কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৭ মে, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>



কালিমাটি অনলাইন / ৭৮



এবছর রবীন্দ্রনাথের ১৫৯তম জন্মদিনটি সবার অলক্ষ্যে নীরবে নিভৃতে পালিত হলো। কিছুদিন ধরে সারা বিশ্ব জুড়ে ভয়ংকর করোনা ভাইরাসের যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চলেছে, তাতে প্রত্যেককেই থাকতে হচ্ছে নিজ নিজ ঘরে, কেননা বাইরে বেরোলেই সংক্রমণের আশঙ্কা। ইতিমধ্যেই মানুষের মৃত্যুমিছিল মানবসমাজের অস্তিত্ব পর্যায়ে একটা প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে। তাই নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য স্বেচ্ছা গৃহবন্দী মানুষ একদিকে যেমন শারীরিকভাবে পারস্পরিক সান্নিধ্যে মিলিত হতে পারছে না, অন্যদিকে তেমনি আয়োজন করতে পারছে কোনো উৎসব বা সমাগম। সেজন্য স্বাভাবিক কারণেই মনে অতৃপ্তি ও দুঃখ থাকলেও সবাই অসহায়। তবে আমার মনে হয়, এবছর  রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রকাশ্যে জনসমাগমে পালন না করে ভালোই হয়েছে। কেননা বারোয়ারীভাবে অনুষ্ঠান করে অনেক ক্ষেত্রেই যথার্থ গুণী ও মহৎ ব্যক্তিত্বের প্রতি  প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করা যায় না। যেমন, রবীন্দ্রনাথের বিশাল রচনাসম্ভারের পাঠ  ও সারমর্ম অনুধাবন ব্যতিরেকে, তাঁর আদর্শ ও ভাবনার যথার্থ অনুশীলন না করে, তাঁর উদার আন্তর্জাতিকতাবোধ এবং মানবতাবোধকে অনুসরণ না করে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের কোনো অর্থ হয় না। এবং সেইসঙ্গে একথাও মনে হয়, রবীন্দ্রচর্চায় শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের বিশাল সত্ত্বাকে অনুভব করলেই তা শেষ  হয়ে যায় না, বরং নিজেদের জীবনে যদি তা প্রয়োগ না করতে পারি, তবে সেই চর্চাও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ভাবলে খুব কষ্ট হয়, এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আরও অন্যান্য বস্তু, বিষয়, ভাবনা ও ভাববাদী দর্শন  তথা মতবাদ যেমন আজ পরিণত হয়েছে পণ্যে, অনুরূপে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামক প্রতিষ্ঠানটিও পর্যবসিত হয়েছে নিছক পণ্যে। এবং এটা অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের ব্যাপার, রবীন্দ্রনাথের সৃজন আজ অনেকের কাছেই শুধুমাত্র বিনোদনের উপকরণ রূপেই গৃহীত হয়ে থাকে। আর তাই, রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আয়োজিত প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে অহেতুক  সাজসজ্জা, আড়ম্বর, শব্দদূষণ, দৃশ্যদূষণ এবং অন্তঃসারশূন্য জাঁকজমক মনকে তৃপ্তি দিতে পারে না।

আমি একান্তই ব্যক্তিগত ভাবনায় মনে করি, রবীন্দ্রনাথ একইসঙ্গে আমার শিক্ষাগুরু, সাহিত্যগুরু, সংস্কৃতিগুরু। সেইসঙ্গে আমার সামাজিক দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা এবং মানবিক দায়বদ্ধতার পথপ্রদর্শকও তিনি। পরবর্তী পর্যায়ে আরও অনেক মনীষীর চিন্তাভাবনা, আদর্শ ও মতবাদেও প্রভাবিত হয়েছি। এবং রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে সেইসব মনীষীর ভাবনার কোনো বৈষম্য আমি খুঁজে পাইনি। তাঁদের সবার ভাবনা ও মতবাদ আমাকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ ও ঋদ্ধ করে চলেছে।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India.

<<<< কথনবিশ্ব >>>>


আলম তৌহিদ




জগত সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির গল্প





(৩)

সর্বশেষ একেশ্বরবাদের উৎপত্তি হয়েছে মক্কা নগরীতে। নবী মুহাম্মদ এর প্রচারক। তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাবের নাম কোরআন। পূর্ববর্তী কিতাব জেন্দ আবেস্তা-তাওরাত-ইঞ্জিলের প্রচুর তথ্য কোরআনে পাওয়া যাবে। কেবল পাওয়া যাবে না তাদের সৃষ্টিকর্তার নাম। কারণটা এখানেও জাতিগত। জোরওয়াস্টার ছিলেন ইস্তিমা জাতির লোক, আর ইব্রাহীম-মুসা-ঈসা ছিলেন ইহুদী। কিন্তু মুহাম্মদ ছিলেন একজন আরব। হাজার হাজার বছর ধরে কুরাইশরা কাবাঘরের প্রধান দেবতা আল্লাহ ও তাঁর কন্যাদের উপাসনা করে আসছিল। ইব্রাহীম যখন মক্কা আগমন করেছিলেন, সেই সময়েও কুরাইশরা ছিলেন পৌত্তলিক। নবী মুহাম্মদ ছিলেন মূলত মূর্তি পুজার বিরোধিতাকারী। তিনি তৎকালীন কাবার প্রধান দেবতা আল্লাহর বিরোধিতাকারী ছিলেন না। তিনি কাবাঘরের মূর্তি ভেঙ্গেই আল্লাহকে লা-শরীক ও নিরাকার করেছেন। তাছাড়া বিজাতীয় সৃষ্টিকর্তাকে গ্রহণ করার চেয়ে তাদের হাজার বছরের উপাস্য আল্লাহকে জগৎ স্রষ্টার আসনে বসানো তাঁর জন্য অধিক যুক্তিযুক্ত এবং মর্যাদার ছিল। এতে আরব জাতীয়তাবাদ গঠন সহজ হয়েছিল।

