়েছিল, সেটা কি সেকালের কথা, না একালের? সেটা কি সেকালের কবির কথা, না একালের? সেটা কি ত্রেতাযুগের কবির কথা, না আমার মত কলিযুগের কবির কথা? তখনো কি সোনার খনির মালিকরা নবদূর্বাদলবিলাসী কৃষকদের ঝুঁটি ধরে টান দিয়েছিল?" ... "আর একটা কথা মনে রাখতে হবে। চাষী যে দানবীয় লোকের টানেই আত্মবিস্মৃত হচ্ছে, ত্রেতাযুগে তারই বৃত্তান্তটি গা-ঢাকা দিয়ে বলবার জন্যেই সোনার মায়ামৃগের বর্ণনা আছে। আজকের দিনের রাক্ষসের মায়ামৃগের লোভেই তো আজকের দিনের সীতা তার হাতে ধরা পড়েছে। নইলে গাঁয়ের পঞ্চবটচ্ছায়াশীতল কুটির ছেড়ে চাষীরা টিটাগড়ের চটকলে মরতে আসবে কেন? " রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য অনৈতিহাসিক ও অবাস্তব বলাটা অসঙ্গত হবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ 'রক্তকরবী'র বিষয়বস্তু আলোচনা করতে গিয়ে অন্যত্র বলেছেন, আধুনিক সমস্যা বলতে কোন পদার্থ নেই, মানুষের সব গুরুতর সমস্যাই চিরকালীন। তাই রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন রামায়ণ ও 'রক্তকরবী'তে একই সমস্যারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সহজ কথায় কৃষিসভ্যতা আর যন্ত্রসভ্যতার মধ্যেকার সতত বিরাজমান এক জটিল দ্বন্দ্ব। এক্ষেত্রে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন অনুভূত হয়। সেটা মেনে নিলে বলতে হয় 'রক্তকরবী'র নন্দিনী কৃষি সভ্যতার প্রতীক এবং যক্ষপুরীর মকররাজ যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক। ঠিক তেমনি রামায়ণের রাম ও রাবণ যথাক্রমে কৃষিসভ্যতা ও যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক। 'রক্তকরবী ' আধুনিক নাটক বলে এতে যন্ত্রসভ্যতার কথা আসা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু রাবণ যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক হতে পারে না। ঊণবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে  শিল্পবিপ্লবের পর যন্ত্রসভ্যতা বা ধনতান্ত্রিক সভ্যতার উদ্ভব হয়। তাই রাবণকে যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক বলা ইতিহাস বিকৃতি। রাবণ কৃষিসভ্যতার অগ্রবর্তী সভ্যতা দাস সভ্যতার প্রতীক। অনুন্নত দাস ব্যবস্থা ধ্বংস করে রামচন্দ্র আপেক্ষিক উন্নত ভূস্বামীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাই বলা যায় মানব ইতিহাসের সমস্যা চিরকালীন এক  নয়। রামায়ণ যুগের সমস্যা আর বর্তমান যুগের সমস্যার ইতিহাস বলে, উন্নত সভ্যতার পাশে যদি অনুন্নত সভ্যতা অবস্থান করে তাহলে উন্নত সভ্যতা কালক্রমে অনুন্নত সভ্যতাকে গ্রাস করে, পরাজিত করে। দুটি ভিন্নধর্মী সমাজব্যবস্থা পাশাপাশি অবস্থান করলে তাদের মধ্যে নিয়ত সংঘর্ষ ঘটে এবং কালক্রমে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা বিজয় লাভ করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যন্ত্রসভ্যতা কৃষিসভ্যতার চেয়ে উন্নততর সভ্যতা। কৃষিসভ্যতায় সামন্তবাদী প্রভুরা তাদের জমিতে কৃষকদের ক্রীতদাসদের মত কাজ করাতো। অপেক্ষাকৃত উন্নত যন্ত্রসভ্যতায় সেই দাস কৃষকেরা মুক্তি পেলো এবং তাদের কলে কারখানায় নিযুক্ত করা হলো। তাদের পরিচয় দাস থেকে শ্রমিক হলো। তাদের পরিচয় হলো মানুষ। 'রক্তকরবী'তে কৃষিসভ্যতার কাছে যন্ত্রসভ্যতার যে পরাজয় অঙ্কিত হয়েছে তা ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করে, সভ্যতার ক্রম পর্যায়ের বিন্যাসকে অবিন্যস্ত করে।