ইসলাম পূর্ব আরবের পৌত্তলিক ধর্মমতে আল্লাহ ছিলেন চন্দ্রদেবতা। তাঁর সাথে বিয়ে হয় সূর্যদেবীর। তাঁদের কন্যারা হলেন উজ্জা, লাত, মানাত। ইসলামে এই আল্লাহ হলেন জগৎস্রষ্টা।

কোরআনে সৃষ্টিতত্ত্ব সুবিন্যস্ত ভাবে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সুরায় খণ্ড খণ্ড রূপে উল্লেখ পাওয়া যায়। সুরা আরফ-এ আছে, আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। সূরা হ-মীম সেজদাতে বলা হয়েছে- আল্লহ দুই দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীর উপরিভাগে স্থাপন করেছেন অটল পর্বতমালা। তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন এবং চার দিনের মধ্যে তাতে খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধুম্রকুঞ্জবিশেষ। অনন্তর তিনি উহাকে ও পৃথিবীকে বললেন, 'তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়'। উহারা বলল, 'আমরা আসিলাম অনুগত হইয়া'। অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলকে দুই দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশে বিধান ব্যক্ত করলেন। আল্লাহ আকাশকে সুশোভিত করলেন প্রদীপমালা দ্বারা এবং করলেন সুরক্ষিত।

সুরা আন-নযিয়াতে বর্ণিত আছে, 'তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কঠিনতর, না আকাশ সৃষ্টি? তিনিই ইহা নির্মাণ করিয়াছেন। তিনি ইহার ছাদকে সুউচ্চ ও সুবিন্যাস্ত করিয়াছেন। আর তিনি ইহার রাত্রিকে করিয়াছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং আকাশকে করিয়াছেন ইহার সূর্যালোক; এবং পৃথিবীকে ইহার পর বিস্তৃত করিয়াছেন'।
সূরা আম্বিয়াতে আছে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে। আল্লাহ উভয়কে পৃথক করে দিলেন। এবং প্রাণবান সবকিছু সৃষ্টি করলেন পানি থেকে।

দেখা গেল যুগে যুগে ধর্ম প্রচারকগণ যাকে সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, তাঁর অনুসারীরা ঐ সৃষ্টিকর্তারই এবাদত করেছে। এতে যেটা ঘটেছে তা হলো নতুন ধর্ম প্রচারকের সাথে সাথে নতুন সৃষ্টিকর্তার আবির্ভাব হতে।

মানব ইতিহাস থেকে আমরা আরও অনেক সৃষ্টিকর্তার নাম পাই। 'ক্ষুণুম' ছিলেন মিশরের প্রাচীন অধিবাসীদের সৃষ্টিকর্তা। তিনি প্রথমে ডিম্বাকার পৃথিবী এবং পরে মানুষ সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যেও আবার সৃষ্টিকর্তা নিয়ে বিভক্তি দেখা যায়। অন্যদলের সৃষ্টিকর্তা হলেন 'টা'। তিনি ঐ ডিম হাতুড়ী দ্বারা ভেঙ্গে ফেলেন এবং সেই ডিম থেকে উৎপন্ন হয় পৃথিবী ও প্রাণীকুলের। আবার প্রাচীন মিশরের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করত 'রা' বা 'রে' (সূর্য) হলো পৃথিবীর সকলের সৃষ্টিকর্তা। প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে একথাও প্রচলিত ছিল যে, 'থোথ' বা চন্দ্র-দেবতার ইচ্ছায় বা আদেশে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল। ফিনিসিয়ার অধিবাসীদের সৃষ্টিকর্তার নাম 'ক্রনস'।


"ফিনিসিয়ার অধিবাসীদের বিশ্বাস ছিল,-'ক্রনস' নামক দেবতা ফিনিসিয়া ও তাহার অধিবাসীদিগকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। খৃষ্ট-পূর্বব দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত 'জেবেল-বিবলস্‌' প্রবর্তিত মুদ্রায় ক্রনসের মূর্তি অঙ্কিত ছিল। সেই মূর্তিতে সৃষ্টিকর্তা ক্রনসের পশ্চাতে ও সম্মুখে দুই দিকে চক্ষু ছিল বলিয়া বুঝিতে পারা যায়। তাঁহার ছয়টী পক্ষ ; তন্মধ্যে কয়েকটী বিস্তারিত এবং কয়েকটি সঙ্কুচিত। প্রাচীন ফিনিসীয়দিগের মতে, তিনিই এই বিশ্ব- সংসারের সৃষ্টিকর্তা।"৩

প্রাচীন ব্যাবিলনের অধিবাসীরা বিশ্বাস করতো মার্দক ছিলেন দেবতাদের অধিপতি। আদিকালের আলোকের নাম হলো মার্দক। গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টির পূর্বে তিনি ছিলেন একমাত্র আলোকের অধীশ্বর। *তিয়ামাৎএর সাথে দেবতাদের বিরোধ সৃষ্টি হলে মার্দক তিয়ামাৎকে দ্বিখণ্ডিত করে হত্যা করেন। তিয়ামাৎএর দেহের এক অংশ হতে পৃথিবী এবং অপর অংশ হতে স্বর্গ সৃষ্টি হয়েছিল। আবার ব্যাবিলনের প্রধান ঈশ্বর হিসেবে 'বেল নিপ্পার' নামও পাওয়া যায়।

আফ্রিকার বন্য-জাতিদের সৃষ্টিকর্তার নাম মাণ্টিস। মান্টিস হলো এক জাতীয় পতঙ্গ। এই পতঙ্গদের মধ্যে 'কাগন' বা 'ইকাগন' মানুষের মঙ্গলকারী দেবতা বলে পূজিত হয়ে থাকে। মাণ্টিসের স্ত্রী, কন্যা ও জামাতা আছে। তিনি স্বীয় পাদুকা হতে চন্দ্র উৎপাদন করেন এবং জামাতার পাদুকা থেকে দ্বীপ সৃষ্টি করেন। মাণ্টিসের পাদুকায় রক্তবর্ণ ধুলা ছিল বলেই চন্দ্র রক্তিমাভ দেখায়।

'সুনি গোয়ান' হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার হটেনটট জাতির সৃষ্টিকর্তা। তিনি শূন্য থেকে বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন। দক্ষি আফ্রিকার জুলু জাতির সৃষ্টিকর্তার নাম  'উন্‌কুলুলু'। তিনি ছিলেন জুলু জাতির আদিপুরুষ এবং পৃথিবীর প্রথম মানুষ। তাঁর থেকেই সকলের উৎপত্তি হয়েছে। জুলুরা তাই পিতৃপুরুষগণের উপাসনা করেন।

অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশের আদিম অধিবাসীদের সৃষ্টিকর্তা হলো একটা পাখি। এর নাম 'পণ্ডজিল'। তাদের বিশ্বাস পণ্ডজিলই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। পণ্ডজিল পৃথিবীকে খণ্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত করেছে। অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য আদিবাসীদের বিশ্বাস 'নুরালি' পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।

গ্রীক পুরাণে আছে, দেবতা ক্যায়োসএর জন্ম হয়েছে অন্ধকার থেকে। ক্যায়োস জন্ম দেন তার কন্যা ইউরোনোমে'কে। জন্মের পর ইউরোনোমে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও পা রাখার জায়গা পেলেন না। কারণ তখন আকাশ ও সাগর একত্রে ছিল। তাই তিনি আকাশ থেকে সাগর পৃথক করলেন এদিকে ক্যায়োস  অন্ধকারের সাথে মিলিত হয়ে উৎপন্ন করলেন রাত-দিন-অন্ধকার ও বাতাস। ক্যায়োস থেকে উৎপন্ন হয়েছিল ওফিয়োন নামক এক বিরাট সাপ। ইউরোনোমে যখন নাচতে লাগলেন ওফিয়োন তা দেখে কামাসক্ত হলেন। সে তার কুণ্ডলী দিয়ে ইউরোনোমেকে আকর্ষণ করলে ইউরোনোমে একটি ঘুঘুর রূপ ধারণ করে একটি ডিম প্রসব করলেন। ওফিয়োন ডিমে তা' দিতে থাকলেন। অবশেষে এই ডিম দুইভাগে বিভক্ত হলো। সেখান থেকে সৃষ্টি হলো চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র। ক্রমে পৃথিবী নদী-সাগর-পাহাড় দ্বারা সুসজ্জিত হলো। তারপর সৃষ্টি হলো উদ্ভিদ ও প্রাণী।

আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান, আলাস্কাবাসী ও উত্তর-পশ্চিম তীরের 'থিলিঙ্কিট ইন্ডিয়ান' নামক অধিবাসীদের সৃষ্টিকর্তা হল দাঁড়কাক। এই দাঁড়কাকের ডিম থেকেই পৃথিবী এবং মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। দাঁড়কাকটি একটি বাক্স হতে চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রপুঞ্জ বের করে এনে পৃথিবীকে আলোকিত করেছে।

উত্তর আমেরিকার 'আল্‌গকিন্‌' জাতির সৃষ্টিকর্তার নাম 'মিকাবো'। এই মিকাবো হল এক বৃহৎ খরগোস। এই খরগোসই পৃথিবী সৃষ্টি করেছিল। খরগোসটি ভেলার সাহায্যে অন্যান্য জন্তুকে রক্ষা করেছিল। ভেলায় অবস্থিত জন্তুদের মধ্য থেকে তিনটিকে একে একে সমুদ্রের তলদেশে মাটি আনবার জন্য প্রেরণ করেন। সমুদ্রের তলদেশ থেকে তারা অল্প অল্প মাটি নিয়ে আসে। সেই মাটি দিয়ে খরগোস একটি দ্বীপের সৃষ্টি করেন। সেই দ্বীপটিই হল পৃথিবী।

উত্তর আমেরিকার 'ইরোকো' জাতির মধ্যে সৃষ্টি সম্পর্কে কোনো জীবজন্তুর গল্প পাওয়া যায় না। তাদের মতে, উপরে স্বর্গ ও নিম্নে অনন্ত জল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। স্বর্গের একটি ছিদ্রের মধ্য দিয়ে 'আতোয়ান্ত্রিসিক' নামে একজন নারী জলের মধ্যে পতিত হয়। সেই স্থানে ছিল একটি কচ্ছপ। আর কচ্ছপের পৃষ্টদেশে ছিল সামান্য মাটি। আতোয়ান্ত্রিসিক পতিত হয়েছিল সেই কচ্ছপের পিঠের উপর। তিনি তখন গর্ভবতী ছিলেন। তার গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় একটি কন্যা। সেই কন্যা জন্ম দেয় যমজ দুই পুত্র। তাদের নাম- জোস্কেহা ও টাওয়াস্কারা। দুই ভায়ের মধ্যে বিরোধ হওয়ায় টাওস্কারা স্বীয় মাতাকে হত্যা করে। তাদের মাতার কঙ্কাল থেকে উদ্ভিদ-সকল উৎপন্ন হয়। জোস্কেহা সৃষ্টি করে মানুষ ও পশু।