যন্ত্রসসভ্যতা রবীন্দ্রনাথের কাছে মানবজীবনের অভিশাপ। যন্ত্র মানুষের সকল অনুভূতিকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে তাকে, শ্রমিককে একটি সংখ্যায় পরিণত করে। মনুষ্যত্বহীন নিষ্প্রাণ কতগুলি সংখ্যা। তাদের বসবাসের স্থান কতগুলি বর্ণ চিহ্নিত মাত্র। কিন্তু যন্ত্র মানুষকে অমানুষ করে না, তা করে বিশেষ সামাজিক পরিকাঠামো। যে সমাজব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় কিছু লোক উৎপাদনের সকল উপায়গুলিকে করায়ত্ত করে সকল সম্পদ ভোগ করে। যন্ত্র আসলে মানুষের অতিরিক্ত শ্রম কমিয়ে তাকে অবসর দেয়, শিক্ষাদীক্ষা ও শিল্পচর্চার সুযোগ দেয়। মনে হয় শ্রেণী বিভক্ত সমাজের  আসল অসুখটি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এতে বিস্ময় জাগে। যে সময়ে 'রক্তকরবী ' লেখা হয়েছে তখন রবীন্দ্রনাথের কাছে সমাজের প্রকৃত সত্য ধরা না পড়াটা বিস্ময়কর বটে।

শ্রেণী সংঘর্ষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা অস্পষ্ট ছিলো অনুমান করা যায় যখন দেখা যায় নাটকটির রাজা ও শ্রমিককে একই যন্ত্রব্যবস্থায় পীড়িত ও যন্ত্রণাহত হতে। শোষক ও শোযিতকে তিনি একই সারিতে প্রতিস্থাপন করেছেন। রাজা ও শ্রমিক উভয়েই একই যন্ত্র শাসন থেকে মুক্তির জন্য সে কী প্রাণপণ ছটফট   যন্ত্রসসভ্যতা শ্রমিক শ্রেণীর কাছে শোষণ নিপীড়নের যন্ত্র হলেও, মালিকশ্রেণীর কাছে তা বিলাস বৈভব, অফুরন্ত সুখের উৎস, শিক্ষা দীক্ষা লাভ, শিল্পকলা সৃষ্টি ও আস্বাদনের উৎস। সুতরাং নাটকটির শেষে রাজা শ্রমিক সকলের শোষণ ব্যবস্থাটিকে ভেঙ্গে চুরমার করার ঐক্যবদ্ধ অভিযান অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক ভাববাদী ভাবনা বললে অত্যুক্তি হবে না।

রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন কৃষিকাজে শ্রী ছিলো, শান্তি ও সমৃদ্ধি ছিলো। কলিকালের যন্ত্রসভ্যতা কৃষকদের যন্ত্রসভ্যতার সর্বনাশা নিপীড়নের মাঝে জোর করে টেনে আনা হয়েছে। ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় কৃষক জমিদার, জোতদারের নিষ্ঠুর অত্যাচার ও শোষণে নিপীড়িত হয়েছে, ঋণভারে কুঁজো হয়েছে, মিথ্যা মামলায় ভূমিহীন হয়েছে। ক্ষুধার্ত অন্নহীন কৃষক একমুঠো ভাতের আশায় নগরমুখীন হয়ে কল কারখানার শ্রমিক হয়েছে। ইতিহাস এমনি সত্যের প্রমাণ দেয়।

'রক্তকরবী'কে গণনাটক বলা সঙ্গত হবে না। তত্ত্বগত দুর্বলতা এর পরিপন্থি হয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর এই দুর্বলতার কারণ বুঝতে হলে রবীন্দ্র-মানসের স্বরূপ সংক্ষেপে হলেও বুঝতে হবে। তিনি আজন্ম ঔপনিষদিক আবহাওয়ায় লালিত, পালিত ও বর্ধিত। মানবমুক্তির বিষয় তিনি সমাজ সংসার থেকে মানুষকে বিশ্লিষ্ট করে বিচার করেন। তাঁর ভাবনায় রাজা প্রজা সকল মানুষই মুক্তি পিপাসু। তিনি ভাবেন বিশ্ব সংসারের সবাই আত্মোপলব্ধির জন্য পিপাসার্ত। মানুষের চিত্ত বন্ধনহীন, প্রাণ চিরমুক্ত। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কোন ব্যবস্থাই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সাময়িক শোষণ পীড়ন পেরিয়ে তা রক্তকরবীর চারার মত আলোর প্রার্থনায় ঊর্ধ্বমুখী হবেই। পৃথিবীর মাটির সঙ্গে প্রাণের কোন বন্ধন নেই। এই ভাববাদী আধ্যাত্মিক দর্শন নাটকটিতে যেন এক কৃত্রিম বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে।