মেক্সিকোর আধিবাসীরা বিশ্বাস করেন বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে পাঁচটি পর্যায়ে। প্রথম চারটি পর্যায়ের নামের উল্লেখ আছে। এগুলো হল স্থল, অগ্নি, বায়ু ও জল। পঞ্চমটির নাম পাওয়া যায় না। প্রথম যুগে সৃষ্টি হয় মৃত্তিকা; দ্বিতীয় পর্যায়ে সৃষ্টি হয় অগ্নি বা আলোকপুঞ্জ; তৃতীয় ধাপে বায়বীয় পদার্থ এবং চতুর্থ ধাপে জলীয় বা বাষ্পীয় পদার্থ।

পেরুবাসীদের সৃষ্টিকর্তা তিনজন। প্রথম জন হলেন পাচাকামাক। তিনি ভূগর্ভস্থ অগ্নিদেবতা। দ্বিতীয় জন ভিরাকোচা। তিনি পৃথিবী সৃষ্টি ও গঠন করেন। আর তৃতীয় জন হলেন মাংকোকাপাক। তাকে বলা হয় অদ্বিতীয় মানুষ। তার পত্নী ও ভগ্নী সৃষ্টিকারী ডিম্ব নামে অভিহিত। অদ্বিতীয় মানুষ ও ডিম্ব সূর্য ও চন্দ্ররূপে প্রকাশমান হন। ব্রাজিলের কিছু কিছু জাতিদের বিশ্বাস জামোয়া নামক দেবতা পৃথিবীর প্রথম মানুষের পিতামহ। তার দ্বারাই সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে।

পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন জাতির মধ্যে সৃষ্টি সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। স্যার জর্জ প্রে-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, পলিনেশীয়ার মাওয়ারী জাতির বিশ্বাস ছিল 'রাঙ্গী' ও 'পাপা' অর্থাৎ স্বর্গ ও পৃথিবী প্রথমে একত্রে ছিল। হঠাৎ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্বর্গ উপরে উঠে যায় এবং পৃথিবী নিম্নে পড়ে থাকে। রাঙ্গী ও পাপার পুত্রের নাম ছিল তাঙ্গালোয়া। তিনি ছিলেন জলদেবতা বা সমুদ্রের অধিপতি। তিনি মৎস এবং সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী সৃষ্টি করেন। পলিনেশীয়ার কিছু কিছু অংশের অধিবাসীরা আবার তাঙ্গালোয়াকেই পরমেশ্বর বলে মান্য করে। তাদের মতে তিনিই সৃষ্টিকর্তা। শ্যামোয়া দ্বীপের লোকেরা তাকে ডাকে তাঙ্গালোয়া লাঙ্গী। অনেকের ধারণা কখনো কখনো তিনি কচ্ছপের মধ্যে বাস করতেন। আবার কখনো কখনো তিনি কচ্ছপটি পরিত্যাগ করতেন। তিনিই পৃথিবীর অবয়ব ও প্রাণী সংখ্যা বৃদ্ধি করতেন। অন্যান্য বিশ্বাস মতে তিনি ডিম্বের মধ্যে বাস করতেন। মাঝে মাঝে তিনি ডিম্ব ভেঙ্গে ফেলতেন। তখন দ্বীপসমূহ সৃষ্টি হত। তার সম্পর্কে আরও একটি প্রবাদ হল, অতি প্রাচীনকালে তাঙ্গালোয়া এক বৃহদাকার পক্ষীর রূপে সমুদ্রের উপর বিচরণ করতেন। সেই সময় তিনি জলের উপর একটি ডিম্ব রক্ষা করেন। সেই ডিম্বই পৃথিবী ও স্বর্গ বা সূর্য। পলিনেশীয়ার অধিবাসীরা বিশ্বাস করে 'পো' হতে দেবগণের উৎপত্তি হয়েছে। পো শব্দ দ্বারা অন্ধকার বোঝায়। এমন কি, তাঙ্গালোয়া পর্যন্ত উদ্ভূত হয়েছিলেন অন্ধকার থেকে।

মেসোপটেমিয় পুরাণ স্বীকার করে সৃষ্টির আদিতে সমুদ্র ছিল। অর্থাৎ জলের অস্তিত্ব ছিল। বেদও জলাকৃতি থেকে বিশ্বভুবন সৃষ্টির কথা বলে। খৃষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে গ্রীক দার্শনিক থেলেসও আমাদেরকে জানান, জলই সৃষ্টির উৎস।  বাইবেল বলে, আদিতে ঈশ্বরের আত্মা জলে ভাসমান অবস্থায় ছিল। ইসলামও বিশ্বাস করে সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহর আরশ জলের উপর ভাসমান অবস্থায় ছিল। উত্তর আমেরিকার 'ইরেকো' জাতিও সৃষ্টির পূর্বে জলের অস্তিত্ব স্বীকার করে। এসব গল্পে সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর ও জলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তখন জল কোথায়, কোন পাত্রে এবং কীভাবে সৃষ্টি হল তা আমাদের জানায় না। ধর্ম প্রণেতা ও প্রচারকরা মানুষের ধর্ম নিয়ে মশগুল ছিল বিধায়,  তারা জলের ধর্ম কী তা জানত না। ইসলাম যখন বলে প্রত্যেকটা মুসলমান একে অপরের ভাই ভাই, তেমনি দেখা যায় ধর্ম ও পুরাণের মধ্যে একটা সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।

মেসোপটেমিয় পুরাণে তারকারাজি দ্বারা আকাশ সুশোভিত ও মাটি দ্বারা মানুষ বানানোর উল্লেখ পাওয় যায়। বাইবেল-কোরআনেও একই কথা বর্ণিত আছে। খৃষ্টপূর্ব ২০০০ বছর কিংবা তারও পূর্বে রচিত 'গিলগামেশ' মহাকাব্য থেকেও আমরা জানতে পারি মাটি থেকে মানুষ বানানোর গল্প। ইহুদীদের প্রাচীন গ্রন্থ 'তালমুদে'ও আমারা অনুরূপ গল্প পাই। দেখা যাচ্ছে পুরাণের সাথে তাদের ভাব-গল্পের বৈসাদৃশ্য নেই। বরং পুরাণের অনেক কিছুই ধর্মে স্থান করে নিয়েছে। নাসদিয় সূক্তে বলা হয়েছে প্রথমে কিছুই ছিল না, কেবল ঈশ্বর ছিলেন। অর্থাৎ ঈশ্বর ছাড়া সবকিছু শূন্য ছিল। কিন্তু আবার বলা হচ্ছে অন্ধকার ছিল, চারদিক জলময় ছিল। যদি তাই হয় তাহলে আদিতে শূন্য কথাটা গৌ হয়ে পড়ে। ধরে  নিতে হয় জল ও ঈশ্বর সমার্থক অথবা জল ভিন্ন ঈশ্বর।


আবার ছান্দোগ্য উপনিষদে জলতত্ত্বের কথা নেই। সেখানে আছে ডিমতত্ত্ব। অর্থাৎ ডিম থেকেই জগত সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য উপনিষদ থেকেও ডিম্বের কথা জানা যায়। ব্রহ্মা স্বয়ং ডিম্বে অবস্থান করেন ও ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। আবার অহুর মজদা মহাবিশ্বকে ভাসমান ডিম্ব আকারে সৃষ্টি করেছেন। প্রাচীন মিশরীয়দের সৃষ্টিকর্তা ক্ষুণুমও ডিম্ব আকৃতির পৃথিবী সৃষ্টি করেন। এই ডিম ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় পৃথিবী ও মানুষ। গ্রীক পুরাণেও আছে ডিম্বতত্ত্ব। এই ডিম্ব দুইভভাগ হয়ে বেরিয়ে এসেছিল  চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র-পৃথিবী এবং আরও কতকিছু। আমেরিকার কিছু কিছু জাতিরও বিশ্বাস ছিল দাঁড়কাকের ডিম থেকে পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যেও ডিম্বতত্ত্ব প্রচলিত আছে। তাদের সৃষ্টিকর্তা তাঙ্গালোয়ও ব্রহ্মার মতো ডিমের মধে বাস করতেন। ডিম ভেঙ্গে সেখানেও সৃষ্টিকার্য সমাধা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে জাতি-স্থান-কাল ভেদেও ধর্মশাস্ত্রগুলো ডিমবচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি। ধর্মশাস্ত্র মানব রচিত বলেই এই সংক্রামক ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারে নি।

মেসোপটেমিয় পুরাণে আছে অসুরের দ্বি-খন্ডিত দেহের ঊর্ধ্বাংশ থেকে আকাশ ও নিম্নাংশ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। এই দ্বি-খণ্ডিত তত্ত্ব বেদেও আছে। ভারতীয় পুরাণ বলে আদিতে ঈশ্বর পুরুষ ও প্রকৃতিতে বিভক্ত হয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই সৃষ্টিগুলো একটার পর একটা বেরিয়ে আসে। শিবও যোগের মাধ্যমে নিজেকে দ্বি-খন্ডিত করে সৃষ্টির কাজে সহায়তা করেছিলেন। সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতিও নিজেকে দ্বি-খণ্ডিত করে হয়েছিলেন একভাগ পুরুষ ও অপরভাগ নারী। মার্দকও তিয়ামৎকে দ্বি-খণ্ডিত করে হত্যা করলে তাঁর দেহের এক অংশ হতে পৃথিবী ও অপর অংশ হতে স্বর্গ সৃষ্টি হয়েছিল।

জেন্দ আবেস্তাতে আমরা পাই ছয় বারে সৃষ্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। প্রথমে আকাশ, দ্বিতীয়তে জল, তৃতীয়তে পৃথিবী, চতুর্থতে বৃক্ষাদি, পঞ্চমতে জীবজন্তু এবং ষষ্ট বারে সৃষ্টি হয় মানুষ। তাওরাত কিতাবেও দেখা যায় জেহোবা ৬দিনে সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তিনিও প্রথম দিনে আকাশ, দ্বিতীয় দিনে জল, তৃতীয় দিনে পৃথিবী, চতুর্থ দিনে চন্দ্র-সূর্য, পঞ্চম দিনে জীবজন্তু এবং ষষ্ট দিনে মানুষ সৃষ্টি করলেন। এখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে সৃষ্টিকর্তা জেহোবা তাঁর সৃষ্টিকার্যে অপর সৃষ্টিকর্তা অহুর মজদাকে অনুসরণ করেছেন। ইসলামও বলে আল্লাহ ৬দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে পূর্ববর্তী সৃষ্টিকর্তাদের সাথে আল্লাহও খাপে খাপে মিলে গেলেন। তবে তিনি এখানে একটু ব্যতিক্রমের পরিচয় দিলেন। তিনি পূর্ববর্তী সৃষ্টিকর্তাদের মতো প্রথমে আকাশ সৃষ্টি করলেন না। তিনি প্রথমে সৃষ্টি করলেন পৃথিবী, তাও দুই দিনে। চার দিনের মধ্যে খাদ্যের ব্যবস্থা করে আকাশ সৃষ্টিতে মনোযোগ দিলেন। শেষ ২ দিনে সপ্তাকাশ সৃষ্টি করলেন। আবার অন্যত্র উল্লেখ আছে, আকাশ ও পৃথিবী এক সাথে মিশে ছিল, তিনি উভয়কে পৃথক করে দিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তিনি যদি প্রথমে পৃথিবী সৃষ্টি করেন, তাহলে তখন আকাশটা কোথায় ছিল? যদি আকাশ ও পৃথিবীকে পৃথক করেন, তবে দুটিই তো এক সাথে সৃষ্টি হওয়ার কথা। তাই কোরআনের বর্ণনাকে অগোছালো মনে হয়।