রবীন্দ্রনাথের সর্বহারা বা শোষিত শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় 'রক্তকরবী'র বিষয়বস্তু গণনাট্যের বিষয়বস্তু হয়নি। এর আঙ্গিক ও ভাষাও গণনাট্যের উপযোগী নয়। জালের আড়ালে সোনা সঞ্চয়কারী এক রাজা থাকেন, কোথা থেকে আসে নন্দিনী নামে এক মেয়ে, সে কে? সাধারণ মানুষ সব বুঝতে চায়, পারে না। এই রূপক -সাংকেতিক নাটক তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পাত্র-পাত্রী, ভাষা সবই তাদের নাগালের বাইরে। কাজেই কোনও অবস্থায় 'রক্তকরবী' গণনাট্য নয়।

লেনিন বলেছিলেন যে, সাহিত্য ক্ষেত্রে সব যুগের শ্রেষ্ঠ রীতিগুলিকে আমাদের  জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং মর্যাদা দিতে হবে। সন্দেহ নেই রবীন্দ্র সাহিত্য তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কিছু কিছু বিষয়ে তাঁর সীমাবদ্ধতা থাকলেও, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি যে স্তরে উন্নীত করেছেন এবং তাঁর লেখায় স্বতোৎসারিত যে শক্তি তা নিঃসন্দেহে শ্লাঘার বিষয়। তাই সর্বস্তরের মানুষেরই তাঁর সৃষ্টিকে পড়তে হবে, জানতে হবে, প্রগতির স্বার্থে গবেষণা ও বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে।




অদ্বয় চৌধুরী

ফ্রম জেমস বন্ড, উইথ ইডিওলজি





(ষষ্ঠ পর্ব)


মাস পর্নোগ্রাফি ও বন্ড-ইডিওলজি

 

“In an address to male spectators, the body of woman is constructed as a spectacle and the mise en scène of representations of women's bodies coded in various ways as both to be looked at by the spectator and, in the same process, to evoke sexual arousal in him.”

 

 

১৯৫৩ সালপ্রথম ‘প্লেবয়’ পত্রিকা প্রকাশিত; প্রথম বন্ড-কাহিনী ‘ক্যাসিনো রয়াল’ প্রকাশিত। এই দু’টি গ্রন্থই প্রথম ‘মাস পর্নোগ্রাফি’ হিসেবে অবিদিত। সেক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী ভাবে প্রশ্ন উঠবে পর্নোগ্রাফি বলতে কি বোঝানো হয়েছে? এক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি বলতে ‘মেল পাওয়ার’-কে বোঝানো হয়নি, কোনো যৌনক্রিয়ার পরিবেশনকেও না। বরং এক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি বলতে, ডেনিং-এর ভাষায়, বোঝানো হয়েছে “…first, a narrative structured around the look, the voyeuristic eye, coding woman as its object, and second, a culture whose very discourse is dominated by, indeed translated into, a code of sexual signifiers” পর্নোগ্রাফিকে ভয়ারিজম-এর প্রকারভেদ হিসাবে ধরে এগোলে বলাই যায় যে শুধুমাত্র কোনো যৌনক্রিয়ার প্রদর্শন পর্নোগ্রাফি নয়, বরং নগ্নতার বিভিন্ন স্তরে নারী-শরীরের পরিবেশনকেই পর্নোগ্রাফি বলা যায়। 