-----------
তথ্যসূত্র
১। সৃষ্টিতত্ত্ব - হিন্দু দর্শন (ইন্টারনেট থেকে)
২। ভারতবর্ষ (৩য় খন্ড) - শ্রীদুর্গাদাস লাহিড়ী/প্রকাশক- শ্রীধীরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, হাওড়া, কলকাতা। ১,২,৩
৩। পবিত্র বাইবেল - বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা।
৪। আল-কোরআন (অ্যারাবিক টু বেঙ্গলী) - ইসলামের আলো পাবলিকেশন।
----------------
*ডক্টর স্পিগেল জার্মানির প্রসিদ্ধ পণ্ডিত। তিনি জেন্দ-আবেস্তা গ্রন্থের অনুবাদক এবং 'জেনেসিস' ও 'আবেস্তার' তুলনামূলক সমালোচনা করেন।
*পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে অপ্‌সু ও তিয়ামাৎ (নর ও নারী) জলরূপে বিদ্যমান ছিলেন। তিয়ামাৎ হলো সাগর-রূপিণী। অন্য মতে তিয়ামাৎ হলো ড্রাগন।




ফারহানা রহমান




জ্যাক লন্ডনের বিস্ময়কর সৃষ্টি ‘কল অফ দা ওয়াইল্ড’




জ্যাক লন্ডনের লেখা হোয়াইট ফ্যাংবইটি প্রথম পড়ি ক্লাস সেভেনে পড়া  অবস্থায়। সদ্য চোখফোটা নেকড়ে শাবকের গুহার মুখ থেকে প্রথম আলোকময় পৃথিবী দর্শনের বিস্ময়কর অভিভূত বর্ণনা পড়ে এক সাথে আমিও বিস্ময়ে  অভিভূত ও মুগ্ধ হয়ে ছিলাম বেশ কিছুদিন। সেই থেকে শুরু। একে একে পড়লাম কল অফ দা ওয়াইল্ড’, ‘দি সি উলফ’, ‘আগুন জ্বালতে হলে’ (To Build a Fire), ‘জীবন তৃষ্ণা’ (Love of Life), ‘বিধর্মী’, ‘গল্পের শেষে’; বিশেষ করে এক টুকরো মাংসযে গল্পটি আমাকে আজও ভাবায়। তবে তাঁর মাস্টারপিস কল অফ দা ওয়াইল্ডসম্পর্কে আলোকপাত না করলেই নয়। কারণ  এই উপন্যাসিকাটি একসময় ইতালি এবং যুগোস্লাভিয়াতে নিষিদ্ধ  ঘোষিত হয়েছিল।  

জ্যাকলন্ডন ছিলেন একই সাথে বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, ছোট গল্পলেখক  প্রাবন্ধিক। তিনি ১৮৭৬ সালের ১২ জানুয়ারি সানফ্রানসিসকো, ক্যালিফোর্নিয়াতে জন্মগ্রহ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম জন গ্রিফিথ চেনে। মাত্র ৪০ বছরের তাঁর সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রবল ঘটনাবহুল জীবন যেন রূপকথার মতই বর্ণময়, এক কথায় বিস্ময়কর গতিশীল দুর্বার জীবন। তিনি বিশ্বের দ্রুত বিস্তারলাভকারী বাণিজ্যিক কথাসাহিত্য পত্রিকাগুলোতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং বিশ্বব্যাপী সেলিব্রিটি হিসেবে একসময় আত্মপ্রকাশ করেন। তার ফিকশন গল্পগুলো এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যা আজ পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্যে সমান জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। লন্ডন ছিলেন সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা একজন অনুরাগী লেখক। আর সেজন্য তাঁকে কম মুল্য দিতে হয়নি। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজের একটি হচ্ছে "কল অফ দা ওয়াইল্ড যা বিশ্বসাহিত্যে মাস্টারপিস হিসেবে সন্মানিত। ১৯১৬ সালের ২২শে নভেম্বর মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।   

জ্যাক লন্ডন বড় হয়ে ওঠেন শ্রমিকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত একজন হিসেবে। দারিদ্রপীড়িত শৈশবে জীবন ধারণের তাগিদে প্রত্যেকদিন অন্তত ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তাঁকে পরিশ্রম করতে হতো। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে  ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডের এক বস্তিতে। একসময় ঝুপড়ি বস্তি ছেড়ে জ্যাক বেরিয়ে পড়েন পৃথিবীর পথে। আর এভাবেই ধার করা টাকা দিয়ে এক সময় কিনে ফেলেন র‍্যাজেল ড্যাজেল নামক এক পুরনো জাহাজ এবং হয়ে যান রীতিমত ঝিনুকদস্যু। আর সে জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর তিনি বাধ্য হয়ে  মৎস্যজীবীদের দলে যোগদান করেন এবং পরে জাপান উপকুলে স্কুনার নিয়ে যান। এর পরের কয়েক বছর, খাবার কারখানার শ্রমিকের কাজ থেকে শুরু করে কয়লা উত্তোলন, পাট কলের কেরানী, শিল মাছ শিকার, শুঁড়িখানার বিক্রেতা ইত্যাদি সব কাজই তিনি করেছেন। ভবঘুরে হিসেবে সারা মেরিকা ঘুরে বেরিয়েছেন আর এইজন্য তাঁকে জেলও খাটতে হয়েছে। এরই মাঝে তাঁর হাতে আসে কার্লমার্ক্স নামের এক দার্শনিক কমিউনিস্টের মেনিফেস্টো যা পাঠ করে  চির ভবঘুরে জ্যাক অন্যরকম জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠেন। এবং বাকী জীবন তিনি সমাজতন্ত্রে সুদৃঢ় আস্থা রেখে তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যান।   