এই সূত্রেই নারী-শরীর এক পণ্যে পরিণত হয়; নারী-শরীর প্রদর্শনের কারণে ক্রেতারা আকৃষ্ট হয় পণ্যের প্রতি। এই সূত্রেই উপরে উদ্ধৃত অ্যানেট কান-এর উক্তিটি অর্থবহ হয়ে ওঠে। বিশেষত জেমস বন্ডের কাহিনীর নিরিখে। আসলে পর্নোগ্রাফি কোনো ব্যতিক্রমী বিষয় নয়। অন্য কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিষয় পরিবেশনার থেকে পর্নোগ্রাফির পরিবেশন কোনোভাবেই আলাদা মাত্রা রাখে না। বরং পর্নোগ্রাফি দখল করে, কান-এর ভাষায়, “one point in a continuum of representations of women, a continuum along which are also situated such commonly available and highly socially visible representations as advertisements”নারী-শরীরের বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা— এই আঙ্গিক থেকে বিচার করলে বন্ডের গল্পগুলি অবশ্যই ‘মাস পর্নোগ্রাফির’ ভিন্ন রূপ হিসেবে পরিগণিত হবে। যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে পশ্চিম ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় তৈরি হওয়া বুর্জোয়া ভোগবাদী কনজিউমার সমাজের যৌন চাহিদাকে প্রকাশ করে এই বন্ড-কাহিনীগুলি।

 

বন্ডের কাহিনীতে, বিশেষত ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ উপন্যাসে, সেই অর্থে কোনো যৌনক্রিয়ার বর্ণনা নেই। আছে ভোগ্যপণ্য হিসেবে নারী-শরীরকে বিভিন্ন নিরিখে ও পদ্ধতিতে ‘দেখার’ বর্ণনা। এমনিতেই বন্ড ‘লাইসেন্স টু কিল’ ক্ষমতাপ্রাপ্তএক্ষেত্রে, ডেনিং-এর ভাষায়, ‘লাইসেন্স টু লুক’-ও অর্জন করেছে বন্ডএই ‘দেখার’ প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মাটির তলার টানেলের ভিতরে লুকানো একটি পেরিস্কোপের সাহায্যে যখন বন্ড ইস্তানবুলের রাশিয়ান এমবাসির ভিতরের দৃশ্য দেখে। সেখানেই সে প্রথম রুশ ক্লার্ক টাটিয়ানা রোমানোভাকে দেখতে পায়। তারপরে ‘স্ট্রং সেন্সেশন্স’ নামক ১৮ নম্বর চ্যাপ্টারে জোরা এবং ভিদা নামের দুই জিপসি মহিলার রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। এরা দু’জন জিপসি-প্রধানের ছেলের দখল নেবার জন্যে একে-অপরের সঙ্গে লড়ছে। এই লড়াই বন্ড ও কেরিম দু’জনে একসঙ্গে দেখে:

“Bond held his breath at the sight of the two glistening naked bodies, and he could feel Kerim’s body tense beside him. The ring of gypsies seemed to have come closer to the two fighters. The moon shown on the glittering eyes and there was the whisper of hot, panting breath.”

 

এই দুই যুদ্ধরত মহিলা লড়াইয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে তাদের অঙ্গের শেষ বস্ত্র-খণ্ডটিও দর্শকদের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এখানে দর্শক ও পাঠক একই সারিতে অধিষ্ঠান করে। দর্শক-পাঠকও ওই বস্ত্র-খণ্ডের ঘ্রাণ ও স্বাদ নেয়, এবং সরাসরি ওই অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে ওঠেকির্লেঙ্কো-হত্যার দৃশ্যে হত্যাকাণ্ডটি গুরুত্বহীন, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের স্থানটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ: mouth of Marilyn Monroe’—

“Bond rested his forearm against the door jamb and raised the tube to his right eye…The outline of a huge woman’s face and some lettering appeared…Bond inched the glass down the vast pile of Marilyn Monroe’s hair, and the cliff of forehead, and down the two feet of nose to the cavernous nostrils. A faint square showed in the poster. It ran from below the nose into the great alluring curve of the lips…Out of the mouth of the huge, shadowed poster, between the great violet lips, half open in ecstasy, the dark shape of a man emerged and hung down like a worm from the mouth of a corpse.”



 

কির্লেঙ্কোর মৃত্যু এবং সেই মৃত্যুর দৃশ্যটি ভীষণ তুচ্ছ ও ছোটো হয়ে পড়ে মনরোর পোস্টারে আঁকা আকারের দিক থেকে বিশাল বেঢপ হলেও ভীষণ লোভনীয় ঠোঁটের ছবির পাশে। অদ্ভুত ভাবে এখানে ‘দেখার’ বিষয় কোনো নারী-শরীর নয়, বরং এক ‘কমোডিফায়েড ইমেজ’। অ্যানেট কান নারী-শরীর ও বিজ্ঞাপনের যে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন তত্ত্বের মাধ্যমে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত। এ হল কনজিউমার ক্যাপিটালিজম-এর চূড়ান্ত প্রতীক। কির্লেঙ্কোর হত্যাস্থল থেকে হোটেলের ঘরে ফিরে বন্ড দেখে নগ্ন টাটিয়ানা তার বিছানায় অপেক্ষারতা। তারা প্রথা-মাফিক যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি অদ্ভুত মোচড় অপেক্ষা করছে: গুপ্তচর বন্ড নিজে এখানে গুপ্তচরবৃত্তির শিকার হয়বন্ড এবং টাটিয়ানার শরীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের বিশদ বর্ণনা না দিয়ে ফ্লেমিং এখানে পাঠকদের ও রুশ গুপ্তচর বাহিনীর মাঝে এক অদ্ভুত সমীকরণ আঁকেনসমান্তরাল অবস্থানের ভিত্তিতে তাদের সমগোত্রীয় করে তোলেনএখানে রুশ গুপ্তচর ও পাঠক দু’ পক্ষই একসঙ্গে কিছু দৃশ্যের ও অভিজ্ঞতার অংশীদার হয়:

“Above them, and unknown to both of them, behind the gold-framed false mirror on the wall over the bed, the two photographers from SMERSH sat close together in the cramped cabinet de voyeur, as, before them, so many friends of the proprietor had sat on a honeymoon night in the stareroom of the Kristal Palas. And the viewfinders gazed coldly down on the passionate arabesques the two bodies formed and broke and formed again, and the clockwork mechanism of the cine-cameras whirred softly on and on as the breath rasped out of the open mouths of the two men and the sweat of excitement trickled down their bulging faces into their cheap collars.”


রুশ গুপ্তচররা এই ভিডিওটি তৈরি করেছিল বন্ডের সম্মান ও জনপ্রিয়তাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। এখানে পাঠক-দর্শকরাও এক প্রকারের ফটোগ্রাফারের ভূমিকা পালন করে। ফ্লেমিং-এর বর্ণনা তাদের চোখে ফটোগ্রাফে অনূদিত হতে থাকে

 

বন্ডের গল্পে পর্নোগ্রাফির জন্যে আলাদা করে স্থান ও সময় রাখা হয়নি। বন্ডের নিজস্ব বৃত্তির মধ্যে, এবং তার সাধারণ জীবন-প্রণালীর পরতে পরতে পর্নোগ্রাফিক বিষয় স্থান করে নিয়েছে। এটাই কনজিউমার ক্যাপিটালিজম-এ যৌনতার নতুন মাত্রা। কনজিউমার ক্যাপিটালিজম-এর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, হার্বার্ট মার্কাস-এর যুক্তি অনুযায়ী, “the libidinalization of the workplace and daily life” মার্কাস এই ঘটনাটিকে ‘repressive desublimation’ নামে অভিহিত করেন। এই পরিস্থিতিতে যৌনতা পরিণত হয় ‘মাস্টার কোড’-এ। এই ‘মাস্টার কোড’-এ অন্যান্য সমস্ত ডিসকোর্স— কমার্শিয়াল, পলিটিকাল, ফিলোজফিকাল, এমনকি রিলিজিয়াস— অনূদিত হয়ে যায়। এখানে, এই সেক্সুয়াল ডিসকোর্সে, ‘লিবারেশন’ এবং ‘রিপ্রেশন’-এর মধ্যে কোনো সংঘর্ষ ঘটে না। ডেনিং এই বিষয়ে বেশ বিশদে আলোকপাত করেছেন:

“The apparent liberation of sexuality from patriarchal norms— the so-called ‘sexual revolution’— is both a genuine change in sexual practices and a reconstitution of sexuality in a fetishized mode that continues to subordinate and oppress women.”