জেল থেকে বের হওয়ার পর জ্যাক বুঝতে পারলেন যে পেশী শক্তি বাড়াবার চেয়ে মেধাশক্তি বাড়ানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ফলে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হলেন। পরে কলেজে পড়ার সময় দৈনিক পত্রিকার একটি গল্প প্রতিযোগিতায় জয়ী হন। তখন থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করারএরই মাঝে ১৮৯৭ সালে তিনি স্বর্ণ সন্ধানীদের সাথে  হুজুগে মেতে কলেজ ত্যাগ করে আলাস্কা ও ক্লোনডাইকে যাত্রা করেন। একসময় জ্যাক কপর্দকহীন অবস্থায় ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে আসেন, তবে সঙ্গে নিয়ে আসেন সোনার চেয়েও অনেক মূল্যবান তাঁর এতদিনের অভজ্ঞতার ঝুলি যা  দিয়েই তিনি একসময় দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন।  

উত্তরের প্রচণ্ড শীতে কুকুর ও নেকড়েদের মাঝে থেকে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করছিলেন, পরবর্তীতে তা দিয়েই তিনি লিখে যান একের পর এক জগতবিখ্যাত সব গল্প-উপন্যাস। জ্যাক লন্ডন একটানা ষোল বছর লেখালেখির কাজে জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে ছিল উনিশটি উপন্যাস, আঠারোটি ছোটগল্প ও প্রবন্ধের বই এবং আরও বেশ কিছু অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক বই।

১৯০২ সালের শেষের দিকে জ্যাকের মাথায় কুকুর নিয়ে এক গল্প খেলে যায়, এটিকে তিনি ৪০০০ শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করেন কিন্তু একসময়  আবিষ্কার করেন যে গল্পটি আসলে মাত্র বলা শুরু হয়েছে। এবং সেই প্রথম বারের মত তিনি বুঝতে পারেন যে লেখার সময় গল্পের চরিত্রগুলো নিজে থেকেই জীবিত হয়ে ওঠে আর সে চলে তার নিজের খেয়াল-গতিতে যেখানে লেখকের আসলে তেমন কিছুই করার মত ক্ষমতা থাকে না। এই গল্পের নাম দেন তিনি কল অফ দা ওয়াইল্ড’, যা বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে এই উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে গণ্য হয়। 

এ গল্পের প্রধান চরিত্র বাক একটি চারবছর বয়সী বিশালদেহী আধা সেন্টবার্নারড এবং আধা স্কটিশ মেষপালক কুকুর। যে তার ধনী মালিক জজ মিলারের অত্যন্ত প্রিয় ও আদুরে কুকুর হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা  ক্লারাভ্যালীর রেঞ্চে সুখে-শান্তিতে দিনযাপন করে আসছিলো। ঠিক এই সময়টাতেই উত্তরে স্বর্ণখনি আবিষ্কৃত হয়। এবং বড় সাইজের কুকুরগুলো হঠাৎ খুবই মূল্যবান উপাদানে পরিণত হয়, যেহেতু এরা খুব শক্তিশালী ছিল এবং গভীর বরফক্ষেত্র থেকে স্লেজগুলকে টেনে আনতে পারতো। আর ঠিক এ সময়টিতেই হঠাতই একদিন বাকের জীবন একটি নাটকীয় মোড় নেয় যা এক অর্থে নারকীয়ও বটে।

জুয়ায় আসক্ত জজের, এক অসাধু দাস বাককে চুরি করে উত্তরের কুকুর কেনা বেচার ব্যবসার সাথে জড়িত একটি চোরদলের কাছে বিক্রি করে দেয়। সে, এই প্রথমবারের মত খাচায় বন্দী হয়ে ভ্রমণ শুরু করে এবং আলাস্কাতে বিক্রি হয়ে যায় যেখানে কুকুর স্লেজই পরিবহনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিলো। 

বাক, এখানে কুকুরদলের সাথে একসাথে থেকে কি করে স্লেজগাড়ী টানতে হয়, কি করে ঘুমের জন্য বরফের ভেতর গর্ত তৈরি করতে হয়, কি করে চিরস্থায়ী ক্ষুধা যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয় এবং কখন কি করে পশুদের সহজাত বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করে চলতে হয়, সেটাও তাকে বাধ্য হয়ে শিখতে হয়। এবং একটি ব্যাপার সে বুঝতে পারে যে তার মধ্যে সহজাত পশুপ্রবৃত্তি অত্যন্ত প্রখর। ফলে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই যে পাল্টা আক্রমণে প্রতিপক্ষকে  মুহূর্তের মধ্যে ঘায়েল করে ফেলতে হবে আর তা না হলে যে নিজেরই জীবন এসব পরিস্থিতিতে বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে সেটাও তার বুঝতে বাকী থাকে না। একই সাথে সে বুঝতে পারে যে এই বরফাচ্ছন্ন উত্তরের জীবনে তাকে প্রতি মুহূর্তে সতর্কতার সাথে নানা প্রকার অস্বস্তি ও ক্রমাগত ব্যথা বেদনার সাথে জীবনধা করার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে।     

দিনের পর দিন ক্ষুধার্ত থেকে থেকে বাকের কাঁচামাংস ও রক্ত খাওয়ার আদিম প্রবৃত্তি আবারও জেগে ওঠে। একই সময়ে স্লেজগাড়ী টানার প্রধান কুকুর স্প্লিটজের দ্বারা নানাভাবে উত্যক্ত হয়ে হয়ে একসময় বাক সুযোগ বুঝে ওর উপরে ঝাপিয়ে পরে আর যুদ্ধের মাধ্যমে নিজের সুযোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নেয়। এবং র ফলেই সে তার দুই মাস্টার ফ্রাসোয়া ও পেরল্ট-এর কাছে একসময় খুবই প্রিয় হয়ে ওঠে।   

পরবর্তী সময়ে বাক-এর নতুন স্কটিশমাস্টার একটি অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে প্রায় অসহনীয় অবস্থায় বাককে কাজ করতে বাধ্য করে। বাক ছাড়া আর প্রায় সব কুকুরগুলোই এ অবস্থায় পথিমধ্যেই মারা পরে। যদিও এ পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণায় বাককে ভয়ংকরভাবে তার ওজন হারাতে হয়। যদিও পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে যখন - বাক পরবর্তীতে বিক্রি হয়ে যায় তিনজন একেবারেই অপেশাদার তবে দুঃসাহসী, ভ্রমণকারীদের কাছে। এরা হলো চালস, হল ও মারসেডিস। এরা এমন একটি দল যাদের কোন ধারণাই নেই যে কিভাবে বরফাচ্ছন্ন উত্তরের তীব্র প্রতিকূল পরিবেশে কুকুরের দলকে  সুসংগঠিত ভাবে পরিচালনা করতে হয়। বা তাদের যত্নের সাথে সুপরিকল্পিত  ভাবে পথ প্রদর্শন করে সামনে এগিয়ে নিতে হয়। এরই ফলস্বরূপ অর্ধেক রাস্তায় যেতে না যেতেই খাবার ফুরিয়ে যায় এবং বাক সামনে এগোতে অস্বীকৃতি জানায় এবং সে পরবর্তী সময়ের সমুহ বিপর্যয়ের আশংকাও করে। যদিও এজন্য তাকে  অমানুষিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। পরবর্তীতে দেখা যায় যে সেই দুঃসাহসী অপেশাদার ভ্রমণকারিগ ও তাদের বাকী জীবিত কুকুরগুলোর বরফাচ্ছাদিত নদীতে সলিল সমাধি হয়।   
আর এখানেই বাক-এর সাথে পরিচয় হয় জন থরন্টন নামক একজন দয়ালু  ব্যক্তির যার নিরলস সেবায় বাক একসময় নিজের হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পায়। এতে করে বাক তার নতুন মাস্টারের প্রতি গভীর আনুগত্য ও নিষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকে এবং মাস্টারের সাথে ছায়ার মত থেকে তাকে সব ধরনের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। কিন্তু এসব কিছুর পরেও বাক একদিন গভীর জঙ্গল থেকে এক রহস্যময় ডাক শুনতে পায় যা তার ভেতরের বহু পুরাতন ঘুমন্ত সত্তাকে তীব্রভাবে জাগিয়ে তুলতে চায়।  
       
এরপর জন থরন্টন বাককে নিয়ে সভ্যজগতে ফিরে আসলে একটি মাতাল খনিজীবি তার উপর হঠাত আক্রম করে বসে। ফলে বাক তৎক্ষণাৎ লোকটাকে নিহত করে। এবং পরবর্তীতে তিনি আবারও নদীর স্রোতে ভেসে গেলে বাক তীব্র স্রোতের প্রতিকূলে নিজের জীবন বিপন্ন করে মাস্টারকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। 
     
জন থরন্টনের মৃত্যুর সাথেই শেষ হয়ে যায় সভ্য জগতের সাথে বাক-এর সমস্ত  লেনদেন। সে ফিরে যায় তার বন্য জীবনের নেকড়েদের মাঝে। কিংবদন্তী আছে  যে, বাক নেকড়ে ও কুকুরের সংমিশ্রণে একটি নতুন বংশবৃদ্ধি করে, যারা এখনো গ্রেট উত্তরের বন্য জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়ায় এবং মধ্যরাতের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মানুষ তাদের গান এখনো শুনতে পায়।   


১৯০৩ সালে প্রকাশিত কল অফ দা য়াইল্ড জ্যাক লন্ডন-এর সবচেয়ে পঠিত ও সবচেয়ে ভালো বই বলে মনে করা হয়, যা মাষ্টারপিস হিসাবে প্রশংসিত হয়। জ্যাক লন্ডনের এ লেখাটি ১৯২০ এবং ১৯৩০ সালের মধ্যকার সময়ের বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় একনায়কতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থার জন্য মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। এরই ফলস্বরূপ লেখাটিকে ব্যানড বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।    

১৯২৯ সালে ইতালি ও যুগোস্লাভিয়াও কল অফ দা ওয়াইল্ড’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যেহেতু লন্ডন এ লেখাগুলোতে স্পষ্টভাবে সমাজতন্ত্রর সমর্থক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এছাড়াও ১৯৩৩ সালে নাৎসি পার্টি লন্ডনের কাজগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে।  

কল অফ দা ওয়াইল্ডএ আমরা দেখতে পাই যে, বাক প্রথমে তার আরামদায়ক অস্তিত্ব থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং নিজেকে একটি সফল স্লেজগাড়ী কুকুর হিসেবে গড়ে তোলে এবং একসময় নিজেকে নেকড়ে দলের নেতা হিসেবে প্রমাণিত করে। ফলে সে নিজেই নিজের দেবতা হয়ে ওঠে।

সম্ভবত এই জিনিসটিই ইউরোপীয় শাসকশ্রেণীর কাছে সবচেয়ে আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেখানে দেখানো হয়েছে যে, শ্রমিকশ্রেণী নিজেদের  ক্ষমতা উদ্ধারের জন্য শাসকশ্রেণীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে এবং নিজেদের ক্ষমতাধর হিসেবে সমাজে তুলে ধরছেআসলে কটি একনায়কতন্ত্রের শাসন  ব্যবস্থা ততদিনই টিকিয়ে রাখা সম্ভব যতদিন রাষ্ট্রের জনগকে অবরুদ্ধ করে রাখা যায়। ফলে তারা এমন একটি বইকে চিরকালের জন্য ঢালাও ভাবে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছিল, যেখানে একজন নিজের সত্য সত্তাকে খুঁজে নিতে এবং সমস্ত বশ্যতাকে অস্বীকার করে নিজেকে নিজের দেবতা ভাবতে পারে বলে মনে করা হয়।