 

মেয়েদের প্রতি দমনমূলক ও নিপীড়নমূলক আচরণ ও ব্যবহারের প্রত্যক্ষ প্রমাণ বন্ড নিজেই; মহিলাদের প্রতি বন্ডের বুর্জোয়া ‘মেল শভিনিস্টিক’ মানসিকতা—

“He sighed. Women were for recreation. On a job they got in the way and fogged things up with sex and hurt feelings and all the emotional baggage they carried around. One had to look out for them and take care of them. ‘Bitch’, said Bond…”

 

মহিলাদের প্রতি বন্ডের এই দৃষ্টিভঙ্গি ভীষণভাবে গতানুগতিক‘ব্রিটিশ সুপ্রিমেসি’ বজায় রাখার থেকেও ‘মেল সুপ্রিমেসি’ বজায় রাখার ক্ষেত্রে লেখক ফ্লেমিং বেশি আগ্রহী। সেই কারণে কেরিমের তুর্কীয় বাবার দ্বারা তার ব্রিটিশ মা ‘বশ’ হয়। কেরিমও একইভাবে ‘বেসার্বিয়ান হেল-ক্যাট’ মহিলাকে ‘বশ’ করে। পুরুষতান্ত্রিকতার বৃহত্তম নমুনা হচ্ছে এই কেরিম: ইস্তানবুলের সমস্ত ব্রিটিশ গুপ্তচর, যারা কেরিমের হয়ে কাজ করে, তাদের সবারই বাবা কেরিম নিজে। এছাড়াও জিপসি-প্রধানের ছেলেকে ‘জয়’ করার জন্যে তারই হুকুমে দুই মহিলা প্রাণঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধ এককপ্রকারের রিচুয়াল, এক ধর্মীয় আচার, এবং অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিকতার উপাসনা। এখানেও ফ্লেমিং-সৃষ্ট চরিত্র বন্ড বুর্জোয়া ঔপনিবেশিকতাবাদী ইডিওলজির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিক প্রবন্ধের পঞ্চম পর্বের শুরুতে এবং শেষে টোনি বেনেট-এর ‘ideologies of sexism and imperialism’ বিষয়ক পর্যবেক্ষণের সামান্য একটু উল্লেখ আছে। এখানে সেই পর্যবেক্ষণটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। ফলস্বরূপ বিশদ বিবরণের দাবি রাখে:

“…the ideologies of sexism and imperialism are inscribed within the very form of the Bond novels…As the relations between Bond and the villain and between Bond and the girl develop and move toward their resolution, a series of collateral ideological tension is thus simultaneously worked through and resolved. It is in this way that the Bond novels achieve their ‘ideological effect’— the effect, figuratively speaking, of placing women back in position beneath men and putting England back on top.”

 

এই পর্যবেক্ষণটি বন্ড-বাহিত সমস্ত ইডিওলজিকে একত্রে প্রকাশ করে, এবং যথাযথ ভাবেবিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায়, সম্পর্কের ওঠা-নামায়, গল্পের গতিবেগের প্রতিটি পরতে বন্ড নির্দিষ্ট ইডিওলজির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে, প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ওঠে। তবে এই ইডিওলজিগুলো পরোক্ষ উপায়ে পরিবেশিত হয়; রঙ্গিন মোড়কে, রোমাঞ্চের আবরণে পেশ করা হয়। এই পরোক্ষ ইডিওলজি বাদে ফ্লেমিং ও বন্ডের একটি প্রত্যক্ষ ইডিওলজিও আছে: রাশিয়া-বিরোধিতা, রাশিয়া-কুৎসা।

 

 

 

সূত্র ও ঋণ

1)  Michael Denning. ‘Licensed to Look’.
2)  Annette Kuhn. ‘The Body in the Machine’. p. 115.
3)   Herbertt Marcuse. One-Dimensional Man. Beacon Press. Boston, 1964.
4)  Ian Fleming, Casino Royale. Hodder and Stoughton. London, 1988), p. 33.
5)  Tony Bennet. ‘James Bond as Popular Hero. U203 Popular Culture: Unit 21. Milton Keynes: Open University Press, 1982.
6)  Jerry Palmer. Thrillers: the deviant behind the consensus’. Politics and Deviance. ed. I. Taylor and J. Taylor. Harmondsworth: Penguin, 1973.
Quoted in ‘Figures of Bond’. Tony Bennet and Janet Woollacott. Popular Fiction: technology, ideology, production, reading. Routledge. London and New York, 1990.